শিকাগো ডায়েরি
১) মাধবী-মধুপে
আবুধাবি থেকে শিকাগো যাবার আকাশপথে মেন্যুতে ছিল আমার জন্য চিকেন মাধবী ইন এ বেড অফ মাধবী রাইস উইথ ড্যাকুস স্যস্। স্যস টা অনেকটা আমাদের মোমোর ট্যোম্যাটোর চাটনির মত তবে ঝাল নেই আর একটু ফ্ল্যাট। বিরিয়াণীর সঙ্গে রায়তা থাকে অনুপান হিসেবে। এখানে মাধবীর সঙ্গে ড্যাকুস স্যস অপরিহার্য। অর্ডারের আবদার পেশ করেই কল্পগল্পে মন নিবেশ কিন্তু সেই প্রতীক্ষিত সুখাদ্যের মোরগ পেটের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আরব দেশে মুরগীর সে কি এমন পদ যার নামে মাধবী উতলা? মাধবী শব্দটি তবে কোন্ মূল আভিধানিক সূত্রে মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশে জায়গা করে নিয়েছে? জুঁই, বেল, গোলাপ ছেড়ে শেষমেশ মাধবী? তবে কি জেসমিন রাইসের অনূরূপ মাধবী গন্ধে মাতোয়ারা সেই ডিশ? হাতের কাছে গুগুল নেই যে একটু মাধবী বেত্তান্তে আলোকপাত করি। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।
আমার ভিতর বাইরে, অন্তরে অন্তরে মাধবী তখন আছে জুড়ে।
মা আর ধোবি? মা কে ফেলে রেখে এসেছি সুদূর আমার শহরের এক কোণের ব্যালকনিতে। তার জন্য মনে একটু কষ্ট আছেই তবে ধোবি? তাকে শিকেয় তুলেছি মাস খানেকের জন্য। চুলোয় যাক কাপড় শুকোনোর দড়ি। হারিয়ে যাক ক্লিপ গুলো সব।
আবারো মাধবীর জন্য এহেন মধুপের উতলা হল চিত্ত। কখন হবে মাধবী আর মধুপে মিতালি?
মাধবী আর আসে না। মুরগী কি ডিম থেকে প্রসব হবে আকাশপরীদের রান্নাঘরে?
অতঃপর আকাশপরী হাসিমুখে অবতীর্ণ হয়ে একফালি টেবিলে রাখে চিকেন মাধবী। আমি তখনও ভেবে চলেছি আমার মাধবীলতার কথা। কি আবেশে দোলে সে বারান্দায়। মায়ের যত্নে ডালপালা ফুলে ফুলে বিকশিত হয়। তবে কি মালতীলতার????
সামনে রাখা সুদৃশ্য সাদা সেরামিকের প্ল্যাটারে ধবধবে সাদা মাধবী রাইসের বাগানে তুলতুলে নরম, কাঠকয়লার আঁচে মশলাদার গ্রিলড মুরগীর শরীর এলিয়ে পড়ে আছে আরামে। আর ফুরফুরে বাসমতী ভাতের শরীরে বেরেস্তা আর টুসটুসে কিশমিশ আদর করছে।
চালে, চিকেনে চুমু খেতে খেতে আমার ঠোঁটে উঠে পড়ে দুজনে। সেখান থেকে জিভের ডগায় উষ্ণ আলিঙ্গনে। দন্তরুচিকৌমুদীর আলতো চাপে মুখের অভ্যন্তরে সে এক রসায়ন ঘনীভূত ইত্যবসরে। লবঙ্গ? তবে কি মাধবী মোরগে চালের মিশ্রণে পলান্ন বা বিরিয়ানির স্বাদ অনুভূত হল? তবে কেশরী বা জাফরানী সাজ নেই শরীরে।আতর, কেওড়া, গোলাপজলের সুগন্ধ মাখেনি তাই সেই অর্থে ধনী নয়, দরিদ্র। আর তাই বুঝি তার স্বাদবাহারে এত পারিপাট্য।
আবারও বলে উঠি, হে মাধবী দ্বিধা কেন? আসিবে কি ফিরিবে কি দ্বিধা কেন? ভীরু নয় তো এ মাধবী তবু তোমার দ্বিধা কিসের আমাকে গ্রহণ করতে?
সবশেষে আমারি জিত হল। জমে উঠল। আমার ওষ্ঠে, জিভে, দন্তরুচি কৌমুদীর জ্যোতস্নায় স্নাত হতে হতে মাধবী মুরগীর সুললিত টুকরো আমার বশে এল।
প্লেটের দিকে চোখ পড়তেই দেখি মোটে একটি মাধবী এখনো ঠিকই ফুটে আছে আমার জন্যে। তাকে বললাম, কেন? অসহায়? এসো প্রবেশ কর আমার অভ্যন্তরে। নয়ত আমার চোখের জলে তোমার এই হাহাকার দেখতে ভালো লাগেনা যে মাধবী!!! আমার পাকস্থলীর আভ্যন্তরীন রসায়ন তখন চাইছে আরো আরো মাধবী। চালের দহন ক্রিয়া শুরু হয়েছে সবেমাত্র।
আমার ইহকাল, পরকাল সব তোমায় দিলাম মাধবী!
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।