ঝুম্পা লাহিড়ীর ইন আদার ওয়ার্ডস : অকারণ বাগাড়ম্বর
।।হা সা ন ফে র দৌ স।।
তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ইন আদার ওয়ার্ডস প্রকাশ হওয়ার আগে মোট চারখানা বই লিখেছেন ঝুম্পা লাহিড়ী, প্রতিটিই বেস্ট সেলার। বাঙালি বা ভারতীয় লেখক হিসেবে নয়, ইংরেজি ভাষার একজন সেরা লেখক হিসেবেই তিনি আদৃত হয়েছেন। যেসব ভারতীয় লেখক ইংরেজ ভাষায় লিখে খ্যাতি পেয়েছেন, যেমন সালমান রুশদি বা অমিতাভ ঘোষ, তাঁদের অধিকাংশই ভারতীয় অভিজ্ঞতার পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত থেকেছেন। সেদিক থেকে ঝুম্পা কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি নিজে অভিবাসী, প্রধানত অভিবাসী অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁর গল্প বা উপন্যাস নির্মিত। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস দি লো ল্যান্ডস যদিও নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত, সে-উপন্যাসেরও অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে অভিবাসী মানুষের গল্প।
যে মানুষ ও জীবনকে তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন, ঝুম্পা তার গল্পই বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিবাসী জীবন বেছে নেওয়ার সেটাই একমাত্র কারণ নয়। ঝুম্পা তাঁর নতুন বই, ইন আদার ওয়ার্ডসে জানাচ্ছেন, এতদিন তাঁর পিতা-মাতার ‘হারিয়ে যাওয়া মাতৃভূমি’ পুনরুদ্ধার তাঁর গল্প লেখার একটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তবে কলকাতাকে তিনি নিজের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু করেছেন এ-কারণে নয় যে, সে-শহর ও সে-জীবন তাঁর দেখা ও চেনা। বস্তুত, কলকাতা বা বাংলাদেশ তিনি মোটেই চেনেন না। ছুটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছেন পর্যটক বা অতিথির মতো। পাখির চোখে যে-জীবন দেখেছেন, তাকে নিজের বলে মনে হয়নি। বাংলা বলতে পারেন, কিন্তু তাকে কখনো ভাব প্রকাশের প্রথম বাহন বিবেচনা করেননি। তারপরও এই জীবন নিয়েই গল্প লিখতে বসেছেন। কারণ ঝুম্পার নিজের কথায়, ‘আমার ব্যক্তিগত জীবন ও নিজের সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি দূরত্ব – একটু জায়গা – রাখতে চেয়েছিলাম।’ এসব গল্প-উপন্যাস পড়ে আমরা পাঠকরা ভেবেছি, এই গল্প বুঝি ঝুম্পার নিজের গল্প। বস্তুত সব লেখকই তো কোনো না কোনোভাবে নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সাহিত্য নির্মাণ করেন, অন্যথায় নির্মিত সাহিত্য কৃত্রিম মনে হয়, তাকে মনে হয় অবাঞ্ছিত। ঝুম্পা এখন আমাদের জানাচ্ছেন ঠিক উলটো কথা। নিজের জীবন নয়, অন্যের জীবনের গল্পই তিনি করেছেন, কারণ নিজের গল্প বলা তাঁর কাছে এক ধরনের ঔদ্ধত্য মনে হয়, মনে হয় বড় বেশি আত্মম্ভরী।
তাঁর কাহিনির চরিত্রগুলো সবই দক্ষিণ এশীয়, এর কারণ তিনি নিজে দক্ষিণ এশীয়, এমন কথা মানতে ঝুম্পা নারাজ। সেস্নট নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঝুম্পাকে এ-কথা বলা হলে তিনি রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ‘এমন সমালোচনা কি আমরা চেখভ বা জন আপডাইক সম্বন্ধে করি বা বলি?’ সেই একই সাক্ষাৎকারে ঝুম্পা আমাদের এমন কথাও জানান, অন্য কারো জন্য নয় – শুধু নিজের জন্যই তিনি লেখেন। ‘আমার লেখা হলো এক ধরনের অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রা। সব লেখকই সংযুক্ত হওয়ার বাসনা থেকেই এই অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রায় শামিল হয়। অন্য সব লেখকের মতো আমিও এক অসহনীয় নির্জনতা থেকে যন্ত্রণা ভোগ করেছি, (যা থেকে পরিত্রাণ পেতে) নিজেকে প্রকাশ করার আগ্রহ জন্মেছে।’ সেখান থেকে সাহিত্য।
ঝুম্পার এ-কথাগুলো পরস্পরবিরোধী, সংযুক্ত হওয়ার বাসনার অর্থই তো পাঠক-নির্ভরশীলতা। অন্যথায় এই অভিযাত্রা – তা অভ্যন্তরীণ বা বহির্গত যা-ই হোক, তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কিন্তু সে-কথার কাটাছেঁড়ায় আমরা যাব না, সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ইন আদার ওয়ার্ডস লেখার উৎস বা তাড়না বুঝতে হয়তো এই ব্যাখ্যা আমাদের সাহায্য করবে, সেজন্যই ঝুম্পার নিজের কথার উদ্ধৃতি আমরা ব্যবহার করছি।
মূল কথায় আসি। ইন আদার ওয়ার্ডস ইংরেজি বই নয়, এটি ইতালীয় ভাষায় লেখা। ঝুম্পাই লিখেছেন, ইংরেজিতে তার অনুবাদ করেছেন অ্যান গোল্ডস্টিন। ইতালীয় ভাষার প্রতি ঝুম্পার দুর্বলতা – অথবা ভালোবাসা – বেশ পুরনো, ছাত্র বয়সে নিজের বোনকে সঙ্গে নিয়ে ইতালি ভ্রমণের সময় থেকে। সে-সময় কথা বলতে – কথা বলে বোঝাতে সুবিধা হবে এই ভেবে অধিকাংশ ট্যুরিস্টের মতো তিনিও একটি ইংরেজি-ইতালিয়ান অভিধান কিনে নেন। সেই থেকে শুরু। নিজের পিএইচ.ডি থিসিসের বিষয় ছিল সাহিত্যে ইতালীয় স্থাপত্যকলার প্রভাব। সে-সময় নিজের প্রয়োজনেই ভাষাটাকে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেন। প্রথমে একা, পরে শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে। ২০১২ সালে ঝুম্পা সপরিবারে রোমে চলে আসেন থাকবেন বলে। এখানে এসে ইতালীয় ভাষার ভেতর আমু-ু ডুবে গেলেন ঝুম্পা। ভাষাটাকে পুরোপুরি নিজের করার চেষ্টায় তিনি অন্য কোনো ভাষায় বই পড়া বা লেখা একদম ছেড়ে দিলেন। ভাষা শিক্ষার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ইমারশান মেথড’ বা ‘নিমজ্জন পদ্ধতি’। শেষ পর্যন্ত তিনি ভাষাটাকে শুধু রপ্তই করলেন না, এই ভাষায় গল্প লিখলেন। সে-গল্প ছাপাও হলো।
এক ইতালীয় পত্রিকায় ছোট ছোট অধ্যায়ে এই ভাষা শিক্ষার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। সেসব অধ্যায়কে জোড়া লাগিয়েই তৈরি হয়েছে এই বই, যার নাম আমরা বাংলায় দিতে পারি অন্য কথায়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে-ভাষায় তিনি সিদ্ধ, যে-ভাষায় তিনি ভাবেন-লেখেন, তা ছেড়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাষা তাঁকে এভাবে আঁকড়ে ধরতে হলো কেন। ঝুম্পা নিজেই এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। একটা নতুন ভাষাকে রপ্ত করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি নিজের সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মিল খুঁজে পেয়েছেন। নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে যে-দ্বন্দ্ব আশৈশব বোধ করেছেন, এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তার একটা মীমাংসাও খুঁজে পেয়েছেন। ফলে অন্য কথায় ঝুম্পার ‘আত্মপরিচয়, আবিষ্কার ও সৃজনশীল প্রক্রিয়ার’ সঙ্গে নিবিড়ভাবে অন্বিত। সেস্নট পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঝুম্পা এমন একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন :
‘অন্য যে-কোনো লেখকের মতোই আমি চাই নিজ মত ও ভাবনা প্রকাশের শুদ্ধ স্বাধীনতা – সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত পথে এগোবার স্বাধীনতা। লেখক হিসেবে স্বীকৃতি ও খ্যাতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু (বিড়ম্বনাও) আসে। একবার মনে হয় যা করেছি, তা হয়তো অর্থপূর্ণ হয়েছে, কিন্তু এর ফলে এক ধরনের প্রত্যাশারও জন্ম হয়। আমি সারাজীবন অন্যের – এবং নিজের – প্রত্যাশার জবাব দিতে দিতে জীবন কাটিয়েছি। কিন্তু ইতালীয় ভাষায় লেখার একটা মজা হলো, এ-ভাষা থেকে কেউ আমার কাছে কিছুই আশা করে না। এটা আমি করছি সম্পূর্ণ আমার নিজের ইচ্ছায়। এ প্রথম আমি যা চাই তা প্রকাশের পুরোপুরি স্বাধীনতা পেয়েছি।’
সত্যি বলছি, আমি ঝুম্পার এই যুক্তির কোনোটাই বুঝিনি। তাঁকে ইংরেজিতে বা বাংলায় লিখতে কেউ ধরে বসে নামায়নি, যা করেছেন নিজের ইচ্ছায়। বাংলার বদলে ইংরেজিতে লেখেন, সেটিও তাঁর নিজের ইচ্ছায়, যার বড় কারণ এই ভাষাটাই তিনি বাংলার চেয়ে ভালো জানেন। নিজের মনের কথা পুরোপুরি স্বাধীনভাবে বলতে হলে সে-ভাষাটাকে ভালোমতো রপ্ত করতে হয়, তাকে নিজের করে নিতে হয়। ইতালীয় ভাষা তিনি ঠিকই শিখবেন, কিন্তু এই ভাষা কখনোই তাঁর নিজের হবে না, সে-কথা নিজেই স্বীকার করেছেন। ফলে তিনি চাইলেও ইতালীয় ভাষায় নিজে যা চান তা বলার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ তিনি কখনোই অর্জন করবেন না। তাহলে এ-কেমন কুহক যার পেছনে এই লেখককে ছুটতে হচ্ছে?
ঝুম্পা জানিয়েছেন এটি তাঁর প্রথম বই, যা পুরোপুরি তাঁর নিজের, কারণ এর বিষয়বস্তু তিনি নিজে। এই গল্প তাঁর নিজের, তাঁর প্রকৃত – যাপিত জীবনের ভিত্তিতে যার নির্মাণ। ‘বলতে পারেন, এটা এক ধরনের ভাষাগত আত্মজীবনী, এক ধরনের আত্মপ্রতিকৃতি।’
‘অন্য একটা ভাষায় লেখা মানে একদম শূন্য থেকে শুরু করা। এক শূন্যস্থান থেকে এর শুরু, প্রতিটি বাক্যের উদ্ভব ঘটে শূন্যতা থেকে। এই পথে একটা ভাষা যেভাবে নিজের হয়ে ওঠে, তার সঙ্গে সৃজনশীল প্রক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে – তারা উভয়েই রহস্যময়, যুক্তিহীন।’
বলা বাহুল্য, ঝুম্পাই প্রথম লেখক নন যিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। জোসেফ কনরাড অথবা ভস্নাদিমির নবোকফ নিজের মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজি ভাষার সেরা লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে শুধু নোবেল পুরস্কারই পাননি, ইংরেজি সাহিত্যধারার একজন প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মিলান কুন্ডেরা চেক ভাষা ছেড়ে ফরাসিতে লিখেছেন, তার জন্য বাহবাও পেয়েছেন। স্যামুয়েল বেকেটও প্রথমে ফরাসিতে লিখে পরে নিজেই নিজের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এঁরা কেউই নিজেদের ভাষা শিক্ষার ওপর আস্ত একটা বই কেন, ছোটখাটো কোনো প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজন দেখেননি।
তাহলে বিদেশি ভাষায় এমন একটা বই লেখার এমন আলাদা কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে? বস্তুত এটি প্রথাগত অর্থে কোনো সাহিত্যিকের লেখা ফিকশন অথবা
নন-ফিকশন কোনোটাই নয়। আমার মনে হয়েছে এটি কেবল বিদেশি ভাষা শেখার একটি গাইড বই মাত্র। কী করে বিদেশি ভাষা শেখা যায়, নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ধাপে ধাপে তার প্রতিটি পর্যায় ঝুম্পা আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে একটা অভিধান কেন, নতুন শব্দ পেলে খাতার মার্জিনে লিখে রাখ, প্রতিটি নতুন শব্দ মোটা কালিতে দাগিয়ে রাখ, নতুন কী শব্দ শিখলে একটি নোটবুকে তা টুকে রাখ ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে-বিদেশে অনেক বাঘা বাঘা সাহিত্য-সমালোচক ঝুম্পার এই বইকে মহান সৃষ্টি বলে রায় দিয়ে বলেছেন, এ হলো একই সঙ্গে ‘উন্মূলতা ও আবিষ্কারের’ মানচিত্র। পাঠক হিসেবে নিজের সীমাবদ্ধতা কবুল করে বলছি, সেই মানচিত্র আমার কাছে ধরা পড়েনি। আমার মনে হয়েছে এই বই সাহিত্য নির্মাণ প্রক্রিয়ার ধারা-বিবরণ নয়, ভাষা শিক্ষার ধারা বিবরণ মাত্র। মূল ইতালীয়তে কেমন হয়েছে জানি না, ইংরেজি অনুবাদে পড়ে তা আমাদের বেশ লাগে, বোঝা যায় এর মূল লেখক একজন সাহিত্যিক। কিন্তু সেই সাহিত্যিককে নিজের পরিচিত ভাষা ছেড়ে সদ্য শেখা এক ভাষায় এরকম একটি বই রচনা, আমার বিবেচনায়, নিজের ক্ষমতার অপচয় ভিন্ন আর কিছু নয়।
গোড়ায় উলেস্নখ করেছি, ঝুম্পা আত্মজৈবনিক গ্রন্থ রচনায় অনাগ্রহী। কারণ তাঁর চোখে সেটি বড় আত্মম্ভরী। হায়, ভাষা শিক্ষার একটি গাইড বুক রচনা করে তিনি ঠিক সেই আত্মম্ভরিতারই নজির রাখলেন।