Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti boishak bihu

প্রবন্ধ: অসমে নববর্ষ উদযাপন । বাসুদেব দাস

Reading Time: 3 minutes

আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় অসমে নববর্ষ উদযাপন। অসমে নতুন বছর রঙ্গালি বিহু উদযাপন দিয়ে শুরু হয়। রঙ্গালি বিহু আর নতুন বছরের উদযাপন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। লোক সংস্কৃতি গবেষকদের মতে ‘বিহু’শব্দের মূলগত অর্থ আনন্দ, কৃষি সংস্কৃতির আনন্দ। মানুষ একা এই আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। আনন্দ প্রকাশ করার জন্য মানুষের সঙ্গ বা সমাজের প্রয়োজন। এই প্রয়োজন থেকেই আনুষ্ঠানিক উৎসবাদির সৃষ্টি হয়। উৎসব শব্দের মৌলিক অর্থ হল উৎপাদন। উৎপাদনের উদগ্র আগ্রহ থেকে মানুষ কৃষি প্রণালীর আবিষ্কার করে। আদিম কৃষিজীবী সমাজের লোকবিশ্বাস মতে গীত এবং বাদ্যের মূর্ছনায় যেভাবে প্রকৃতি চঞ্চলা হয়, তেমনই গীত, নৃ্ত্য এবং বাদ্যের প্রভাবে ফসলের উৎপাদন বৃ্দ্ধি হয়। বিভিন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে পরম্পরাগত ভাবে চলে আসা লোক-উৎসব সমূহের গোড়াতেও এই ধরিত্রীকে শস্য-শ্যামলা উৎপাদন বৃ্দ্ধি করার ভাবনা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ‘পয়চামনাম’, মহারাষ্ট্রের আখতীজ, উড়িষ্যার পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুর ‘পুঙ্গল’, কেরালার বিচু,পঞ্জাবের বৈশাখী, পশ্চিম বাংলার ‘নব বর্ষ’রাভাদের ‘খুকচী’, উত্তর ভারতের ষটপূজা প্রভৃতি লোক উৎসব অনুষ্ঠান সমূহ মূলত কৃষি বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত।   

প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে অসমিয়া রূপকথার প্রবাসী কন্যা ‘বরদৈচিলা’ ঝোড়ো বাতাস সহ মায়ের বাড়িতে ফিরে আসে।তার দুডানায় বৃষ্টির ঝারি,পরনে মেখেলা,দুচোখে বিদ্যুৎচ্ছটা। সঙ্গে বিহুর উপহার নিয়ে আসে-‘বিহুয়ান’-ফসলের ফরমান। সে আসবে বলে সারা চৈত্র মাস জুড়ে বাড়ি বাড়ি চলে নানা আয়োজন।প্রতিজন অসমিয়ার মনের ভাব তখন ‘বিহু বিহু লাগিছে গাত’।

প্রকৃতির বুকে পরিবর্তন আসে। জীর্ণ শীর্ণ গাছে পুরোনো পাতা ঝরে পড়ে,নতুন পাতা দেখা দেয়। প্রকৃ্তি নতুন সাজে সজ্জিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন গরু বিহু। সেদিন সকালবেলা মাহ,হলুদ বাটা দিয়ে গরুকে স্নান করিয়ে,বেগুন খাইয়ে দীঘলতি পাতা দিয়ে গরুকে প্রহার করে মন্ত্র পাঠ  করে গরুর শ্রীবৃ্দ্ধি কামনা করা হয়।–

 ‘দীঘলতি দীঘল পাত

 গরু কোবাও জাত জাত

 মার সরু বাপের সরু

 তই হবি বর গরু

 লাও খা বেঙেনা খা

 বছরে বছরে বাঢ়ি যা।’

প্রবাদ অনুসারে মাহ-হলুদ দিয়ে, গরুকে স্নান করিয়ে দীঘলতি পাতা দিয়ে প্রহার করলে গরু রোগমুক্ত হয় এবং শ্রীবৃ্দ্ধি হয়। বিকেলে গরু বাড়িতে নিয়ে আসা হলে নতুন রশি দিয়ে বাঁধা হয়।

পরের দিন মানুষ বিহু। বিহু অসমিয়া জীবনের ঐক্য এবং সম্প্রীতির প্রতীক। হুচরি বিহুগীতের অর্ন্তভুক্ত। বাড়ি বাড়ি হুচরি গেয়ে গৃহস্থ কুশলে থাকুক বলে আশীর্বাদ দেওয়াই গীতের উদ্দেশ্য। হুচরি গীতের শেষে গৃহস্থ টাকা, পান-সুপুড়ি, গামোছা,শরাই দিয়ে হুচরি গায়কদের সম্মান জানায়। বিহু হুচরি দলকে টাকা পয়সা দিয়ে সমাদর করা ছাড়া পিঠা, চা আদি দিয়ে অ্যাপায়ন করাটা অসমিয়া সমাজ ধর্মের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করে।  

অসমের জাতীয় উৎসব রঙ্গালি বিহু। পয়লা বৈশাখ থেকে পনেরো দিন সমস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ঢোলের বোল এবং পেপা বাঁশির সূর আশেপাশের পাহাড়ের গায়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে বাতাসে তরঙ্গ তোলে।উৎসব মত্ত তরুণ তরুণীরা তখন হয়ে পড়ে ‘বিহুবলিয়া’-বিহুপাগল।প্রতিটি বাড়ির শোভা তাঁতশাল,তাঁতশালের শোভা সুন্দরী কন্যা। তাঁতশালের টানাপোড়নে সে বুনে তোলে নক্সাকাব্য। তাই নাম তার ‘শিপিনী’। কোনো যুবতী মেয়ে তাঁতে কাপড় বুনতে না জানা অসমে লজ্জার কথা। কিন্তু এই তাঁত শালও বিহুতে অচল, তাঁতিনী বিমনা। সে গান ধরে –

অতিকৈ চেনেহর মুগায়ে মহুরা

অতিকৈ চেনেহর মাকো

তাতকৈ চেনেহর বহাগর বিহুটি

নেপাতি কেনেকৈ থাকো।

যুবতী গান ধরে –

বিহু মারি থাকিবার মনে ঐ লাহরী

বিহু মারি থাকিবার মন

বিহু মারি থাকোতে পলুয়াই নিনিবা

ভরিব লাগিব ধন।

(মন বিহু নাচে মত্ত হয়ে থাকতে চায়, কিন্তু দেখ নাচতে গিয়ে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ো না, তাহলে আমাকে খেসারত দিতে হবে)

যুবক তখন তার উত্তরে গেয়ে ওঠে –

কায চাপি চাপি নাহিবি নাচনি

হাতত ঢোলর মারি আছে-

(নাচতে নাচতে বেশি কাছে চলে এসো না, আমার হাতে ঢোলের কাঠি রয়েছে)

বিহু একান্তই ইহ জাগতিক। তার মানবিক প্রেম রাধা-কৃষ্ণকে ভর করে স্বর্গের দিকে যাত্রা করেনি। তবে উন্মুক্ত প্রান্তরের সেই উদ্দামতা আজ গৃহপ্রাঙ্গণে সীমিত হয়ে এসেছে। তবু বিহুর দিন আজও নাচে গানে দুরন্ত শৃঙ্গাররসে ভরপুর আদিম আরণ্যক মদিরা যেন প্রতিটি মানুষ তাদের শিরায় শিরায় অনুভব করে।

প্রকৃতির লীলাভূমি অসম।নীল পাহাড় ও সবুজ উপত্যকায় ঘেরা অসমের বুকে জড়িয়ে রয়েছে সাতলহরী হারের মতো ব্রহ্মপুত্র ও তার অসংখ্য শাখাপ্রশাখা।অসমে ব্রহ্মপুত্রকে বলা হয় লুইত। এই লুইত অসমিয়া কাব্য সাহিত্যে চিরপ্রবাহমান।–

লুইতর বালি বগী চকে চকি

কাছই কণী পারে লেখি

গাতে জুই জ্বলিছে সরিয়হ ফুটিছে

ধনক পানী ঘাটত দেখি।

(ব্রহ্মপুত্রের ঝিলমিল বালিচর, সেখানে গোপনে কাছিম গুণে গুণে ডিম পেড়ে যায়, জলের ঘাটে প্রিয়কে দেখে আমার সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ হচ্ছে।)

প্রকৃতির পটভূমিতে মানবিক প্রেমের এমন সমন্বয় সাহিত্যে সত্যিই বিরল। এভাবেই দুই একটি কথায় রেখায় অসংখ্য ছবি ফুটে উঠে বিহু গানে। ধীরে ধীরে প্রকৃ্তির পটভূমিও বদলে যায়-আসে রেলগাড়ি, জাহাজ, চা বাগান ইত্যাদি।–

উকিয়াই উকিয়াই রেলগাড়ি চলিছে

রঙ্গিয়াত গোধূলি হল

তোমাক আনিম বুলি বরে ঘর সাজিলো

গরুবন্ধা গোহালী হল।

(সিটি দিয়ে রেলগাড়ি চলে গেল।রঙ্গিয়া জংশনে সন্ধ্যা নামল। তুমি আসবে বলে ঘর বেঁধেছিলাম-সেই ঘর গোহাল হয়ে উঠল। ব্যর্থ প্রেমের এক অসাধারণ ছবি।)

ধর্ম প্রভাব মুক্ত ইহ-জাগতিকতা ও শ্রমশীল জীবনের প্রতি অসীম মমতা, এটাই হল বিহুর দর্শন। ধর্মীয় আচার বিচার, দেবদেবী,উপদেবতা বা অপদেবতার উৎপাত থেকে বিহু পুরোপুরি মুক্ত। বর্ণহিন্দু সমাজের বিধিনিষেধ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই হল বিহুর প্রধান উপজীব্য। সামন্ত সমাজ পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে আদিম ট্রাইব্যাল  ও অর্ধ ট্রাইব্যাল সমাজে বসুমতীকে উর্বর করার জন্য যুবক-যুবতীর যৌথ নৃ্ত্য গীতের উপর এল নিষেধাজ্ঞা। প্রণয় ও পরিণয়ের মধ্যে এল প্রাচীর।কিন্তু সমাজপতিদের শাসন সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। জাতিকুল, ধর্মীয় বৈষম্য, নারী পুরুষের সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যূঙ্গ বিদ্রূপ ও তির্যক মন্তব্যে বিহুগীত পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। সমাজের যৌতুক প্রথাকে নিয়ে বিহুগানে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখা যায়।–

চরায়ে, চরায়ে আলচখন পাতিলে

গছর গুটি খাবর মন 

আইনো কৈ বোপায়ে আলচখন পাতিলে

আমাক বেচি খাবর মন।

(পাখিতে পাখিতে পরামর্শ করে গাছের ফল খাবার জন্য। মা-বাবা পরামর্শ করে আমাকে ‘বেচে খাবার জন্য’।)

আহোম রাজত্বকালে স্বর্গদেউরা রংঘরের প্রাঙ্গণে বিহু রাজকীয় উৎসব হিসেবে পালন করত। বহাগ (বৈশাখ) বিহুতে বিভিন্ন খেলা, বিহুগীত,বিহুনৃ্ত্য, হুচরি, স্থানীয় গীত এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রজাদের আমোদ আহ্লাদের ব্যবস্থা করত। রংঘরের প্রাঙ্গণ বহাগ বিহুর সাতদিন আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠত।

এভাবেই নববর্ষ আর বিহুর আনন্দ মিলে মিশে কখন যেন একাকার হয়ে গেছে।এখানেই তো যে কোনো উৎসবের সার্থকতা। আমরা এই উৎসবের দিনে আমাদের ক্ষুদ্র আমির গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ‘বড় আমি’র সঙ্গে অনায়াসে মিশে যাই।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>