| 19 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

পাপের উত্তরাধিকার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আর্মি টেনিস কোর্টে সিনিয়র অফিসাররা বিকেলে টেনিস খেলে। সফিক অফিস যাওয়ার পথে প্রতিদিনই এমন দৃশ্য দেখে। দেখে তার মন খারাপ হয়। বিকেলের এই সময়টা মানুষ খেলে, কেউ দল বেঁধে আড্ডা দেয়, কেউ প্রেম করে। আর সফিককে অফিস যেতে হয়। পত্রিকা অফিসে সাব এডিটরের চাকরি। বিকেল থেকে মাঝ রাত অব্দি কাজ। তবু ভালো, বড় ভাই তার বস কোন এক আর্মি অফিসারকে বলে চাকরির ব্যবস্থাটা করেছিল। না হলে বেকার হয়ে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হতো। সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর চারটা মাত্র পত্রিকাতে আর কত জনেরই বা জায়গা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরনোর পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই কচুক্ষেতে একটা দোকান নিয়ে ব্যবসা করবে বলে ঠিক করেছিল। হঠাৎ করে ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ কচুক্ষেতের মার্কেটটা ভেঙে দিল। শোনা যায় বঙ্গবন্ধুও নাকি আর্মিদের উপর খুব খেপেছিলেন এই মার্কেট ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে। কয়েকজন সিনিয়র অফিসারকে ডেকে নিয়ে নাকি তার ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘একটা সদ্য স্বাধীন দেশ। কোন সম্পদ নেই। আমি বাইরে থেকে ভিক্ষে করে নিয়ে আসি। তা আমার গরীব দুঃখি মানুষের হাতে পৌঁছে না। চোর চুট্টিয়া চুরি করে খায়। আর্মিরা আছে তাদের প্রমোশন আর সিনিয়রিটি নিয়ে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সিনিয়রিটি দিতে হবে। দিলাম মুক্তিযাদ্ধা অফিসারদের দুবছরের সিনিয়রিটি। কয়েকটা গরীব মানুষ ব্যবসা করে খাচ্ছিল সেটা ভাঙার দরকার হল কেন? আমি এখন তাদের কি জবাব দেব?’ লোকটা দেশের মানুষের কথা ভাবে। অথচ দেশের মানুষ সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। দেশটা এতো বড় একটা দূর্ভিক্ষ পার করছে। তাতে কারও কোন সহযোগিতা নেই। এক দল আছে সমাজতন্ত্রের নামে দেশে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করার পাঁয়তারায়। আজ সকালে সফিক যখন নাজমাকে নিয়ে কলা ভবনের দিকে হাঁটছিল তখনও টি এস সির সামনে দুটো শক্তিশালী বোমা ফাটিয়েছে। কাল যখন বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন তখন কি অবস্থা হবে কে জানে। কামাল ভাই, বাচ্চু ভাইকে দেখলাম আয়োজন আর নিরাপত্তা নিয়ে বেশ তৎপর। এই সব ভাবতে ভাবতে সফিক টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে বড় ভাইয়ের দুজন বন্ধু টেনিস কোর্ট বাউন্ডারির ভেতরে দাঁড়িয়ে কি যেন শলাপরামর্শ করছে। বাসায় বড় ভাইয়ের কাছে ওদেরকে বেশ কয়েকবার যেতে দেখেছে। একদিন সফিককে ওদের সাথে পরিচয় করিয়েও দিয়েছিল। ওদের একজনের নাম নূর আর আরেক জনের নাম ডালিম। ওরা দুজনই কিছুদিন আগে আর্মি থেকে চাকরি হারিয়েছে। ডালিম তার নতুন বউকে নিয়ে একটা বিয়ের পার্টিতে গিয়েছিল। সেখানে ডালিমের শালার সাথে গাজী নামের একজনের ছেলে বেয়াদবি করায় তাকে চড় মারে। গাজী অনেক প্রভাবশালী মানুষ। তিনি ডালিম আর তার বউকে গাড়ীতে করে তুলে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুর বাসায় বিচার করার জন্য। এদিকে নূর খবর পেয়ে কেন্টনমেন্ট থেকে তার দলবল সহ গাড়ী নিয়ে প্রথমে গাজীর বাড়ী এবং পরে ৩২ নম্বরে হাজির হয়। সে দলে সফিকের ভাইও ছিল। তবে কপাল ভাল সফিকের ভাইয়ের চাকরিটা আছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ডালিম আর নূরের চাকরি গেছে। সফিক ভেবে পায় না, যেখানে সিনিয়র অফিসাররা খেলছে সেখানে চাকরি হারানো দুজন জুনিয়র অফিসার ঘুর ঘুর করছে কেন? চাকরি ফিরে পাওয়ার সুপারিশ নাকি কোন ষড়যন্ত্র? বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাতাসে নানা রকম গুজব ঘুরে বেরাচ্ছে। ভালো মানুষগুলো সব কিভাবে যেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তোষামোদকারীরা এমন ভাবে তাকে আগলে রেখেছে যেন দেশের বাস্তব অবস্থাটা তিনি জানতেই পারছেন না।

অফিসের ডেস্কে বসেই দেখে নিউজ বাস্কেটে অনেকগুলো নিউজ জমা হয়ে আছে। প্রথম নিউজটায় চোখ রাখতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেলা সাড়ে ১২ টায় নোয়াখালীর রামগতি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ভারতের একটা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। ২ জন অফিসার সহ ৮ জন নিহত। একটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার ৭ টা লাশ নিয়ে ঢাকা ফিরেছে। এই সব খবর লিখতে সফিক মানসিক ভাবে খুব বিচলিত বোধ করে। কোন মৃত্যু, কোন হত্যাই সে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। যেকোন মৃত্যুর কথা শুনলেই মায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। মাকে সে বাঁচাতে পারেনি। যুদ্ধের সময় সফিকের কলেজের বন্ধুরা অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সফিকের বাবা যুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বড়ভাই তখন আর্মির চাকরি নিয়ে করাচিতে আঁটকা পড়ে আছে। মাকে দেখাশোনার জন্য সফিক যুদ্ধে যেতে পারেনি। অথচ সেই মাকে সে রক্ষাও করতে পারেনি। এলাকার রাজাকাররা সফিকের বাবার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার মাকে খুন করে। সফিক কাপুরুষের মতো লুকিয়ে থেকে মাকে খুন হতে দেখেছে। সফিককে পেলে সেদিন ওরা তাকেও মেরে ফেলত। তাই ‘দেশমাতৃকা’ শব্দটির অর্থ সফিকের কাছে শুধু কথার কথা নয়। এই দেশের মাটির সাথে সত্যিকার অর্থেই মায়ের রক্ত মিশে আছে। মায়ের রক্তের বিনিময়েই সে আজ এই স্বাধীন দেশের নাগরিক। রাজাকারদের সে তাই কোন ভাবে মেনে নিতে পারে না। আজ সকালে যখন সে জানল নাজমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ছিল তখন তার নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হয়। ঘৃনা হয়। কিভাবে সে একজন রাজাকারের মেয়ের সাথে দীর্ঘ তিন বছর সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে। কোনদিন সে এ বিষয়টা জানেনি বা জানার চেষ্টা করেনি। আজ কথা প্রসঙ্গে সে যখন নাজমার কাছে জানতে চায়, সবাই তো ছুটি পেলে গ্রামের বাড়ী যায়। তোমাদের কি গ্রামে কোন বাড়ী নেই?

-আমাদের গ্রামে বাড়ী আছে। কিন্তু আমরা গ্রামের বাড়ীতে যাই না। সেটা বেদখল হয়ে আছে।
-বেদখল হয়ে আছে মানে? তোমার বাবা কি রাজাকার ছিল নাকি ? বাড়ী বেদখল হয়ে আছে। তোমরা গ্রামে যাও না। সফিক কিছু না ভেবেই কথাগুলো বলে ফেলে।
-কেন? আমার বাবা রাজাকার হলে কি আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে? তোমার সম্পর্কটা আমার সাথে। এর মাঝে বাবাকে টানছ কেন? আমি তো রাজাকার না। নাজমা বেশ ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলে।
-তার মানে প্রকারন্তরে তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ, তোমার বাবা একজন রাজাকার ছিল। এবং আমি একজন রাজাকারের মেয়ের সাথে প্রেম করছি। এটা অসম্ভব। অ্যাবসলিউটলি ইমপসিবল। মুক্তিযাদ্ধা রফিকুদ্দীন কমান্ডারের ছেলে একজন রাজাকারের মেয়েকে ভালোবাসতে পারে না।
সফিক পাল্টা যুক্তি হিসাবে কথাগুলো বলে বটে কিন্তু তখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি যে সে সত্যিই রাজাকারের মেয়ে। নেহায়েত নাজমাকে রাগিয়ে একটু মজা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিষয়টা মজার সীমা ছাড়িয়ে কান্নাকাটিতে পৌঁছায়।
-আমাদের এতো দিনের সম্পর্ক কিছু না। এখন আমার বাবা যদি রাজাকার হয় তাহলে আমি তোমার অযোগ্য হয়ে যাব।
-দেখ, কিছু কিছু অপরাধ বংশ পরম্পরায় বহন করতে হয়। কারো বাবা যদি রাজাকার হয় তবে তার মেয়েকে এই ঘৃনিত পরিচয় বহন করতেই হয়।

পরিস্থিতি সত্যি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। নাজমা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেয়। সফিক একটা বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে যায়। যুক্তিতর্কের সীমা ছাড়িয়ে সত্যটাকে নিশ্চিত হওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। ছুটে যায় জগন্নাথ হলে রাজীবের কাছে। সে নাজমার এলাকার ছেলে। সফিক রাজীবের কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। রাজীব জানায়, নাজমার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। তাদের এলাকার সব চেয়ে বড় রাজাকার। প্রচুর মানুষ হত্যা করেছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেই সব উদ্বাস্তু লোকজন নাজমাদের বাড়ীতে বাস করে। একজন মুক্তিবাহিনী কমান্ডারের সাথে নাজমার বিয়ে দিয়ে তারা এলাকায় ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু নাজমা রাজি না হওয়ায় বিয়েটা হয়নি।

সফিক মন খারাপ করে বাসায় ফিরে তড়িঘড়ি রেডি হয়ে অফিসে চলে আসে। কাজ মন বসে না। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের উপর একটা ক্রোড়পত্র বের হবে। তাতে কিছু ভুলভ্রান্তি নিয়ে সম্পাদকের কাছে বকা খায়। বাসায় ফেরার পথে প্রতিদিনের মতো গাড়ীতে উঠেই সফিক ঘুমিয়ে যায়। এলিফেন্ট রোড থেকে গাড়ীটা যখন মিরপুর রোডের দিকে টার্ন নেয় তখন ঘুমটা একটু হালকা হয়, তবু চোখ খুলতে ইচ্ছা করে না। যখন চোখ খুলল তখন ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে ৩২ নম্বর রোড পার হচ্ছে। হঠাৎ মনে হল আজ তো বৃহস্পতিবার রাত, রাত পোহালেই কাল শুক্রবার। ভাবী তো আজকের রাতের কথাই বলেছিল। সেদিন মঙ্গলবার রাতে ভাইয়ের বন্ধু ফারুক ভাইয়ের বিবাহ বার্ষিকীর পার্টি ছিল ক্যান্টনমেন্টের অফিসার মেসে।সেখানে নাকি তারা আজকের রাতে বড় কোন ঘটনা ঘটনোর পরিকল্পনা করছে। পরদিন ভয় পেয়ে ভাবীই সফিককে বলেছিল, তোমার ভাই বন্ধু বান্ধবদের সাথে কি যে পাগলামী শুরু করেছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের কপালে কি যে আছে। সফিক শুনে ভাবীকে বলেছিল, তুমি অযথাই চিন্তা করছ। রাতের পার্টিতে ওরকম আগড়ুম বাগড়ুম অনেক বড় বড় পরিকল্পনা করা যায়। বাস্তব অত সহজ না। তবু কথাটা মনে হতে সফিকের গা ছম ছম করে ওঠে। যদিও ৩২ নম্বর রোডের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে অন্য সব দিনের মতই স্বাভাবিক, সুনসান নিরবতা। ক্যান্টনমেন্ট গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর শফিক বেশ আস্থা ফিরে পায়। যাক, আজ রাতে অন্তত: কিছু হচ্ছে না। পুরো ক্যান্টনমেনট এলাকা রাতের অন্ধকারে ঢাকা। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। অথচ সফিক জানেনা কয়েক ঘন্টা পূর্বেই সেনানিবাসের এই রাস্তা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ তুলে বেরিয়ে গেছে ষড়যন্ত্রের সাঁজোয়া বহর। যারা তখন নতুন বিমান বন্দর এলাকায় সমবেত হয়ে নীল নকশা বাস্তবায়নে যার যা দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে।

সফিক ভেবে পায় না, বঙ্গবন্ধুর ওপর কিছু মানুষ এতো ক্ষুব্ধ কেন। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব, না কি মানুষ স্বাধীন ভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে না পারার কারণে এতো ক্ষোভ। এইসব ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকে সফিক শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়।ক্লান্ত শরীর তবু ঘুম আসে না। নাজমার চিন্তাটা মাথার ভেতরে ঘুর পাক খেতে থাকে। মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। ফুঁপিয়ে কান্না আসে। কেন আসে তা সে জানেনা। সে জানে আগামীকাল সকালে আবার নাজমার মুখোমুখি হতে হবে। তখন সে কি বলবে ভেবে পায় না। ঠিক করে একটা চিঠি লিখে নাজমার হাতে দেবে।চিঠিতে কি লিখবে তাই ভাবতে ভাবতে চোখটা বন্ধ হয়ে আসে।

একটা ধুম করে শব্দ হয়। জানালা খুলে যায়। সোঁ সোঁ করে জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে। বাতাসে সফিকের ঘরের দরজাটা খুলে যায়। দরজার ওপাশে উপরে ওঠার সিঁড়ি।সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা। তার মাঝে ভেসে আসছে একটা ভাঙা চশমা। ওপরের দিকে তাকাতেই দেখে চেক লুঙ্গি আর সাদা ধবধবে পান্জাবি। রক্তে ভেজা। হাতের তর্জনীটা ছিঁড়ে ঝুলে আছে রক্তের মাঝে। রক্তের ধারা এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডি লেকে। সফিক এগিয়ে যায় রক্তের ধারার সাথে। নেমে পড়ে ধানমন্ডি লেকে। মনে হয় সারা বাংলাদেশ তলিয়ে যাচ্ছে রক্তস্রোতে। সফিক ডুবে যেতে থাকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সফিকের। লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসে। শারীর ঘামে ভেজা। পানি খায়। ওজু করে। ফজরের নামাজ পড়ে। বাইরে তখন সৈনিকদের পিটি প্যারেডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক। আর পাঁচটা ভোরের মতই। সফিক ভাবে তার অবচেতন মনের চিন্তাগুলো দুঃস্বপ্ন তৈরী করেছে।
জানালার ওপাশে একটা কাক বিরামহীন কা কা করে যাচ্ছে। সফিক চিঠিতে নাজমেকে কি লিখবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায়। একটু বেলা বাড়লে ভাবী এসে দরজায় ধাক্কা দেয়।
-এতো সকালে ধাক্কা ধাক্কি করছ কেন?
-রেডিও শোন। দেখ কি কান্ড ঘটিয়েছে।শেখ মুজিবকে তো ওরা মেরে ফেলেছে।
-বড় ভাই কোথায়?
-তোমার ভাইতো কাল সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেছে। তার সাথে তো কোন যোগাযোগ করতে পারছি না। তুমি একটু তোমার ভাইয়ের অফিসের দিকে গিয়ে দেখবে? কোন খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।

সফিক রেডিও অন করে। দেশাত্মবোধক গান বাজছে আর কিছুক্ষণ পর পর ঘোষনা হচ্ছে।আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সফিকের মনে পড়ে গতকাল টেনিস কোর্টে দেখা সেই দুজন অফিসার কথা। ওদেরই একজন মেজর ডালিম। বড় ভাইয়ের বন্ধু। এরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেলল। যে কাজ পাকিস্তানিরা করতে সাহস পায়নি। সেই কাজ বাঙালীরা করল।

নাজমাকে লেখা সফিকের চিঠির ভাষা পাল্টে যায়। তার নিজের প্রতি খুব ঘৃনা হয়। মুক্তিযাদ্ধা রফিকুদ্দীন কমান্ডারের ছেলে, আজ থেকে তার নতুন পরিচয় হবে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাই। এই পরিচয় রাজাকারের সন্তানের পরিচয়ের থেকে লক্ষগুণ ঘৃনিত এক পরিচয়। মা যখন রাজাকারদের অত্যাচারে মৃত্যু যন্ত্রনায় আর্তনাদ করেছে। সফিক তখন নিজের জীবনের ভয়ে মায়ের কাছে এগিয়ে যেতে পারেনি। আর এখন, দুইদিন আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার এমন একটি পরিকল্পনার কথা জানার পরেও সে কিছুই করতে পারল না। সফিক এই সব ভাবনায় যখন বিপর্যস্থ তখন ভাবী খবর নিয়ে এল বড়ভাই রেডিও স্টেশন থেকে টেলিফোন করেছিল। তারা সবাই ভাল আছে। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। সেই সাথে শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের পরিবারেরও কেউ বেঁচে নেই। এখন তিন বাহিনী প্রধান আর খন্দকার মোশতাককে রেডিও স্টেশনে নিয়ে এসেছে। মোশতাক হবে প্রেসিডন্ট আর তিন বাহিনী প্রধান তার প্রতি আনুগত্যের ঘোষনা দেবেন। ভাবী তার সাথে আরো যোগ করে, তুমি এসব নিয়ে বেশি ভেবো না। যার যা পরিণতি তাই হয়েছে। তোমার ভাই তোমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছে।

সফিক রাগে দুঃখে ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ওঠে, তোমরা কার পরিণতির কথা বলছ? এখন নিজেদের পরিণতির কথা ভাব। তোমরা কি মনে করেছ? বাংলাদেশের মানুষ কি তোমাদের ছেড়ে দেবে? আমার ভাই বঙ্গবন্ধুর খুনি। এমন ভায়ের মুখ আমি দেখতে চাই না। ও মুখে আমি থুথু দেই।
-তুমি কিন্তু তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। বেরিয়ে যাও বাসার থেকে। ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে আর ভাইয়ের মুখে থুথু দেও। মুরোদ থাকলে বাইরে গিয়ে প্রতিবাদ কর।
-তাই করব। তার জন্য যদি মরতে হয় মরব। এমন পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল।

সফিক বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে বত্রিশ নম্বরের দিকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু আর্মি ভ্যান। কোথাও কামানবাহী ট্রাক। কোথাও একটা দুটো ট্যাঙ্ক। প্রতিবাদী মানুষের খোঁজে দৌড়াতে থাকে সফিক।আকাশে তখন সূর্যের অনেক তেজ। সফিকের বুকের আগুন একসময় সূর্যের তেজের সাথে মিশে যায়। শফিককে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনার কয়েকদিন পর নাজমার নামে একটা চিঠি আসে। চিঠিটা রক্তে আর ঘামে ভেজা। লেখাগুলোর সামান্যই বোঝা যায়। …রাজাকারের সন্তান। এই পরিচয়টি লজ্জার। এর থেকে লক্ষগুণ ঘৃনার পরিচয় আমি একজন বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাই। আমি আজ তোমার বড়ই অযোগ্য। ভালোবাসা আমার জন্য নয়। আমার জন্য মানুষের ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই আশা করি না।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত