সত্তরের দশক শেষ হতে কেবল বছর দুয়েক বাকি আছে, সেই অপয়া দশকে বলা নেই–কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন বাজান আমাদেরকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন; অর্থাৎ মরে গেলেন । দিন দুয়েক বাদে কিশোর আমি বাজানের অভাবটা মনে হয় প্রথম টের পেলাম । সন্ধ্যারাতে যখন বাজানের লেপের নিচে শুয়ে আপার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা সারছি, লেপে লেপ্টে থাকা বাজানের গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগল। এতদিন কান্না লুকিয়ে রাখলেও এই প্রথম কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না । এই অবস্থায় কেউ কি কান্না ধরে রাখতে পারে? হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আম্মা, বাজানোর গতরোর গন্ধ লেফো লাগি রইছে। আপাও কেঁদে উঠল । আম্মা তো কাঁদছেন সেই প্রথম দিন থেকে । আমারে সাগরো বাসাইয়া কানো ( কোথায় ) গেলায় তুমি ? কানো গেলায় তুমি?
সত্যি আমরা সাগরে ভেসে গেছি। আত্মীয়স্বজন– জ্ঞাতিকুটুম কেউ বলতে গেলে এই তল্লাটে নেই। সব ওপারে। খুচরো দুচারজন যে আছেন, বাজানের বদলি জনিত চাকরির কারণে বছর পঁচিশেক হয় দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ায় অনেকটাই দূরে সরে গেছেন। বাজান সারাটা জীবন বলতে গেলে ঢাকা–রংপুর–ময়মনসিংহ–বগুড়ায় চাকরি করেছেন। বছর দেড়েক হয় চেষ্টা–তদবির করে বদলি নিয়ে বগুড়া থেকে এখানে তাঁর পুরনো কর্মস্থলে আমাদেরকে নিয়ে এসেছেন।
এই প্রথম আমরা নদীর পাড় লাগোয়া স্টাফ কোয়াটার্সে বসবাস করতে শুরু করেছি । আমাদের বাড়িও ছিল নদীর পাড়ে । বরাক–মধুরার পাড়ে । বরাক পেরিয়ে মধুরার পাড় ঘেষে শ তিনেক গজ হেঁটে গেলেই আমাদের বাড়ি । চার কিয়ারি ( কেদার ) বাড়ি । বাপ চাচাদের পুরো বাড়ি হিসেবের মধ্যে নিলে আট–নয় কিয়ার হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় আমাদের শহর লাগোয়া বাড়িটির । ছোটোমামা বড়ো সখ করে নিজ হাতে তিনশ সুপারি গাছ লাগিয়েছিলেন । ইংরেজ আমলে কী ছিল না এ বাড়িতে । হাতি–ঘোড়া মোটামুটি সব ছিল । দাদা ধবধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে হেঁটে চলতেন । বাপ–চাচারাও ধুতি পরে চলাচল করতেন । থাক, সে সব দিনের কথা ভেবে চোখের জল আর নাকের জলে একাকার হতে চাই না । এমনিতেই বন্ধুরা বলে, তোদের এখানেও কিছুই নেই, ওখানেও কিছু নেই । পারলে যোগ করে, তোদের দোতলা পুকুর ছিল, বাড়ি ভর্তি হাতি–ঘোড়া ছিল ! এই তো দিন কয়েক আগে একজন সাহিত্যিক–ই বলে বসলেন আপনারা সকলেই জমিদার ছিলেন, যারা ওপার থেকে এসেছেন , আর এপার থেকে গেছেন !
তো বাজানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে দুলাভাই তাঁর কর্মস্থল পাবনা থেকে ছুটে এলেন । সেই সময়ে পাবনা এই তল্লাট থেকে বহুদূর ! ঢাকা থেকে এলেন ফুফাতো ভাইসাহেব । এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম, বাংলাদেশে একজন আপন ফুফাতো ভাই আছেন আমাদের ।
আমরা চারবোন একভাই । আমি সকলের ছোটো । আমার বড়ো দুবোন ওপারে । আমরা একটি ব্রোকেন ফ্যামেলির মানুষ । ৪৭ এর দেশভাগ বাবাকে বৃন্তচ্যুত করেছিল, আর ৬৫ সালের পাক–ভারত যুদ্ধ আমাদেরকে সপরিবারে উচ্ছেদ করেছে স্বভূমি থেকে । সে সব ম্যালা কথা । হাতে সময় থাকলে হয়ত সে সব কথা বলতে চেষ্টা করব ।
তো বাজান মরে যাওয়ায় একদম ভাসমান হয়ে গেলাম । রিফিউজির আবার ভাসমান–টাসমান কী । রিফিউজিরা তো এমনিতেই ভাসমান । তারপরও বাজান আমাদেরকে বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছিলেন । দু:খ–কষ্ট–বেদনা কোনো কিছুই বুঝতে দেননি । একাই সামলিয়েছেন ।
এই প্রথম বুঝলাম; উপলব্ধিও করলাম , যখন পড়াশোনা লাটে উঠল । থাকা–খাওয়ারই সংস্থান নেই, আর পড়াশোনা ! মাস দেড়েকের মধ্যে বাজান যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেই কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদেরকে সরকারি বাসায় নিয়ে এলেন । পূর্বে মাস দুয়েক আগে আমরা যে সরকারি বাসা ছেড়ে গিয়েছিলাম সেই বাসায় আরকি । আজ মনে হয় কী দিয়ে যে তৎকালীন এই কর্তৃপক্ষের রিন শোধ করি । তো থাকার জায়গা একটা তো হল । আর খাওয়া ? বাজান ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ ইহজগত ত্যাগ করেছিলেন, তাই ২১ দিনের বেতন–ভাতা, ব্যাংক–লাইফ ইন্সুরেন্স মিলিয়ে চলার উপযোগী কিছু টাকা মায়ের হাতে এল ।
ভাইবোন আবার স্কুলে যেতে শুরু করলাম । সেই সময়ে প্রায় সকলেই দলবেঁধে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত, তা মাইল তিনেক দূরে হোক, আর চারেক হোক । আপার সে সমস্যা ছিল না , কারণ, নদী পার হয়ে কাছেই ওর স্কুল ছিল । আমি মাইল তিনেক দূরের স্কুলে সহপাঠী এবং বন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গী হয়ে গেলাম । সঙ্গে মায়ের দেয়া পঁচিশ পয়সা । এই তো আমার সম্বল । নৌকায় পার হয়ে গেলে সেই সম্বলও প্রায় শেষ হয়ে যেত ।
টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসমেটদের কেউ কেউ স্কুল পালিয়ে পাশের লালকুঠি–রংমহল সিনেমা হলে ম্যাটিনি শোতে, আবার কেউ কেউ সিরাজি– আলবেলা রেস্টুরেন্টে নাস্তা সারত । আমার সামর্থ তো কুল্লে পাঁচ পয়সা কিংবা তারওকিছু বেশি, কাজেই কারো সঙ্গে সঙ্গী হতাম না । স্কুলে থাকতাম । বাস্কেটবল প্রাকটিস করতাম । মোটামুটি খেলতে পারতাম । সেই সময়ে বাস্কেটবলে আমাদের রাজ জিসি হাই স্কুল ছিল জেলার সেরা ।
একদিন দেখি মামা এসে হাজির হয়েছেন । মায়ের কাছে শুনেছি, আমাদের তিন মামা । কিন্তু আমি আমার এই জীবনে অন্য মামাদের দেখিনি । তাই, আমার কাছে বড়ো মামা–ই মামা । আমরা যেখানে থেকেছি; বসবাস করেছি, মামা এসে হাজির হয়েছেন ।
তখন পাসপোর্ট–ছয়ফুটের তেমন বালাই ছিল না । পাসপোর্ট অপেক্ষা লোকে ছয়ফুটে যেত বেশি । মামাও ছয়ফুটে জকিগঞ্জ মানিকপুরের আয়াস আলি ব্যাটার ঘাট পেরিয়ে সোজা এসে হাজির হয়েছেন ।
মামাকে দেখে মায়ের সে কী কান্না ! তাকিয়ে দেখি মামাও চোখ মুচছেন । বললেন, মখজিলদার চিঠি পাইয়া আইছি । হায়রে হায় ! কিতা অইলো ইতা ! ইংরেজ আমলোর গ্রামোর শিক্ষিত– ধনী– জমিদার পরিবার, আইজ দেশভাগোর লাগি সর্বহারা !
মামা দম নিলেন না । পেনশন– প্রভিডেন্ট ফাণ্ড–গ্র্যাচুয়িটির কাজে বাজানের বন্ধু রুহুল আমিন চাচার সঙ্গে এ অফিস– ও অফিসে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলেন ।
একদিন স্কুলে ফুলফ্রি স্টুডেন্টশিপের দরখাস্ত নিয়ে এলেন । স্যারেরা জানতেন আমাদের দীনতা, তাই দ্রুত ফুলফ্রি স্টুডেন্টশিপ মঞ্জুর হয়ে গেল । কথাটা যত সুন্দর শোনাচ্ছে, আদতে তা কিন্তু নয় । সোজা কথায় গরিব ফাণ্ডের টাকা মঞ্জুর হয়ে গেল । এখন স্কুলে পড়াশোনা করতে আর বেতন লাগে না । শুধু নির্দিষ্ট দিনে আমরা জনা দশেক ছাত্র গোমরা মুখে হেডস্যারের চেম্বারের সম্মুখে পায়চারি করি । হেডস্যার তাঁর খাসপিয়নের মাধ্যমে আমাদের স্লিপ নিয়ে দস্তখত দিয়ে দেন, বেতন আমাদের মওকুফ হয়ে যায় । দুর্গেশ রে তোর কথা মনে আছে ভাইরে । আমি ইকবালের কথা কি স্মরণে আছে তোর ?
এখানে আমার রুহুল আমিন চাচার কথা না বললেই নয় । নোয়াখালীর ভদ্রলোক রুহুল আমিন চাচা ছিলেন আমার বাজানের পরম বন্ধু । পরম বন্ধু এই জন্যে বলছি যে, তিনি বন্ধুত্বের দায় মিটিয়েছিলেন । পেনশন–প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কাজ ছাড়াও পরীক্ষার আগে বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই বিকেলবেলা তিনি ঘণ্টা দেড়েক আমাদের পড়াতেন । দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমাদেরকে পড়িয়েছিলেন । বিনিময়ে শুধু এককাপ চা খেতেন । তাও আবার লাল চা ! এই স্থলে আরেকজনের কথা না বললেই নয় । তিনি হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ আ. ম. শফিউদ্দিন আহমেদ । আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝড়ঝাপটা বলতে গেলে তিনি একাই সামলিয়েছেন ।
এঁদের আত্মার শান্তি কামনা করা ছাড়া আমার কী বা করার আছে ।
আমার নিঃসঙ্গ জীবনের শুরু বলা যায় সেই সময় থেকে । তারপর, কত দিবস–রজনি সংগ্রাম করে পার হয়ে গেল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই । নিঃসঙ্গতা আর কাটল না । মনে হয় শৈশব– কৈশোরে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত নিয়ে যারা বড়ো হয়; দাঁড়ায়, তারা নিঃসঙ্গই থেকেই যায় । আমি এখনও নিঃসঙ্গই আছি ।
বাজান তোমাকে বলছি, বাজান আমি মরিনি; হারিয়েও যাইনি । রিফিউজিরা মরে না, হারিয়েও যায় না । রিফিউজিরা ঢোলকলমি লতা, বাজান । পুতে দিলে ঝড়ঝাপটা সহ্য করে দাঁড়িয়ে যায় ।
বাজান, আমি দাঁড়িয়েছি। বাজান, তোমার ছেলে আজ দাঁড়িয়েছে।
জন্মঃ ১লা জানুয়ারি, সিলেট শহর। ছোটোগল্পে হাতেখড়ি ২০০৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখার মাধ্যমে। তারপর আর থেমে থাকেননি। অবিরাম লিখেই চলেছেন। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল সিলেটের জনমানুষ, প্রকৃতি ধরা দেয় নির্মোহ ভঙ্গিতে।
বাহ !
হীরক সেনগুপ্ত