| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

বিশ্ব কাঁপিয়েছিল ভারতের যে ‘যৌন কেলেঙ্কারি’

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মেহেদী হাসান ও এলেন গারট্রুড ডোনেলি—এই যুগল ছিলেন উনিশ শতকের হায়দ্রাবাদে পরিচিত মুখ। সমাজের এলিট শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে ছিল তাদের ওঠাবসা। তখন ভারতে ভিন্ন বর্ণের মধ্যে প্রেম বা বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই ছিল না। কিন্তু তারা রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে সংসার শুরু করেন। এ নিয়ে টুকটাক সমালোচনা হলেও মেহেদী এবং এলেনের তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কিন্তু হুট করেই তাদের সুখের সংসারে ‘আগুন জ্বালালো’ আট পৃষ্ঠার একটা বই। তাদের মানসম্মান ধূলোয় মিশে যায় নিমিষেই। কি ছিল এই বইটিতে? সে আলোচনার আগে জেনে নেয়া যাক এই যুগল সম্পর্কে।


এই যুগল সম্পর্কে

উনিশ শতকে ভারতের হায়দ্রাবাদের সম্ভ্রান্ত মুসলমান মেহেদী হাসান এবং তার ব্রিটিশ বংশদ্ভূত স্ত্রী এলেন গারট্রুড ডোনেলির নাম সবাই জানতো। হায়দ্রাবাদের ‘নিজাম’ বা রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন মেহেদী। ওই দায়িত্ব পালন করতে করতে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন তিনি। সমাজের মধ্যবিত্ত ক্যাটাগরি ছেড়ে উচ্চবিত্তদের কাতারে দাঁড়িয়েছেন খুবই কম সময়ে। তখনকার সংবাদপত্রে প্রায়ই তার ছবি ও কথা ঠাঁই পেতো। অনেকেই তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ছিলেন।

পরে যখন মেহেদি হায়দ্রাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, তখন তার প্রতি হায়দ্রাবাদের মানুষের ঈর্ষা বাড়তে থাকে। অনেকের অভিযোগ ছিল, তিনি সাধারণ মানুষদের মূল্যায়ণ করতেন না। কিন্তু এ অভিযোগে মেহেদির কি-বা আসে যায়, তিনি নিজের মতো করে এগোতে থাকলেন! পরে তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

মেহেদির স্ত্রী এলেন গারট্রুড ডোনেলির ক্ষমতাও কম ছিল না। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ ছিল। শোনা যায়, রানী ভিক্টোরিয়া একবার তাদের লন্ডনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে তারা গিয়েছিলেন কি-না, তা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ রানীর সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ছিল বেশ গাঢ়। সবমিলিয়ে মেহেদি ও এলেন হয়ে উঠেছিলেন সেসময়কার ভারতের অত্যন্ত ক্ষমতাধর এক দম্পতি।


উনিশ শতকের হায়দ্রাবাদে মেহেদী-এলেন ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী দম্পতি

উনিশ শতকের হায়দ্রাবাদে মেহেদী-এলেন ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী দম্পতি


হঠাৎ কী ঘটেছিল?

মেহেদি-এলেন দম্পত্তি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শত্রুও বাড়তে থাকে। ১৮৯২ সালের এপ্রিলে হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়েছিল ইংরেজিতে লেখা আট পৃষ্ঠার এক প্যাম্পলেট বা পুস্তিকা। বইটি এই দম্পত্তিকে নিয়েই। এটি যখন সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়লো নাটকীয়ভাবে মেহেদী এবং এলেনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং সুনাম হঠাৎ করেই মলিন হয়ে গিয়েছিল।

বইটির কোনো নাম ছিলনা। এটি কে লিখেছেন বা কোনো ছাপাখানায় ছাপানো হয়েছিল তাও উল্লেখ ছিল না। তবে কে প্রকাশ করেছে তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল বইতে। কিন্তু ঠিকই হায়দ্রাবাদবাসীর কাছে বিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিল বইটি। এরপর বেশ কয়েকদিন তারা রাস্তায় বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। কারণ সাধারণ মানুষ ক্ষমতাধর এই যুগলকে অপমান করতে কোনো দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু কী লেখা ছিল এই বইয়ে তা জানেন? খুবই ভয়ঙ্কর তথ্য। তবে সেসব সত্য কি-না তা এখনো অজানা।

যা লেখা ছিল বেনামী বইটিতে

মূলত মেহেদীর কাজে কোনো ত্রুটি খুঁজে না পেয়ে এলেনকে টার্গেট করেন বেনামী ওই লেখক। বইটিতে ব্রিটিশ বংশদ্ভূত ওই নারীকে নিয়ে তিনটি অভিযোগ তোলেন। এর প্রত্যেকটি অভিযোগ ছিল ‘যৌন কেলেঙ্কারি’ নিয়ে।

তিনটি অভিযোগের প্রথমেই বলা হয়- মেহেদীকে বিয়ের আগে এলেনের পেশা ছিল পতিতাবৃত্তি। শুধু তাই নয় এক সময় পুস্তিকার বেনামী লেখক ও তার কয়েকজন বন্ধুর রক্ষিতাও ছিলেন এলেন। দ্বিতীয় অভিযোগটি ছিল- মেহেদী এবং এলেনের মধ্যে কখনোই বিয়ে হয়নি। এটা অবশ্য অনেকেই অবিশ্বাস করেছেন। কারণ তাদের কাছে বিয়ে নথিপত্র ছিল। আর সবশেষে অভিযোগ ছিল, মেহেদী হায়দ্রাবাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে নিজের স্ত্রী এলেনকে পাঠিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতেন। সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সর্বশেষ অভিযোগটিই।


রেসিডেন্সি কোর্টে মামলা করেন মেহেদী

রেসিডেন্সি কোর্টে মামলা করেন মেহেদী


মামলা করেন মেহেদী

বইটি প্রকাশ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপে গিয়েছিলেন মেহেদী। কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে বন্ধুদের পরামর্শ নিলেন। সবাই বললেন, বিষয়টিকে একেবারেই পাত্তা না দিতে এবং পাল্টা ব্যবস্থা না নিতে। কিন্তু তাদের কথায় কান না দিয়ে পুস্তিকার প্রকাশক এসএম মিত্রর নামে রেসিডেন্সি কোর্টে মামলা করেন মেহেদী।

রেসিডেন্সি কোর্টের বিচারপতি ছিলেন একজন ব্রিটিশ নাগরিক। মামলার বাদী ও বিবাদী দুই পক্ষই মামলার জন্য বিখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। সাক্ষীদের ঘুষ দেয়া, তাদের দিয়ে মিথ্যা বয়ান দেয়ানো এবং মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টায় কেউ কারো চেয়ে কম যাননি। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো, পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, অবৈধ সহবাস, মিথ্যা সাক্ষী দেয়া, ঘুষ দেয়াসহ বহু অভিযোগ থাকার পরও এসএম মিত্রর কোনো সাজা হয়নি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সে সময় এ মামলা খুবই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। হায়দ্রাবাদে নিজাম বা রাজ্য সরকার, ব্রিটিশ ভারতের সরকার, লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার এবং সারা পৃথিবীর খবরের কাগজের চোখ ছিল নয় মাস ধরে চলা সেই মামলার দিকে। মামলা শেষ হবার কয়েকদিন পরই এই যুগল ভারতের লখনৌ শহরে চলে যান। সেখানেই তাদের শৈশব কেটেছিল। পেনশন পাবার জন্য মেহেদী লখনৌর স্থানীয় সরকারের কাছে চাকরি পাবার চেষ্টা করেন কয়েকবার, যেখানে একসময় তিনি চাকরি করেছেন। এই ঘটনা ফাঁস হবার পর সেখানে তার চাকরি হয়নি।

এই যুগলের জীবনের শেষাংশ

মামলায় হেরে যাওয়া মানেই সব শেষ! হায়দ্রাবাদ রাজ্য সরকারও তার পাশে দাঁড়ায়নি। তাকে স্বরাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে কোনো পেনশন বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। এমনকি এলেনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা ব্রিটিশ প্রশাসনও কোনো ভূমিকা রাখেনি। অথচ রানী ভিক্টোরিয়াকে খুশি করার জন্য মেহেদী একবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পার্টিকে ‘বিপজ্জনক’ বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন!

৫২ বছর বয়সে মৃত্যুর বরণ করেন মেহেদী। এলেনের জন্য সম্পদ রেখে যেতে পারেননি তিনি। এরপর এলেনের অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। বৃদ্ধ অবস্থায় নিজাম এবং হায়দ্রাবাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন এলেন। সরকার দয়াপরবশ হয়ে সামান্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল তাকে, কিন্তু অল্পদিন পরেই প্লেগ আক্রান্ত হয়ে এলেন মারা যান। কিন্তু এই ‘কেলেঙ্কারি’ আজও অমীমাংসিত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত