Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইরাবতী অণুগল্প: প্রটোকল । অমিতা মজুমদার

Reading Time: 2 minutes
 
বিনায়কবাবু গতরাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। বিপত্নীক বিনায়কবাবু দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। এই গ্রামে এসেছিলেন শিক্ষক হয়ে। তারপরে এখানেই হেমলতাদেবীকে বিয়ে করে সংসার পাতেন। তা প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে। ছেলে অর্কপ্রভর বয়সই তো এখন পয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। সেদিন খবরের কাগজে দেখেছেন তার জন্মদিন পালনের ছবি। হেমলতা বছর দুই আগেই গত হয়েছে। দূর সম্পর্কের এক বোন আর তার ছেলেকে নিয়ে থাকে বিনায়কবাবু।
 
অর্কপ্রভ, বৌমা অনেকবার বলেছে তাদের ওখানে গিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু বিনায়কবাবু ঠিক স্বস্তি বোধ করেন না ওখানে গিয়ে থাকতে। চিরকালের স্বাধীনচেতা স্বভাবের মানুষ সে। শিক্ষকতা করে এসেছেন সততা আর নিষ্ঠার সাথে। তার পক্ষে ছেলের সুনিয়ন্ত্রিত জীবনের ছকে মানিয়ে চলা একটু কঠিন। তাই ছেলে বৌমার আবদার এড়িয়ে গেছেন সযতনে।
 
এই বিনায়কবাবু বলা নেই কওয়া নেই দুম করে মারা গেলেন। গ্রামের সকলে মিলে পরামর্শ করে ছেলে অর্কপ্রভকে ফোন করল। সে জানাল বডি যেন ঠিকভাবে রাখা হয়, সে এসে মুখাগ্নি করবে। সেইমতো গ্রামের মানুষ বিনায়কবাবুর শবদেহ নিয়ে বসে থাকল।
 
মানুষের দেহে যতক্ষণ প্রাণের স্পন্দন থাকে ততক্ষণই সে মানুষ, প্রাণহীন শরীর শুধুই দেহ। যাকে আজকাল আর কেউ দেহ বলে না, বলে বডি।
 
শীতকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, মাস্টারমশাইয়ের অনেক ছাত্র আছে আভিধানিক অর্থে তেমন সফল মানুষ নয় জীবনে। কেউ গঞ্জের বাজারে মুদি দোকান চালায়, কেউ নিজের জমি জিরাতের দেখাশুনা করে। কেউ কেউ দশ ক্লাস পাশ করতে পারেনি নানা দৈব-দুর্বিপাকে, দিন আনে দিন খায়। কিন্তু মাস্টারমশাই ডাকলে এক ডাকে ছুটে আসে। এরা সকলেই আছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে চাল-ডাল ফুটিয়ে খিচুড়ি খেয়েছে দুপুরবেলা সবাইকে নিয়ে। গাছ কেটে রেখেছে শবদাহ করার জন্য। মোটের উপর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যা যা দরকার সব প্রস্তুত করে রেখেছে। যাতে মাস্টারমশাইয়ের ছেলে ওদেরই তো একসময়ের খেলার সাথি অর্কপ্রভ এলেই শবদেহের স্নান করিয়ে দাহ করা যায়।
 
সকলের মনের মধ্যে একটু অস্বস্তি কেউ কাউকে কিছু বলছে না, সেই রাত থেকে মাস্টারমশাইয়ের শবদেহ এভাবে পড়ে আছে!
 
বিনায়কবাবুর দূর সম্পর্কের ভাই বিজনবাবু অর্কপ্রভকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পায়নি।
 
এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারনী কর্মকর্তা অর্কপ্রভ চাইলেই তো হুট করে চলে আসতে পারে না, তাকে অনেক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তার অনুপস্থিতিতে কে কাজ করবে, পরিবার সহ যাতায়াতে তাদের নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। বাড়িতে বাবার কাজ যাতে যথাযথ সম্মানের সাথে হয় তাও দেখতে হবে। এসবের উপরে তার আগামী সময়ের অনেক কিছু নির্ভর করে। সবকিছু গুছিয়ে অর্কপ্রভ তার গাড়ির বহর নিয়ে যখন গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছালো তখন সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। আগে এলো নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি, তারপরে নামল সদ্য পিতৃহারা অর্কপ্রভ ও তার পরিবার। তার সাথে আসা আজ্ঞাবাহী অনুচরেরাই সব দায়িত্ব নিয়ে নিল।
 
কোথায় কীভাবে সমাধিস্থ করা হবে,অর্কপ্রভ কী করবে না করবে সবই তারা একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনামাফিক করতে শুরু করল।গ্রামের মুরুব্বিরা বলতে গেল বিনায়ক চেয়েছে তোমার মায়ের সমাধির পাশে তার সমাধি হবে। আবার রাত থেকে মৃতদেহ পড়ে আছে, বারবেলা পড়ে গেছে আর রাখা ঠিক নয়, কিন্তু অর্কপ্রভর সাথে আসা নামিদামি বন্ধুরাই ঘিরে আছে তাকে। তারা আর পৌঁছাতে পারছে না অর্কপ্রভর কাছে।
 
গ্রামবাসী, স্কুলের সহকর্মীগণ, প্রাক্তন ছাত্ররা, আত্মীয়-স্বজন কেমন নিজেদের বাহুল্য মনে করতে লাগল। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আচার, নিয়মের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্ব পেল বেশি। প্রটোকলের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গেল সকলের প্রিয় মাস্টারমশাই।
 
সবকিছুর ভিডিও ধারণ থেকে শুরু করে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চেয়ে অর্কপ্রভর কর্তব্যনিষ্ঠার প্রমাণ রক্ষা করতেই ব্যস্ত তার অনুচরবৃন্দ।
 
একসময় সকল প্রটোকল ভেঙে বিনায়কবাবুর দেহাবশেষ পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>