Irabati re-reading story diver Smaranjit Chakraborty

ইরাবতী পুনর্পাঠ গল্প: ডুবুরি । স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

Reading Time: 3 minutes
জানলা দিয়ে বাইরের নিমগাছটার দিকে তাকাতেই ভগবানের কথা মনে পড়ে গেল লেবুর। ছোটবেলায় বিছানায় ঠিক এই জায়গাটাতে শুয়েই বাবা ওকে আঙুল দিয়ে বাইরের গাছটাকে দেখাত। বলত, “ওই নিমগাছটা দেখছিস, ওর মগডাল ছাড়িয়ে আর একটু উপরে উঠলেই ভগবানকে দেখতে পাওয়া যায়।”
 
ছোট্ট লেবু বাবার পাশে শুয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করত মগডালটা শেষ হচ্ছে কোথায়! কিন্তু সেটা এই জানলা থেকে দেখা যেত না। তাই ও ভাবত, তবে কি কোনও দিন ভগবানের বাড়িটা ও দেখতে পাবে না!
 
লেবু জিজ্ঞেস করত, “বাড়িতে বসে ভগবান কী করে বাবা?”
 
বাবা হাসত, বলত, “আমি সামান্য মানুষ। আমি কী তার কাজের খবর জানি!”
 
 
 
বাবার ভগবানে বিশ্বাস ছিল খুব। জন্ম থেকেই লেবু দেখে এসেছে বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। শরীরের নীচের অংশটা অকেজো। পরে শুনেছে, ও যখন মায়ের পেটে, তখনই নাকি কারখানায় ক্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল বাবা। ব্যস, সেই যে পড়েছিল, আর উঠতে পারেনি।
 
 
জুট মিলে চাকরি করত বাবা। ভালই মাইনে পেত। কিন্তু ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর পরই মিলটা বন্ধ হয়ে যায়। কম্পেনসেশনের টাকাও আর পায়নি ওরা। ফলে ঝড়ের ভিতর ডানা-ভাঙা কাকের মতো ওদের সংসারটা গোঁত্তা খেয়ে পড়েছিল মাটিতে।
 
লেবুর যখন দশ বছর বয়স, তখন বাবা মারা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভগবানের উপর বাবার বিশ্বাস ছিল শেষ দিন পর্যন্ত! বলত, “দেখিস, ভগবান যা করবে ভালই করবে।”
 
 
লেবুর এখন হাসি পায় এ সব ভাবলে। ভগবান কী করবে! সে তো আসলে মল্লিকবাজারের ও দিক থেকে আসা শিলকাটাও-ওয়ালা। পুরো নাম ভগবানদাস কুইরি। বেঁটে, ভীষণ ট্যারা আর মাথায় একটা ইয়াব্বড় টিক্কি! ভগবান ‘শিল কাটাও-ও-ও’ বলে ডাক দিতে-দিতে ঘোরে ওদের এই ছোট্ট মফস্সলের অলিতে-গলিতে। হাতে থাকে ছোট কয়েকটা ছেনি আর দুটো হাতুড়ি।
 
আর যখন কেউ ডাকে ভগবানকে, সে গিয়ে শিলের উপর ঠুংঠুং করে খোদাই করে দেয় মাছ, ময়ূরপঙ্খি আর ফুল পাতার নকশা।
 
সেই দেখে চটা বলে, “দ্যাখ লেবু একেই বলে গিরিপ। কী সুন্দর ছেনি ধরেছে দ্যাখ! এই গিরিপ তৈরি না করলে সব ফসকে যায়, বুঝলি? তোকেও জীবনে একটা গিরিপ তৈরি করতে হবে।”
 
লেবু ওর উচ্চারণ ঠিক করে দিতে বলে, “গিরিপ নয়, গ্রিপ!”
 
সেই শুনে চটা রেগে গিয়ে বলে, “অ্যাঁঃ, পণ্ডিত এসেছেন! শালা কেলাস ইলেভেন গাড্ডু খেয়ে পড়া ছাড়লি, আবার আমায় ঢ্যামনামো শেখাচ্ছে!”
 
সত্যি, অনেক কিছুর মতো এটাও লেবুর একটা দুর্বল জায়গা। পড়াশোনাটা ঠিক হল না ওর। মা চেয়েছিল ফেল করার পরেও চটা যেন আর একবার চেষ্টা করে। কিন্তু ও জানত এতে পয়সাই নষ্ট হবে। কাজের কাজ কিছু হবে না। তা ছাড়া তখন দাদাও ওদের সংসার ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ফলে মায়ের একার রান্নার কাজে যে সংসার চলবে না, সেটা বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল এ বার ওকেও রোজগারের পথ দেখতে হবে।
 
বিছানায় পাশ ফিরল লেবু। কাল রাতে বেশ জ্বর এসেছিল। তবে এখন জ্বর নেই। কিন্তু ক্লান্ত লাগছে খুব। বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। আজ তাই কাজে যাবে না ঠিক করেছে।
 
“লেবু উঠেছিস?” মা চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল।
 
“তুমি কাজে যাওনি?” লেবুর অবাক লাগল খুব।
 
মা বলল, “সকালে গুপিদের বাড়িতে আজ রান্না নেই। ওরা ঘুরতে যাবে। বেলার দিকে কদমবাবুদের বাড়িতে গেলেই হবে।”
 
ও ভাবল, টাকাটা আর আনা হল না। তা ছাড়া মানিক তো কথাই শুনল না ওর। শাসাল ‘এ দিকে এলে মেরে দেব’ বলে।
 
ও আর এক বার তাকাল বাড়িটার দিকে। লোকের ভিড় আরও বেড়েছে। ওর মনে হল, মানিক যদি এক বার ওর কথাটা শুনত! যদি এক বার ওকে বলার সুযোগ দিত!
 
লেবু এ দিক-ও দিক দেখে ভেজা প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল। তারপর সাবধানে বের করে আনল জিনিসটা। বহু দিন জলের তলায় থেকে গায়ে কেমন যেন ময়লা জমে গিয়েছে। ও বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষল মাথাটাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে রৌদ্র পেয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল হিরেটা!
 
হাত মুঠোয় আংটিটা চট করে বন্ধ করে ফেলল লেবু। সেবার অত খুঁজেও পায়নি। কিন্তু এবার না খুঁজতেই যেন জলের তলার মাটি ঠেলে নিজেই উঠে এল ওর হাতে! মানিককে তো এটাই বলতে গিয়েছিল ও। কিন্তু লোকটা শুনলই না। কিছুতেই শুনল না! তবে এটার কী হবে? এটা তবে কার এখন?
 
লেবু আকাশের দিকে তাকাল। কালো ধোঁয়া, মল্লিকবাড়ি ছাড়িয়ে এবার মফস্সলের আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে।
 
ওর মনে পড়ল বৃদ্ধার কথাগুলো, “ভগবান, এ কী করলে তুমি!”
 
সত্যি, শিল-কাটা ছাড়াও ভগবান আরও যে কী সব করে!
 
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>