Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti boiishakh indira

কলোনিয়াল ক্যুইজিনঃ জলে ও ডাঙায় মাংস রান্না । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

Reading Time: 6 minutes

 

 

কলকাতার কাছেই রয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসতের ডাকবাংলোর মোড়।সে যুগে ছিল এমন অজস্র ডাকবাংলো। এবার ছবিটা ভাবুন তো একবার। হয়ত ঘুটঘুটে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে এক ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে কেয়ারটেকার আব্দুল কিম্বা গফুর চাচার সন্ধে ঢুলনিটা সবেমাত্র এসেছে।কিছুটা  দূরে বসে মালী ফটিক লম্প জ্বেলে রামায়ণ পড়ছে সুর করে। আচমকা ডাকবাংলোর চৌহদ্দির বাইরের ফটকের সামনে ঘোড়ার খুরের টকাটক টকাটক শব্দে কেয়ারটেকারের ঝিমুনি টা খানখান হয়ে গেল ভেঙে । বড়সাহেবের জবরদস্ত ঘোড়া তখন সবেমাত্র ফটক পেরিয়েছে কি পেরোয় নি । আব্দুল অথবা গফুর ঝিমুনি ভুলে ছুট লাগালো রান্নাঘরের দিকে । রান্নাঘরে জোগাড় হতে থাকল বড়সাহেবের জন্য খানাপিনার। মালী ফটিক রামায়ণ গানে ইতি টেনে মশলা বাটতে বসল শিলে। গফুর কিম্বা আব্দুল গেল তাদেরই হাতে পালাপোষা পুরুষ্টু মুরগী কেটে আনতে।

 

ব্রিটিশ আমলে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্যই শুরু হয়েছিল ডাকব্যবস্থা। চিঠি বইবার জন্য ছিল ঘোড়ার পিঠ। ঘোড়ার পিঠে চেপে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ব্রিটিশ কর্মচারীদের পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকসময়ই সন্ধে  ঘনিয়ে আসত । তাদের রাত্রিবাসের জন্য তৈরি হল ডাকবাংলো । এল আব্দুল কিম্বা গফুরদের মত ডাকবাংলোর কেয়ারটেকাররা । ব্ল্যান্ড রান্না খাওয়া সাহেবি জিভে ঝাল সইত না । তাই অল্প ঝাল দিয়ে তাদের জন্য তৈরি হত মুরগীর কারি । সঙ্গে ভাত কিম্বা হাতরুটি । ডাকবাংলোর চৌহদ্দির দিশী মুরগীর দেওয়া  অপর্যাপ্ত ডিমও থাকত।  প্রথমে চড়া আঁচে বসিয়ে তারপর ঢিমে আঁচে অনেকটা সময় ধরে রান্না হত বলেই বুঝি এত সুস্বাদু ছিল সেই রান্না।

 

বাংলার পুরনো বা হারানো মাংস রান্না নিয়ে লিখতে বসলেই বেশ কিছু অনুষঙ্গ এসে পড়ে। স্টিমার যাত্রা, মুসলমান মাঝিমল্লা, খালাসি, দেশভাগের করুণ স্মৃতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর সর্বোপরি আমাদের ছোটবেলার সেই ব্যাবসায়ী খেলা বা মোনোপলি গেম। এইসব প্রসঙ্গ ভাবনার খেয়া কে ভাসিয়ে নিয়ে চলে কখনও বুদ্ধদেব গুহ’র ঋজুদা সিরিজে, জঙ্গলে, শিকারে। কখনও আবার সৈয়দ মুজতবা আলির লেখায় কিম্বা ভোজনরসিক শক্তি চট্টোপাধ্যায় অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যপুরে। বুদ্ধদেব গুহর শিকারকাহিনীতে একই সঙ্গে জঙ্গলে ভ্রমণ এবং সেখানে মজাদার খাবারের আস্বাদ পাওয়া যেত । সেখানেই শোনা বাংলার জঙ্গুলে মাংস রান্নার কথা। অনেক তাবড় সাহিত্যিকদের লেখাতে আব্দুল বা গফুরদের মত চৌকিদার বা চওকিদারই ছিল ডাকবাংলোর পাহারাদার কাম কেয়ারটেকার এবং প্রধান পাচকও বটে। 

 

স্বাধীনতা আসেনি তখনও আমাদের দেশে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪০ সালে ভারতের অগণিত রমণীয় স্থানে নিজেদের কাজের সুবিধার্থেই কিছু ডাকবাংলো তৈরি শুরু করেন। ডাক পরিষেবা ছাড়াও সরকারি কর্মচারী সাহেবসুবোরা সপরিবারে সেখানে গিয়ে একদিকে সবুজ প্রকৃতিকে উপভোগ করতেন আর অন্যদিকে জঙ্গলের মধ্যে নিজেদের গ্যাস্ট্রোনমিক স্ফূর্তিতে জমিয়ে দিতেন ছুটির দিন। সাহেবের আদেশে খানসামার হাতের দেশি পদ তৈরী হত আর সাহেবরা তা খেতেন কবজি ডুবিয়ে। সেই থেকেই এই ডাকবাংলো রান্নার ট্র্যাডিশন চলেছে এখনও।

সেকালে মুরগী বা মাটনের গরগরে লালচে ঘন ঝোলের মধ্যে ডুবে থাকত  ইয়াব্বড় দু আধখানা আলুর টুকরো। সঙ্গে সেদ্ধ হাঁসের বা মুরগীর ডিম। সাদামাটা রেসিপি কিন্তু সাহেবদের ব্ল্যান্ড রান্নার কাছে অত্যন্ত মুখরোচক হয়ে ওঠে এই ইন্ডিয়ান কারি । তাই ভাত বা রুটির সঙ্গে জনপ্রিয় হয়। দিশী মুরগী কিম্বা কচি পাঁঠা সে যুগে কড়াই, হাঁড়ি বা ডেকচিতেই চাপা দিয়ে ঢিমে আঁচে রান্না হত। তাই অভাবনীয় হত সে রান্নার স্বাদ ও গন্ধ।

তখন দেশীয় বাজারে মুরগি ছিল তুলনামূলকভাবে অপর্যাপ্ত । ১৮৭০ সালে আস্ত একটি জ্যান্ত মুরগি পাওয়া যেত এক আনায়, আর বিশাল ‘জাঙ্গল ফাউল’ মিলত দু’ আনায়। প্রচলিত এবং স্থানীয় মশলাপাতি দিয়ে চটজলদি মাংস রান্না করা আবিষ্কার করে ফেললেন খানসামা তথা ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার কাম চৌকিদাররা। বড়সাহেবের অর্ডার হলেই যেকোনো সময় পাতে বেড়ে দেওয়া যাবে এই ভেবে। বলাই বাহুল্য ভাত বা রুটি দুয়ের সঙ্গতেই জমে যায় এমন পদ। একে ছুঁচোয় ডন বৈঠক দেওয়া ক্ষুধার্ত পর্যটকের পেটের আগুন অন্যদিকে পথশ্রমের ক্লান্তি সব মিটিয়ে পরিতৃপ্তি দিতে পারত এই মাংস।

 

অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত কয়েকটি মাংসের ডিশের মধ্যে রেলওয়ে মাটন কারি, মাদ্রাস ক্লাব কোর্মা, মুলিগাটনি স্যুপ, ঝালফেরেজি, গোয়ালন্দ স্টিমার কারি আর ডাকবাংলো চিকেন কারি হল উল্লেখযোগ্য।

 

এই ডাকবাংলো মুরগী নিয়ে একটি মজার গল্প আছে।

১৮৫৬ সালে চার্লস ডিকেন্সের পুত্র ওয়াল্টার ডিকেন্স সৈনিক হিসেবে কলকাতায় আসেন । তাঁর লেখাতেই আছে এমন।

ভারতে আসার আগে এই ডাকবাংলোর মুরগি রান্নার একঘেয়েমি বিষয়ে প্রচুর রসিকতা শুনে এসেছিলেন তিনি। তাই সেটি ঠিক কতটা বোরিং সেটা জানতেও উৎসাহী ছিলেন বৈকি। ভাগ্যক্রমে এদেশে এসে যেসব ভিন্ন ভিন্ন ডাকবাংলোয় তিনি থেকেছিলেন  সেখানকার খানসামারা তাকে সত্যিসত্যি এই ডাকবাংলো মুরগি রান্না করে খাইয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যতটা একঘেয়েমির কথা তিনি শুনেছিলেন তেমন লাগেনি তাঁর বরং মুরগির মশলাদার মজার স্বাদই তাকে মুগ্ধ করেছিল।

বিশেষ কোনো রান্নার সঙ্গে একটি জায়গার নাম জড়িয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছুই নয়। চিকেন বা মাটন ডাকবাংলোর ক্ষেত্রেও এমনি হয়েছিল আমাদের দেশে।

অথচ রেসিপি তে আহামরিত্ব নেই। আমরা ছোটবেলা থেকে  মায়ের হাতে যেমন সাদামাটা মাংস খেয়ে আসছি তেমনই শুধু অভিনবত্ব সেদ্ধ ডিমের উপস্থিতিতে।  সেকালে প্রচুর তেল মশলা সহযোগে মাংসের কারি কিম্বা ট্যালট্যালে মাংসের স্টু…  সেদ্ধ আলু আর ডিম ফেলে দিয়েই তাকে গালভরা নাম ডাকবাংলো বলে ডাকা হতো।

উপমহাদেশের কোণায় কোণায় প্রায় প্রত্যেক ডাকবাংলোর চৌকিদারের হাতের স্টেপল খাবার হিসেবে মুরগির ঝোল হিসেবে যে পদটি মিলত উনিশশতকের শেষার্ধে এসে আলু আর সেদ্ধ ডিমের যুগলবন্দিতে সেই পদেরই  নাম দাঁড়ায় চিকেন ডাকবাংলো ।

 

ব্রিটিশরাজের কালেই মুরগি জনপ্রিয় হয়েছিল ভারতীয় রসনায়, কলকাতার কেতাদুরস্ত ক্লাবগুলিতে। চিকেন ডাকবাংলো, চিকেন ঝালফ্রেজি আর গোয়ালন্দ স্টিমার কারি এসব হল অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সব রান্না। সেসময় সরকারি বাবুদের সরকারি নানান কাজে দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হত । ডাকবাংলোর বাবুর্চি বাংলোর ধারেই থাকত পরিবার নিয়ে। থাকত দারোয়ান কিংবা মালির কুঁড়েঘর। তারাই বাবুদের জন্য দানা পানি দিয়ে বড় করত দেশি মুরগি। সযত্নে সঞ্চিত রাখত মুরগীর ডিমও।  

 

জঙ্গলডাঙার অন্তরমহলে ডাকবাংলো ছেড়ে এবার যাই স্বপ্নের মত এক জল সর্বস্ব দৃশ্যপটে। ধরুন সামনে বিশালকায় প্রবাহিণী, ক্রন্দসী, ছন্দসী পদ্মা। কখনও তার লাস্যময়ী সর্পিল গতি গ্রাস করছে নিজের পাড়। দেদার গিলছে  মাটি। কখনও আবার মূর্তিমতী করুণায় শান্ত হয়ে নিজের কোলে স্থান দিচ্ছে মানুষ বোঝাই, পণ্য বোঝাই  নৌকা, ভেসেল, স্টিমার, জাহাজ। নদীর বুক জুড়ে যাতায়াত অসংখ্য বিশালাকায় ভেসেলের। তাদের সব নামগুলিও কাব্যিক। ‘বনলতা’, ‘শাপলা শালুক’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘মাধবীলতা’ অথবা ‘ভাষা শহীদ বরকত’ কিংবা ‘বীরশ্রেষ্ঠ আমীন’ কেউ গোয়ালন্দ থেকে আরিচায় চলেছে তো কেউ আবার আরিচা থেকে গোয়ালন্দ অভিমুখে । “বদর বদর ভাই, গাজী গাজী বল ভাই”  বলে শুভ জলযাত্রার রওনা দিত তারা। দুপুরের সোনালি রোদের আঁচল লুটিয়ে পড়ত সর্বগ্রাসী পদ্মার গায়। এসবের সাক্ষী ছিল তার তীরে গোয়ালন্দঘাট।

 

ডাঙার ডাকবাংলোর মাংসের ঝোলের পর সেকালের এমন আরেক উৎকৃষ্ট মাংসের ঝোলের স্বাদ নিই  এবার। তবে সেটি জলের ওপর রান্না হত। ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত অথবা গরম হাতরুটির সঙ্গে জমে যাওয়া সে যুগের আরেক অভিনব পদ গোয়ালন্দ স্টিমার কারি। আবারও স্থান মাহাত্ম্যে কাটতি এ যুগেও। নদীর বুকে, জাহাজ ঘাটে রাঁধা বলে কথা।

মুরগীর সালনের কথা পাওয়া যায় সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ অনেক সাহিত্যিকের লেখায়। পদ্মাপারের শোভা ছাড়াও এই গোয়ালন্দ আরও বিখ্যাত হয় তার চিকেন কারির জন্য। ‘গোয়ালন্দ স্টিমার কারি’র নাম শুনলেই জিভে জল আসত বাঙালির। এটিই সেসময়ের স্টিমারের খালাসিদের নিজেদের জন্য রাঁধা মুরগির পাতি ঝোল। সরষের তেলে রান্না করা ঝাঁঝালো ও কষে লঙ্কা দেওয়া ঝাল ঝাল এই ঝোল দিয়েই সাপটে ভাত উড়ত অধুনা বাংলাদেশের গোয়ালন্দ থেকে কলকাতাগামী স্টিমার যাত্রীদেরও ।

কারও কারও মতে, এই রান্নার বিশেষত্ব হচ্ছে মুরগির ঝোলে কুচো চিংড়ি বাটা। অনেকক্ষেত্রেই চিংড়ি শুঁটকি দেওয়ার রেওয়াজ তবে টক দই বা টোম্যাটো পড়ত না। কুচোনো পেঁয়াজ, অনেকটা রসুনকুচি, নুন, হলুদ, সামান্য আদা কুচোনো আর লঙ্কা দিয়ে মুরগীর টুকরো মজবে কিছুক্ষণ। তবে সরষের তেলের ব্যাপারে উদার হতে হবে। এক চামচ চিনি দিতে হবে নয়ত জমবে না গোয়ালন্দ স্টিমার কারি।

চিকেন ডাকবাংলোর মতই খুব সাধারণ রান্নার এটাই হল অভিনবত্ব।  সব শেষে  এক মোচড় লেবু এর স্বাদের মূলে। গরিব মাঝি মাল্লারা কেউ  ঘি গরমমশলা নিয়ে ষ্টীমারে উঠত না। এই সাধারণ মালমশলা থেকেই তৈরি হয়েছিল অসাধারণ এই কারি।

 

দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে পশ্চিমবাংলায় চলে আসা অনেক ছিন্নমূল মানুষের মুখে শোনা যায় বাংলাদেশের পদ্মার স্মৃতি বিজড়িত নস্ট্যালজিক গোয়ালন্দ ঘাটের কথা । জাহাজের মাঝিমাল্লা, খালাসিদের হই হই করে রান্না করা, জিভে জল আনা অনবদ্য এই মুরগির ঝোলের গল্প করতে করতে এখনও তাদের নোলায় জল পড়ে ।

কে জানে? সেকালের মাঝিমাল্লারা হলুদ গুঁড়ো আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়োর বদলে শিলনোড়ায় গোটা হলুদ আর শুকনো লঙ্কা মিহি করে বেটে নিত বলে আর উৎকৃষ্ট মানের দেশি মুরগির জন্যই বুঝি অত স্বাদ হত এ রান্নার।

 

কলকাতা আর পূর্ববঙ্গের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ রক্ষায় এই গোয়ালন্দের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৮৬২ সালে প্রথম শিয়ালদা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালু হয় রেল চলাচল। আর, তার ন’বছর পরেই, ১৮৭১ সালে  কুষ্টিয়া থেকে রেলপথ সম্প্রসারিত হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। তখন থেকেই, ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য গোয়ালন্দ ছিল প্রধান ভরসা। এমনকি, গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্তও, কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ অব্দি যেতে ‘ঢাকা মেল’এর ওপরই ভরসা করতেন নিত্যযাত্রীরা।

তাই বুঝি রবিঠাকুরের নৌকাডুবি কিম্বা যোগাযোগ সব উপন্যাসেই এই গোয়ালন্দ এর নাম।

ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার আগে পূর্ব বাংলার মানুষকে এই গোয়ালন্দ ঘাট থেকে কোলকাতার ট্রেন ধরে ফিরতে হত। গোয়ালন্দ পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হতো পদ্মা। সেই গোয়ালন্দ ঘাটের রেস্টুরেন্টে, কিংবা একবার যাদের স্টীমারের রাঁধুনিদের হাতের মাংস রান্না খাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাদের মুখে এখনো লেগে আছে সেই রান্নার স্বাদ।

ভোজনরসিক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় এই গোয়ালন্দ চিকেন কারির অনুপম বর্ণনা আছে।

 

“ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলাইনি শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল। এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনো আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোঁদা-সোঁদা যে গন্ধটা আর সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতরে থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে। এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে-কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায় । পুরনো দিনের রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সবই রয়েছে, শুধু লক্ষ্য করলুম ভিড় আগের চেয়ে কম।”

 

“নাম শোনছেন গোয়ালন্দ? স্টিমার ঘাটে ভাতের হোটেল।

ইস রে সে কী ইলশা মাছের সোয়াদ – কী ভাই, শোনছেন নাম?”

 হ্যাঁ, এভাবেই অকালপ্রয়াত কবি পিনাকী ঠাকুরের লেখাতেও ধরা দিয়েছিল গোয়ালন্দ ঘাট। মেজাজে একটুও বদলায়নি গোয়ালন্দ ঘাট । পদ্মার তীরের এই জনপদ আজও নদী পারাপারের অন্যতম ঠিকানা।

 

ইতিহাস বলে সেই কোনকালে পর্তুগিজ, মগ, ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল এখানে। পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেসের নাম থেকেই ‘গোয়ালন্দ’ নামের নাকি উৎপত্তি । আবার, কারো মতে, স্থানীয় গোয়ালপাড়া থেকেই ‘গোয়ালন্দ’-এর জন্ম।

 

এই গোয়ালন্দ ঘাটের আশেপাশে এখনও দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য ভাতের হোটেল। পিনাকী ঠাকুরের কবিতাটির মতোই সত্যিই ঘটত অমন। হোটেলগুলিতে কেউ খেতে বসলেই, ভোঁ দেওয়া হত স্টিমার থেকে। কখনও কখনও হোটেলের কর্মচারীরা নিজেরাই ঘণ্টা বাজাত। আবার খাওয়া ছেড়ে ঝটিতি প্রস্থানও হত তাদের।

 

সারা বিশ্ব জুড়ে নদীর বহমানতার গল্পগুলো বুঝি এমনই হয়। নদী তার আপন খেয়ালে বয় আর তার পথচলায় জড়িয়ে নেয় অজস্র মানুষকে। দায়িত্ব নেয় জনপদের। কালেকালে গোয়ালন্দ আর তার পদ্মা নদীর সঙ্গে সেখানকার মানুষজনেরও এমনি এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর সেই সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধার দায়িত্বে ছিল এই গোয়ালন্দ স্টিমার কারি। এর মাহাত্ম্য এমনি যে ব্রিটিশ ভারতের রেলপথের অন্যান্য রুটেও ছড়িয়ে গিয়েছিল ‘গোয়ালন্দ স্টিমার কারি’ এর চাহিদা ও সুনাম। তাই বুঝি কলকাতার নামীদামী ক্লাবে এখনও অর্ডার করলে মেলে গোয়ালন্দ স্টিমার কারি কিম্বা চিকেন ডাকবাংলোর মত পদ।

 

 

তথ্যসূত্র

উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন সংবাদপত্র

প্রহর ডট ইন

বিবিসি, এনডিটিভি

প্রথম আলো,

 

 

 

One thought on “কলোনিয়াল ক্যুইজিনঃ জলে ও ডাঙায় মাংস রান্না । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

  • আপনার লেখাটা আমার এতো ভালো লেগেছে যে কী বলবো… আমি যেন একদম ঘুরে এলাম সেই সময়টা থেকে.. একদম ছবির মতন… নদীর পাড়ের কথা যখন পড়ছিলাম মনে হচ্ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস… আহা…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>