| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

ইন্টারনেট এবং আগামীর মানবমন—স্বরুপ সন্ধান

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

“We live in a world of numbers……we try to be very data-driven, and quantify everything.”                                                   

Marissa Mayer (Google executive)

কোয়ান্টিটি (quantity) শব্দটির মর্ম সমাজ বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচার করলে তা হবে নেহাতই মামুলি অর্থহীন এক প্রচেষ্টা, কিন্তু বিশ্বব্যাপী বিপুল মানবজাতির বাজার কেন্দ্রিক ক্রমবর্ধমান পণ্যবিলাসি মনোভাবের নিরিখে যদি কোয়ান্টিটি শব্দটির কাটাছেঁড়া করা হয় বস্তুত আজকের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি তো বটেই বরং ডিজিটাল চক্রবুহ্যে জড়িয়ে গিয়ে মানুষের মননশীলতার ক্রম-হ্রাসমান কোয়ালিটির (quality) দিকটিও অতি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

নিরন্তর সামাজিক লেনদেন মানুষকে বিভিন্ন কাজে উসকানি দেয়। সৃজন কাজ, মানব দরদী সামাজিক কাজ থেকে শুরু করে তথাকথিত অসামাজিক ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজে যে সকল ভিন্ন মানসিকতার মানুষের ভিড় আমাদের ঘিরে থাকে তাদের সকলেই প্রায় অলিতে গলিতে রাজপথে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন শপিং মলে পা রাখেন, বিভিন্ন পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং চটজলদি কিনেও ফেলেন। ইন্টারনেটের সুবাদে এই কেনাকাটির হিড়িক বহু গুণে বেড়েছে। বাড়িতে বসেই স্মার্ট ফোনের সাহায্যে বিভিন্ন সাইট থেকে অনলাইন জিনিসপত্র খুব সহজেই কেনা যায়। মোদ্দা কথা শ্রেণী ধর্ম জাতি শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে সকল হোমো স্যাপিয়েন্সই এখন আদ্যপান্ত হোমো কন্সিউমেন্স।  

হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন অতএব হাতের মুঠোয় পৃথিবী। মগজের জটিল নিউরাল সার্কিটের মতো এই পৃথিবীর আনাচ কানাচ টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন কানেক্টেড। ইন্টারনেট হল এই সবকিছুকেই জুড়ে দেওয়ার মধ্যমণি। একথা প্রায় সকলেই আমরা একবাক্যে মেনে নিয়েছি যে মানুষকে বিপুল সুযোগ সুবিধা দিয়েছে ইন্টারনেটের লম্বা হাত। আমাদেরকে একলাফে অনেকটাই উপরে তুলে দিয়েছে। গুগল নামক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সার্চ ইঞ্জিনটির সাহায্যে দরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটগুলির খোঁজ পাওয়া যায়। শিক্ষা স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ছাড়াও ছোটখাটো বিভিন্ন প্রাত্যহিক চাহিদার অনলাইন সুরাহা জানতে অনেকেই গুগলের  শরণাপন্ন হন এবং সঠিক এবং দরকারি তথ্যটুকু নিমেষে সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এই গুগল ডিজিটাল তথ্যের একমেবাদ্বিতীয়ম বিশ্বভান্ডার যেখানে আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সবকিছুরই খোঁজ মেলে।

গুগলের সার্চ বক্সে আমাদের দেওয়া টেরাবাইট ডাটার সাহায্যে গুগল কর্মীরা তাদের অ্যাল্গরিদমগুলিকে নিরন্তর আরও নিখুঁত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে মানুষ আরও দ্রুত তাদের প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্যটি খুঁজে নিতে পারেন। একটি মানুষ কতক্ষণ সাইটে থাকছেন, তাদের হাতের মাউসের নাড়াচাড়ায় কারসরের স্থান পরিবর্তন, কোন সাইটে তারা ক্লিক করছেন এবং কোন সাইটে তারা একেবারেই ক্লিক করছেন না এই সমস্ত কিছুই কৃত্রিম মেধায় পুষ্ট জটিল প্রোগ্রামগুলির কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার হয়। গুগল এক্সিকিউটিভ মারিসা মায়ারের ( Marissa Mayer) ভাষায়, “You have to try and make words less human and more a piece of the machinery”. নীল পোস্টম্যান (Neil Postman) ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার বই টেকনোপলি ( Technopoly )তেবলছেন , “.. that infact human judgment cannot be trusted, because it is plagued by laxity, ambiguity, and unnecessary complexity; that subjectivity is an obstacle to clear thinking; that what cannot be measured either does not exist or is of no value; and the affairs of citizens are best guided and conducted by experts.”  নীল পোস্টম্যানের এই বক্তব্যের শেষ অংশটুকুর খানিক রদবদল করলেই তা গুগলের বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিতত্বের সঙ্গে একেবারেই মিলে যায়। নীল বলছেন নাগরিকদের কাজকর্ম সবচেয়ে ভালভাবে চালিত হতে পারে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা কিন্তু গুগুলের ক্ষেত্রে এই বিশেষজ্ঞরা হল আসলে সফটওয়্যার অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমের সাহায্যে কোটি কোটি ওয়েবসাইটের খোঁজ দিতে পারে গুগল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। বিশ্বের প্রায় সকল অংশের কোনও না কোনও মানুষ গুগলের মাধ্যমে দরকারি তথ্যের সন্ধান পান। এ বিষয়ে গুগলের অবদান অনস্বীকার্য এবং তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুগুল যে একমেবাদ্বিতীয়ম সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। যত বেশি সংখ্যকমানুষ যত দ্রুত গতিতে গুগল ব্যবহার করবে গুগলের মুনাফার হার আবার ততই বেশি। আইরিন অ (Irene Au) বলছেন, “Our goal is to get users in and out real quickly. All our design decisions are based on that strategy” (Walters, Google’s Irene Au). গুগুল ব্যবহারকারীর প্রত্যেকটি মাউস ক্লিকই শুধু নয়, একটি ওয়েব সাইট থেকে আরও একটি ওয়েব সাইটে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে যাওয়ার সঙ্গে গুগলের অর্থনৈতিক স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দ্রুত তথ্য অনুসন্ধানের অন্য একটি দিকও আছে।এই পদ্ধতিতে যত দ্রুত মানুষ তথ্যের অনুসন্ধান করবে কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর মনোযোগ দেওয়ার সময়ও একই হারে কমতে থাকবে। ফলস্বরূপ ক্রমশ বাড়তে থাকবে ভাসা ভাসা জ্ঞান এবং বিষয়কে উপর-উপর ছুঁয়ে যাওয়ার প্রবণতা। মার্কিন লেখক নিকোলাস কার ( Nicholas Carr) তার বহুচর্চিত “The Shallows: How the internet is changing the way we think,read and remember” বইটিতে গুগুল সম্বন্ধে লিখেছেন, “The last thing the company wants is to encourage leisurely reading or slow, concentrated thought. Google is, quite literally, is the business of distraction”.

এই অনলাইন কাজকর্মগুলির মুহূর্তগুলিতে মানসিক যোগাযোগ ছাড়াও আমরা ছোটখাটো বিভিন্ন শারীরিক কাজও করে থাকি। যেমন আঙুলের নাড়াচাড়ায় বা হাতের মধ্যে মোবাইলটিকে বিভিন্নভাবে ধরার চেষ্টা। গড়ে দৈনিক দু’ঘণ্টা ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগ থাকলে এই সমস্ত মানসিক এবং শারীরিক কাজগুলিতে আমরা প্রায় পুরোটাই ডুবে থাকি এবং সেই সময়ে বাইরের ঘটনাগুলি থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়ি। এই সময়টিতে ইন্টারনেট আমাদের ভিসুয়াল, সমাটোসেন্সরি এবং অডিটরি কর্টেক্সে বিশেষ ধরণের ইনপুটের সুস্থিত স্রোত পাঠাতে থাকে। আমাদের আঙুল হাত চোখ এবং কানের একই সঙ্গে ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সংবেদনশীল হয়ে উঠি। গন্ধ এবং স্বাদ বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকে একইসঙ্গে আবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে এই ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেটে ডুবে থাকার সুদূরপ্রসারী মানসিক প্রভাব নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও একটি কথাকে সহজেই আমরা মেনে নিতেই পারি যে ইন্টারনেট আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসলে তাকে বিক্ষিপ্ত করার জন্যই। যেহেতু আজকের সিংহভাগ ডিজিটাল মানুষ তথ্যপিয়াসী, আরও আরও যোগাযোগ এবং অনলাইন লেনদেনের প্রতি উন্মুখ তাই বই পড়া বা ধীর গতিতে ক্রমশ কোনও বিষয়ের গভীরে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াগুলি এখন আর তার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। সে চায় একই সঙ্গে অনেককিছু যা ইন্টারনেট তাকে দেয়। বিভিন্ন অ্যাপ, ওয়েবসাইট, ফেসবুকের প্রোফাইল এই সবকিছুই যেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যেই তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে তাকে বিক্ষিপ্তই করতে চায়।           

এই বিষয়টিকে যদি মানুষের দৈনন্দিন অনলাইন সময় কাটানোর পরিপ্রেক্ষিতে আরও ব্যাপক ভাবে বিচার করলে বলাই যায় যে এই ইন্টারনেট তার বিপুল সুবিধার ভাণ্ডারের মালিক হওয়া সত্ত্বেওমানুষের লেখা পড়ার অভ্যাস শুধু নয় তার মনন, চিন্তার অভিমুখও ক্রমশ বদলে দিচ্ছে। ধরা যাক সকাল বিকেল অনলাইন থাকা কোনও মানুষ গভীর মনোযোগের দাবি রাখে এমনই কোনও কাজের মধ্যে এখন আছে। তবুও মনোযোগ হারিয়ে তার ঘন ঘন মন উশখুশ। আসল কারণটি কিন্তু পকেট কিমবা ভ্যানিটি ব্যাগের স্মার্টফোন। এই বুঝি আমার ফেসবুক পোস্টটিতে কেউ কমেন্ট করল। এই বুঝি আরও গোটা দশেক লাইক। হোয়াটসঅ্যাপে খুব দরকারি কিছু কথার বিনিময় ঘটে গেল অথচ আমি অফলাইন।এই দোটানায় তার মন আনচান। শেষে থাকতে না পেরে সে মনোযোগ ছিঁড়ে ফেলে ফেসবুকে একটু চোখ বুলিয়ে নিল। বন্ধুর জন্মদিনে প্লেট প্লেট লাজবাব খাবারের ছবি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তবু শান্তি।মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও সে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। চোখের এই নেশাই যেন তার প্রমাণ। তার কাছে এই সমাজ স্মার্টফোনের ভেতর সঙ্কুচিত এক অন্যরকমের পৃথিবী। কারসর এবং ক্লিকেই এই সমাজের ভেতরের মানুষগুলো জেগে ওঠে। কিলবিল করে। চুমু খায়। ঝগড়া করে।তার এই নতুন চেতনায় এই মানুষগুলোই জীবন্ত। আসলে কিন্তু তারা বাইনারি। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ইনট্যাঞ্জিবল। রক্ত নাই। মাংস নাই। আছে শুধু এক আর শূন্য।

এ যেন জালের পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনও এক রাজার কারসাজি। এই কারসাজিই মানুষটাকে স্মার্ট বানায়। ভীষণ স্মার্ট। মৌলিক চিন্তার পথ থেকে দূরে সরিয়ে তথ্যগ্রস্ত হয়ে মাল্টিটাস্কিং করতে শেখায়। শেখায় বিটোফেনের পাস্তোরাল শোনার পরেই চারটে ক্লিকে পর্ণোসাইটে পৌঁছে যাওয়ার কৌশল। মানুষটি সবই শিখে ফেলে। শিখে নেয় কীভাবে হাই তুলতে তুলতে আমাজনে কেনাকাটি করে বাজারের ক্ষয়িষ্ণু ফুসফুসটিকে পাম্প করে ফুলিয়ে তোলা যায়। ঘাঁটাঘাঁটির পর যখন আর তেমন কিছুই ভালো লাগছে না সে ফিরে যায় ফেসবুকের বাইনারি সমাজে। থিতিয়ে যাওয়া মন চাঙ্গা করতে সে খুঁজে বেড়ায় মন-পছন্দ কমেন্ট। জালের পেছনে রাজা বলে ওঠে, মোর স্পীড। মোর স্পীড। মনে রাখতে হবে মানুষটি কিন্তু ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠছে। একজন দক্ষ তথ্য শিকারি। খুব কম সময়ে অনেকগুলি বিষয়ের উপর ভাসা ভাসা ধারণা গড়ে তোলার দক্ষতা। একই সময়ে অনেকগুলি বিষয়ের উপর মন দিয়ে আদপে কোনও কিছুতেই মন না দেওয়ার দক্ষতা।

এই মানুষটিকে পরিচিতরা একসময় বইপোকা বলে ডাকত। বই পড়ার সময় বইয়ের মধ্যেকার মানবিক কারবার তাকে উচ্চতর স্নায়বিক স্তরে ঠেলে দিত। বুঁদ হয়ে এক তূরীয় আনন্দ চেটেপুটে নিত তার একমুখী মন। মনকে সে আদর করে বসাত এমনই এক জায়গায় টি এস এলিয়টের ভাষায় যাকে বলা হয় “the still point of the turning world” (T.S. Eliot, Four Quartets)। সেদিন মানুষটির হাতে রক্তকরবী। অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছে, “সকালে ফুলের বনে যে আলো আসে তাতে বিস্ময় নেই, কিন্তু পাকা দেয়ালের ফাটল দিয়ে যে আলো সে আর-এক কথা। যক্ষপুরে তুমি সেই আচমকা আলো”। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে রাখা স্মার্ট ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠল। সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো ভাইব্রেসন। জালের ওপার থেকে যেন রাজা বলে উঠল, এস আমায় ধর। এই মরা ধনে বিস্ময় আছে। মরা ধনের বিস্ময় হয়ে দাঁড়াল ভারতের এসিয়ান গেমসে সোনা জয়ের লেটেস্ট ইনফরমেশন। বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। নন্দিনী ততক্ষণে একটু দূরে সরে গিয়েছে। মানুষটি আরও ইনফরমেশন জানতে গুগলে সার্চ করল। এশিয়ান গেমস। কিন্তু কিপ্যাড এবং আঙুলের বেঠিক মোলাকাতে সার্চ টেক্সট হয়ে দাঁড়াল এশিয়ান পেইন্টস। স্ক্রিন জুড়ে সারি সারি হাইপারলিঙ্ক। নন্দিনী ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।

এই মানুষটি যদি ছাত্র হয় তাহলে সে এম সি কিউ ( Multiple Choice Question )  এম সি কিউ খেলায় ওস্তাদ। সে জানে সাল তারিখ তাপমাত্রা। পরবর্তী আইফোন সিরিসের সঠিক দাম। সে জানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন রক্তকরবী। এই সব ইনফরমেশন তার ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু অধরা থেকে যায় রঞ্জনের ভালোবাসার রঙের তত্বটি। বোঝা হয় না বিশুপাগল কেন মদ খায়। এসব না জানলেও চলে কারণ আজকের এই ছাত্র ভবিষ্যতের ডিজিটাল শ্রমিক। সাইকোথেরাপিস্ট মাইকেল হসয়ার (Michael Hausauer) কম বয়েসের ছেলেমেয়েদের অনলাইন থাকার তীব্র প্রবণতা সম্বন্ধে বলছেন যে অন্যের এবং তাদের সমবয়সীদের জীবনে কী ঘটছে তা জানার আগ্রহ তাদের প্রচণ্ড এবং একই সঙ্গে সমাজের মূল অনলাইন স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ানক উদ্বেগ তাদের সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। এই অনলাইন যাপনে ভীষণভাবে মগ্ন আজকের প্রজন্ম যেন ছকে বাঁধা এক মার্জিত নির্জীব। পরিকল্পিত শিক্ষা এবং সমাজ ব্যবস্থায় তথ্যকে জ্ঞানের সঙ্গে গুলিয়ে দিলে আখেরে লাভ কিন্তু সেই জালের পিছনে লুকিয়ে থাকা রাজারই। মানুষ শুধু বইয়ের পাতা উলটাক। খুঁজে নিক এই মহাপৃথিবীর গতিশীল প্রবাহের বিশেষ একটি মুহূর্তের দরকারি ইনফরমেশনটুকু। অবজ্ঞা করতে শিখুক এক সুতোয় গাঁথা বিশ্বব্যাপী গোটা জীবনের ব্যপক দিকটিকে যেদিকে হাঁটলে মানুষ হয়ে ওঠে একজন ফেলো ট্র্যাভেলার। একজন ক্লোজ সিম্প্যাথাইজার।

এই ডিজিটাল চক্রবুহ্যে গুলিয়ে যাওয়া, প্রকৃত অর্থে গুলিয়ে দেওয়া মানব জীবনে এখনও বন্ধুর মতো পাশে থাকে শক্ত মলাটের মাঝখানে ছাপানো অক্ষরের আদরে রাশি রাশি সজীব শব্দের সম্মিলিত সমাবেশ। ডিজিটাল সাহিত্যের আগমনী সুরে কাগুজে গ্রন্থপাঠের উদ্বর্তন পাঠক মহলে এখন অতিচর্চার বিষয় বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না।

গ্রন্থপাঠের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে মধ্যযুগের বিশপ আইজ্যাক (Isaac of Syria) অফ সিরিয়া বলেছেন, “as in a dream, I enter a state when my sense and thoughts are concentrated.Then, when with the prolonging of this silence the turmoil of memories is stilled in my heart, ceaseless waves of joy are sent me by inner thoughts, beyond expectation suddenly arising to delight my heart” ( Quoted in Alberto Manguel, A History of Reading)। মলাট বন্দি বই তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণ করে নিজস্ব প্রচ্ছদ, গন্ধ এবং বইয়ের তাকের একটি বিশেষ জায়গা দখলের মধ্য দিয়ে। এই বই নিয়ে সমুদ্রের তীরে কিমবা গ্রামীণ কোনও প্রাচীন বনস্পতির ছায়ায় দিব্যি সময়ের ব্যবহার করা যায়। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয় নেই, জল কিমবা নোংরায় নষ্ট হওয়ার বা ব্যটারি ফুরিয়ে যাওয়ারও ভয় নেই। অন্যদিকে ডিজিটাল সাহিত্যের রসগ্রহন সম্পূর্ণ ভাবেই এক ডিজিটাল ডিভাইস নির্ভর অভিজ্ঞতা। ডিজিটাল ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, আইপ্যাড বা কিনডেল একটি লাইব্রেরীর সমস্ত বই একইসঙ্গে বয়ে বেড়াতে পারে। ছাপা বইয়ের ক্ষেত্রে এই সুবিধা নেই। ইন্টারনেটে পাওয়া যায় এইসব বইগুলিকে ই-বুক (E-book) বলা হয় যেগুলি ডিজিটাল ডিভাইসে ডাউনলোড করে পড়ার আনন্দ নেওয়া যায়। অ্যামাজনের কিনডেল এমনই এক পণ্য যা শুধু বই পড়ার অভিজ্ঞতা নয় একই সঙ্গে গুগল সন্ধান এবং অন্যান্য ওয়েব সাইটে সার্ফিং করার সুযোগও দেয়। এছাড়াও ডিজিটাল সংবাদপত্র বা ম্যগাজিন পড়া এমনকি গান শোনার আনন্দও উপভোগ করা যায় একই সময়ে এই কিনডেল ডিভাইসটির মাধ্যমে। হারপার স্টুডিওর ভাইস প্রেসিডেন্ট ই-বুক সম্বন্ধে বলেছেন, “E-books should not just be print books  delivered electronically, we need to take advantage of the medium and create something dynamic to enhance the experience.I want links and behind the scenes extras and narration and videos and conversation” (HarperStudio blog, February 26,2009). অতএব ডিজিটাল বই মানে শুধুই বই পড়ার অভিজ্ঞতা নয় একইসঙ্গে অন্যান্য  ডিজিটাল কার্যকলাপেরও সুযোগ ভাণ্ডার যা বস্তুত বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক বিক্ষেপেরই (distraction) নামান্তর। অনলাইন সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনের এইধরণের ই-বুকের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না  কারণ আখেরে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য থেকে বেরিয়ে এখন তার তথ্য সংগ্রহের দিকেই বেশি ঝোঁক। ডিজিটাল বইয়ের স্ক্রিনে যখনই হাইপারলিঙ্কের প্রাচুর্য দেখা যায় এবং বই যখন ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয় বুঝে নিতে হবে প্রকৃতপক্ষে তা চিরাচরিত পড়ার অভিজ্ঞতাকেই বদলে দিতে চায়।

অনলাইন পাঠকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে লেখকের লেখায় তা প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। যেহেতু গুগল মূলত ওয়েবসাইটের র‍্যাঙ্কের উপর ভিত্তি করে সার্চের ফলাফল দেখায় এবং এই র‍্যাঙ্ক সাইটের টেক্সটের উপরেও নির্ভরশীল তাই বিশেষ কিছু শব্দ, বাক্য বা অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের মাধ্যমে লেখক চেষ্টা করবেন তার বইটিকে গুগল অনুসন্ধানের ফলাফলের প্রথমদিকের র‍্যাঙ্কের দিকে নিয়ে যেতে। অতএব লেখার প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে আপস করার এক প্রবণতা লেখক মহলে গড়ে উঠতেই পারে। মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার ক্ষেত্র ছাড়াও আরও নানান ভুমিকায় ই-বুকের সুবিধাগুলি স্বীকার করতেই হয় কিন্তু নিবিড় পাঠের মধ্য দিয়ে লেখকের সঙ্গে  একজন নির্জন পাঠকের ঘনিষ্ঠ বৌদ্ধিক সম্পর্ক কতটা গড়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দেয়।নিকোলাস কার ( Nicholas Carr)  বলছেন, “The way people read—write—has already been changed by the Net, and changes will continue as, slowly but surely, the words of books are extracted from the printed page and embedded in the computer’s ‘ecology of interruption technologies’”. (The very image of a book,p-108,Shallows: How the internet is changing the way we think, read and remember )

ছাপা অক্ষরে নিবিড় গ্রন্থপাঠের বিপরীত প্রান্তে অনেক মানুষকেই বলতে শোনা গিয়েছে যে তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (War and Peace) বা প্রুস্তের ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’ (In Search of Lost Time) এইগুলি অত্যন্ত দীর্ঘ উপন্যাস এবং কোনও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকাজ নয়। দীর্ঘ সময় ধরে এই উপন্যাস পড়ার কোনও সঠিক অর্থ তারা খুঁজে পান না। আসলে এইধরনের মানসিকতা ডিজিটাল সাহিত্যকে ন্যায্যতাই শুধু দেয় না মানুষের অনলাইন থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রক্রিয়াকে নিবিড় পাঠ এবং চিন্তাশীল মানসিক অবস্থার বিকল্প হিসেবেও খাড়া করে।গ্রন্থপাঠ এক সেকেলে ব্যাপার এবং কখনই তা অপরিহার্য নয় একথা যারা বলেন বা সমর্থন করেন তারা চিন্তাশীল মানুষকে অনলাইন যাপনে দারুণ অভ্যস্ত করে বিক্ষেপের জগতে চিরকালের জন্য আটকে রাখতেই চায়।                    

এইভাবেই ক্রমাগত অনলাইন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ একটা সময় এসে বুঝতে পারে যে তার বই পড়ার অভ্যাস শুধু নয় তার দৈনিক কাজকর্মের রুটিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। মোবাইল স্ক্রিনে সে আগের থেকে অনেক বেশি সময় কাটায়। তার মনের খিদে মেটাবার রসদ সে এখন আর বইয়ের পাতায় পায় না। বইয়ের পাতায় তার মনোযোগ এখন বড়জোর দুটি পাতা বা তিনটি মিনিট। তার মন এখন যা খুঁজে বেড়ায় তার হদিশ একমাত্র ইন্টারনেটে। সে বুঝতে পারে তার মগজে কিছু একটা ঘটে চলেছে। কোনও জটিল বিষয়ে সে এখন আর আগের মতো মন দিতে পারে না। বিষয়ের গভীরে ঢুকতে তার মস্তিষ্ক আর তাকে সায় দিচ্ছে না। সে অনলাইন হতে চায়। স্মার্টফোন থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও তার মন উশখুশ করতে থাকে স্মার্টফোনটিকে ধরার জন্য।কানেক্টেড থাকার এক প্রচণ্ড খিদে তাকে ক্রমাগত হুল ফোটায়। আসলে সে তার পুরনো মস্তিষ্কটাই হারিয়ে ফেলেছে।

প্রখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং মনস্তত্ববিদ মাইকেল মেরজেনিক (Michael Merzenich) ইন্টারনেটকে ‘Modern cultural specialization” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “While acknowledging that it’s hard to imagine living without the internet and online tools like the google search engine, he stressed that “THEIR HEAVY USE HAS NEUROLOGICAL CONSEQUENCES”. (Michael Merzenich, ‘Going Googly’, On the Brain Blog, Aug 11, 2008)

মানুষটির ভাবনা চিন্তার অঙ্গ, করোটির সুরক্ষায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তার মস্তিষ্ক আসলে কিন্তু খুব মহৎ। মানুষটির কাছে যখনই কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে, শুরু হয় মস্তিষ্কের ভিতর নিউরন অ্যাক্সন ডেনড্রাইট আর সিনাপ্সের গভীর যোগাযোগ। একটি নিউরনের আর একটি নিউরনকে জাগিয়ে তোলার মধুর খেলা।

মস্তিষ্কে মূলত দু’ধরণের স্মৃতির ভাণ্ডার থাকে। একটি সাময়িক । অন্যটি দীর্ঘমেয়াদী। সাময়িক ভাণ্ডারে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘোরাফেরা করে বাইরের যা কিছুই আমাদের চেতনায় ধরা দেয়। অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা, বোধ এবং বুদ্ধির মিশেলে সেই সাময়িক প্রত্যক্ষণ জায়গা করে নেয় দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতির ভাণ্ডারে।জ্ঞানের জন্ম হয়। সেখান থেকে আরও জটিল প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে একটা ওয়ার্ল্ড ভিউ। ইনফরমেশন আগ্রাসী মনোভাবে জড়িয়ে ইন্টারনেটের বিচিত্র বিক্ষেপে আটকে মস্তিষ্কের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি বারংবার বাঁধা পায়। মস্তিষ্কের যে অংশটির ঘন ব্যবহারে মানুষের মন সৃষ্টিকাজে মেতে ওঠে কিমবা হঠাৎ পবিত্র উল্লাসে চুরমার করে দিতে পারে যক্ষপুরী তা পড়ে থাকে শুকিয়ে যাওয়া ঘরোয়া তেজপাতার মতো। সাময়িক তথ্য কখনই দীর্ঘমেয়াদী জ্ঞানের চেহারা নেয় না। মানুষটি বুঝতে পারে কেন সে আর কবিতাপাঠে প্রাণ পায় না। গল্প উপন্যাসের গভীরে ঢুকতে পারে না।ভালোবাসার সহজ সঞ্চার তাকে নাড়া দেয় না। ইন্টারনেটের বৌদ্ধিক পরিবেশে তার সমস্ত জেনে বুঝে নেওয়া এখন উপর-উপর।যেহেতু চিন্তাভাবনা টুকরো টুকরো হয়ে অনলাইন মাল্টিটাস্কিং-এর দখলে তাই সময়ের চালচলন সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। কোনওরকম প্রতিবাদ ছাড়াই এক ডিজিটাল গড্ডলিকায় ভেসে যাওয়াতেই তার প্রকৃত সুখ। সে বুঝে নিয়েছে যে উচ্চতর জীবনবোধে চাকরি মেলেনা। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার না করেও সুন্দর জীবন কাটিয়ে নেওয়া যায়। অতএবঠিক ভুল কিমবা আদৌ জিনিসটির প্রয়োজন আছে কি না তার সঠিক বিচার না করেই একজন আম আদমি স্মার্টলি অনলাইন অর্ডার করে। ঘরে আর জিনিস রাখার জায়গা নেই। ওয়াড্রব উপচে পড়ছে। তবুও। এটাই যেন  মেনে নেওয়া এক সহজ স্বাভাবিক অভ্যস্ত নাগরিক জীবন। এই মানুষটি নাটক, গান, সিনেমায় গল্পে খুঁজে বেড়ায় সহজবোধ্য হালকা লেনদেন। কারণ পুরোনো মস্তিষ্কটি সে হারিয়ে ফেলেছে। যে মস্তিষ্কটি ছিল প্রকৃত রসবেত্তা।যা তাকে ভাবিয়ে তুলত। জাগিয়ে তুলত। বাজারচালু লুলাবাইয়ের আমেজে এখন সেই মন ঘুমায়।এই ধরণের মনের মানুষগুলি নিরন্তর ছড়িয়ে পড়ছে হাটে বাজারে বাস টারমিনাসে। এই মানুষগুলির সংখ্যা সামনের দিকে এগোলে বিজ্ঞানসম্মত নিয়মেই শিল্পের মান যে পিছনের দিকেই যাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

মস্তিষ্কের এই বদল ঠিক কীভাবে কাজ করে তা কিছু অভিজ্ঞতালব্ধ উদাহারণের সাহায্যে বুঝে নেওয়া যাক। জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানেরঅধ্যাপক জেমস ওল্ডস পরিণত মস্তিস্ককে  ‘খুব নমনীয়’ (Very plastic) (James Olds, interview with the author, Feb 1, 2008) বলেছেনএবং মাইকেল মেরজেনিক (Michael Merzenich)মস্তিস্ককে ‘ব্যাপক নমনীয়’ (Massively Plastic) (Graham Lawton, ‘Is it worth going to the mind gym?’ ,New Sceintist, Jan 12,2008) আখ্যা দিয়েছেন।আমাদের মস্তিষ্কের নমনীয়তা  (Plasticity) বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে কিন্তু এই প্রক্রিয়ার কোনও শেষ নেই। নিউরন পুরনো যোগাযোগ ভেঙে অ্যামিনো অ্যাসিড গ্লুটামেটের মতো  সিনাকাপটিক নিউরোট্রান্সমিটারের আদানপ্রদানের মাধ্যমে সবসময় নতুন যোগাযোগ তৈরি করে। নতুন স্নায়ুকোষ তৈরির প্রক্রিয়াও কখনও থেমে থাকেনা। দীর্ঘমেয়াদী কোনও অভিজ্ঞতা যেমন মনস্তাত্বিক এবং শারীরবৃত্তীয় পরিবর্ত ঘটায় তেমনি মস্তিষ্কের সিনাকাপটিক যোগাযোগকেও দুর্বল করে দিতে পারে। আমাদের দেখা, শেখা এবং প্রতিদিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সবকিছুই মস্তিষ্কের অন্দরমহলের চির পরিবর্তনশীল কোষীয় যোগাযোগগুলির উপর ভিত্তি করে। বর্তমানে স্নায়ু বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের নমনীয়তার (Neuroplasticity) চরিত্রটিকে হেব্বস রুল(Hebb’s Rule) দিয়ে ব্যাখা করেন যা এককথায় বলে,” Cells that fire together wire together”। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে হঠাৎ যদি কোনও মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন দৃষ্টিলব্ধ উদ্দীপনা (visual stimuli) সংক্রান্ত কাজগুলির জন্য দায়ী ভিসুয়াল কর্টেক্স (visual cortex) কখনই ক্রিয়াহীন হয়ে পড়ে না বরং শ্রবণ প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী সার্কিটের দ্বারা তার ক্রিয়াশীলতা সংগৃহীত হয়। সেই মানুষটি আবার যখন ব্রেইল (Braille) শিখতে শুরু করেন তখন ভিসুয়াল কর্টেক্স স্পর্শের সাহায্যে তথ্য বুঝতে নিজেকে পুনরায় সংগঠিত করে। মস্তিষ্ক নমনীয় (plastic) হওয়ার কারণেই এই কোষীয় পুনর্গঠন সম্ভবপর হয়। দেখা গিয়েছে দুর্ঘটনার ফলে হাত পা হারিয়েছেন এমন মানুষদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিতে মস্তিষ্ক ব্যাপকভাবে নিজেকে পুনর্গঠন করেছে। এই যুক্তিতে  রুচিশীল মানবিক চর্চায় নিয়োজিত মস্তিষ্ক ঠিক যেভাবে নিজেকে ক্রমশ এক ধীর প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠনের মাধ্যমে মানবমনকে আরও উচ্চতর জীবনচর্চায় উৎসাহিত করে উল্টোদিকে স্বার্থপর সামাজিক দায়-বদ্ধতাহীন  এক নীরস রোবোটিক যাপনের দিকে যেতে মানুষের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গিয়েছে ইন্টারনেটে দীর্ঘকালীন সময় কাটানো অত্যন্ত দ্রুত ক্রিয়াশীল মানবমস্তিস্ক সমাজ, অন্যান্য মানুষের সমস্যা এবং তাদের যন্ত্রণার প্রতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম সহানুভূতিশীল। মেরি হেলেন (Mary Helen Immordino-Young) বলছেন “For some kind of thoughts,especially moral decision making about other people’s social and psychological situations, we need to allow for adequate time and reflection. If things are happening too fast, you may not ever fully experience emotions about other people’s psychological states” (Nobler Instincts)। ইন্টারনেটের অপরিসীম গুরুত্ব এবং সুবিধার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও একথা প্রায় জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি মস্তিস্কে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবের ফলশ্রুতি আমাদের মানবিক বোধ এবং মানবিক সত্ত্বার ধীর ক্ষয়।

ইন্টারনেটের সুপ্রভাবের কথা স্বীকার করে তার মননশীল ব্যবহারের দায়িত্ব ব্যবহারকারীর উপরেই বর্তায়।সঠিক সমাজবোধ এবং মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ অর্জন এবং বর্জনের সময়কালীন গুরুত্ব বোঝেন। প্রযুক্তি মানবমনকে নিয়ন্ত্রণ করলে সামাজিক অবক্ষয় নিশ্চিত। অতএব প্রযুক্তি এবং মানবমনের অন্তরলীন তাৎপর্য বোঝার সময় কিন্তু এখনই। আগামীর বহু প্রজন্মের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই বোঝার প্রক্রিয়াটিকে কর্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়াই মানবমনের পরিচয়। 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত