লেখালেখির পেছনে আসার প্রেরণা আমিই : রিজিয়া রহমান

Reading Time: 9 minutes

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের প্রয়াণে ইরাবতী পরিবার শোকাহত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রোদসীর ১৩ জুলাই,২০১৬ তে প্রকাশিত রিজিয়া রহমানের সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


রিজিয়া রহমান বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট এক নাম। জন্ম  ১৯৩৯, ভবানীপুর কলকাতায়। বেড়ে ওঠেন ফরিদপুর। তাই দুই বাংলার অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মাঝেই তার জানাশোনা। তার উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত উপন্যাসগুলো হলো একাল, চিরকাল, বং থেকে বাংলা, শিলায় শিলায় আগুন, অলিখিত উপ্যাখ্যান ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এই লেখক সামান্য কিছুদিন অধ্যাপনার পর জীবনের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন সাহিত্যের সেবায়। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী নূর কামরুন নাহার।

আপনার শৈশব নিয়ে কিছু বলুন।

কলকাতার ভবানীপুরে আমার জন্ম। আমার একেবারে শৈশব তাই কলকাতায় কেটেছে। তারপর বাবা বদলি হয়ে ফরিদপুর আসেন। সেখানেই আমার শৈশবের বেশ খানিকটা এবং কৈশোর কাটে। বাবার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে হলেও আমার মায়ের বাড়ি ঢাকা জেলার পদ্মা নদীর পারে। পদ্মা নদীর পারের মানুষ এবং জীবনের সঙ্গেও তাই আমার অন্য রকম একটা জানাশোনা।

শৈশব ও কৈশোর আপনার লেখালেখিতে কী রকম ভূমিকা রেখেছে?

প্রকৃত অর্থে আমার শৈশব-কৈশোর আমার লেখালেখিতে খুব বেশি আসেনি এবং ওইভাবে খুব প্রভাবও রাখেনি।

লেখালেখিতে আপনার উপস্থিতি কম কেন?

এর একটা কারণ হচ্ছে আমার গল্প-উপন্যাসের অধিকাংশ মানুষেরাই সমাজের প্রান্তিক মানুষ। সমাজের এই নিম্নশ্রেণির সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম আমার লেখার অন্যতম বিষয়। শ্রেণিবিচারে আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। আমাকে আমি তাদের জীবনের ভেতর প্রতিস্থাপন করতে পারিনি।

লেখালেখি শুরু করেন কিসের মাধ্যমে?

আমার লেখালেখি শুরু হয় কবিতা দিয়ে।

আপনার আলোচিত উপন্যাসের নাম রক্তের অক্ষর। দেহপসারিণীদের নিয়ে এ উপন্যাসটি লিখেছেন সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। ওই সময় এ রকম একটি উপন্যাস লেখার কথা কেন চিন্তা করলেন?

আমার এ উপন্যাস নিয়ে বহু পাঠক কৌতূহলী হয়েছে। নানাভাবে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, বহু পাঠক টেলিফোন করেছে, পত্রিকায়ও লেখা হয়েছে এ রকম একটি উপন্যাস লেখার প্রেরণা নিয়ে। এ উপন্যাসটি লেখার আগ্রহ বোধ করি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিচিত্রা’য় তাদের ওপর জরিপ করা হয়েছিল এবং জরিপের ভিত্তিতে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সে প্রতিবেদনে তাদের মানবেতর জীবনের যে রিপোর্ট হয়েছিল। সেখান থেকেই আমি এটি লেখার প্রেরণা পাই। মূলত তাদের মানবেতর জীবন আমাকে খুব আন্দোলিত করেছিল।

যখন উপন্যাসটি লিখেছেন তখন তাদের জীবন যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। 

এটা একদম সত্যি বলেছ, আমাদের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তাদের মানবেতর জীবন শেষ হয়নি। কোনো দিন হবে কি না তাও বলা যায় না।

এ ধরনের একটা বিশেষ পেশাজীবী শ্রেণির মানুষদের নিয়ে লিখতে নিশ্চয় তাদের খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে হয়েছে, জানতে হয়েছে।  

তা তো অবশ্যই। তবে আমি তাদের জীবনকে ওইভাবে দেখার সুযোগ পাইনি। তখনকার দিনে এখনকার মতো সবকিছু এত সহজ ছিল না। সমাজ আরও রক্ষণশীল ছিল, আমার বয়সও তখন কম ছিল। তাই আমি ওদের জীবন দেখার জন্য যেতে পারিনি। তবে আমাকে ওদের সম্পর্কে জানতে হয়েছে। জানাটা নানানভাবেই আমি করেছি। বিভিন্নভাবে তথ্য-উপাত্ত নিয়েছি। চরিত্র তৈরি করা বা সেট তৈরি করার জন্য অনেক তথ্য যেমন নিয়েছি, তেমনি চিন্তাও করেছি।

তা ছাড়া একধরনের চিত্রকল্প তো লেখক তৈরি করেই থাকেন। আর লেখক তো এই চিত্রকল্পের  মাধ্যমেই সৃষ্টি করেন।

সেটা তো অবশ্যই। তবে এই চিত্রকল্প বা ভিজ্যুয়ালাইজেশন ভিত্তিহীন নয়। এটা বাস্তবতা থেকেই গ্রহণ করতে হয়, যেটা আমিও করেছিলাম। আর আমি এ জন্য তাদের অনেক ছবি নিয়েছিলাম ফটোজার্নালিস্টের কাছ থেকে। তিনি বেশ বড় বড় করে আমাকে অনেক ছবি এনে দিয়েছিলেন। তারপর আমি তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। তারা কীভাবে থাকে, কীভাবে গল্প করে, কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করে সেখানে থেকে চিত্র তৈরি করি।

IMG_0116

আপনার রক্তের অক্ষর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়াসমিন। এ ইয়াসমিনকে কি আপনি দেখেছেন নাকি এটিও আপনার চিত্রকল্প?

না, ইয়াসমিনকে আমি দেখিনি। তবে এটা আমার কোনো কল্পনার চরিত্র নয়, যিনি আমাকে ছবি দিয়েছিলেন, তিনিই আমাকে এমন একজনের তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ওখানে এমন একজন মেয়েকে আমি দেখেছি যে শিক্ষিত, চিন্তাভাবনাগুলো অন্য রকম, একেবারে আপনাদের মতো। তার ওই রকম বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই আমি চরিত্রটা সৃষ্টি করেছিলাম।

ইয়াসমিন যা চেয়েছিল উপন্যাসে তা হয়নি। অর্থাৎ ইয়াসমিনদের জয় হয়নি বরং শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে রক্তের অক্ষর তৈরি করতে হয়েছে। আপনি এ রকম একটা সমাপ্তির দিকে উপন্যাসটিকে নিয়ে গেলেন কেন?

আমি উপন্যাসে জয়ও দেখাইনি, পরাজয়ও দেখাইনি। আমি মানবিকতার বিষয়টি দেখাতে চেয়েছি। চেয়েছি আমাদের বোধে একটা ধাক্কা দেওয়ার। এ উপন্যাসটি যখন আমি লিখি, তখন নারীবাদ বিষয়টি বা নারীর অধিকারগুলো ওভাবে আমাদের সাহিত্যে আসেনি।

আপনার আরও একটা আলোচিত উপন্যাস বং থেকে বাংলা যেখানে জাতিসত্তার বিকাশ দেখি। 

বং থেকে বাংলায় আমি আমাদের জাতিসত্তার কথা বলতে চেয়েছি। জাতি তৈরিতে ভাষা বড় ভূমিকা রাখে। ভাষাই আমাদের জাতিসত্তার প্রধান উপাদান। ভূখণ্ডের কারণে আজ আমরা আলাদা হলেও আমাদের জাতিসত্তা এক। ভূখণ্ড ভাগ হলেও ভাষাকে ভাগ করা যায়নি। বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। আমরাই হচ্ছি এর উৎসভূমি।

একাল চিরকাল উপন্যাসে সাঁওতালদের জীবনের চিত্র এঁকেছেন। এটিও কি তাদের সম্পর্কে তথ্য জেনে করেছেন নাকি সাঁওতালদের জীবনকে কাছ থেকে দেখেছেন?

সাঁওতালদের আমি কাছ থেকে দেখেছি। যদিও আমি একবারে তাদের সঙ্গে বাস করিনি। তবে তাদের দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার স্বামী ছিলেন মাইন জিওলজিস্ট। পেট্রোবাংলায় তিনি কাজ করতেন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির বিষয়ে তিনি সেখানকার গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছিলেন। তখন প্রায়ই ওই এলাকায় যেতেন। সঙ্গে আমিও যেতাম। তাদের দেখতে দেখতেই আমার এ রকম একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে করে।

এখানে তো তাদের বিবর্তনকেও এঁকেছেন। আদিবাসীদের বদলে যাওয়া জীবন, শিকারি থেকে কৃষক তারপর আবার শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু তারপরেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আমরা দেখি না।

মানুষের তো বিবর্তন ঘটেই। সবারই বিবর্তন হয়। আমাদের কী হয়নি, হয়েছে। সাঁওতালেরা শিকারি ছিল। তারপর তাদের কৃষিকাজ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা খনির শ্রমিক হয়ে উঠল, সেটা আমি আঁকতে চেয়েছি। ওই উপন্যাসের শেষে একটা গান আছে। গানের কথার মূলটাই হচ্ছে যে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।

বঞ্চনার অবসান হয়তো হয় না কিন্তু কখনো কখনো সাধারণ মানুষ জেগে উঠে বিপ্ল¬ব ঘটায়, মুক্তির স্বপ্ন দেখে। সে বিষয়গুলোকে কীভাবে লেখায় এনেছেন?

বঞ্চনার অবসান কি সেভাবে আমরা দেখি? পরিবর্তন হয় তবে খুব ধীরে। বঞ্চনা থেকে মুক্তি আবশ্যক সে রকম একটি বিষয় আমি ‘বাঘবন্দী; উপন্যাসে আনতে চেয়েছি। উপন্যাসটি ২০০৪ সালে বের হয়েছিল।

প্রথম সারির লেখকের জায়গায় নারীদের অবস্থান খুব কম। কেন? কী মনে করেন?  

নারী লেখক-পুরুষ লেখক এটি আমিও কোনো পার্থক্য করে দেখি না। মেয়েরা ওইভাবে লেখার জগতে জায়গা করে নিতে পারেনি তা কিছু সীমাবদ্ধতা তো আছেই। তবে মেয়েদের লেখার ক্ষমতা নেই তা নয়। আমার কাছে যেটা মনে হয় মেয়েদের লেখায় একটা আলাদা মাধুর্য থাকে। মেয়েদের লেখায় আবেগ থাকে। উচ্ছ্বাস বেশি থাকে। এখানে বোধ হয় একটা পরিমিতি বোধ থাকা দরকার।

IMG_0107

আজকাল মেয়েদের লেখায় যৌনতার বিষয়গুলো আসছে। এর কারণ কী মনে হয়।

অনেকে নিজেকে বলিষ্ঠ লেখক হিসেবে প্রকাশের জন্য লেখে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি শক্তিমান প্রমাণের কোনো বিষয় নয়। আমি জানি না ঠিক এ কারণেই মেয়েদের লেখায় যৌনতা আসছে কি না তবে মানবজীবনের সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য না লিখে অপ্রয়োজনীয়ভাবে যদি যৌনতাকে আনা হয়, তবে সেটা ঠিক হবে না।

সাহিত্যে বা শিল্পে যৌনতার প্রকাশটা কেমন হওয়া উচিত?

ঠিক কেমন হওয়া উচিত কেমন হবে এটা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। শিল্পের একটি লাইন আছে। শিল্পের একটা সীমা আছে। শিল্পের একটা সৌন্দর্যও আছে, সেখানে তার সীমারেখা যতটুকু, ততটুকুই যৌনতার প্রকাশ ঘটাতে হবে। তার বেশি হলে অকারণ যৌনতা এলে শিল্পটা ব্যাহত হবে।

বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক যেমন মোরাভিয়া, মার্কেজ এদের সাহিত্যে তো আমরা যৌনতার খোলামেলা প্রকাশ দেখি?

বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী লেখকেরাও শিল্পের সেই সীমারেখাকে অতিক্রম করেননি। তারা এটার শিল্পিত প্রকাশই ঘটিয়েছেন।

সাহিত্যের জন্য যৌনতা কি একান্ত অপরিহার্যই?

আমার তা মনে হয় না। সব সময় যৌনতার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি হলো তরকারিতে পাঁচফোড়ন দেবার মতো। কোনো কোনো তরকারিতে আমরা পাঁচফোড়ন দিই। কিন্তু সব তরকারিতে প্রয়োজন হয় না।

বাংলা সাহিত্যে নারীদের সার্থক রম্যরচনা দেখা যায় না, তাই তেমন নারী রম্যলেখকও নেই।  এর কারণ কী বলে মনে হয়।

ওটার কী কারণ তা বলতে পারি না। রম্যরচনা মূলত কঠিন।

মেয়েদের এই রম্য লেখা না লেখার কারণ কি ইমেজের কোনো সংকট?

আমি ইমেজের সংকট মনে করি না। রবীন্দ্রনাথ তো সব ধরনের লেখাই লিখেছেন। ইমেজের কোনো সংকট তো হয়নি। আমি মনে করি লেখকের যদি ক্ষমতা থাকে, তবে সব ধরনের লেখাই সে লিখতে পারে।

আপনার এই লেখালেখিতে আসার প্রেরণা কার কাছ থেকে পেলেন?

লেখালেখির পেছনে আসার প্রেরণা আমিই। আমার পরিবারে সেভাবে কেউ লেখেননি।

লেখা তো একটা সাধনা। তার প্রতি নিমগ্ন থাকা এবং তার জন্য নিবেদিত হওয়া তো একটা বড় ব্যাপার, তাই না।

অবশ্যই লেখা একটা বিরাট সাধনা। লেখা একটা নেশাও বটে। লেখা একটা পরিশ্রমসাধ্য বিষয়ও বটে। অনেক পড়াশোনার বিষয়। ব্যাপক পাঠ দাবি রাখে।

আমরা কোন উপন্যাসকে সার্থক বলব?

এটা বলা খুব কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যা মনে করি তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপন্যাস চরিত্রপ্রধান হতে পারে। আবার প্লটপ্রধান হতে পারে। আঙ্গিক কী হবে তা বিষয়ই নির্ধারণ করে দেয়। উপন্যাসকে আমি কোনো ছকে ফেলে লিখি না। গল্প বা বিষয়ের দাবিতেই এটি তৈরি হয়ে যায়। কোনো নির্দিষ্ট ফর্মকেই মানতে হবে তা আমি মনে করি না। আসলে তা হয়ও না। সমাজ, সময় এবং পারিপার্শ্ব বদলায়। মানুষ বদলায় তার চিন্তাধারা বদলায়। তা থেকেই লেখাও পরিবর্তিত হয়। নানাভাবে তার ফর্ম পরিবর্তিত হয়। তবে তা অবশ্যই শিল্প হতে হবে, সাহিত্য হতে হবে।

গল্পের ভাষারও তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। 

অনেকেই ভাষা তৈরি করতে চায়। তবে ভাষা ব্যাকরণসম্মত হতে হবে। তৈরি করতে হলেও তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

গল্পের আঙ্গিক নিয়ে এখন প্রচুর নিরীক্ষা চলছে। আখ্যানহীন গল্প, আধুনিক গল্প বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। অনেকে বলছেন এখন ভালো গল্পের আকাল চলছে ?

আধুনিক গল্প মানেই তো দুর্বোধ্য শব্দ দিয়ে পৃষ্ঠা ভরে দেওয়া হয়। পরীক্ষার মানেই দুর্বোধ্যতা নয়। যারা এভাবে গল্প লিখছেন তারা তাদের দুর্বলতারই প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। আঙ্গিক পরিবর্তন করতেই পারেন। কিন্তু আঙ্গিক পরিবর্তনের সঙ্গে আমি যা বলতে যাচ্ছি তা বলতে হবে। উদ্দেশ্যহীন কিছু শব্দ দিয়ে শব্দ জাল তৈরি করা কোনো আধুনিকতা নয়। ভালো গল্প হচ্ছে না এটা আমি মানি না। এখনো বেশ কিছু গল্প খুব ভালো হচ্ছে।

আবার যদি সেই সার্থক গল্পের কথায় আসি তাহলে তার স্বরূপটা কী?

ভেতর থেকে যা আসবে। যা আন্দোলিত করবে।

কলকাতার সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যের পার্থক্য কী?

সমরেশ মজুমদার একবার বলেছিলেন প্রবন্ধ ভালো হয়েছে। কবিতা সমান সমান। গদ্য পিছিয়ে আছে। আমি কিন্তু তার প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য বহু বিচিত্র। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য মূলত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের বিষয়বৈচিত্র্য অনেক বেশি। মোটকথা আমাদের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশক থেকে আমাদের পরিবর্তিত রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবন আমাদের সাহিত্যকে জাতীয় সাহিত্য করে তুলেছে।

আমরা নিজস্ব সাহিত্য তৈরিতে আমাদের কবি, সাহিত্যিকেরা সক্ষম।

আপনি বললেন আমাদের নিজস্ব সাহিত্য তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা কি ভাষায় কোনো নতুন মাত্রা আনতে পেরেছি?

আমাদের লেখার ভাষাটা ভিন্ন তা বলব না। তবে সাতচল্লি¬শের আগে আমাদের লেখার ভাষা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক একটি ভাষা। এখন বোধ হয় সেটা আমাদের নিজস্ব। এখানে একটি কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা কিন্তু বদলে যায়নি বরং কলকাতায় ভাষা কিন্তু বদলে গেছে।

আমাদের ভাষায় কিন্তু এখন অকারণ প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। মিডিয়ায় একধরনের জগাখিচুড়ি বাংলা বলা হচ্ছে। এমনকি বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজি টানে বাংলা বলছে।

বাঙালি চেয়েছে বলেই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। আর বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি অন্যতম প্রধান কারণ ভাষা। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলা আমাদের দেশের ভাষা। বাংলা ভাষাকে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। যারা এ দেশে বাংলাকে বিকৃত করে তাদের জিজ্ঞেস করা উচিত ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল। আড়াইশ বছর পরাধীন থেকে পশ্চিমবঙ্গের টিভি দেখে যদি আমরা অনুকরণ করি, তবে জাতিগতভাবে হেরে যাব। এসব পরিবর্তনের জন্য শুধু লিখলে হবে না, আন্দোলন দরকার।

IMG_0121

আমাদের বর্তমান সময়ের সাহিত্য নিয়ে আপনার কী মূল্যায়ন?

আমার তো মনে হয় নব্বইয়ের পরে আমাদের সাহিত্য আরও গতি পেয়েছে। আগে তো আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। যেমন ১৯৮০ সালে আমিই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম কিন্তু সেভাবে আমি সেটাকে প্রকাশ করতে পারিনি। আমাকে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে।

কিন্তু আমাদের সাহিত্যে তো সে রকম জীবনের চিত্রায়ণও দেখা যাচ্ছে না। হালকা জনপ্রিয় উপন্যাসের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয়তার মোহে লেখকেরা জীবনঘনিষ্ঠ পরিশ্রমী লেখায় আগ্রহবোধ করছেন না। 

এটা অবশ্যই কিছু সত্য। সেটা হচ্ছে এখন বাজার অর্থনীতির যুগ। বাজার অর্থনীতির বড় উপাদানই হচ্ছে প্রচার। প্রচার অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই মূল বিষয়টি চটক দেওয়া অথবা নাম কামানো এবং প্রচারমাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা এগুলো সাহিত্যেও প্রভাব রেখেছে। যার ফলে সাহিত্যের মানে একধরনের সমস্যা করছে।

সবকিছুর পরও বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা ভাষার বিকাশ নিয়ে আপনি কেমন আশাবাদী?

বাংলা ভাষা নিয়ে আশাবাদী। কারণ, যত দিন বাঙালি থাকবে তত দিন বাংলা থাকবে। জনগণের বিরাট অংশ হচ্ছে গ্রামভিত্তিক। তারা তো বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে। তবে ক্ষতি হচ্ছে হিন্দি চ্যানেলগুলোর কুফল তো ব্যাপক।

এবার আপনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি, বিশ্বসাহিত্যের কার কার লেখা আপনার খুব প্রিয়। আপনার বহুবার পড়া কোনো বই থাকলে পাঠকদের যদি জানান?

অনেকেরই। আর বিশ্বসাহিত্যে যারা নোবেল প্রাইজ পান তখন প্রচুর অনুবাদ হয়, সেগুলো পড়া হয়। বহুবার পড়া ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। আর ‘ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা’ প্রতিবছর একবার করে পড়ি। এটা আমার এত ভালো লাগে।

আপনার দেশে আপনার সমসাময়িক নারী লেখকদের কার লেখা আপনার ভালো লাগে?

রাবেয়া আপা আমার সিনিয়র। তার সে বইটা ভালো লাগে ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’। পুরান ঢাকার ওপর। তার গল্পগুলো খুব ভালো। সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ খুব ভালো উপন্যাস। দিলারা হাসেম আমার সিনিয়র। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ নিয়ে একটু বিতর্ক ছিল, তবু বেশ ভালো। নাসরীন জাহান আমার অনেক জুনিয়র। তার ‘উড়ুক্কু’ ব্যতিক্রমীধারার বিষয়, তাই বেশ নাম করেছে। রাজিয়া খানও অত্যন্ত শক্তিমান এবং আধুনিক লেখক।

এ সময়ের নারী লেখকদের লেখা কেমন লাগছে?

শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ অসাধারণ বই। জাহানারা নূরীর ‘ঘেরের মানুষ’ খুব ভালো লেগেছিল।  কিন্তু এর পরে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আর আসছে না।

এখন নারীবাদ আমাদের সাহিত্যে বেশ স্বতন্ত্রভাবেই উঠে আসছে। শুধু নারী নয়, পুরুষদের অনেকের লেখায়ও আসছে। এটি কি আমাদের সাহিত্যে নতুন মাত্রা এবং ভিন্ন কোনো ধারার সৃষ্টি করবে কি না?

নারীবাদ যা আমাদের সাহিত্যে এখন বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। হয়তো তা নতুন এক মাত্রা সংযোজন করবে। তবে আমার যেটা মনে হয় অনেকেই এর মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এটা কিন্তু সৃজনশীলতার জন্য ভালো নয়।

ঢাকায় আছেন বহুদিন। আপনার আগের দেখা ঢাকার সঙ্গে বর্তমান ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেমন লাগে এই ঢাকা?

জন্ম কলকাতায়, দেশ ভাগ হওয়ার আগে আগেই ফরিদপুরে আসি। তারপর আসি ঢাকায়। বহুদিন তো হলোই। তবে এভাবে কখনো চিন্তা করিনি। ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ নামে একটি বই লিখছি। সেখানে আমার ঢাকার জীবন এবং ঢাকার ইতিহাস লিখছি। আসলে প্রাচীন ঢাকাই তো ঢাকা ছিল। আমাদের ছোট দেশ। দেশের তুলনায় জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য বেশি। সবকিছু পরিকল্পিতভাবে হয় না। পরিকল্পনা তো আর পাবলিকের হাতে নেই। তবে অস্থির মনে হয়। এত বড় বড় বিল্ডিং আমাকে অস্থির করে তোলে।

আপনার জীবনে প্রেমের ভূমিকা কী? জীবনে কীভাবে কতবার প্রেম এসেছে?

জীবনটাই তো প্রেমময়। শুধু নারী-পুরুষের প্রেমই কি প্রেম। প্রেমের ব্যাখ্যাটা অনেক অনেক বড়। পৃথিবীতে অনেক প্রেম আছে। ভাইবোন, মা-সন্তান, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি এমন বহু প্রেম রয়েছে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে প্রেম, সেটা একটু অন্য রকম। আবেগের প্রেম। মায়ের আবেগ আবার উদ্বেগের আবেগ যত প্রেম আছে পৃথিবীতে। আমার কাছে মনে হয় স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির যে প্রেম সেটাই সবচেয়ে গভীর।

জীবনের অনেকটা সময় পার করে এসেছেন। অনেক কিছু দেখেছেন। অনেক কিছু সৃষ্টিও করেছেন। এতটা পথ অতিক্রান্ত করে এসেছেন। জীবনটা আসলে কেমন?

খুব কঠিন কথা। জীবনটা এত আশ্চর্য। একেকবার একেক রকম মনে হয়। মনে হয় পনেরো বছর জীবন এক রকম। সংসার আর এক রকম। আমার কাছেও মনে হয় এত সময় পার করেও যেন এতটুকু সময় পার করলাম। নিজেকে আবার আমার পর্যটক বলে মনে হয়। পর্যটক যেমন নানা দেশ হেঁটে যান অনেক কিছু দেখেন, তেমনি আমিও যেন বহু বৈচিত্র্যে ভরা অনেক কিছুর ভেতর হেঁটে হেঁটে পার হয়েছি। জীবনটা খুব সুন্দর।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>