Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti boishakh ‍article rob

প্রবন্ধ: বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ, বাংলাদেশী ও বাংলা নববর্ষ ১৪২৮

Reading Time: 3 minutes

বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশও বাংলাদেশী এই শব্দগুলোর আছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস। এগুলিআমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা নববর্ষেরও আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে সেসব নিয়ে কথা বলার আগে কিছু গোড়ার কথা বলে নেওয়া দরকার। ধারণা করা হয়, বৈদিক যুগে প্রাচীন বাংলার পত্তন হয়েছিল এবং এই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত বিভিন্ন দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ব্রম্মপুত্র-পদ্মা-মেঘ্না- যমুনা বাংলাকে ভারতের বাকি অংশ থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। ফলে বাংলাকে টিকে থাকতে হয়েছ নিজস্ব শক্তিতে। যতদূর জানা যায়, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে বাংলায় সভ্যতার ক্রম-বিকাশ শুরু হয়। এ তো গেল ভৌগলিক বাংলার কথা। বাংলা ভাষা (বাঙলা, বাঙ্গলা, তথা বাঙ্গালা নামগুলোতেও পরিচিত) একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা[1]।বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরের পুরনো। চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শন। বাংলা ভাষা মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। শুধু তাই নয়, এ ভাষার এমনই শক্তি যে তা এক ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এক্ষত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনার মূলভিত্তি ও শক্তির উৎস। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মতোই বাঙালির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়।

বাঙালি, দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী আদিতম মানব গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে একটি। অস্ট্রিক ও আলপীয় জনগোষ্ঠী মানুষ। যারা মূলত দ্রাবিড় ও আলপীয় উপাদানে গড়া। এসব মানুষ মূলতঃ কৃষিজীবী যারা পশুপালন, বৃক্ষ ও বয়ন শিল্পকে কেন্দ্র করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করত। এসব জীবনাচরণের এক বিশেষ অঙ্গ হিসেবে গড় উঠেছে বাংলা সংস্কৃতি। বাংলার সংস্কৃতি বাঙালি জাতির এক গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রকাশ। বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ চেনা যায় বাংলার সংস্কৃতিকে দেখে। কিন্তু সংস্কৃতি বিষয়টির সংজ্ঞা কোনো সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ নয় বরং তা অত্যন্ত ব্যাপক। আজ আমরা খুব ভালো করেই জানি একটি জাতির ইতিহাস, ভাষা,  সার্বভৌমত্ব, চিন্তা-ভাবনা, শিল্পকলা, সাহিত্য তথা যা কিছু সৃজনশীল সব কিছুই তার সংস্কৃতির অন্তর্গত। বাংলার প্রাকৃতিক এবং সামাজিক জীবনের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এখানকার সাংস্কৃতিক জীবন-ধারার ক্রমবিকাশ ঘটেছে।

বহু ধর্মের মানুষের মেল্টিং পট এই বাংলা।  হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের বাস এখানে। কালের বিবর্তনে ভারত বর্ষের অবিভক্ত বাংলা হয়েছে খণ্ড-বিখণ্ড। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম ভারতের অন্তর্ভূক্ত থাকলেও পূর্ববাংলা হয়ে পড়ে ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বাংলা ভাষা সাময়িকভাবে দিকভ্রান্ত বাঙালিদের পথ দেখায়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্যে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যু্দয় হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ-কথা সত্য, একদিন যে ভাষা-সংস্কৃতি ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়, সেই পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক এই পরিচয়কে বড় করে তোলার অপতৎপরতা শুরু হল। পরিকল্পিতভাবে বাঙালি না বাংলাদেশী বিতর্ককে সামনে আনা হল জাতিকে বিভক্ত করার জন্যে। এ বিভক্তি এমন পর্যায়ে গেল যে শুরু হল দীর্ঘ  সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে আজ যখন পিছনে তাকাই তখন দেখি, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে এই লড়াইয়ে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা, ভাষা ও সংস্কৃতিকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজে। সে যুদ্ধ আজও অব্যাহত রয়েছে। একদিকে মৌলবাদী হেফাজতী গোষ্ঠীর দেশটাকে পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা, অন্যদিকে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন সমান ভাবেই অব্যাহত আছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ, একুশে উদযাপন, বইমেলা হয়ে উঠেছে বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশের  সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা। এগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন  প্রজন্ম অংশ নেয় নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপে। পাশাপাশি বিদেশী সংস্কৃতির নিউ ইয়ার্স, ভ্যালেটাইন ডে উদযাপনের জন্য এগিয়ে আসে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত একটি শ্রেণী। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোও প্রমোট করছে এমন অনেক উপাদান যা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এসবের মিথষ্ক্রিয়া থেকে বাংলার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি কতটা এগিয়ে যাবে তা সময়ই বলবে। তবে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা জোরদার করা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

নানাদিক দিয়ে অগ্রগতি সাধিত হলেও বাংলাদেশে কৃষির গুরুত্ব আজো অপরিসীম। বাংলা নববর্ষ এলে তা প্রতিফলিত হয় কৃষিজীবী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। হালখাতা, বাংলা সনের সাথে কৃষির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এসব কর্মকাণ্ড কৃষিকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। আজ জিডিপিতে কৃষির অবদান শতকরা বিশভাগ। প্রায় সত্তুরভাগ লোকের কর্মসংস্থানের উৎস এইকৃষি। পাশাপাশি, গ্রামে-গঞ্জে-শহরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের দিন তাদের পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। প্রাচীনকাল থেকে এখনো এ অনুষ্ঠানটি বেশ জাক-জমকভাবে পালিত হয়ে আসছে।এর ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও অকৃষি খাতে ব্যবসা বাণিজ্যের অগ্রগতিও লক্ষ্যনীয়। বৈশাখী মেলা গুলোতে আবহমান গ্রাম-বাংলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি পরিচিতি ফুটে ওঠে। বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগানে মেলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। যাত্রা, নাটক, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা ইত্যাদি মেলায় বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। বিগত বছরগুলোতে অবশ্য এসব কার্যক্রমে অনেক ভাটা পড়েছে। তারপরেও বাংলা নববর্ষে সারা জাতি যেন প্রাণ থেকে জেগে ওঠে।

কোভিড-১৯ বাংলা নববর্ষ উদযানের ক্ষেত্রে এক অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। কোভিডের কারণে সারাদেশে মেলা অনুষ্ঠিত হতে না পারায় এই মেলাকে ঘিরে খাবার পোষাক ও হস্তশিল্পসহ নানা ব্যবসা হয় প্রতিবছর তাতে ধস নেমেছে। তবু আশা করি,বাংলা নববর্ষআবার আমাদের জাতীয় জীবনের সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

[1]উইকিপিডিয়া, মুক্তবিশ্বকোষথেকেরর

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>