| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতীর বর্ষবরণ ১৪২৮

ইরাবতী ভ্রমণ: চারখোল-কোলাখাম । শুভময় পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

 

ঠিক দুক্কুর বেলা! নাঃ, ভূতে ঢেলা মারেনি, কিন্তু সেরকম হলেও মন্দ হতো না ; অন্ততঃ শরীরী বা অশরীরী কারোর একটা অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত! কেউ কোত্থাও নেই… এই ভর দুপুরে বাইরে শরতের রোদ্দুর, আর এখানে, এই জঙ্গলে অন্ধকার ঘন হয়ে চেপে বসেছে I বৌ, বাচ্চা নিয়ে আতান্তরে I

 

মহালয়ার আগের দিন; কাশ, তিস্তা, মহানন্দা স্যাংচুয়ারি, সাদা মেঘের ভেলা; ডুয়ার্সের সবুজ চিরে কাঞ্চন কন্যায় নিউ মাল জংশনI চারখোলের ব্লু-পাইন রিট্রিটের লোকজন বলে দিয়েছে লোলেগাঁও হয়ে চারখোল যেতে I গাড়ি, তার ড্রাইভার মস্তু, চালসার ছেলে, কিন্তু চারখোল যায়নি I হালকা জলখাবার খেয়ে রওনা দিয়েছিলাম শরতের নীলে I চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গরুবাথান, ফাগু, আপার ফাগু, ফাফরখেতি আর ঢেউ খেলানো সবুজ I নদীতে, সবুজে, ফুলেতে, ছায়াতে মাতোয়ারা হয়ে লাভা; নিশ্চিন্তে, নিরুপদ্রবে I  লোলেগাঁও ও কোনো অশনিসঙ্কেত দেয়নিI লোলেগাঁও বাজার পেরিয়ে ওপরে উঠে ঢুকেছিলাম এই জঙ্গলে! সেই থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে চলেছি I ক্রমশঃ অন্ধকার ছুঁয়েছে আমাদের, বাচ্চাদের কলকলও থেমে গেছে I মস্তুও কিছু ঠাহর করতে পারছে না I রাস্তা ক্রমশঃ সরু হচ্ছে, ডালপালা গাড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছে, নেমে চলেছি যেন অনন্তকাল, সামনে কোথায় শেষ কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা I অবশেষে নামতে নামতে দূরে নিচে ডুয়ার্স দেখা দিলো I আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়েকে পেলাম কাঠকুটো নিয়ে চলেছে I

 

তারপর আর কি? রাস্তা পেলাম, স্বস্তি পেলাম, পৌঁছে গেলাম I পাহাড়ের ঢাল দিয়ে এঁকেবেঁকে একদম পাহাড়ের মাথায়, নিচে বাগরাকোট থেকে সোজা রাস্তা উঠে এসেছে চারখোল পর্যন্ত; এ রাস্তা দিয়ে এলে কতই না সহজ হতো! ছোট্ট টিলার মাথায় ব্লু পাইন রিট্রিট; একদম স্বপ্নমাখা; ডানদিকে মূল বিল্ডিং, ওপরে ডাইনিং আর কিছু থাকার ঘর… এগিয়ে এলে মাঠ, তার দিকে মুখ করে ছোট ছোট কটেজ I ব্যাস, আর কিচ্ছু করার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই I মাঠ ভরা জানা-অজানা ফুল, একটা পায়ে চলা পথ ধীরে ধীরে ওই টিলার মাথায় উঠে গেছে, দুটো ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা, আর সামনে ধুধু নীল আকাশ, আর কাঞ্চনজঙ্ঘা I ধীরে ধীরে সন্ধ্যে এলো, একদম পাহাড় বেয়ে I আকাশ লালে লাল, রঙের ছোপ আমাদেরও মনে I পূর্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢেকে গেছে I কিচকিচ কিরকিট পাখির ডাকে ক্রমশঃ এলো রাত I ভোরে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢাকা, শিশির ঘাসে, গাছে, মাঠে I কুয়াশা ফুঁড়ে আবির্ভাব কাঞ্চনজঙ্ঘার I শুরু হলো ম্যাজিক; পাহাড় মাখলাম, বুক ভরে নিলাম গন্ধ, গড়াগড়ি খেলাম মাঠ জুড়ে; মনোজগৎ তোলপাড় করে সারাদিন ঘর করলাম কাঞ্চনের সাথে I কাঞ্চনকে সাক্ষী রেখে অলস সময়, সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে আবার সন্ধ্যা I রাত এলো, এলো মন খারাপ, কাল ছেড়ে যাবো I 

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে চারখোল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে লোলেগাঁওয়ের রাস্তা এড়িয়ে ডানদিকে বেরিয়ে এলাম I

চারখোলের পাহাড়কে পাক দিয়ে নামতে নামতে ঘন জঙ্গল পেরিয়ে নদী টপকে এসে পড়লাম কালিম্পঙ-লাভার রাস্তায় I পাইন বনে মেঘ ঘনালো I লাভায় আবার রোদ্দুর, বাঁকের মুখে মনাস্ট্রি I মনাস্ট্রি ঢোকার মুখেই বাধা, ঢোকা বারণ I তর্ক চলছে লামাদের মধ্যে I জীবনে প্রথম দেখা এরকম দৃশ্য I চাতাল জুড়ে গোল হয়ে বসে একদল পুঁথিপত্তর নিয়ে, প্রত্যেকের সামনে একজন করে দাঁড়িয়ে I দাঁড়িয়ে যিনি উনি বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন, আর বসে যিনি, উনি পুঁথিপত্তর দেখে উত্তর দিচ্ছেন; আর তুমুল তর্ক হচ্ছে I ভাষা না বুঝলেও তর্ক বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা I খানিক পরে রোল রিভার্সাল I তারপর ওনারা মনাস্ট্রির ভেতরে অদৃশ্য হলেন, আমরা ঢুকলাম I সুদৃশ্য মনাস্ট্রি দেখে আবার কোলাখামের রাস্তায় I

 

সোজা মনাস্ট্রিকে বাঁদিকে রেখে চৌদাফেরির দিকে, যেখান থেকে নেওড়া ভ্যালি ট্রেক শুরু হয় I যেতে যেতে বাঁয়ে বেঁকে নিশ্ছিদ্র জঙ্গলে, ডানদিকে চলে গেলো চৌদাফেরির রাস্তা I অন্ধকারে পথ চলা, বাইরে তখন মেঘ I চলতে চলতে হঠাৎ পথের বাঁকেই, বেতালের ডেনকালীর অরণ্যর মতো কাঠের গুঁড়ি দিয়ে গেট, ‘নেওড়া ভ্যালি জঙ্গল ক্যাম্প’, পাহাড়ের গায়ে থাকার ঠিকানা I অবাক চোখে সবুজে হারিয়ে যাওয়া I জঙ্গলের মধ্যেই ধাপ কেটে কেটে কটেজ, খাবার ঘর, রান্নাঘর I বাঙালি ভদ্রলোক, জন্ম কর্ম পাহাড়েই, স্বপ্নের আস্তানা I কটেজের ভেতরে সিঁড়ি, ওপরে ছোটবেলার রূপকথার মতো থাকা I সামনে বারান্দা, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আকাশে চোখ রাখার I খাওয়া-দাওয়া রাজকীয় I দুপুর গড়িয়ে বিকেল I নীল খামে চিঠি ডাকবাক্সে I সবুজ কাগজে রংবেরঙের কালির ছোপ I জল চুঁইয়ে রং মাখামাখি I হেঁটে বেড়ানো চুপিচুপি, পাখির রাজ্যে I এলাচ গাছে, পাইন, ওক, নাম-না-জানা অন্ধকারে সারাদিন পাখির কিচির-মিচির I রাত এলো ফিসফিসিয়ে, মেঘ এলো, মেঘের কোণায় জল এলো… চুপিসারে ভিজিয়ে দিলো সোঁদা গন্ধকে; ভিজলো সবুজ, ভিজলো কালো অন্ধকার, আমূল ভিজলাম অন্ধকার বারান্দায় আমরা, পোকায় ছেয়ে গেলো বারান্দার কাঁচI ঘুমিয়ে পড়লাম টুপটাপ শব্দের সাথে I

 

সকাল ভিজিয়ে দিলো আবার; হালকা নীল, গাঢ় নীল কাঞ্চনজঙ্ঘার আভাস দেখিয়ে আকাশ মেঘের চাদর টেনে নিলো সকাল সকাল I বেলার দিকে এলো আবছায়া রোদ্দুর, হেঁটে ঘুরলাম ছবির মতো গ্রাম, কোলাখামI চাঙ্গে ঝর্ণা যাওয়ার রাস্তা ভূমিকম্পে ভাঙা; ৬ কিমি মাত্র, দুপুরের দিকে হেঁটে যাবো কথা ছিলI হলো নাI মেঘ জমলো গাছের মাথায়, নীলচে কালো আকাশ জুড়েI ছবির মতো কোলাখাম ভিজলো নিশ্চিন্ত বর্ষায়, এই শরতের মেদুর বেলায়I পরদিন ফেরাI চারখোল রোদ্দুরে ওম দিয়েছিলো, কাঞ্চনজঙ্ঘা শুয়েছিল পাশে I মনটা কি একটু খারাপ ছিল? কুয়াশা মেঘেদের জন্য? বুঝেছিলো কোলাখাম I তাই বোধহয় ভিজিয়ে দিলো অম্লানI টাটকা, তাজা সবুজ মেখে ফিরে এলাম I

‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে;

ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

জরুরি তথ্য:

** ব্লু পাইন রিট্রিট, চারখোল : কটেজ : ২৫০০ টাকা দুজনের, মূল বিল্ডিংয়ে ঘর : ১৫০০ টাকা, দুজনের গাড়ি ভাড়া, বড় গাড়ি মোটামুটি ১২কিমি/ লিটার I  

** নেওড়া ভ্যালি জঙ্গল ক্যাম্প, কোলাখাম : ভাড়া : থাকা, খাওয়া নিয়ে দুজনের (সাথে ছবছরের ছোট বাচ্চার ছাড়) : তিনটে কটেজ ৫৫০০ টাকার, দুটো কটেজ ৬৫০০ টাকার, আর একটা কটেজ ৭৫০০ টাকারI এছাড়াও আরো অনেক থাকার জায়গা আছে, গ্রামের আশেপাশে I তবে জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের গায়ে এই একটিই I

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত