| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইন্দু বিন্দু (পর্ব -৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

শ্রীচৈতন্যের জীবনী নিয়ে মধ্যযুগেই কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্য-আসরে আত্মজীবনী সাহিত্য এসেছিল বেশ চমক দিয়ে। চমক এ জন্য যে, আধুনিক যুগ ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্যনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতিতে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় ‘আত্মজীবনী’ লেখার ইতিহাস একেবারেই ভিন্নভাবে এসেছে। কোনো ইংরেজ প্রভাবিত বা কোনো শিক্ষিত লোক আত্মজীবনী লেখেননি। লিখেছেন অজপাড়াগাঁয়ের প্রায় অশিক্ষিত এক মেয়ে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কেউ তাঁকে পড়তে বা লিখতে শেখাননি। লেখাপড়া অর্জন করেছিলেন তিনি নিজে, সম্পূর্ণ একাকী। তাই সাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি একটি বিস্ময়। তাঁর নাম রাসসুন্দরী। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার জীবন’। তারপরে আত্মজীবনী অনেক পেয়েছে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের পাঠক।

আরও একটি আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দু’র সাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনি। আদরের নৌকা,শব্দের মিছিল-এ বিক্ষিপ্তভাবে নিজের জীবন নিয়ে লিখেছেন, ইরাবতীর পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিজের জন্মতিথিতে নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। আজ রইলো আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দুর সপ্তম পর্ব।


 

ছায়া ও ছবি

বরানগরে আমাদের স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিবছর দেখতাম ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিষ্ঠাভরে ঝুলন সাজাতে। আটপৌরে, সাবেকী সব বাড়ির দালানের দ্বার সকলের জন্য অবারিত। সটান স্কুলের জুতো খুলে হাত ধুয়ে দেখতে যেতাম ঝুলন। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের যোগাড় দেখে। আর কি নিখুঁত সেই সজ্জা! কি নেই সেখানে! সারাবছর ধরে বুঝি সঞ্চয় করে শুকনোগাছের ডাল, প্লাসটিকের ফুল, শুকনো ফলের বীজ, ভাঙ্গা আয়না, নানা ধরণের নুড়িপাথর, কাঁকর, মোরাম, সাদাবালি, হলদে বালি, পুতুল আরো কত কি! শুধু অপেক্ষা এই বিশেষদিনটির জন্য। সাতদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত মহড়া। কি অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা ছিল ছোট বড়ো সকলের মধ্যে! আক্ষরিক আর্থে ইন্ডোর গেম খেলতে ব্যস্ত পাড়ার সক্কলে। কেউ দিচ্ছে আইডিয়া। কেউ দিচ্ছে অর্থ, বাড়ির বড়োরা দিচ্ছে সাপোর্ট আর কেউ শুধুই বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু। মায়ের হাত ধরে প্রতিবছর যেতাম বরানগর পাঠবাড়ির ঝুলন-উত্সব দেখতে। দেখবার মত ঝুলন হয় এখানে। আর মেলা বসে বিশাল করে। গায়ে নীল রং মাখিয়ে, মাথায় মুকুট পরিয়ে, পরচুলা লাগিয়ে ছোটছেলেকে কৃষ্ণ আর একটি ফুটফুটে মেয়েকে রাধা সাজিয়ে “লাইভ ঝুলন” মিছিল বেরত আমাদের মফস্বলী শহরে। তাদের দেখে আমার কেবলই মনে হত, কি সুন্দর এদের পড়তে হচ্ছেনা আর আমাকে মেলা থেকে গিয়েই পড়তে বসতে হবে। পাঠবাড়ির মন্দিরের মধ্যে ছোটছোট আলাদা আলাদা ঘরের মধ্যে কৃষ্ণের শৈশবজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা যেমন তাঁর জন্ম, পুতনাবধ, কালীয়দমন, অকাসুর বধ, দধিমন্থনকে পুতুলের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রকৃতির মাঝখানে প্রদর্শন করা হত। কি পারিপাট্য সেই ঝুলনযাত্রার! ফেরার পথে মেলা থেকে কাঁচের চুড়ি, মাটির পুতুল আর গরম জিলিপি হত উপরি পাওনা।
আমাদের বরানগর অঞ্চলে কত সিনেমা হল তখন! জয়শ্রী, অনন্যা, নিউতরুণ, নারায়ণী। কতগুলি এখন উঠেই গেছে। আমার প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতি? বাবা-মায়ের সঙ্গে আলমবাজারের নারায়ণী সিনেমা হলে হাতী মেরা সাথী। যেটা বেশ মনে আছে এখনো। আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথ।

তারপর মনে পড়ে অনন্যা সিনেমা হলে নাইট শো’ তে সুচিত্রা সেন অভিনীত “ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য” দেখতে যাবার কথা। বাড়ি শুদ্ধ সকলে কয়েকটা রিকশো ভাড়া করে গেছিলাম সেবার। ঠাকুমা সুদ্ধু, খালি পায়ে। ফিরেছিলাম সবাই কাঁদতে কাঁদতে।
দিদিদের সঙ্গে ক্লাস সেভেনে উঠে মেহবুবা দেখতে গেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার মেনকা সিনেমা হলে। প্রচুর বকুনি জুটেছিল কপালে। তবুও ভবি ভোলার নয়। ক্লাস নাইনে উঠে দেবদাস দেখেছিলাম আবারো দিদিদের প্রশ্রয়ে। আবারো বেদম বকুনি জুটেছিল।
মনে পড়ে বরানগরের জয়শ্রী তে পদিপিসির বর্মি বাক্স আর নিউতরুণ সিনেমা হলে বাবা তারকনাথ দেখার কথা। সেগুলো মায়ের সঙ্গে। আর মামা মাইমার সঙ্গে কপালকুণ্ডলা দেখার অনুমতিও মিলেছিল একবার।

ভাই একটু বড় হবার পরে বাবা আমাদের ফড়িয়াপুকুরের টকি-শো হাউসে নিয়ে গেছেন বেশ কয়েকবার। খুব ভালো ভালো ইংরেজী ছবি আসত ঐ হলে। ভাইয়ের বায়নার চোটে আমারো বেশ কয়েকটা ভালো ছবি দেখা হয়ে গেছিল । ভাই তখন স্কুলে আর আমি কলেজে। টেন কমেন্ডমেন্টস, বেনহার, টোয়েন্টি থাউসেন্ড লিগ্‌স আন্ডার দ্যা সি, ব্রিজ অন দ্যা রিভার কোয়াই, হাটারী, বর্ণ ফ্রি …আরো এমন কত্ত ছবি।
সিনেমা দেখে উল্টোদিকের ফুটপাথে অমৃতর পয়োধি? আহা! কি স্বাদ তার! অথবা সিলভারভ্যালিতে মুচমুচে কবিরাজী কাটলেট? এখনো ভুলতে পারিনা। একবার তো সিনেমা দেখে ট্রামে চড়ে আমাদের স্মরণীয় অভিযান হল কলেজ পাড়ার দিলখুশা কেবিনে। বাবার কলেজ স্মৃতি উসকে দিত যেন। বলতেন দিলখুশার ফাউল কাটলেট না খেলে জীবন বৃথা। তাই আমরাও গেলাম সেই অনবদ্য স্বাদের ভাগীদার হতে।
আমার ছোটবেলায় একবার গড়ের মাঠে সারারাত ব্যাপী বঙ্গ সম্মেলন দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে শেষ শীতের রাতে মাটিতে চাদর পেতে আমরা বসে পড়েছিলাম টিকিট কেটে হেমন্ত-আরতির জলসা শুনতে। আরতি মুখোপাধ্যায় তখন উঠতি গায়িকা। সাদা শাড়িতে গায়ে পরিপাটি ঢাকা দেওয়া আইবুড়ো যুবতী। মোম জোছনায় ভাসিয়েছিলেন রাত জলসার চরাচর। হেমন্ত বাবুর পাল্কির গান আর রানার শোনার অপেক্ষায় আঁকুপাঁকু আমি তখন। মা অনেক দরদস্তুর করে কিনেছিল আলুভাজার কাটার আর ইঁদুর ধরার কল। পরদিন বাড়িতে হৃদয় আকৃতির আলুভাজা পেয়ে ভরে গেছিল মন।
ছোটবেলায় বেশ ভীতু ছিলাম আমি।
একলা ঘরে কোনো শব্দ হলে আমার খুব ভয় করত একটা সময় । অথবা খালি বাড়িতে কল থেকে নির্দ্দিষ্ট পর্যায় টিপ টিপ করে জল পড়লেও কেমন ছমছম করত । মা, বাবা একবার সিনেমায় গেছিলেন । ভাই আর আমি বাড়িতে একা । আমি তখন কলেজে আর ভাই স্কুলে । লোডশেডিং হয়ে গেছিল । আমরা মোমবাতি, হারিকেন না জ্বেলে চুপচাপ বারান্দার লাগোয়া ঘরে বন্দী হয়ে অন্ধকারে বসে রইলাম আর কত রকমের খুটখাট, খটখট, ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ শুনে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে রইলাম । কিছু পরে যখন সিনেমা দেখে বাবা, মা ফিরলেন ততক্ষণে আলো এসে গেছে কিন্তু আমরা ভয়ে জানলা দরজা বন্ধ করে বসে আছি তো জানব কেমন করে?
এই ভয় পাওয়া নিয়ে লিখতে গিয়েই মনে পড়ে গেল তালগাছে তে চার চোখোর মায়ের কথা। বাবা ঘুম পাড়াতে গিয়ে বলতেন, না ঘুমোলে চার চোখোর মা গাছ থেকে নেমে এসে কাঁথা কেড়ে নেবে। এইজন্যেই বুঝি ছোটদের ভয় দেখাতে নেই।

তালগাছেতে হুতুম্‌থুমো, কান আছে পদারু
মেঘ ডাকছে ব’লে বুক করছে গুরু গুরু।
তাদের কিসের আনাগোনা?
শ্যামলতার বাপ এসেছে তাক ধিনাধিন ধিনা।

কেমন যেন সিঁটিয়ে থাকতাম আর সেই হুতুম্‌থুমোর নাম মনে করতে করতেই ঘুম এসে যেত নিজের অজান্তে। মা বলত একানড়ের কথা। এখনো জানিনা কি বিচিত্র এই এক নড়া বা চার চোখ বিশিষ্ট প্রাণীরা। মামার বাড়ির কাছে থাকত আরেকটা বীভত্স চেহারার হারাপাগলা। তাকে দেখেও আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত ভয়ে।

এখন জ্বর হলে ছোটবেলার মত আর সেই তাড়স অনুভূত হয় না। এখন জ্বর আসে জ্বর যায়। স্কুলবেলায় হঠাত করে জ্বর এলেই কড়া শাসন। বাবার ফতোয়া জারি। মায়ের সতর্কীকরণ। এটা না, ওটা না, সেটা না। স্কুল না যাবার আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ণতা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়ার কষ্ট। সে আরেক জ্বালা। কত পড়া হয়ে যাবে। না গেলে জানতেও পারব না। সেগুলি মেকাপ করে পড়ার গাড়িকে লাইনে আনাও মস্ত কাজ। অতএব জ্বর এলেই পথ্যি। সেসময়ছিল কাঁচের বোতলে এলকাসল বা এলকালি মিক্সচার। লেমন ইয়েলো রং। টকমিষ্টি স্বাদ। মনে হত জ্যুস খাচ্ছি যেন। দাগ মিলিয়ে কাঁচের গ্লাসে ঢেলে জল মিশিয়ে হাতে দিয়ে মা বলত, ঢক করে খেয়ে নাও। কি হবে মা? মা বলত পেচ্ছাপ পরিষ্কার হলে সব ব্যাধি সেরে যায়। পরে জেনেছি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক pH সাড়ে ছয়ের আশেপাশে। জ্বর হলে সেটি কমে এসিডিক হয়ে যায়। তাই জ্বরে মুখের স্বাদ চলে যায়। মুখের ভেতরটা টকটক লাগে। আর অ্যালকালি মিক্সচার বা অ্যালকাসল দিয়ে সেই pHকে নিউট্রাল করা হয়। মাথাব্যথা হলে বেঙ্গল কেমিক্যালের ইউথেরিয়া মলম মাথার রগের দুপাশে। সব এক। যাহাই অম্রুতাঞ্জন তাহাই ইউথেরিয়া। সবি মিথাইল স্যালিসাইলেটের ঝাঁঝালোমায়া। নাকবন্ধ হলে কালোজিরের পুঁটুলি শোঁকানো ছিল মায়ের। কয়েকবার কালোজিরের ঝাঁঝ নাকে টেনে নিলেই বেশ কয়েকবার জব্বর হেঁচেই নাক পরিষ্কার। এখন সব নাক বন্ধ হলেই নেজ্যাল ড্রপস। বড় ক্ষতিকারক। সর্দ্দি বসিয়ে দিতে ওস্তাদ। আমাদের ছোটবেলার জ্বরে এত প্যারাসিটামল ছিলনা। ছিল লাল রংয়ের মিক্সচার। কাঁচের শিশিতে। ডাক্তারবাবু লিখে দিলেই সেই ফরমুলায় মেডিসিনের দোকানে বানিয়ে দিত। তার মধ্যে থাকত জ্বর কমানো থেকে সর্দির ওষুধ, এন্টি এলার্জিক থেকে কাশিরওষুধ, হজমের ওষুধ থেকে সামান্য ঘুমের ওষুধ। আর ছিল মায়ের হাতের জলপটি। ধবধবে সাদা নরম কাপড়ে একফোঁটা ওডিকোলন ফেলে একটুকরো বরফ দেওয়া কাঁচের কাপে জল নিয়ে মাথার শিওরে বসে মায়ের জলপটি দিয়ে জ্বর নামানো। মনে করে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখা। আর বালিশের ওপর রাবারশিটে পেতে মাথায় জলধারানি করে মাথার চুলে বিলি কেটে কেটে ধুয়ে দেওয়া। তারপরে আলগা হাতে গামছা দিয়ে মাথা মুছিয়ে দেওয়া খটখটে করে। তারপরেই তালপাতার হাতপাখা দিয়ে ধীরে ধীরে শুকনো করা মাথার চুল। ভুলবশতঃ সেই হাতপাখা কোনোক্রমে গা ছুঁলেই তাকে মাটিতে ঠেকিয়ে নেওয়া….এসব আজ অতীত। সেইসঙ্গে মাখন দিয়ে গরম আলুমরিচ অথবা শুকনোখোলায় চিঁড়েভাজা দিয়ে ছোলাবাদাম।
আজকের ছোটরা, স্কুলপড়ুয়ারা এসব দেখেছে? নাকি জ্বর হলেই প্রথমদিনেই এন্টিবায়োটিক ধুমধাম করে। এটা না চললে সেটা। ডাক্তারবাবুদের ধৈর্য থাকলেও রোগীর বাড়ির ধৈর্য নেই। ইঁদুর দৌড়ে যে পিছিয়ে পড়বে নয়ত। আর এন্টিবায়োটিকের সঙ্গে ভিটামিন। বি-কমপ্লেক্স মানেই হলুদ হিসি। জ্বর না কমলে গুচ্ছের গ্যাঁটগচ্চা দিয়ে টেস্ট। একের পর এক। দূষিত পরিবেশ। ডেঙ্গু থেকে ম্যালেরিয়া। চিকনগুনিয়া থেকে সোয়াইন ফ্লু। জ্বরের সঙ্গে সর্দ্দিকাশি না থাকলেই ভয়। কেন জ্বর, কিসের জ্বর? আর সর্দ্দিকাশি থাকলে সোয়াইন ফ্লু।
কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায় আজকাল। জ্বরের সেকাল আর একালও কেমন বদলে গেছে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত