| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: আমাদের সেই রবিবাউল । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

শিশু ভোলানাথেই আবিষ্কৃত এই শিশুকবির জীবনদর্শন। “বাউল” কবিতাটি লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। আজীবন মুক্তিপিপাসী শিশু রবি বুঝি মনেপ্রাণে আদ্যোপান্ত “বাউল” হতেই চেয়েছিলেন। তাই বুঝি পরবর্তী তে তাঁর গানেও সেই বাউলের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

“বাউল”

দূরে অশথ তলায়

পুঁতির    কণ্ঠিখানি গলায়

বাউল    দাঁড়িয়ে কেন আছ?

সামনে আঙিনাতে

তোমার    একতারাটি হাতে

তুমি       সুর লাগিয়ে নাচো!

পথে করতে খেলা

আমার      কখন হল বেলা

আমায়     শাস্তি দিল তাই।

ইচ্ছে হোথায় নাবি

কিন্তু     ঘরে বন্ধ চাবি

আমার   বেরোতে পথ নাই। 

   

বাড়ি ফেরার তরে

তোমায়    কেউ না তাড়া করে

তোমার     নাই কোনো পাঠশালা।

সমস্ত দিন কাটে

তোমার     পথে ঘাটে মাঠে

তোমার     ঘরেতে নেই তালা।

তাই তো তোমার নাচে

আমার    প্রাণ যেন ভাই বাঁচে —

আমার     মন যেন পায় ছুটি।

আবার এই রবি বড় বয়সে ইউরোপে বসবাসকালে ১৯৩০ সালে তাঁর বিখ্যাত  Hibbert Lecture এ বাউল সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেই বিস্তারিত আলোচনা লিপিবদ্ধ করে ব‌ইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল “The Religion Of Man”  নামক গ্রন্থে।

” One day I chanced to hear a song from a beggar belonging to the baul sect of Bengal.. What struck me in this simple song was a religious expression that was neither grossly concrete nor

metaphysical in its rarefied transcendentalism…” 

 রবীন্দ্রনাথ এবং বাউলের আলোচনায় এসে পড়ে বৈষ্ণবধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং তন্ত্র সাহিত্যের বিদগ্ধ লেখক শশীভূষণ দাসগুপ্তের কথায় 

” We, for the past few decades, have been influenced by the ideas propagated by the poet Tagore in his poems and writings, and also by the writings and speeches of his close associate Pandit Khitimohan Sen, for them baul represents more a spirit of unconventional approach to divinity through anassumed love and piety than any precise religious call.”

অতএব বাউল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আবেগ আমৃত্যু জড়িয়ে ছিল।

সহজিয়ারা স্বভাব মতই সর্বভূত ও জীবনের স্বরূপ পরমতত্ত্ব কে নিজের কল্পনায় আবিষ্কার করে থাকেন। একজন সহজিয়া সাধক মনে করেন মানুষের জন্মলব্ধ সহজাত বৃত্তিগুলি প্রকৃত সত্য দর্শনের সহায়ক। আমাদের রবিবাউলও বুঝি সেই জীবনদর্শনেই উদ্বুুদ্ধ হন। যে জীবনদর্শন খুঁজে ক্ষ্যাপা একদিন দেখা পায় পরশ পাথরের। রবিবাউলও বুঝি গীতবিতানে রেখে গেলেন সেই পরশ পাথরের স্পর্শসুখে সিঞ্চিত এমন সব আখরগুলি।

বাউল সাধনার মাধ্যম এই বাউলগান একপ্রকার রূপক আশ্রিত গান। রবিবাউলের গানের কথাতেও একের পর এক তেমনই রূপক। যেমন ধরা যাক, “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে” অথবা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বসে মানুষ যখন হিসেব-নিকেশ মেলায় তখন বুঝি তার মনে হয় একটাই কথা যা রবীন্দ্রনাথেরও বুঝিবা মনে হয়েছিল…

“আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়। সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়” 

বহুবিধ ধর্ম-দর্শনে সৃষ্ট এই “বাউলতত্ত্ব” কে মান্য করে যারা স্বতন্ত্র জীবনযাপনের পথ বেছে নেন, তিনিই একজন বাউল সাধক। এই তত্ত্বকে যখন বিশেষ সুরে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তখন তা হয়ে উঠে বাউল গান। বাউলগণ একদিকে গানের মাধ্যমে সাধনার তত্ত্ব প্রচার করেন, অপরদিকে তাঁরা গানের মাধ্যমেই “মনের মানুষ”, “প্রাণের মানুষ” বা পরম আরাধ্য ঈশ্বর কে খোঁজেন। নিজের ভেতরে ভেতরে, অন্তরে বাহিরে বাউল আদর্শে দীক্ষিত না হলে কারো পক্ষে বাউল গানের নিগূঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব না। মনে মনে হয়ত কারোকে বাউলগুরু বা মুর্শিদ মেনে নিয়ে একলব্যের মত একনিষ্ঠ শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কে ছিলেন সেই পরমপূজ্য দ্রোণাচার্য তা আমাদের অজানা। হয়তবা ঘরের চাবি ভেঙে, আত্মারামের খাঁচা খুলে বারেবারে তিনি পৌঁছতে চেয়েছেন সেই গুরুর কাছে।  

বাউলের কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে মনে পড়ে যায় লালনের কথা যিনি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অমর বাউল কবি রূপে বিখ্যাত ।  বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম সম্পদ হল লালনের গান। কবীরের মত দরিদ্র লালনের কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের  তথা বাংলার স্বাধীনতা অন্দোলন মুখী বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল লালনের গানে।

আবার কারো মতে, রবীন্দ্রনাথ বাংলার কিম্বদন্তী বাউল লালন ফকিরের খোঁজ পেয়েছিলেন তাঁর যৌবনে। এবং আকৃষ্ট হয়েছিলেন লালনের গানের কথায়। আপ্লুত হয়েছিলেন তার কবিতার ভাবাদর্শে। কৃষক পরিবারের সন্তান এই দরিদ্র বাউলটির ও বুঝি জীবনাদর্শ ছিল রবীন্দ্রনাথের “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়” এর মত। তাঁর গানের কথায় রেখে গিয়েছিলেন সর্বজনীন দেহতত্ত্ব বাদ। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আত্মার মুক্তি। তাই রবীন্দ্রনাথও অকপটে স্বীকার করেছেন সমগ্র বাউল সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর অপরিশোধিত ঋণের কথা।

এই বাউল-ঠাকুর বন্ধনের রেশ কিন্তু থেকে গেছে শান্তিনিকেতনে। তাই আজো পৌষমেলা প্রাঙ্গণে উড়তে দেখি বাউলের গৈরিক উত্তরীয়। বাউলের একতারায় বাজতে থাকে বাউল গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রগান। আবার এই বন্ধুতার রেশ নিয়েই  রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ  এবং নন্দলাল বসুর আঁকা ফ্রেসকো, মিউরাল এবং স্কাল্পচারে স্থান পায় বাউল অনুষঙ্গ। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার পাশাপাশি বীরভূমের কেঁদুলিতে জয়দেবের জন্মস্থানে  কেঁদুলির মেলাতেও বাউল আড্ডা, বাউল গান মাতিয়ে রাখে মেলা প্রাঙ্গণ। কোথায় যেন রবীন্দ্র সঙ্গীত আর বাউলগান মিলে মিশে এক হয়ে যায় তখন ।

সেই বিখ্যাত ইংরেজী গ্রন্থ “The Religion of Man” এ তিনি লিখেছেন

“Where shall I meet him, the man of my heart?

He is lost to me and I seek him wandering from land to land

I am listless for that moonrise beauty which is to light my life,

which I long to see in the full vision in gladness of heart “[pg 524]

এটি  বাউল গগন হরকরা রচিত বিখ্যাত গান

“আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে..”

আবার কবি সেই শব্দমালার অনুরণন তুললেন নিজের সৃষ্টিতে …

“আমি তারেই খুঁজে বেড়াই,  যে রয় মনে আমার মনে..”

এভাবে কবির অনেক গানের কথায় এবং সুরে আমরা দেখতে পাই বাউলগানের সেই মাটির গন্ধ  এবং মেনে নিতে বাধ্য হই যে রবীন্দ্রনাথের গানে বাউলের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বে বাউল সম্প্রদায়টিকে পূর্ব এবং পশ্চিমবাংলার মানুষ বোধহয় কেবলই উদাসীন, খেপা, ছন্নছাড়া ভিক্ষুকের পর্যায় ফেলত। তাদের রচিত গান নিছক পাগলামি বলে প্রতিভাত হ’ত । শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে বাউল, চারণ কবির রচিত গান যে কত উচ্চমার্গের লোকগান তা বুঝতে সমগ্র ভারতবাসীরও অনেক সময় লেগেছিল । কিন্তু যুগযুগ ধরে এই খেপামি ও উদাসীনতার তাড়নায় এই সম্প্রদায় বাংলা-সংস্কৃতির ভান্ডারকে যে কতখানি সমৃদ্ধ করে এসেছে তা আমরা এই মিলেনিয়ামোত্তর যুগে এসেও  খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করেছি। মুগ্ধ হয়েছি আমরা এদের রচনাশৈলীতে । ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা গানের সংস্কৃতি।  আধ্যাত্মিক এবং দেহতত্ত্বের ওপর এই লোকগান ছড়িয়েছে মুখে মুখে । সারা বিশ্ববাসী কদর করেছে বাউলদের।

বাউল সম্প্রদায় সেই অর্থে ছোটো থেকে বড় একটা শিক্ষিত কিম্বা গাইয়েও তৈরী হন না। তাদের  “গাইতে গাইতে গাইয়ে” বলা হয়। উদার আন্তরিকতার সুরে, প্রথাগত ধর্মাচরণের বাইরে থাকেন। এক সরল আত্মভোলা গানের সুরে কথাগুলিকে বেঁধে রাখেন। ঠিক সেই ভাবনা নিয়েই কি তবে রবিঠাকুরও একের পর এক গান বেঁধেছিলেন?

“যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা” কিম্বা “তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না। ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে, হয়তো রে ফল ফলবে না”… এই গানগুলিতে স্পষ্ট বাউল ভাবনার ইঙ্গিত। এমনকি বাউলের মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ যাকে মনবেড়ি দিয়ে বেঁধেছিলেন লালন? “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” এর মতন নাড়িয়ে দেওয়া কথা লিখে। রবিবাউল লিখেছিলেন, “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তার সকল খানে” অথবা “আমার মন যখন জাগলি না রে, তোর মনের মানুষ এল দ্বারে”র মত গান। বাউলের ভাষায় পাই “তাই তুমিও বাঁধা আমিও বাঁধা মুক্তি কোথায় পাই”।

রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ধুলামন্দির কবিতায় রয়েছে “মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে?আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন ‘পরে বাঁধা সবার কাছে”  

বাউলের সহজ-সাধনার ভাব, জীবনদর্শন ও সঙ্গীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি এবং সেইসঙ্গে তার অন্তঃপুরে বিচরণ করে নিবিড় আত্মীয়তায় একাত্ম হয়েছেন। তাই বুঝি বাউলের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র এত মিল। গানের কথায় ও সুরে একইধরণের মূর্ছনা। এই ঐকান্তিক ভাবধারা যা রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছিল তার মূলে কিন্তু ছিলেন লালন ফকির। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সরাসরি পরিচয় হয়েছিল কিনা তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই, শুধু জনশ্রুতি ও অনুমানই এই ধারণার মূলে। নদীয়ার বাউল সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে কবিগুরুর সঙ্গে লালন ফকিরের সাক্ষাৎ হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাউল গগন হরকরা রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে গিয়েছিলেন। এবং বাউলের মনে তখন থেকেই রবীন্দ্রগানের প্রভাব পড়তে থাকে। সুকুমার সেন কোনও সূত্র উল্লেখ না করেই জানিয়েছেন: “সাধনা চালাইবার কালে রবীন্দ্রনাথ উত্তর-মধ্যবঙ্গে লালন ফকির ও আন্দী (?) বোষ্টমীর মতো অনেক বাউল-বৈষ্ণব-দরবেশের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের গীতিনিষ্ঠ ধর্ম-অনুশীলনের পরিচয় পাইয়াছিলেন।”

বিনয় ঘোষও কিছুটা অনুমানের বশেই বলেছেন “১৮৮৪-৮৫ খ্রীস্টাব্দে বাউলগানের সংগ্রহটি তাঁর হাতে পড়ার পর যখন বাংলা লোকসাহিত্যের গোপন রত্নভাণ্ডারের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, তার দু-তিন বছরের মধ্যেই মনে হয়, শিলাইদহে বিখ্যাত বাউল লালন ফকিরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল।”

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে মন্তব্য করেছেন এরূপঃ “লালন ফকিরের গানের সঙ্গে আধুনিক মনের একটা সংযোগ আছে, সে-কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন (যদিও তাঁদের দেখাশুনা হয়নি)। 

শ্রীনিকেতন পল্লিসেবা বিভাগের কাজের ধারা বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘোষের বাবা কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন: ‘তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোশাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত” লালনের সঙ্গে রবিবাউলের দেখা হোক আর না হোক রবীন্দ্রগানে, জীবনদর্শনে যে তার প্রভাব পড়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বাউলরা বন্ধনহীন, বায়ুর মত মুক্ত চারণ কবি। প্রসিদ্ধ বাউল গবেষক ক্ষিতিমোহন সেনও বাউলদের সম্পর্কে সেই এক কথাই বলেছেন। বাউল শব্দের অর্থ তাঁর কাছে পাগল।সংস্কৃত বায়ু শব্দ থেকে উৎপত্তি বাউল শব্দের। সতত পাগলপারা, ভ্রাম্যমাণ, সমস্ত পরম্পরার বন্ধন থেকে মুক্ত তারা ঠিক বায়ুর মতোই। সত্যি কথা বলতে কি এই মুক্তির পথ দেখতেই তো চাইতেন রবীন্দ্রনাথ। আমৃত্যু তিনি ছিলেন মুক্তি পিপাসী। তাই বুঝি এই আকাশেই কিংবা ধূলায় ধূলায়, ঘাসে, ঘাসে নিজের মুক্তি খুঁজেছিলেন আলোয় আলোয়। 

“তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতামালায় ‘Religion of Man’ এর একটি স্থানে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতায় বাউল সম্প্রদায় ও গান সম্পর্কে যে উল্লেখ পাচ্ছি, অত্যাশ্চর্য স্বীকারোক্তি হিসেবে এবং আমাদের প্রসঙ্গের দিক থেকেও তা অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি বলছেন, পিতা কর্তৃক ব্রহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়ে প্রধানত গান রচনা দ্বারা তিনি সমাজের উপাসনা পরিচালনা করছিলেন কিন্তু তৃপ্ত হচ্ছিলেন না । After a long struggle with the feeling that I was using a mask to hide the living face of truth,I gave up my connection with our church. About this time one day I chanced to hear a song from a beggar belonging to the Baul sect of Bengal… it was alive with an emotional sincerity… Since then I have often tried to meet these people and sought to understand them through their songs” 

প্রাবন্ধিক অনন্ত চক্রবর্তীর মতে “আমি কান পেতে রই” বাউল ভাবাদর্শেই রচিত একটি গান যেখানে সুরের দিক থেকে বাউল ও সারিগানের সম্মিলন ঘটেছে। আবার ” ওরে বকুল, পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন” গানটিতে ঝুমুরের প্রভাব দেখতে পান এই লেখক। অন্যদিকে এই বাউলগানের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মূলে আছেন সেই মানুষটি যিনি লালমাটির দেশে বাউলের গৈরিক বসনের রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের রাঙা ধূলায়।

রবিকবি বড় কাছ থেকে বাউল সম্প্রদায় কে দেখেছিলন এবং বুঝেছিলেন  তাদের জীবনদর্শন। কোথায় যেন এক আত্মিক অনুভূতির সুরে নিজের একতারায় বেঁধেছিলেন বাউলের দোতারার সুর। বাউল সম্প্রদায় যেন বাংলার রাঙামাটিরই ফসল। একে চর্চা করতে হবে, বুঝতে হবে এর দেহতত্ত্ব বাদ এদের রচিত লোকগান  মানুষকে দেবে লোকশিক্ষা। ঠিক যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাউল অঙ্গের গানের সুরে মানুষ হারিয়ে গিয়ে  উপলব্ধি করে বাউলগানে আধ্যাত্মবাদ এবং আত্মত্যাগ। কথা আর সুরের মূর্ছনা দেখে প্রতিনিয়ত আমাদের এই প্রাণের কবিটির গানের ভাষায় কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই । একেশ্বর ব্রহ্মবাদে বিশ্বাসই হয়েও যে কবি প্রতিনিয়ত তাঁর গানের কথায় ব্যক্ত করেছেন  সেই আত্মত্যাগ ও ঈশ্বরের প্রতি আকুতি। নিষ্ঠায় সাজিয়েছেন ঈশ্বর পূজার নৈবেদ্য। একের পর এক তাঁর পূজা পর্যায়ের গানে  ঈশ্বরের প্রতি আকুতি  উজাড় করে দিয়েছেন। তাই ২০২১ এর দরজায় দাঁড়িয়ে বাউল কবি বলেও তাঁকে এক একবার প্রণাম জানাই মনে মনে । বাউল যেমন তার গানের কথায় প্রকাশ করে প্রেম, পূজা ও প্রকৃতির কত রঙ, গন্ধ এবং স্পর্শ আমাদের রবিঠাকুরও দেখেছিলেন সেই রঙ। গীতবিতানের ক্যানভাস ভরে গেছিল তাঁর তুলির টানে। কোথায় যেন অন্তরের ছোঁয়া সেই ছবিতে । যেমনটি আমরা পাই বাউলের সুরে আর কথায়।

বাউলকবি দ্বিজভূষণের একতারায় যখন বেজে উঠেছে “তোমায় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না “

রবীন্দ্রনাথ যেন সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন  “ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা, প্রভু তোমার পানে”  

অথবা তাঁর কলম বলে উঠেছে ” আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে, তোমার সেথায় চরণ পড়ে”

দুই বাউলের অন্তরাত্মা সেখানে মিলেমিশে একাকার। দুজনের আর্তি, নিবেদন সবকিছু যেন একই সুরে বাজে আমাদের কানে। এভাবেই  ছন্নছাড়া যত্রতত্র ভ্রাম্যমান বাউলদের মাঝে শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত, জোব্বা পরিহিত আমাদের রবিবাউল যেন নিঃশব্দে রেখে গেছেন তাঁর অগণিত গানপূজার নৈবেদ্যখানি ।

বাউলকে কেউ কেউ বলেন “The master singers of Bengal” যারা নিজেদের তৈরী যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে গান গেয়ে বেড়ায় মনের আনন্দে। কিন্তু সেই গানের প্রতিটি কথায় প্রকাশ ঘটে তাদের চিন্তাশীলতা আর জীবন দর্শন। কবিগুরুর গানেও আমরা পাই ঠিক এমন যেখানে গান শুধু গান নয়, যেন উপনিষদের ভাষায় “বাচহ উবাচম্‌” অর্থাৎ বলা কওয়ার ঊর্ধ্বে । শুধু সেই অন্তর্দর্শন আত্মোপ্লব্ধির। জহুরী রবিবাউল সত্যিই  চিনেছিলেন বাংলার বাউলদের। আর তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথের অন্তরাত্মার মধ্যে সুপ্ত এক চারণ কবি তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল…

“গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে…”

অথবা “ওরে কে রে আমায় নিয়ে যায় রে, যায় রে কোন চুলায় রে আমার মন ভুলায় রে…”

তিনি নিজেই যেন সেই রাঙামাটির পথের পথিক হয়ে আপাদমস্তক বাউল ঘরানায় জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে।

যেখানে আজ আধুনিক বাউলও গেয়ে বেড়ায় রবিবাউলের গান

“আমার ভাঙাপথের রাঙাধূলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন…”

আমরা ধন্য হয়েছি তাঁর বাউল অঙ্গের গান শুনে । রবীন্দ্র নাটকে পেয়েছি সেই বাউল চরিত্রটি যে শুদ্ধ, নির্মল চিত্তে উপলব্ধি করেছে তার মানব সত্তাকে। আকণ্ঠ মুক্তির আস্বাদ পেতে চাইছে গানের মধ্যে দিয়ে।

 “ডাকঘর” নাটকটি মঞ্চস্থ হবার ঠিক পূর্ব মূহুর্ত্তে তিনি মনে করেছিলেন একটি গানের প্রসঙ্গ যেটি ডাকঘরের “অমল” চরিত্রটিকে  একটি সার্থক রূপ দিতে পারে বলে তাঁর মনে হয়। আবার সেই কোন এক কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া নথিহীন বাউলের গান

“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা ,

তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গিয়ে আর পেলেম না …”

এর অনুকরণে  অতি অনায়াসেই সৃষ্টির সাবলীলতায় তিনি রচনা করেছিলেন সেই গান

“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার !

না পেয়ে তোমার দেখা একা একা, দিন যে আমার কাটে না রে …”  

আরো একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতে আমরা পাই লালনের দেহ তত্ত্ববাদের স্পষ্ট ইশারা। বোধ করি লালন ফকিরের দেহ সাধনা এবং মন সাধনায় অনুপ্রাণিত হয়েই কবি লিখেছিলেন এই গান খানি ।

“আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,

তাই হেরি তায় সকল খানে “

যার ইংরেজী অনুবাদটি হল 

The man of my heart dwells inside me.

Everywhere I look, it is he.

In my every sight, in the sparkle of light

Oh, I can never lose him —

Here, there and everywhere,

Wherever I turn, he is right there!

যে গানের মধ্যে বাউলের মানব সত্ত্বায় তার মনের মানুষের চেহারাটি একদম মিলে গেছে রবীন্দ্র চিন্তায় তার প্রাণের মানুষটির সঙ্গে। 

রবীন্দ্রনাথের “The Religion of Man” ব‌ইটির অ্যাপেন্ডিক্সের একটি অধ্যায় “The Baul Singers of Bengal”। কবির হিবার্ট লেকচারে বাউল সম্বন্ধে এই বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন এবং কবি এই গ্রন্থে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ঐ পরিচ্ছেদ গুলি তাঁর গ্রন্থে স্থান ও পেয়েছে ।  ক্ষিতিমোহন সেনের লেখায় আবার উঠে আসে সেই সূক্ষ দেহ বাদ এবং সহজ মনের তত্ত্ব । এক জায়গায় তিনি বলছেন বাউলের গানের ভাষায় :

The Baul sings:

Ah where am I to find him, the man of my heart?

Alas, since I lost him, I wander in search of Him.

Thro’ lands near and far.

আলোচনার সব শেষে অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন বলেছেন চন্ডীদাসের সেই বিখ্যাত উক্তি “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই”। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাতড়ে বেড়িয়েছেন এই অমোঘ সত্যকে আর তাই বুঝি  শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এডওয়ার্ড. সি. ডিমক  রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন “The Greatest Of The Bauls Of Bengal”! আবার দিনান্তে নিজের শেষ খেয়া পার? তাও তিনি পার করে গেছেন গানের কথায়।

“ওগো, তোরা কে যাবি পারে/আমি  তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে”

অথবা খেয়া কবিতায় সেই অমোঘ কথাগুলি?

“দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না,

সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়।

ওরে আয়

আমায় নিয়ে যাবি কে রে

বেলাশেষের শেষ খেয়ায়”

এই কথাগুলি মনে করিয়ে দেয় বিখ্যাত আরেকটি লালনগীতি “আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়। আমি একা রইলাম ঘাটে, ভানু সে রইল পাটে” এইজন্যই কি প্রবাদ আছে ” Great men think alike”?

 

তথ্যসূত্রঃ

  • “The Religion of Man” [NEW YORK, THE MACMILLAN COMPANY 1931] / Rabindrnath Tagore
  • [ Pratidhwani the Echo

A Peer-Reviewed International Journal of Humanities & Social Science

ISSN: 2278-5264 (Online) 2321-9319 (Print)

UGC Enlisted Serial No. 48666

Impact Factor: 6.28 (Index Copernicus International)

Volume-VII, Issue-I, July 2018, Page No. 165-176

Published by Dept. of Bengali, Karimganj College, Karimganj, Assam, India

Website: http://www.thecho.in] 

  • “গানের ভেলায় বেলা অবেলায়” / অনন্তকুমার চক্রবর্তী
  • “An Introduction to Tantric Buddhism”/ Shashi Bhuson Dasgupta
  • রবীন্দ্র-লালন: সাক্ষাতের দ্বন্দ্ব ছন্দ / দেশ ওয়েব সংস্করণ- দেবাশিস তেওয়ারী

 

 

 

 

 

One thought on “গীতরঙ্গ: আমাদের সেই রবিবাউল । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত