Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Interview Bratati Bandopadhay

সাক্ষাৎকার: কবিতাই আমার সন্তান : ব্রততী বন্দোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

ব্রততী বন্দোপাধ্যায় ‍বা ব্রততী ব্যানার্জী বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার। তিনি সারথি নামে একটি বাঙ্গালী গ্র্রুপের সদস্য। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকুমার রায় এবং শঙ্খ ঘোষের কবিতা আবৃত্তির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। আজ ২৬ জুন বাচিক শিল্পী, লেখক, উপস্থাপক ও সংগঠক ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। এই সাক্ষাৎকারটি ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


 

ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এখন একটা ব্র্যান্ডের নাম। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, হাই টেক মিউজিক, স্টেজ ডেকর, আবৃত্তি মানেই আপনি। আবৃত্তির এই প্যাকেজটা তৈরি হল কেমন করে?

সচেতন ভাবে কিছুই হয়নি। ছোটবেলা থেকেই নাটক দেখে, ছবি দেখে বড় হয়েছি। বাবার উত্‌সাহে প্রচুর বই পড়তাম। আবৃত্তির অনুষ্ঠান শুনতাম। না দেখেই আবৃত্তি করে যেতাম। রক্তে মিশে গিয়েছিল আবৃত্তি। স্কুলে আমার নাম ছিল ‘কবিতা দিদি’ আর কবিতা বলতে পারি বলে ফুচকাওয়ালা ফ্রিতে ফুচকা খাওয়াত।

ব্র্যান্ডিং আর প্যাকেজের রমরমায় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় কি বড্ড অহঙ্কারী হয়ে গেলেন?

(মুচকি হেসে) না, একেবারেই না। আজও নতুন কোথাও অনুষ্ঠান থাকলে সেই প্রথম দিনের মতোই ভাবি কী পড়ব? আমার নাম হয়ে গেছে, এই সাম্মানিকটাই চাই। নয়ত যাব নাএসব ভাবি না। কখনও তো মনে হয় না, আমার নাম আছে বলে যা করব লোকে তাই শুনবে? তবে একটা অহঙ্কারের মোড়ক আছে আমার…আসলে আমি একলা মহিলা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় আমায়। আমার মনে হয় আজকের যুগে, একলা মহিলার লড়াইয়ে ঘাড় শক্ত, অহঙ্কারী ইমেজটা আমায় অনেক কিছু থেকে বাঁচিয়েই রেখেছে। নিরাপত্তা দিয়েছে। আসলে কিন্তু আমি ‘সেই মেয়ে’।

একলা মহিলা কেন?

সকলেই জানেন আমি একা থাকি!

আপনার তো বিয়ে হয়েছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু একসঙ্গে থাকতে পারছিলাম না আমরা। ওই সময়টা খুব অদ্ভুত সময় ছিল…. আবৃত্তি পরিষদের পরিচালনায় রবীন্দ্রসদনে আমার প্রথম আবৃত্তির একক। আনন্দবাজারের একটা বিজ্ঞাপনেই হাউসফুল হয়ে গেছে। তার বোধহয় ছ’দিন আগে আমার বিয়েটা ভাঙল, আমি ঘরছাড়া….অনুষ্ঠান করার মানসিকতা ছিল না। তখন আঠাশ বছর বয়স আমার। কিন্তু শুনলাম আমার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকে আসছে। ছিয়ানব্বই সালেই অনেকে বলছেন তখন বাইরে স্ক্রিন লাগিয়ে দিন…. এসব শুনে না বলতে পারিনি। তিন ঘণ্টার প্রথম অনুষ্ঠান। ‘এক সন্ধ্যায় একা ব্রততী’। সকলের মন ভরিয়েছিল। তারপর থেকেই কবিতা বিনোদনের জায়গায় চলে এল। আবৃত্তিকারদের সময় ও সাম্মানিকও বাড়ল।

তাহলে আপনার জীবনের বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে আপনি কবিতা দিয়ে জয় করতে পারেন?

একদমই তাই। কবিতার মধ্যেই বাস। কবিতাই জীবন। আমি বজ্রের মতো কঠোর কুসুমের মতো কোমল, কবিতাই জানিয়েছে।

আর বিয়ে করবেন না?

(প্রচণ্ড হেসে) নাহ্-নাহ্ একেবারেই নাহ্! কাউকেই পছন্দ হয় না। আর রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, লেখা পড়ে প্রিয় যে পুরুষ মনের মধ্যে আছে তার সঙ্গে তো কেউই মেলে না।

আপনি কিন্তু খুব রোম্যান্টিক। প্রেম হয়নি আর?

প্রেম তো সমুদ্রের ঢেউ, আসবে যাবে। বিবাহিত জীবন অন্য কথা। সেখানে কমিটমেন্টের জায়গা থাকে। কিন্তু একা থাকলে বিষয়টা আলাদা। সম্পর্ক যায় আসে। কিন্তু একটা সম্পর্ক যদি আমায় মানসিক ভাবে ঋদ্ধ না করে তাহলে কোনও মানে হয় না। শারীরিক সম্পর্ক তো আছেই। কিন্তু মানসিক ঋদ্ধতা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এরকম কোনও পুরুষ আছেন যিনি ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানসিক ভাবে ঋদ্ধ করেছেন?

আছে… এসেছেন হয়তো, আবার মিলিয়েও গেছেন। আবারও হয়তো আসবেন। কালীদহে কখন যে ঝড় আসে কেউ বলতে পারে না! তবে ঝড়ের পর আবার সব স্থিরও হয়ে যায়। আমি এ ভাবেই ভাবি। আসলে সব সম্পর্ককে গোদা করে দেখলে হবে না।

যেমন?

আমার জীবনে কী রোম্যান্স নেই? আছে তো! যার প্রতি আছে সেও হয়ত জানে না। বলব কেন? আমি তো তার থেকে নিরাপত্তা,অর্থ, সংসার কিছুই চাইছি না। কিন্তু তার একটা উপস্থিতি যদি আমাকে নেপথ্যে প্রাণিত করে সেটাই যথেষ্ট। সেটাকে সাধারণ সম্পর্কের যোগ-বিয়োগের মধ্যে ফেললে নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা গোপন থাক।

সন্তানের কথা ভেবেছেন কখনও?

কবিতাই আমার সন্তান। একটু একটু করে সন্তানের মতোই আমি আমার রক্ত, গন্ধ, স্বর, শব্দ, বিশ্বাস দিয়ে তৈরি করেছি আমার কবিতাকে, কবিতা জগত্‌কে। আর শিল্পীদের একা হতেই হবে। এটাই সবচেয়ে বড় সত্য।

একাকীত্বে আঘাতের কঠিন সুর বাজলে কী করেন?

গীতবিতানের পাতা ওল্টাই। আমি তো বলি, গীতা আর গীতবিতান একই। রবীন্দ্রনাথ প্রেমে, মৃত্যুতে কি কম যন্ত্রণা পেয়েছেন? আত্মহত্যাও তো করতে গেছেন। কিন্তু আবার যন্ত্রণা পেরিয়ে জীবনের আলোয় উজ্জ্বল হয়েছেন। সেখান থেকেই আমি, আমার মতো হাজার মানুষ ঝড়ের ঢেউ পেরিয়ে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ মেডিসিনের মতো।

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ব্রততীর মনে আর কোন আবৃত্তিকার বাস করেন?

আবৃত্তি মানে গৌরীদি (গৌরী ঘোষ), শাঁওলীদির (শাঁওলো মিত্র) কণ্ঠস্বর। ওঁদের উচ্চারণ মুগ্ধ হয়ে শুনি।

লোকে তো বলত আপনি শাঁওলী মিত্র ঘরানার…

হ্যাঁ শুনেছিলাম আমি এটা। কিন্তু সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছি বহু কাল।

কখনও মনে হয় না ব্রততী একটু এখন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে? ব্রততী মানেই খোঁপায় ফুল, শাড়ি, গোল টিপ, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কবিতা…

অনেক সময় হয় এমন। একই কবিতা পড়ছি বিভিন্ন মঞ্চে। ‘বেণীমাধব’, ‘আমি সেই মেয়ে’, ‘না পাঠানো চিঠি’ এগুলো না বললে আমাকে লোকে মঞ্চ থেকে নামতেই দেবে না। তারপর দেখছি কবিতাটা বলে নিজের ভাল লাগছে না। তখন আর বলি না সেটা। সুনীলদার (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) ‘না পাঠানো চিঠি’ বহু দিন বলিনি, সুনীলদা চলে যাওয়ার পরে এখন আবার বলছি। তৃপ্তি না পেলে কবিতা বলি না। থেমে যাই।

উপস্থাপনায় একঘেয়েমি আসেনি?

মানুষ এটাই চাইছে। ওটা ভাঙতে চাই না আমি। কবিতায় বৈচিত্র আনার চেষ্টা করি। প্রসঙ্গ ভেবেও বলি, যেমন ছন্দা গায়েন চলে গেল, ওঁর জন্য যেমন কিছু বলতে ইচ্ছে করলে, মন কেমন করলে বলি। এইভাবে এক্সপেরিমেন্ট করি।

নতুন কোনও কাজের কথা ভাবছেন?

সম্প্রতি ‘দুজনে দেখা হল ’ বলে একটি অ্যালবাম বেরিয়েছে আমাদের। অনেকেই চেয়েছিলেন শ্রাবণী (সেন) আর ব্রততী একসঙ্গে কিছু করুক। বিদেশি কবিদের কবিতা আমাদের কবিরা অনুবাদ করেছিলেন, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সেগুলো নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। হয়তো শুধু প্রেমের কবিতাই হবে।

এত তো কবিতা বলে চলেছেন কোনও কবিতা কার বলতে গিয়ে শুধু মনে হয় এ কবিতা আমার…

অনেক কবিতাই তো আছে। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন দেবতা’। যা করেছি আমি, আমার স্খলন, পতন, ত্রুটি যদি থাকে সব ক্ষমা করে দাও।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>