চা প্রসঙ্গে লিখতে বসে মজার এক গল্প মনে পড়ছে। চীরকুমার সাহেব নামে খ্যাত বাবার চাচাতো ভাই সাহেব চাচা। ছিপছিপে লম্বা শরীরের ওপর সৃষ্টিকর্তা দয়া করে একটা চেহারা বসিয়ে দিয়ে দায় সেরেছেন যেন। তবে দিয়েছেন অতীতে ডুব দিয়ে দারুণ সব গল্প তুলে আনার ক্ষমতা। সেই সঙ্গে গল্প বলার অদ্ভুত সব কায়দা-কানুন তো রয়েছেই। এই সাহেব চাচার কর্মজীবনের দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে। তবে চীরকুমার এ চাচা কখনো বিকাল ৪টার পর চা খেতেন না। জোর করেও কেউ তার এ নিয়ম ভাঙতে পারেনি, শুধু একবার এক বন্ধুর স্ত্রীর অনুরোধ ফেলতে না পেরে সন্ধ্যাকালীন নাশতায় এক কাপ চা খেয়েছিলেন। ওইদিন রাতভর ঘুম আসেনি তার। পরদিন উস্কখুস্ক চুলে সকালে নাশতার টেবিলে বসে তিনি শুনিয়েছিলেন চা বাগানের গল্প; কত ডিগ্রি অক্ষাংশে চা গাছ জন্মে থাকে, কখন চা পাতা তুলতে হয়, গাছের কোন অংশের পাতায় কেমন চা হয়— এমন সব বিষয় সম্পর্কে শুনে কেটেছিল সে সকাল।
এ অঞ্চলে চা চাষের শুরুটা মূলত উনিশ শতকে, সিলেট ও আসামে। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে, বাংলার ভূমি কিংবা আবহাওয়া নয়, এখানে চা চাষের একমাত্র কারণ হয়ে কাজ করেছে আফিম-যুদ্ধ (ব্রিটিশ বেনিয়ারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে চীনে ব্যাপক পরিমাণে আফিম সরবরাহ করে এবং একসময় তা মাদক হিসেবে ছড়িয়ে দেয়। আফিমে নেশাগ্রস্ত যুবসমাজ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তত্কালীন চীনা সম্রাট আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধের পাশাপাশি কঠোর আইন তৈরি করেন এবং বণিকদের কাছে রক্ষিত ২০ হাজার পেটি আফিম ধ্বংস করেন। এ ঘটনার পর ব্রিটিশরা চীনে যে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় তা পরিচিত ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে)। ১৮৩৯ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের জের ধরে চীনের চা বাজারে নিজেদের কর্তৃত্ব হারায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উপায়ান্ত না পেয়ে চা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য বিকল্প বন্দোবস্তের পথ খুঁজতে থাকে তারা। এভাবেই প্রথমবার গুরুত্বের সঙ্গে তত্কালীন ভারত উপমহাদেশের কিছু অঞ্চলে চা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এর আগে কিন্তু তেমন করে আসাম কিংবা সিলেটে চা চাষের সম্ভাবনার বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি এই ইংরেজ বণিকরা। এমনকি এ অঞ্চলে চা গাছ খুঁজে পেয়েও তা নাকচ করে দেয়ার মতো কাণ্ডও তারা ঘটিয়েছেন।
আসামের জঙ্গলে খোঁজ মেলে
ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-৮৫) সাল পর্যন্ত প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর এবং পরবর্তী সময়ে গভর্নর জেনারেল, ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম কৃতিত্ব তার) আমলে চীন থেকে কিছু চা বীজ বাংলায় আনেন। ১৭৭৪ সালে ভুটানে নিযুক্ত ব্রিটিশ দূত জর্জ বেগানের কাছে সেই বীজ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে তা ফলপ্রসূ হয় না। চার বছর পর জোসেফ ব্যাঙ্ক নামে এক ব্যক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যানের বরাতে ভারতে চা চাষের সম্ভাবনাগুলো উল্লেখ করে একটি চিঠি লেখেন। কিন্তু তখনো চীনের বাজারে মনোযোগী কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা এ অঞ্চলে চা চাষের সম্ভাবনাকে খুব একটা আমলে নেননি। শুধু কি তাই, ‘ব্লু ব্লাড’ তত্ত্বে বিশ্বাসী কোম্পানির গোড়া উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ড. এন ওয়ালিচ তো আসামে পাওয়া চা গাছকে স্বীকৃতিই দিতে চাননি।
১৮২৪ সালে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের সময় কর্নেল ল্যাট্টার অসমিয়াদের মধ্যে চা পানের অভ্যাস লক্ষ করেন। যদিও ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস ভারতের আসামে খোঁজ পান চা গাছের। তবে তার এ আবিষ্কারের বহু বছর আগে থেকেই আসামের স্থানীয় জনজাতি খামটি, সিংপোরা জেনে গেছে সবুজ এ পাতা থেকে আশ্চর্য পানীয় তৈরির উপায়। বাঁশের চোঙে চা পাতা দিয়ে রোদে তা শুকিয়ে নেয়া হতো, এভাবেই তারা তৈরি করত পানের উপযোগী চা। যাই হোক, আসামের জঙ্গলে চা গাছ আবিষ্কারের পর জনজাতী সিংপো সর্দার বিসাগ্রামের সঙ্গে চা বীজ ও গাছ-সম্পর্কিত একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেন তিনি।
এদিকে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের জের ধরে ১৮২৪ সালে রবার্টের ভাই চালর্স ব্রুস গানবোট অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন। আসাম বার্মা সৈন্য মুক্ত হলে সিংপো সর্দার বিসাগ্রাম চার্লস ব্রুসের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে এলে চুক্তি অনুযায়ী তিনি এই নেতার কাছে চা গাছের কথা বলেন। বিসাগ্রামও সানন্দে চার্লসের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় চা গাছ। সেই চা গাছ কোম্পানির নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার ইনচার্জ ডেভিড স্কটের কাছে পাঠালে তিনি নিজ বাগানে এর চাষ করেন। মূলত স্কটের বাগানের ওই চা পাতাই পাঠানো হয়েছিল এন ওয়ালিসের কাছে। নাক উঁচু এ উদ্ভিদতত্ত্ববিদের ধমনিতে বয়ে চলে গর্বিত নীল রক্ত আসামের এই চাকে চীনের অভিজাত চা গাছের জায়গায় বসাতে রাজি ছিলেন না। তাই সেদিন তিনি সে গাছকে চা গাছ হিসেবে স্বীকৃতিই দিতে চাননি। স্রেফ বন্য ‘ক্যামিল্লা’ বলে নাচক করে দেন। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস, ১৮৬০-এর দশকে ইংরেজ বাগান মালিকরাই চীনের বনেদি চা গাছকে ফেলে দিয়ে দেশী গাছকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন এর গুণাবলির জন্য।
চা অঞ্চল আবিষ্কার
ভারতে চা চাষ ও চা শিল্পের সম্ভাবনা খুঁজতে ১৮৩৪ সালে ১২ জন ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সেই চা সমিতির মধ্যে রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেন নামে ছিলেন দুজন বাঙালি সদস্য। সমিতির সম্পাদক নিযুক্ত হন জর্জ জেমস গর্ডন। ১৮৩৭ সালে সরকারি উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট ও আসামে চা চাষ শুরু হয়। বিসাগ্রামের সর্দারের কাছ থেকে চা গাছ নিয়ে তা পরীক্ষাগারে পাঠানোর স্বীকৃতিস্বরূপ আসামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা আবাদের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয় চার্লস ব্রুসকে। ১৯৩৯ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আসামে ১২০টি চা অঞ্চল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি অঞ্চলে আগামী এক বছর নাগাদ ১১ হাজার ১৬০ পাউন্ড চা উত্পাদন হবে। তিনি আরো জানান, আসামের সব পাহাড় আর উপত্যকায় যদি চা বাগান গড়ে তোলা যায়, তাহলে ইংল্যান্ডের চাহিদা মিটিয়েও এখান থেকে অন্যত্র চা রফতানি করা সম্ভব।
১৮৩৮ সালের দিকে চা সমিতির পক্ষ থকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের সম্ভাবনার কথা জানানো হলে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে যায় সে খবর। লন্ডনভিক্তিক তিনটি ও কলকাতার একটি কোম্পানি আসামে চা চাষের অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে। লন্ডনের কোর্ট অব ডিরেক্টরস আগ্রহ প্রকাশ করলে সেখানে ‘আসাম কোম্পানি’ নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি হয়। পাঁচ লাখ পাউন্ড মূলধনে তৈরি এ কোম্পানি ৫০ পাউন্ডের ১০ হাজার শেয়ারে বিভক্ত ছিল, যার মধ্যে দুই হাজার শেয়ার রাখা হয় ভারতে আর বাকিটা বিক্রি করা হয় ইংল্যান্ডে।
বাঙালি উদ্যোক্তা দ্বারকানাথ ঠাকুর
এদিকে একই উদ্দেশ্যে বাঙালি উদ্যোগপতি দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’র উদ্যোগে স্থাপিত হয় ‘দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন’। সে সময় এ কোম্পানির মূলধন দেখানো হয় ১০ লাখ টাকা, যা ছিল আসাম কোম্পানির দেখানো মূলধনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। তবে ১৮৩৪ সালের পর পূর্ব ভারতে যত জয়েন্ট স্টক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সবগুলোর পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এ বাঙালি।
চা সমিতির সম্পাদক জর্জ জেমস গর্ডন ছিলেন দ্বারকানাথের বন্ধু। পাশাপাশি কলকাতায় এই ইংরেজের ছিল নিজস্ব আফিম ব্যবসা, তার এ ব্যবসার কাজে একসময় দ্বারকানাথের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি। গর্ডনের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণেরই চা সমিতিতে ভীষণ প্রভাব ছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। এদিকে দ্বারকানাথের ওই উদ্যোগের খবর পেয়ে আসাম কোম্পানির পক্ষ থেকে কলকাতার ‘কোকেরেল অ্যান্ড কোম্পানি’ যোগাযোগ স্থাপন করে এবং টেগোর কোম্পানির শর্ত অনুসারেই দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশনকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী মূল কোম্পানির এক-পঞ্চমাংশ মূলধন বিনিয়োগ করেও ঠাকুরের এই কোম্পানি লন্ডন শাখার সমান সুযোগপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। তবে পরবর্তী সময়ে দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশনের নাম বিলুপ্ত হলেও এর বোর্ড অব মেম্বারস আসাম কোম্পানি স্বাধীন ভারতীয় শাখা হিসেবে কাজ চালাতে থাকে। ১৮৩৯ সালের ৩০ মে কার টেগোরের অফিসে কোম্পানির প্রথম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। কোম্পানির দুই হাজার শেয়ারের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং সে সময়ের আর এক বিখ্যাত উদ্যোক্তা মতিলাল শীল ১০০ করে শেয়ারের মালিক ছিলেন। টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির ছিল সর্বমোট এক-চুতর্থাংশ শেয়ার।
১৮৪৩ সালে কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের প্রথম লভ্যাংশ দিতে সক্ষম হয়। তবে সে বছরই একটি ঘটনাকে উপলক্ষ করে দ্বারকানাথের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক তলানিতে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে কোম্পানির কলকাতা শাখা দুর্বল হতে থাকে, ফলে লন্ডন জোরালোভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করে এখানে। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৬ সালে লন্ডন কর্তৃপক্ষ কলকাতা বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটাতে সমর্থ হলে কোম্পানির পরিচালন সমিতি নতুন করে গঠিত হয়।
সে সময়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮৫৩ সালে দুই হাজার একর চা বাগান ছিল আসাম কোম্পানির কাছে, সাত বছরের ব্যবধানে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার একরে। ১৮৯৬ থেকে ’৯৭ সালে কোম্পানির চা বাগানের পরিমাণ দেখা যায় ১০ হাজার ৯ একর এবং মোট জমির পরিমাণ ৫১ হাজার একর। আসামের শিবসাগরে কোম্পানির ১৫টি চা বাগানের এক একটি ছিল ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত।
চা শ্রমিকের লাঞ্ছনার ইতিহাস
চীনের অনুকরণেই এ অঞ্চলের চা বাগান তৈরি হবে শুরুতেই এমন ঘোষণা দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাই চা বীজ, চা গাছের চারা ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি চীন থেকে দক্ষ চীনা শ্রমিক আনে তারা। এভাবে আসামে ৩০০ জন বিদেশী শ্রমিককে আনা হয়। তবে কাজ শুরুর এক পর্যায়ে চীনা শ্রমিকরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পারিশ্রমিক না পাওয়ায় দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। তাছাড়া টানা দুই মাস সমুদ্রযাত্রা শেষে এই শ্রমিকরা যখন জানতে পারে কর্মস্থানে পৌঁছতে আরো তিন মাস সময় লাগবে, তখন এ বিষয়টি তাদের পক্ষে মেনে নেয়াও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে বহু শ্রমিককে কোম্পানি নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে একসময় বাইরে থেকে শ্রমিক আমদানির বিষয়টি চিরতরে রদ করে চা বাগানে দেশী শ্রমিক নিয়োগ শুরু করে কোম্পানি। আর এভাবেই শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। চা বাগানের এই শ্রমিকদের ডাকা হতো কুলি নামে। এই কুলি সংগ্রহের কাজ ছিল বাগান সর্দার ও কনট্রাক্টরদের। তারা আবার আড়কাঠির সাহায্যে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এই শ্রমিকদের সংগ্রহ করে চা বাগানে নিয়ে আসত।
দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে শ্রমিকরা চা বাগানে কাজ করতে আসত, কিন্তু ফিরে যেত দুঃসহ সব স্মৃতি নিয়ে। এর মধ্যে অনেক শ্রমিকই আর কখনই ফিরতে পারেনি। কোম্পানির নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে তারা। কারণ নিজেদের প্রয়োজন ও তাগিদেই শ্রমিক সংগ্রহের আইন বারবার পরিবর্তন করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর প্রমাণ ১৮৮২ সালের আইনে শ্রমিক সংগ্রহের ব্যাপারে বিধিনিষেধ তুলে দেয়া। শুরুতে চা বাগানে কাজের মেয়াদ তিন বছর থাকলেও নতুন আইনে চা শ্রমিকদের সঙ্গে বাগান কর্তৃপক্ষের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয় আরো দুই বছর। আগে যেখানে তাদের বছরে দুবার বাধ্যতামূলক ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর নিয়ম ছিল, পরবর্তী সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের ইচ্ছানুযায়ী তা করানোর নিয়ম করা হয়। এছাড়া চা বাগান থেকে পালানো শ্রমিকদের আদালতের ওয়ারেন্ট ছাড়াই ধরে এনে বাগানের কাজে লাগানোর কথাও বলা হয় ওই আইনে। যদিও কাজে যোগ দেয়ার আগেই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তির নিয়ম ছিল, কিন্তু এখানেও ছাড় দেয়া হয়, কাজের শুরুর আগেই নতুন শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি না করে চা বাগানে আনার পর চুক্তি করার ব্যবস্থা রাখা হয় এ আইনে। ফলে কর্মক্ষেত্রে আসার পথে কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার দায় এড়াতে পারত কোম্পানি।
বাংলা সাহিত্য চা শ্রমিকদের কথা
নীল চাষীদের মতো কোম্পানির চা-কররাও শ্রমিক নির্যাতনের মাধ্যমে রক্তাক্ত করেছে এ বাংলার ইতিহাস। উনিশ শতকের ছয়ের দশক থেকে সেই অত্যাচারের খবরগুলো দেশীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ‘নীল দর্পণ’ নাটকের অনুপ্রেরণায় ১৮৭৫ সালে নাট্যকার দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায় লেখেন নাটক ‘চা-কর দর্পণ’। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক রামকুমার বিদ্যারত্ন আসামে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে জানতে পারেন সেখানের শ্রমিকদের এ সমস্যা সম্পর্কে। এর পর নিজের ওই ভ্রমণ অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে ১৮৮১ সালে ‘উদাসীন সত্যশ্রবার’ নামে একটি বই লেখেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, কলকাতায় কুলি ডিপো এবং ডিপোর মহাজনরা কীভাবে পল্লীগ্রাম থেকে কুলি সংগ্রহ করে আনে। রামকুমার পরবর্তীতে ‘কুলি কাহিনী’ নামে নতুন একটি বই লেখেন, যেখানে ইংরেজ সরকার বা চা-করদের সমালোচনা করেন। ১৮৮৩ সালে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে, হেরম্বচন্দ্র এবং কালীশঙ্কর সুকুল মিলে প্রকাশ করেন ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা। পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় দীর্ঘদিন প্রকাশ হতে থাকে রামকুমারের অভিজ্ঞতা। তবে চা-করদের এ কুকীর্তির কথা প্রকাশ হয়ে গেলে তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সঞ্জীবনীতে যে দুটি ঘটনার বর্ণনা আলোড়ন সৃষ্টি করে তাহলো— ওয়েব কেস ও উমেশ হত্যা মামলা।
১৮৮৪ সালে ওয়েব সাহেব শুকুরমণি নামে এক তরুণীকে লাঞ্ছিত করেন, আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। এমন বহু ঘটনার অনুঘটক ওয়েবের বিরুদ্ধে সে সময় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কাজে ফাঁকি দেয়ার অপরাধে উমেশ নামে ১৪ বছরের এক কিশোরকে চা বাগানের ম্যানেজার পদাঘাতে হত্যা করে। এক্ষেত্রেও সাহেব ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। রামকুমার তার কুলি কাহিনীতে উল্লেখ করেন উমেশের এ ঘটনাকেও। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনার ফলে ভারত সভা আসামের চা বাগানে সরেজমিন তদন্ত করার জন্য সংগঠনের সহসম্পাদক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে আসামে পাঠায়। আসামের বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে বেঙ্গল ও সঞ্জীবনী পত্রিকায় সে সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখেন তিনি। তার সে প্রবন্ধে উঠে আসে চা বাগানের শ্রমিকদের লাঞ্ছনার ইতিহাস।
আসামের চা বাগানের কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন, ১৮৮২ সালের নতুন আইনের ফলে চা বাগানে কুলি মৃত্যুহার আনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৮২ সালে প্রতি বছরে হাজারে মৃত্যু হার ছিল ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দুই বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ। আর ১৮৮৪ সালে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে চা শ্রমিকদের মৃত্যুহার ছিল ২০ শতাংশ। যেখানে একই অসুখে স্থানীয় বাসিন্দাদের মৃত্যুহার ছিল অনেক কম। সে বছর চা বাগানে ১০ হাজার ৬৬৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্যে ২ হাজার ৬২৪ জন বা সাড়ে ২৪ শতাংশ বসন্ত রোগে মারা যান। ওই বছর একই রোগে আসামের বাসিন্দাদের মৃত্যুর হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির দেয়া এ চিত্রটি তুলে ধরে চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থার কথা।
সচেতন বাঙালির ক্ষোভ
১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন দ্বারকানাথ ও তার বন্ধুরা। তারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন অধিবেশনে তারা চা শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন। যদিও সে সময় কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতারা প্রাদেশিক সমস্যার অজুহাত দিয়ে প্রস্তাবটি অধিবেশনে তুলতেই দেননি। অথচ ১৮৭২ সালে মোট ৩৪ হাজার ৪৩৩ জন চা শ্রমিকের মধ্যে ২২ হাজার ৮০০ জনই ছিলেন ভিন্ন রাজ্যের। তাই সমস্যাটিকে প্রাদেশিক বলে নাকচ করে দেয়ার বিষয়টি ছিল ভিত্তিহীন। কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের এমন কাণ্ডে আশাহত না হয়ে দ্বারকানাথ ও তার সতীর্থরা কলকাতায় পৃথকভাবে আয়োজন করেন প্রাদেশিক সম্মেলনের। সে সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় চা বাগানের সমস্যাগুলো। বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর ক্ষোভের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে চা বাগানের শ্রমিক সমস্যা নিয়ে সরকার একটি কমিশন গঠনের চিন্তা করতে শুরু করে। শেষমেশ ১৮৯০ সালে শ্রমিকদের অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য সরকার একটি পৃথক কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯৪ সালে কমিশন সিলেট ও কাছাড় বাদে অন্যত্র চুক্তিতে কুলি নিয়োগ বন্ধের সুপারিশ করে। ১৮৯৬ সালে অর্থাত্ দ্বারকানাথের প্রচেষ্টার ১০ বছর পর প্রথমবার কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বাদশ অধিবেশনে প্রথমবার চা শ্রমিকদের নিয়ে প্রস্তাব রাখা হয়। প্রস্তাবটি রাখেন থিয়েস্টিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ। অবশেষে ১৯০১ সালে স্যার হেনরি কটনের প্রচেষ্টায় ‘ইনডেঞ্জার সিস্টেম’-এর অবসান ঘটে। আসাম লেবার অ্যান্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট চুক্তির মেয়াদ চার বছর করা হয় এবং চতুর্থ বছরে পুরুষ ও নারী শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ধরা হয় যথাক্রমে ৬ ও ৫ টাকা। এই আইনের ফলে আড়কাঠি ব্যবস্থাও কমে যায় ক্রমেই।
বিস্মৃতির অন্তরালে
এ অঞ্চলে চা চাষের শুরু থেকে বিবর্তনের প্রতিটি বাঁকে বাঙালি সমাজ ছাপ রেখেছিল তার নিজস্বতার। চা আবাদের সূচনালগ্নে বাঙালি শিল্পপতি দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিনিয়োগের তথ্য যদিও অনেকটাই বিস্মৃতির অন্তরালে। আর এই চা শিল্পের হাত ধরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভালোভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
বাঙালি উদ্যোক্তার পাশাপাশি জমিদার হিসেবে দ্বারকানাথ তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সে যুগে ইউরোপীয় ম্যানেজার নিয়োগ করে। ব্রিটিশের বশত্যা স্বীকার না করে তাদের কাজে লাগিয়ে কর্ম উদ্ধারের উপায় খুঁজেছেন। কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির এ প্রতিষ্ঠাতা একাধারে ছিলেন উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক। নিজের যোগ্যতা বলে ব্রিটিশ বণিকদের বাণিজ্য জগতে একজন সমান অংশীদার হিসেবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে প্রথা ভেঙে দিয়েছেন তিনি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় কোনো পাবলিক ব্যাংক ছিল না। ১৮২৮-এ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কলকাতার মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার নেপথ্যেও রয়েছে দ্বারকানাথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেবল তা-ই নয়, ১৮২১ সালে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘সংবাদ কৌমুদি’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার হাতে সূচনা হয়েছে বাংলা ‘বঙ্গদূত’ ও ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’-এর। ১৮৪২ সালে বিলেতে যান দ্বারকানাথ। ‘ইন্ডিয়া’ নামে নিজস্ব জাহাজে চেপেই সাউথহ্যাম্পটন বন্দরে পা রেখেছিলেন তিনি। লন্ডনে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার রানী ভিক্টোরিয়ার অতিথি হয়েছেন, আমন্ত্রিত হয়েছেন প্যারিসের রাজা লুই ফিলিপের দরবারে।
দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে যে তথ্য শুনলে চমকে উঠতে হয় তা হলো, পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসা-সংক্রান্ত দলির দস্তাবেজগুলো একসময় পুড়িয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই এ বিষয়ে অনেক তথ্যই হারিয়ে গেছে আজ।