লোকে যারে বড়ো বলে বড়ো সেই হয়
নিজের গুণের কথা নিজের মুখে কী বলবো? লোকে বিচার করবে কেন বইদুটো স্থায়ি হলো।
গ্রন্থিঃ তাহলে জিগ্যেস করি, পরের কবিতার বইগুলি প্রথমদুটির মতো পাঠকপ্রীতি বা সমালোচকের প্রশংসা অর্জন করতে ব্যর্থ হলো কেন?
বিনয়ঃ “ফিরে এসো চাকা”তে একটা কেন্দ্রিয় বিষয় ছিলো। একজন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাগুলি লেখা। তেমনি “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”র মূল বিষয় ছিলো অঘ্রাণ মাস, মানে হেমন্ত ঋতু। কবিতাগুলি পড়লে যেন পাঠকের মনে একটা হেমন্তের অনুভব জাগে, এই ছিলো উদ্দেশ্য — সে চৈত্র মাসে পড়লেও যেন জাগে, কি বৈশাখ মাসেও। তা সে কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি আছে লন্ডনে।
গ্রন্থিঃ “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”র পাণ্ডুলিপি লন্ডনে রয়েছে! কীভাবে ঘটলো ঘটনাটা?
বিনয়ঃ তখন তো আমার কবিতার বই কেউ ছাপাতে চাইতো না। তো, কয়েকজন প্রকাশকের কাছে ঘুরে-টুরে শেষে গেলাম বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। তাদের বললাম, ম্যানাসক্রিপ্টখানা রেখে দিন। বললো, না রাখবো না। তারপর গেলাম ওয়েস্ট বেঙ্গল আর্কাইভে, ভবানী দত্ত লেনে। চেনো তো ভবানী দত্ত লেন? কলেজ স্কোয়্যারের কাছাকাছি। তারাও বললো — না। তখন আমার এই বত্রিশ বছর বয়েস। পাণ্ডুলিপিটি নিরুপায় হয়ে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দিলাম পাঠিয়ে। এই ঘটনার পঁচিশ বছর পরে একটা চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলাম পাণ্ডুলিপির খবর। তাতে ওরা উত্তর দিলো, আপনার বইটি আমরা যত্ন করে সংরক্ষণ করেছি। এবং “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”ই আমাদের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত আধুনিক বাংলা কবিতার একমাত্র ম্যানাসক্রিপ্ট।
গ্রন্থিঃ বাহ, এটা তো অত্যন্ত আনন্দের বিষয়! আচ্ছা, এবারে একটু অন্য ব্যাপারে কথা বলি। প্রথম থেকেই দেখা গেছে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখছেন আপনি। “গায়ত্রীকে” — এই এক ফর্মার কাব্যগ্রন্থ থেকেই। সম্প্রতি প্রকাশিত “সমান সমগ্র সীমাহীন”এও তাই। মাঝখানে অন্য কিছু ছন্দে লিখেছেন, বিশেষত গানগুলি রচনা করলেন যখন। তো, অক্ষরবৃত্তের ওপর এই পক্ষপাতিত্বের কারণ কী?
বিনয়ঃ ওভ্যেস, আর কিছু নয়। প্রথম থেকে ওটা লিখতে লিখতে পরে ওভ্যেসের মতো হয়ে গেলো। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আমি কথা বলে যেতে পারি অনর্গল। একে নাম দিয়েছিলাম “অমিল পয়ার”। কলকাতার আড্ডায় এসব বিষয়ে কথা হতো। তা বীরেন দত্ত (কবি বীরেন্দ্র দত্ত) তো এই নামে একখানা বইই লিখে ফেললো।
গ্রন্থিঃ গানের প্রসঙ্গ উঠেছিলো একটু আগে ছন্দ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। একসময় টানা বেশ কিছু গান লিখেছেন এবং যথারীতি সেসব ছাপাও হয়েছে কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে। গান লেখার পেছনে কেমন ভাবনা কাজ করলো? এসব গানে সুরই বা কে দেবে?
বিনয়ঃ ও কিছু নয়। মাত্র পাঁচ-ছয়টা গান লিখেছিলাম। মূল্য দিইনি।
গ্রন্থিঃ তাই কি? আমরা কিন্তু আপনার অনেকগুলো গীতরচনাই পড়েছি পত্রপত্রিকায়।
বিনয়ঃ (হাত নেড়ে) না না, পাঁচ-ছয়টার বেশি হবে না কিছুতে। মূল্যবান নয়। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ গানের কথার — উনি বলতেন বাণী — চেহারা ঠিক করে দিয়েছেন। অন্য কেউ এটা পারেনি। আমি পুশকিন পড়েছি। পুশকিন অনেক গান লিখলেও গানের নির্দিষ্ট চেহারা দান করতে সক্ষম হননি। একটা উদাহরণ দিই। ধরো, কবির “সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়” গানটি। প্রথমে “সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে/তাহারি রাগিণী লাগিল গায়ে” এদুটি হলো সম্পূর্ণ পংক্তি। তারপর সব অর্ধের লাইনের সমাহার —
সে সুর বাহিয়া/ভেসে আসে কার/সুদূর বিরহ-/বিধুর হিয়ার/অজানা বেদনা/সাগরবেলার…।তারপর “অধীর বায়ে বনের ছায়ে”তে এসে লাইন শেষ হলো। আবার একইভাবে পরের স্তবকে—
ছবি মনে আনে/আলোতে ও গীতে—/যেন জনহীন নদীপথটিতে/কে চলেছে জলে কলস ভরিতে
এই অর্ধেক লাইনগুলিও “অলস পায়ে বনের ছায়ে”তে গিয়ে সম্পূর্ণতা পেল। এই যে দুটি সম্পূর্ণ বাক্যের মাঝখানে অর্ধেক বাক্য সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরি রচনাকৌশল —এ-জিনিস গানে রবীন্দ্রনাথের আগে কোনও দেশে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই।
গ্রন্থিঃ বেশ, তাহলে অসমাপ্ত দ্বিতীয় প্রশ্নটিতে এবার ফিরে যাচ্ছি।“ফিরে এসো চাকা” ও “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” ব্যতীত অন্য কবিতার বইতে কি এই কেন্দ্রিয় বিষয়বস্তুটি নেই? আর তাই তারা পাঠকমনে প্রতিক্রিয়া জাগায় না?
বিনয়ঃ ঠিক তাই। পরের বইগুলোতে বিভিন্ন কবিতা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তাই সার্থকতা অর্জনে ব্যর্থ হলো।
গ্রন্থিঃ তবে এখন, এই সময়কালে যেসব কবিতা লিখছেন তাদের সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
বিনয়ঃ ওগুলো কবিতাই নয়। ছোট গদ্য। (তাঁর নিজস্ব ঢংযে টেনে টেনে আবৃত্তি করেন)
এখন শুধু গদ্য লিখি/তাও আবার কদাচিত
আসলে ভালো লাগে খাটে/থাকতে পড়ে সদা চিত
“শিলংয়ের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন। আমারও এখন সেই অবস্থা। তবে রবীন্দ্রনাথ মহত প্রতিভা। এর পরেও সৃষ্টি করেছেন পূরবী, মহুয়া ইত্যাদি কাব্য। তার মতো অন্য কেউ নয়।
(আবার আবৃত্তি করেন পূরবী কাব্য থেকে দুটো পংক্তি। সরলার্থও করে দেন।)
গ্রন্থিঃ তাহলে দুটো প্রশ্ন মনে জাগছে। প্রথম হলো, মহত্তর প্রতিভার কি লক্ষ্মণ এটা যে তা অন্যের তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিয়াশীল থাকে?
বিনয়ঃ হ্যাঁ, সে তো বটেই।
গ্রন্থিঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি মনে করেন লিখতে পারছেন না, তবুও লিখছেন কি লেখার পুরনো ওভ্যেসে, না আমাদের মতো খুদে পত্রিকার লোকজনের চাপে পড়ে?
বিনয়ঃ তাগাদায়, শুধুমাত্র তোমাদের তাগাদার জন্যে। আসলে লেখার জন্যে এখন কোনও নতুন দরকারি চিন্তা খুঁজে পাই না। পেলে কবিতা সৃষ্টির আগ্রহ জন্মাতো। কবিতার বিষয়বস্তুই তার প্রধান জিনিস, লিখনশৈলী সেই বিষয়ের হাত ধরে আসে —এইরকমই আমার মত।
গ্রন্থিঃ পরের জিজ্ঞাসায় যাই। আপনি এই বাড়িতে বসেই বেশ কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ছন্দ ও অন্ত্যমিলে লিখলে সে কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায়। কাজেই পাঠকের স্মৃতিতে কবিতাকে সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি। এখনও কি তাই মনে করেন, কবি? তবে কি গদ্যে লেখা কবিতাগুলি মানুষ বিস্মৃত হবে কালে কালে?
বিনয়ঃ আজও তাই মনে হয়।
গ্রন্থিঃ কিন্তু ধরুন, লাতিন আমেরিকায় বা ইউরোপেও তো শুধু গদ্য কবিতার ছড়াছড়ি। মিটার নামক শব্দটা ওরা হয়তো ভুলেই গেছে। শুধু কিছু গানের কথা ছাড়া —
বিনয়ঃ গানও আজ গদ্য হয়ে গেছে। আমিও তো গদ্যকবিতা লিখেছি, প্রথম লেখাটির নাম ছিল “আমার প্রথম গদ্যকবিতা”, বেরিয়েছিলো “রোপণ” পত্রিকায়। আমার ধারণা, লোকে গদ্যকবিতা পংক্তির পর পংক্তি — এভাবে মনে রাখে না। মনে রাখে শুধু কবিতাটির বিষয়বস্তুকে।
গ্রন্থিঃ একটা আলোচিত বিষয় হলো, আপনার কবিতায় জীবনানন্দের রচনারীতির প্রভাব। এই ব্যাপারটা স্বয়ং বিনয়ের মুখ থেকে শুনতে চাই।
বিনয়ঃ (হেসে ওঠেন) আরে, জীবনানন্দের প্রভাব তো থাকবেই। ওর মতো লিখতে পারলে ধন্য হয়ে যেতাম। শক্তি একসময় চেষ্টা করেছিলো, উৎপল কুমার বসুও। (আবার হাসেন) আমি একবার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, আলোক সোম আর বাপী সমাদ্দারের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলাম যে জীবনানন্দ দাশ হলেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। সেটা আটলান্টিক লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল। সন্দীপ দত্ত আমাকে দেখিয়েছিল তার এক কপি।
গ্রন্থিঃ তাহলে আপনার প্রকৃত মত কী? বাংলা ভাষার সার্থকতম কবি কে, জীবনানন্দ না রবীন্দ্রনাথ?
বিনয়ঃ জীবনানন্দ হলো জটিল……কিন্তু…
(চুপ করে যান একটু অস্বস্তি নিয়ে। তবে কি তার পক্ষপাত রবীন্দ্রনাথের দিকেই? আমরা প্রশ্ন করি কিন্তু আর উত্তর আসে না। কিছুক্ষণের অপেক্ষা। কাঁপা হাতে প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরান, টান দেন উপর্যুপরি।)
গ্রন্থিঃ এখনকার বাংলা কবিতায় মেয়েরা যৌনাকাঙ্খামূলক লেখাগুলো বেশ খোলামেলা ভাবেই লিখছেন। প্রতিষ্ঠিত কবিরা স্বাগতও জানাচ্ছেন এই পরিবর্তনকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রন্থি-র বর্তমান সংখ্যাতেই তসলিমা নাসরিন লিখেছেন একটি গদ্য, নাম “নারী-শরীর”। আপনিও যৌনঅভিজ্ঞতার কথা সরাসরি (দু’একটি প্রতীকের আড়াল রেখে) লিখেছিলেন “ভুট্টা সিরিজ”এর কবিতায়। একটা ছোট বইও সম্ভবত হয়েছে কবিতাগুলো জড়ো করে। পরে আপনি তাদের disown করেন। আজ এই মুহূর্তে কি পাল্টাবেন মতামত? বা, এই ধরণের কবিতার কোনও স্থায়ি মূল্য কি আছে?
বিনয়ঃ (মৃদুস্বরে বলে যান) না, কোনও বই নেই তো! আমার জানা নেই এমন কোনও বইয়ের কথা। এগুলো উল্লেখযোগ্য লেখা নয় (অস্বীকারের ভঙ্গিতে হাত নাড়েন)। তবে মহিলা কবিরা চিরকাল ভালো কবিতা লিখে এসেছেন। “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে”, বা ওই লেখাটা “ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়…“।
আর স্থায়ি মূল্যের কথা বলছো? দ্যাখো, প্রথমে যখন লিখতে শুরু করি তখন লক্ষ ছিলো পাঠককে জ্ঞান দান, তার বুদ্ধি বাড়ানো, কবিতাগুলিকে তার মনে রাখানোর চেষ্টা, তার সাথে যেন আমার কথাও মনে পড়ে সেদিকে নজর রাখা ইত্যাদি। কবিতা কীভাবে হয়, কীভাবে সার্থক, আমিও জানি না। হয়ে যায়, এই পর্যন্ত।
গ্রন্থিঃ কিছু গল্প লিখেছেন, আমরা জানি। কখনও উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে হয় না?
বিনয়ঃ আমার লেখা তেত্রিশটা গল্প ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তার তিরিশটা গল্প নিয়ে “কবিতীর্থ” বই করেছে, “বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প”। উপন্যাস কোনওদিন লিখিনি, লিখতে ইচ্ছে করেনি।
গ্রন্থিঃ আলোচনার শুরুতে আপনি বলেছিলেন “ফিরে এসো চাকা”তে একটা কেন্দ্রিয় ভাবনা আছে। সে কি প্রেম, যার অপর নাম গায়ত্রী চক্রবর্তী? কীভাবে তার প্রতি মনোযোগী হলেন?
গ্রন্থিঃ আরে, আমি তো ছিলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। তা, সেখান থেকে হলাম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। আর গায়ত্রী প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। এই কথা যেই জানলাম, ওমনি মনে হলো, এ-মেয়েও তো আমার মতো ডুবে যাবে, কেননা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পর আমার পতন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে কবিতার বইটি লিখে ফেললামঃ “একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে”, মানে একবার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েই “দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেল”, অর্থাৎ জীবনে আর কিছুই করতে পারলো না!
(কবি হাসতে থাকেন, ক্ষুরধার বুদ্ধিমানের কৌতুকভরা হাসি। হাসিমাখা চোখদুটো আমাদের মুখের ওপর ঘুরতে থাকে — যেন বলছেন “কী, কেমন ব্যাখ্যা দিলাম একই সাথে আমার কবিতার আর তোমাদের প্রশ্নের? দারুন না!” আমরাও হেসে ফেলি। তার ঠকিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটুকু উপভোগ করি সবাই, তবু আরও একটু তত্ত্ব-তলাশের ইচ্ছে বুড়বুড়ি কাটতে থাকে মনের মধ্যে।)
গ্রন্থিঃ গায়ত্রী চক্রবর্তী তো তলিয়ে যাননি। এখনকার গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্কলার। উত্তর-আধুনিকতার ব্যাখ্যাতা হিসেবে প্রায় তুলনাহীন, দেরিদা-র মূল্যায়নে ক্রিস্টোফার নরিস-দের ছাড়িয়ে গেছেন, এছাড়া সমাজতত্বের নানা মতবাদ বিষয়েও তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
বিনয়ঃ আরে, আমি ওকে নিয়ে কাব্যগ্রন্থ লিখলাম বলেই না এতকিছু হলো!
গ্রন্থিঃ বেশ, তা নয় হলো। কিন্তু খোদ কবির যে অবস্থা ফিরলো না! তার তো একা একা দূর গ্রামে কেটে গেল গোটা জীবন।
বিনয়ঃ আমি কোনওদিন কিছু চাইনি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
বহুদিন মনে ছিলো আশা,
ধরণীর এক কোনে রচিব আপন মনে
এতটুকু বাসা।
জীবনানন্দ লিখেছেনঃ
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়,
আরও এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে
আমার আশাও নিতান্ত কম। আমি লিখেছিঃ
জাগতিক সফলতা নয়, শয়নভঙ্গির মতো
অনাড়ষ্ট সহজ বিকাশ সকল মানুষ চায়।
(একটু থেমে বিনয় নিজেই আগের প্রসঙ্গে ফিরে যান) তাছাড়া গায়ত্রীকে এক বিশেষ প্রেমের দৃষ্টিতে দেখেই যে আমি সব কবিতা লিখেছি, তা তো নয়। “অথবা করেছো ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো……“ এমন লাইনও আছে ওই কাব্যগ্রন্থে।
গ্রন্থিঃ আমরা জানি, আপনি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার মনোযোগী পাঠক। অনেক পত্র-পত্রিকাও পৌঁছোয় আপনার কাছে, যেমন এই মুহূর্তে “কলেজ স্ট্রীট” পত্রিকার একটা কপি ডাকে এসেছে। তো, এখনকার, মানে ধরুন নব্বই দশকে লিখছেন এমন কবিদের মধ্যে কার লেখা ভালো লাগে?
(বিনয় চুপ।আমরা প্রশ্নটা রিপিট করি এবং নব্বইয়ের কবিদের যতগুলো নাম মনে আসে বলে যেতে থাকি। অবশেষে নীরবতা ভাঙেন বিনয় মজুমদার।)
বিনয়ঃ আমি মোহিত চট্টোপাধ্যায়কে একবার বলেছিলাম, তিরিশ বছর পরপর একজন ভালো কবি জন্ম নেন কোনও ভাষায়। যেমন মধুসূদনের তিরিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের তিরিশ বছর পরে জীবনানন্দ, তার তিরিশ বছর বাদে শক্তি।
গ্রন্থিঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো পঞ্চাশের কবি। তাহলে তার তিরিশ বছর পরে আটের দশকের লেখকদের মধ্যে কোনও প্রধান কবির সন্ধান কি পাওয়া গেল?
বিনয়ঃ পঞ্চাশ না ভেবে যদি ষাট ধরা যায়, তবে তার তিরিশ বছর বাদে নব্বইয়ে একজন লিখছে, হিন্দোল ভট্টাচার্য। সেও বড়ো কবি হয়ে উঠতে পারে।
গ্রন্থিঃ হিন্দোল ভট্টাচার্য?
বিনয়ঃ আরও একজন আছে, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। কিন্তু সে তো মারাই গেল।
গ্রন্থিঃ আপনাকে নিয়ে টিভিতে একটা টেলিফিল্ম হয়, তাতে আপনার ভূমিকায় অভিনয় করেন কবি জয় গোস্বামী। দেখেছেন? কতোটা মিল আছে টেলিফিল্মে বর্ণিত কবির সঙ্গে বিনয় মজুমদারের জীবনের?
বিনয়ঃ দিনপঞ্জী লিখে লিখে এতটা বয়স হল
দিনপঞ্জী মানুষের মনের নিকটতম লেখা
(ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাইনদুটো আবৃত্তি, আর কিছু বলতে চান না। জানা যায়, তিনি ফিল্মটা দেখেছেন প্রতিবেশি বাড়ির টিভিতে। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও টেলিফিল্ম নিয়ে কোনও মন্তব্য পাইনি। শুধু বললেন শেষে, “এক-দু ঘন্টার সিনেমায় কি গোটা জীবন ধরা যায়?”)
গ্রন্থিঃ অসুস্থতা ও বিনয় মজুমদার, স্বেচ্ছা-নির্বাসন ও বিনয় মজুমদার — এগুলো সমার্থক হয়ে গেছে। যদি ধারাবাহিক অসুস্থতা না থাকতো, জীবন কি অন্য রকম হতো কিছু? যদি চাকরি থাকতো, কলকাতায় থাকতেন — আরো বেশি লেখা হতো বা আলাদা ধরণের?
বিনয়ঃ আমার চাকরি টিঁকলো না রাশিয়ান ভাষা শিক্ষা করে ওই ভাষা থেকে নানা লেখা অনুবাদ করার কারণে। আর কী হলে কী হতো, তা ভাবি না। জীবন অন্য রকম হতে পারতো, কিন্তু এখন তো ওসব চিন্তা করে লাভ নেই!
গ্রন্থিঃ রাশিয়ান ভাষার চর্চা কি এখনও চালু রেখেছেন? ***“সমান সমগ্র সীমাহীন”-এর দ্বিতীয় কবিতায় লিখেছেন, “ই তাক দালিয়ে দালিয়ে”। এই শব্দগুচ্ছের মানে আপনার কাছে জানা হয়নি।
বিনয়ঃ আমি নিয়মিত রুশ ভাষা চর্চা করি। আমাদের এখানে রুশ জানা দুজন লোক আছে, গোবিন্দ দেব আর বিমল দে। এদের সাথে এই ভাষায় মাঝে মাঝেই কথাবার্তা চালাই। আর “ই তাক দালিয়ে দালিয়ে” মানে হল, ইত্যাদি, প্রভৃতি…ইংরাজিতে যাকে এট সেটেরা বলে।
গ্রন্থিঃ এখানে “সমান সমগ্র সীমাহীন” নিয়ে আর একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। এই বইয়ের এগারোতম কবিতাটি এই রকমঃ
তোমরা বিশ্বাস করো আমি এই
খাতাটির পৃষ্ঠাপরি যা লিখেছি
তার মধ্যে আমারই তো মুখ প্রতিবিম্বিত
হয়ে দেখা যায় আরও এই সব
লেখাগুলি ছাপা হয়ে বেরোলেও
সেই ছাপা হরফের জায়গায়
এ-আমার মুখখানি দেখা দেবে
সকলেরই এই হয়, দেবদেবীদের হয়
মানুষের এই হয় পোস্টকার্ডে
চিঠি লিখলেও হয় প্রতি মানুষের হয়।
সুইডেনে গিয়ে দেখো সুইডেন দেশটির
সম্রাট বিনয়, সব খবরকাগজে ছবি ছাপা
এই বারো লাইন-বিশিষ্ট কবিতার প্রথম দশ লাইন একভাবে বুঝতে পারি। আপনার অন্যসব কবিতার মতোই এখানেও এক টুকরো বিনয় মজুমদারীয় ভাবনার আসা-যাওয়া। বিশেষত পোস্টকার্ডের উদাহরণ যেখানে আনা হয়েছে তা খুব চেনা। পুরনো সিনেমায় দেখা যেত কেউ চিঠি পড়ছে এবং মধ্যে গোল হয়ে লেখকের মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো। কিন্তু শেষ দু’লাইনের মর্মোদ্ধার একেবারেই করতে পারিনি। “সুইডেন দেশটির সম্রাট বিনয়” কীভাবে?
বিনয়ঃ একসময় সুইডেনের রাজা ছিলেন গুস্তাভ। খুব লম্বা চেহারা। আমাদের ইন্দিরা গান্ধি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। ছবিও ছাপা হয়েছিলো। এই সুইডেন দেশই তো নোবেল পুরষ্কার দেয়।
গ্রন্থিঃ তাহলে কি আপনার কখনো মনে হয়েছিলো (বা, এখনও মনে হয়), আমার সাহিত্যসৃষ্টি এই সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা দাবী করে?
বিনয়ঃ (সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন) না না। কখনই এইরকম কথা বলতে চাইনি।
গ্রন্থিঃ সমান সমগ্র সীমাহীন-এর পর আপনার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ কী?
বিনয়ঃ মাঝখানে আমি কিছুদিন কবিতা লেখা ছেড়ে জ্যামিতিচর্চা করছিলাম। ঠাকুরনগর স্টেশানের দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে কাগজে জ্যামিতির নানা আঁকিবুকি কাটতাম। জ্যামিতির ভাবনা থেকেই কিছু লেখা তৈরি হয়েছিল। সেসব রচনা আছে “শিমূলপুরে লেখা কবিতা” বইটিতে; “কবিতীর্থ” প্রকাশ করেছে গত পুস্তকমেলায়।
গ্রন্থিঃ আপনাকে আর বেশিক্ষণ বিরক্ত করবো না। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন, এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। অনেক অদরকারি ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছি।
বিনয়ঃ আমিও তো অনেক কথাই ফাঁস করে দিলাম (হাসতে থাকেন)।
গ্রন্থিঃ একজন কবিতা-পাঠক হিসেবে যখন কবি বিনয় মজুমদারের মহত্ব বা uniqueness-এর কারণ খুঁজতে বসি, মনে হয় বৈজ্ঞানিক মনন, বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতি আর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাকে কাব্যরসে আগাগোড়া ডুবিয়ে হাজির করার অভূতপূর্ব গুণটিই আপনার কাব্য-সার্থকতার জন্যে এক নম্বর কৃতিত্ব দাবী করতে পারে।“ফিরে এসো চাকা”র খুব জনপ্রিয় কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি উদাহরণ হিসেবে। “মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়” — এই লাইনের শিরদাঁড়া একটি বৈজ্ঞানিক সাধারণ জ্ঞান বা বা যুক্তিসিদ্ধ পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর কিছু তো নয়। অথচ এটি এক শ্রেষ্ঠ পংক্তি হয়ে উঠলো কীভাবে? “প্রকৃত” শব্দের প্রয়োগের জন্যে। “মানুষ নিকটে গেলে সারস উড়ে যায়” প্রায় কোনও কবিতাই তৈরি করছে না। “মানুষ নিকটে গেলে কাক উড়ে যায়” আরও খারাপ। “সারস” শব্দের সুদূরপ্রসারী সৌন্দর্য নিশ্চয়ই সাহায্য করেছে পংক্তিটাকে। কিন্তু মূল ম্যাজিক ওই “প্রকৃত”য়। সে লাইনটার কতগুলো অর্থ তৈরি করছে দেখা যাকঃ-
ক) বাজারি মানুষেরা কাছে গেলে সাধকেরা দূরে চলে যান।
খ) প্রকৃত সারস অর্থাত শুদ্ধ সৌন্দর্য শুধু নির্জনতাতেই বাসা বাঁধে।
গ) জীবনের গূঢ় রহস্যময় জ্ঞান মানুষের অধরা চিরকাল।
ঘ) মানুষের আশা ও স্বপ্ন তার অর্জনের বাইরেই থেকে যাবে।
……ই তাক দালিয়ে দালিয়ে।
এইভাবে হয়তো এন-নাম্বার (আপনার ভাষায় ঢ়-সংখ্যক) মানে করা যেতে পারে।
একইভাবে “একটি উজ্জ্বল মাছ…পুনরায় ডুবে গেল” এই দীর্ঘ-বিখ্যাত কবিতার লাইন মূলত বিধৃত করছে ক্লাস নাইনের ফিজিক্সের জ্ঞানকে, একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিশিয়ে। আমরা সবাই পড়েছি, জলের নিজস্ব রঙ নেই। গভীর জলের মধ্যে আলোকরশ্মি প্রবেশ করলে রশ্মিগুচ্ছ বর্ণালীতে বিশ্লিষ্ট হয়। বর্ণালীর সাত বর্ণের সাতটি বিভিন্ন চ্যুতিকোন আছে। জলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে যে নির্দিষ্ট রঙের চ্যুতি চোখের অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায়, আমরা জলকে সেই রঙেই রঞ্জিত দেখি। আপনি “দৃশ্যত সুনীল” না লিখে “দৃশ্যত সবুজ” বা “দৃশ্যত তমস” (যেখানে সব রঙ শোষিত) লিখতে পারতেন। কিন্তু লাইনটায় কবিতা সৃষ্টি হল “প্রকৃত প্রস্তাবে” শব্দবন্ধ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে। বিজ্ঞানভাবনার হাড়কাঠামোর ওপর সৌন্দর্যের মাংস-ত্বক বসিয়ে দিলো সে। এইরকম নানা উদাহরণ আছে। যেমন মশা উড়ে গেলে তার এই উড়ে যাওয়া “ঈষত সংগীতময়” হয়ে থাকে যে, সেই বিষয়টা।
এখন কথা হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক মননকে এভাবে বাংলাকবিতায় তো কেউ আনেননি।
বিনয়ঃ তোমাদের এই কথাটা ভুল হলো। প্রাচীন কালেও কবিরা বিজ্ঞানভাবনা থেকে কাব্যের আঙ্গিক সৃষ্টি করে নিয়েছেন। আমি যে খুব নতুন কিছু করলাম, তা নয়। যেমন ধরো, কালিদাসের “কুমারসম্ভব কাব্য”। একটি দৃশ্যে যখন হরপার্বতীর বিয়ে হচ্ছে, কালিদাস লিখলেন, পৃথিবীর চারদিকে যেমন আলো আর অন্ধকার ফিরে ফিরে আসে, তেমনে শিব আর উমা আগুনের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছেন। এটা তো বিজ্ঞানই। অথবা, এই সংস্কৃত শ্লোকটি লক্ষ করোঃ হংসের্যথা ক্ষীরম অম্বু মধ্যাত। মানে হলো, হাঁস যেমন অম্বু অর্থাৎ জলের ভেতর থেকে ক্ষীর (বেছে নেয়)। তো, এটাও তো সেই তোমার ভাষায় যুক্তিসিদ্ধ বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে কাব্যে প্রকাশ করা। নয় কি? আমিও লিখেছি, “ব্রোঞ্জের জাহাজ আছে যেগুলি চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। এরূপ জাহাজে বৈজ্ঞানিক সামুদ্রিক গবেষণা করে।“ এই কবিতাটি “গায়ত্রী” কাব্যগ্রন্থে আছে। “ফিরে এসো চাকা”তে নেওয়া হয়নি।
গ্রন্থিঃ বেশ। কিন্তু পরের দিকের কাব্যগ্রন্থে আর একটা জিনিস লক্ষ করা গেল। বিজ্ঞান বা অঙ্কের কোনও কনসেপ্ট-কে আপনি মানবজীবনের কোনও ঘটনার মতো উল্লেখ করছেন কবিতায়। বা, বহু জায়গায় অঙ্কের সূত্র দিয়ে মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। বিজ্ঞান ও অঙ্কের সূত্রেরা এভাবে রক্তে-মাংসে জীবিত হয়ে উঠছে।
বিনয়ঃ মনুষ্যীকরণ। মনুষ্যীকরণ। আর কিছুই না। সেই সময়ে বিজ্ঞানের বেশ কিছু বই অনুবাদ করতে হয়েছিলো আমাকে। বইগুলো মন দিয়ে পড়ে দেখলাম, বৈজ্ঞানিক সত্যদের মানুষের জীবনের সঙ্গে মেলানো যায়। এবং এটা কবিতা লেখার নতুন এক পদ্ধতি হতে পারে।
গ্রন্থিঃ সীমা, অসীম, কল্পনা, ব্যোম, রেখা ইত্যাদি আঙ্কিক ধারণাগুলোকে আপনি মানব বা মানবীচরিত্র দিতে লাগলেন কবিতায়। জ্যামিতির ওপরও আপনার অসম্ভব টান লক্ষ করি।
বিনয়ঃ ঠিক তাই। আচ্ছা, আমি হচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। একটা কথা আছে, ড্রয়িং ইজ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অফ এঞ্জিনিয়ারস। আমি যদি একটি ড্রয়িং এঁকে পাঠিয়ে দিই, তবে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই একজন ইঞ্জিনিয়ার সেটি দেখে বুঝতে পারবে আমি কী বলতে চেয়েছি। নানারকম ভাবনা মনে আসে। ধরো, ম্যাক্সিমা-মিনিমা বিষয়টা। একটা কার্ভড লাইনের পয়েন্ট অফ ইনফ্লেক্সন-এ কার্ভটাকে ডিফারেনশিয়েট করলে পাচ্ছো একটা পজিটিভ ম্যাক্সিমা, তাকে আবার ডিফারেনশিয়েট করলে আসবে নেগেটিভ স্ট্রেইট লাইন, তাকে ফের ডিফারেনশিয়েটের ফল হলো, নেগেটিভ মিনিমা বা ইনফিনিটি…অর্থাত অসীম। সুতরাং, কার্ভটির পয়েন্ট অফ ইনফ্লেক্সন-এ কী ঘটছে, তার ডায়াগ্রাম এঁকে আমি একখানা জেরক্স করে রেখে দিয়েছি।
গ্রন্থিঃ আপনার আরেকটি চূড়ান্ত রহস্যময় কবিতা হলো, সমান সমগ্র সীমাহীন-এর ছ’নম্বর লেখাটিঃ
একটি বিড়ি ধরিয়ে সেই পোড়া দেশলাই
কাঠি দিয়ে আমি
টেবিলে লিখেছিলাম অসীম এক নং যোগ
অসীম দুই নং যোগ অসীম তিন নং
যোগ ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা
ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা যোগ অসীম ঢ় নং
সমান সমগ্র সীমাহীন শূন্য সমগ্র অসীম
আরও আমি কিছু রেখাকর্ম করে (যা এর পরের
কবিতায় লিখে দেবো) পেলাম অসীম সিংহ
পেলাম অসীম বালা, অসীম মজুমদার
পেলাম অসীম রায়, ভাইরে অসিম।।
আমরা জানি ইনফিনিটি অবিভাজ্য। তো এই অসীমকে ভাগ করা বা বিভিন্ন অসীমের
ধারণা করা কীভাবে সম্ভব?
বিনয়ঃ কতগুলো চিন্তা আমার মাথায় অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খায়, এটি তার অন্যতম। ধরা যাক, আমাদের এই ঠাকুরনগরে এক বিঘে বর্গক্ষেত্রাকার জমি আছে, অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে এক বিঘে, প্রস্থেও এক বিঘে। এবার যদি মাটির ওপর ওই জমির অংশটুকু কল্পনা করি, তবে তা আকাশ ছাড়িয়ে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাবে। একই ভাবে জমিটি মাটির নিচেও নেমে যেতে যেতে অসীম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। কাজেই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের এক টুকরো অসীম পাওয়া গেল।
গ্রন্থিঃ কিন্তু বর্গক্ষেত্র তো দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের গুণফল, তার অস্তিত্বের ধারণা শুধুমাত্র টু ডাইমেনশনাল। সেটি আকাশে বা পাতালে প্রসারিত হওয়ার উপায় কোথায়?
বিনয়ঃ বেশ, তাতে নয় আমি আরেকটা মাত্রা জুড়ে দিলাম। সুতরাং, ত্রিমাত্রিক কল্পনা করতে আর অসুবিধে নেই। এইভাবে, ধরো, ওই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের পাশে আর এক টুকরো এক বিঘের বর্গক্ষেত্র, তার পাশে আরও একটা…এইভাবে টুকরো টুকরো অসীমকে পেয়ে যাচ্ছি। এই অংশগুলির কোনওটির নাম দেওয়া যায় অসীম বালা, কেউ অসীম রায়, কেউ অসীম মজুমদার ইত্যাদি। আবার এই সব আলাদা অসীমের যোগফল এক পূর্ণ অসীমও কিন্তু রয়েছে। সে যেন এক ঈশ্বর, এই ব্রহ্মাণ্ডের রাজা। সম্পূর্ণ অসীম যেন এইসব ছোট ছোট অসীমের সাহায্যে আমাদের বিশ্বকে শাসন করে চলেছে।
গ্রন্থিঃ অসাধারণ! তাহলে এইরকম বলা যায় যে, আপনার “ফিরে এসো চাকা” ও “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”য় বিজ্ঞান ও কবিতার মধ্যে অন্তর্নিহিত জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে লেখাগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতো। কিন্তু ক্রমে আপনি সেই পদ্ধতির অনুসরণ বন্ধ করলেন। আপনার লেখায় সরাসরি ফুটে উঠতে লাগলো বাইনোমিয়াল থিয়োরেম বা ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস বা ইন্টারপোলেশান সিরিজ — মানবজীবনে তার প্রয়োগের দুঃসাহসিক রূপকার্থ নিয়ে। বিজ্ঞান, অঙ্ক আর জ্যামিতির শুদ্ধতা দিয়ে আপনি বাংলা কবিতাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন।
বিনয়ঃ (বাধা দিয়ে) কিন্তু এইসব লেখার কোনও সার্থকতা নেই। এ একান্তই আমার নিজের চিন্তা। কারও কোনও কাজে লাগবে না
(বিনয়-কবি চুপ করে যান হঠাত। চুপ তো চুপই। বিষণ্ণতা নেমে আসছে সারা অবয়বে। চোখ মুখোমুখি দেওয়ালের দিকে, কিছুই-না-দেখার চোখ)।
গ্রন্থিঃ হয়তো আপনার কবিতা জনসাধারণ থেকে জনবিশেষের আস্বাদনের জিনিস হয়ে যেতে পারে এই পরিবর্তনের ফলে। তাতে কী? আজীবন শিল্পের অর্থই হলো শুদ্ধতার চর্চা। সেই প্রয়াস মানুষের কাজে লাগা না-লাগার গুজবে কোনওদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হবেও না।
বিনয়ঃ নাহ! রবীন্দ্রনাথের “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর” গানটির মূল্য আছে। কিন্তু আমার লেখা অসীম বিষয়ক কবিতার দাম নেই।
(আর কথা বলানো যায়নি কবিকে। তার নীরবতা যেন আমাদের বিদায়-অভ্যর্থনা। দমচাপা মন নিয়ে উঠে পড়ি। দরজার গোড়ায় এগিয়ে আসেন মন্থরভাবে। প্রণাম করবো বলে নিচু হই। তবুও নিঃশব্দ-মুখ। কালো-সবুজ মানবহীন একটা পথ হেঁটে ফিরে যাই — বিনয়ের শেষ বলা কথা ক’টির প্রতি অসীম অবিশ্বাস সঙ্গে থাকে)।।