একগুচ্ছ কবিতা । সাইফুল ভূঁইয়া
মোর্ফিনের স্মৃতি
কাউকে বিদায় বলছি না
মরে ও যাচ্ছি না
পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে, জল পালিয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র যাচ্ছে হিমালয়ে
আমি কিছু করছি না…
হ্যালো বলছে টেলিফোন
ইনবক্স উপচে পড়ছে
জবাব দিচ্ছি না, শব্দ করছে দরজা, তেলাওয়াত হচ্ছে
নিঃশ্বাস বন্ধ হচ্ছে না…
চুল ঘুমাচ্ছে, হাত ঘুমাচ্ছে
ঘুমাচ্ছে স্বপ্ন, ঘুমাচ্ছে ঠোঁট
জেগে আছে স্তন, কিছুই বলছে না
তাঁকে ভালোবাসি না, সে জানে না…
ঘা আছে, ক্ষত আছে
রক্ত ঝড়ে পড়ে গেছে
গলে পড়ছে পুঁজ, লেপ্টে আছে ব্যথা
মোর্ফিনের স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছি না…
জিতে যাচ্ছে কেউ
কেউ করছে আত্মসমর্পণ
জানালায় উঁকি দিচ্ছে, থুতু ফেলে নিজের নাম লিখছে
আমার স্বপ্ন হোটেলে ঘুমাচ্ছে, ডেকে তুলছে না কেউ…
সতের বাড়ি
এই জীবনে সতেরটা বাড়িতে বাস করেছি
কিন্তু মনে নাই কতটা শার্ট পরেছি
কতটা হাফপেন্ট
সতেরটা বাড়িতে আমার সতেরটা আমি থাকি
একজন হাফপেন্ট পরে ঘোড়াউত্রায় ডুব দেয় আর উঠে না
আরেকজন মাধবপুর থেকে হেঁটে হেঁটে
হরিনবেড় বাজারের পথে নেমে গন্তব্য ভুলে যায়
একজন কাজিরদেউরি মেসবাড়িতে দরজা বন্ধ করে
সুইসাইড নোট লিখে আর কেটে ফেলে বারবার
চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যালয়ের আলাওল হলে
একজনের চোখবাধা পিঠমোড়া হাতবাধা
তার কানে বাজে ট্রলারের ইন্জিনের শব্দ
আর নাকে লেগে থাকে বঙ্গোপসাগরের ঘ্রাণ
এই সতের জনকে যে নারী ভালবাসবে
আমি শুধু তাকেই ভালবাসবো
কিন্তু এক নারী দুজনকে ভালবাসতে পারে
পাঁচ জনকে ভালবাসতে পারে
সতের জনকে ভালবাসবে এমন দ্রোপদী আজও পাইনি
তাই প্রকৃতপক্ষে আমি কাউকেই ভালবাসিনি
ধ্রুব সাদিক আর কাক
মাথার ভিতর মাঝরাতে ডাকছে কাক
নখর দিয়ে মগজ ছিঁড়ছে আর খাচ্ছে
কোন কোন কাক জেগে থাকে সারারাত
লাশটানা গাড়িতে ছিলাম নয়জন
অপেক্ষায় ছিল সমুদ্র
জাহাজ থেকে পতেঙ্গায় নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস
সৈকতে দাঁড়িয়েছিল ফুটবল আর সূর্য
বালিতে নাম লিখে করতে পারিনি শেষ
ষ মুছে হয়ে গেছি “মানু”
লাশের গাড়িতে ঢুকে গেছে দীর্ঘশ্বাস
এই নগরে অমাবস্যা আমরাই এনেছিলাম
দীর্ঘশ্বাস আর সমুদ্র আমাদের ঐশ্বর্য
ভাষার নাম দীর্ঘশ্বাস
কাক আর ধ্রুব সাদিক মাঝরাতের ফোনালাপ
আমাকে প্রতিরাতে খেয়ে ফেলে ধ্রুব সাদিক আর কাক
ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি
আগুনের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি
আমার কাছে কেউ আগুন নিতে আসে না
একদিন আমার উঠানেও ছিল আগুন
এইসব গোধূলির দিগন্ত আমার আগুনে পোড়া
আগুনের গাড়ি আর লাশের গাড়ি ঘুরছে এদিক-ওদিক
আমার কাছে একটুও আগুন নাই
তবুও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি
আগুনের প্রয়োজন হলে ওরা মিছিল খন্দকারের কাছে যাক
লাশের প্রয়োজনে আসুক আমার কাছে
আমার কাছে একটাই লাশ আছে
শিশু
… আর আমি একথা সকলকে জানাচ্ছি
যে শিশুর জন্ম হতে পারতো কিন্তু যার জন্ম হয়নি
সে-ও কোথাও আছে জোনাকি, তারা অথবা ঘাসফুলে
শিহিরকণা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার পথে।
যে শিশুর জন্ম হওয়ার সম্ভব কিন্তু যার জন্ম হবে না
সে-ও থাকবে আমার চলার পথে, যেন আমার বন্ধু রামেশ্বর
যে বন্ধু মুখে মুখে মেলাতো জটিল পাটিগণিত
সে পথে কথা বলে তাঁর খুলি উড়ে বেড়ায় বিলাপ
যে শিশুর জন্ম হবে না তার কোমরে আছে
একটি ছুরি, যা দিয়ে তাকেই হত্যা করা হয়েছে
সে-ই ছুরিতে রয়ে গেছে আমার আঙুলের ছাপ
রেডিও পাঠ করছে মৃত্যু-সংবাদ দরুদ কালাম।
যার জন্ম হয়নি যে শিশু জন্মাতে পারতো
তারও হোক বেহেস্ত নসিব
তার সাথে তার মা যাবে বেহেস্তে
আমি কোথাও যাবো না….
যে শিশুকে মায়ের কোল থেকে চুরি করতে পারতাম
তার গর্ভ-রজ্জু আমার গলায় পেঁচানো আছে
অনন্তকাল ঝুলে থাকবো মায়ের জরায়ু থেকে
যে শিশু জন্মাতে পারতো সে-ই উদ্ধার করবে…
যে পথ আমাকে ডাকে তাতে খেলা করছে
অসংখ্য শিশু পতঙ্গ, হেসে হেসে গল্প করছে
আমার বাবার কংকাল আর মিষ্টি তামাকের ঘ্রাণ
আমার পথে হাঁটে সেসব জন্ম না হওয়া শিশু।
যে শিশুর জন্ম হয়নি তার মাকেই ভালবাসি
অবহেলা আর হত্যা করি
যে শিশুর জন্ম হয়নি তার মা, তার আত্মা
আর কঙ্কাল আমাকে ভালবাসে, ঘৃণা করে
দেখতে চায় পরাজয় দেখতে চায় বিজয়
যার জন্ম হয়নি সে ভেসে যায় অশ্রুর নহরে
প্রেমে পড়েছি এক মৃত্যুর
যদি সবাই ঘুমিয়ে পড়ে অথবা
সবাই মরে যায় কীভাবে জানবে
কীভাবে মরে যাচ্ছি
পরিত্যাক্ত করে দিয়েছি দুটো পা
দৃষ্টির শেকল দিয়েছি কেটে
যদি ঘুমিয়ে পড়ে সবাই
কে জানবে
প্রেমে পড়েছি এক অন্য মৃত্যুর
প্রেমের খবর সবাই জানুক
যেমন উঠেছে চাঁদ
যদি সবাই মরে যায়
কে দেখবে এ্যারপোর্টরোডে
বিষন্ন গাড়ীর সারি
কালো শাড়ির সেল্ফি
কে জানবে ফ্লাইওভারগুলো
প্রেমে পড়েছে করছে কুর্নিশ
কেন বনশাইগুলো স্পর্শ করছে
এয়ারপোর্ট হোটেলের দশতলা
কে জানবে, যেনতেন শব্দের সাথে
কথা বলেনি এই জিহবা আলজিহবা
যদি সবাই মরে যায়
কে জানবে যেনতেন চুম্বন-স্মৃতিতে
কেঁদে উঠেনি এই ঠোঁট
মৃতের অন্তর্বাস
জিজ্ঞেস করবো না…
কোন্ গাঁ থেকে নেমেছে এই নদী
কোন্ সন্ধ্যার ধোঁয়া লেগে আছে দেহে
নাম না শুনে, পরিচয় না জেনে
খেলেছি ভালবাসা-বাসি
শুধু তাঁর ছায়া লাগে চেনা চেনা।
প্রণয়ের রক্ত থেকে উঠে এসেছে
শয্যায় তাঁকে পেয়ে চোখ থেকে
উড়ে যায় একশত রেলগাড়ি
হুইসেল দিয়ে চলে গেছে পানামার জাহাজ
কর্ণ-কুহরে গান গায় মাতাল নাবিক।
জিজ্ঞেস করবো না…
কোথা হতে রুটি নেমেছে রেললাইনে
চাঁদপানা কপালে রক্তের টিপ
আর নিজের পরিচয় না জেনে
ফিরিঙ্গি বাজারে উঠেছি গান-গাওয়া নৌকায়
শুয়ে থাকি মৃতের অন্তর্বাস পরে।
বাড়িয়েছি হাত নক্ষত্রের দিকে
যতদুর গিয়েছে অন্ধকার
তারও পরে যেখানে তুমি
তোমাকে পেরিয়ে আমার দীর্ঘশ্বাস
তোমাকে বুঝার আর কোন পথ জানা নেই