| 29 নভেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইরাবতীর কথা (পর্ব-১২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির ১২তম পর্ব।


 সরকারি ভবনের দশতলায় বসেন মন্ত্রী অনন্ত গোঁসাই। খুব বড় কোনো বিভাগের মন্ত্রী না হলেও তাঁর অঞ্চল থেকে আগত লোকজনের সংখ্যা অসংখ্য। যখনি সে আসে এই দৃশ্য দেখে। তাকে যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বুঝতে পারলো। বাইরের লাল আলো জ্বলছে। মানে মন্ত্রী এসে ভেতরে ঢুকে গেছেন। সে ভিজিটার রুমে গিয়ে নিজের কার্ড জমা করে করিডোরের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

এখান থেকে বাইপাশের ভেড়িগুলো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আর তার পিছনে সবুজ গাছেদের সারি। সেদিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল ইরাবতী। ভিতরের জানলাগুলো কখনো খোলা হয় না বলে দিন রাত টিউব জ্বলছে। অথচ জানলাগুলো খুলে রাখলে অনন্ত আকাশ আর আলো দুইয়েরই সহবস্থান ঘটত। নিজের মনেই ভাবছিল সে। দূরে একটা ডিঙি। কোনো দিকে না তাকিয়ে ঢেউ ভেঙে সে আপন খেয়ালে ভেসে চলেছে অজানার দিকে। তার মনে হল, ওই তরীর মাঝিকে সে চেনে। সে মনে মনে বলে উঠল , ‘ ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে? বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে…’।

  এই তরীতে তার ঠাঁই নেই। তাকে একলাই পড়ে থাকতে হবে ধূলি, বালি মাখা পুতিগন্ধময় সমাজে। পরমুহুর্তেই বেদভ্যাসের কথা মনে এল। কেউ কারোর জীবন সুন্দর করে দিতে পারে না। নিজেই মনের আলোতেই নিজেকে বিকশিত হতে হয়।

তার মন পরম প্রশান্তি ভরে গেল।      

ম্যাডাম, স্যার ডাকছেন। এই যে আপনাকে স্যার ডাকছেন। চমক ভাঙল ইরাবতীর পিছন থেকে আসা তীক্ষ একটা স্বরে। মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। আমাকে বলছেন?

যতদূর সম্ভব আপনাকেই। মিনিষ্টার কখন থেকে ডাকছেন। যত সব পাগলের ভিড়। ছেলেটি ইরাবতীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

ইরাবতীর হাসি পেল। পৃথিবীতে একটা মানুষও কী সুস্থ? তাহলে সাইক্রিয়াটিস্টদের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে কী করে!

সে- আসব? বলে মন্ত্রীর ঘরে ঢুকল।

দুজন বসে ছিলেন। অনন্ত বাবু ইরাবতীকে বসতে বলে তাদের বললেন, বেশ তবে আমি এস ডিও সাহেবকে ফোন করে দিচ্ছি। বলেই নিজের মোবাইল থেকে রিং করলেন। ও প্রান্তে কী বলল, শোনা না গেলেও ইরাবতী শুনলো, হ্যালো, এস ডিও সাহেব, আমার পার্টির দুজনের জমি সংক্রান্ত একটা সমস্যা হয়েছে। ওদের পাঠাচ্ছি। স্থানীয় থানা নাকি কোনো অ্যাকসান নেননি। আপনি যদি একটু দেখে নেন…।

ওদিকের শব্দ এসে না পৌঁছলেও ইরাবতীর বুঝতে অসুবিধা হল না উত্তরটা বুঝতে।

মন্ত্রী লাইন কেটে দিয়ে সামনের লোকেদের বললেন, চলে যান ওনার কাছে। আশা করি এবার আর অসুবিধা হবেনা। লোকদুটি প্রণাম জানিয়ে চলে গেল।

বলো ইরাবতী, চা খাবে তো! বলেই বেল বাজালেন। দুটো চা। বিস্কুট দিয়ে। আর কিছু নেবে ?

না। থাঙ্কস। ইরাবতী হাসল।

ছেলেটি বেরিয়ে যাওয়া মাত্র অনন্ত ল্যান্ডলাইনে ফোন করে কাউকে নির্দেশ দিলেন, এখন কাউকে এ ঘরে পাঠাবেন না। আমি একটা ইন্টারভিউ দিতে বসছি।

ইরাবতী বুঝে উঠতে পারছিল না, মিনিষ্টার কাকে ইন্টারভিউ দেবেন! সে ছাড়া তো ঘরে এখন কেউ নেই। ভিতরে ভিতরে টেনসান হলেও বাইরে সে কিছুমাত্র প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

শোনো ইরাবতী, তোমাকে যে কারনে ডেকেছি আগে সেটা বলি, তারপর অন্য কথা বলছি।

ইরাবতী তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইল।

আমি একটা নিউজ পেপার বের করতে চলেছি। প্রাইমারি কাজ সব শেষ। আমার জেলা থেকেই বেরবে। এখন তোমাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।

ইরাবতী চুপ করে শুনতে লাগল।

আমি চাইছি এর পুরো আউটলেট ডিজাইন কভার স্টোরি এইসব তুমি দায়িত্ব নাও। তার জন্য তোমার যা রেমুনারেসন বা সাম্মানিক দক্ষিণা যেটাই হোক না কেন আমি দেব।

ইরাবতী ঠান্ডা মাথায় বুঝে নিতে চাইছিল এত যোগ্যতা সম্পন্ন লোক চারদিকে থাকা সত্ত্বেও মিনিষ্টার তাকে বলছেন কেন!

অনন্ত বোধহয় তার মাথার মধ্যে চলা কথাটা বুঝতে পারলেন। দেখো , তোমাকে নিতে চাইছি, কারন আমি যতটুকু বুঝেছি তুমি অসৎ নও, আর কাজের প্রতি ডেডিকেশন আছে। তাছাড়া আমি যে ধরনের কভার স্টোরি রাখতে চাইছি তাতে তোমার ভাবনাটা কাজে লাগবে। টাকা পয়সা, থাকা নিয়ে চিন্তা কোরো না। তুমি কলকাতাতে বসেই কাজটা করবে। এখন তো সব অন লাইনেই হয়। কিন্তু কাজটা তোমাকে করতেই হবে। শেষের কথাটা শুনে ইরাবতীর মনে হল উনি ইরাবতীকে শান্ত ভাবে অর্ডার দিচ্ছেন।

সে যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে শান্ত গলায় উত্তর দিল, এতো আমার পরম সৌভাগ্য। তোমার সঙ্গে কাজ করার আলাদাই আনন্দ। কিন্তু দাদা তোমার এই বোন একসঙ্গে অনেক কাজ সামলাতে পারে না। তাই আমি বলি কী কভার স্টোরি নিয়মিত আমি করে দেব, কিন্তু লে আউট, ডিজাইন এই কাজগুলো আমি পারি না, এগুলোর দায়িত্ব অন্য কাউকে দিলেই ভালো।

তোমাকে আমি মাসে দুলাখ টাকা করে দিলে হবে? না আরো ?

ইরাবতী মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ালো। তারপর ততধিক ঠান্ডা গলায় বলল, দাদা দুলাখ টাকা পাবার মতো সাংবাদিক আমি নই। পেপার চালাবার কোনো অভিজ্ঞতাও আমার নেই। আমি খুব ছোটো একটা এন জিও চালাই।মাঝেমধ্যে শখে লিখি। সেটা প্রকাশ করার মতো কিছু নয়।  ইরাবতী থামল। সে লক্ষ্য করল মন্ত্রীর চোখদুটো ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে। এই প্রথম বোধহয় তিনি কারোর থেকে সরাসরি ‘না’ শুনলেন।   

  ইরাবতী নিজেকে শান্ত রেখে ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলল, টাকাটা ম্যাটার করলে নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতাম না দাদা।  পেপার চালু হলে জানিও। তুমি যখন বলেছ কভার স্টোরি নিশ্চয়ই লিখে দেব। কিন্তু বাকি দায়িত্ব যোগ্য কোনো মানুষকে দেওয়াই উচিত। তাতেই ভালো হবে।

অনন্ত অদ্ভুত শান্ত স্বরে বলল, আরে ইরাবতী তুমি রেগে যাচ্ছ! আমি তোমাকে বলছিলাম, শ্রমের তো একটা মূল্য আছে। তুমি আমার হয়ে এত পরিশ্রম করবে, মাথা খাটাবে, আর এইটুকু পারিশ্রমিক না নিলে আমার কেমন লাগবে! আফটার অল তুমি আমার খুব কাছের। তাছাড়া বিরোধীরা জানলে বলবে, তোমাকে বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নিচ্ছি।

ইরাবতী শব্দ করে হাসল। আচ্ছা বেশ। তাহলে একটা কাজ করো, আমি একটা আশ্রমের ঠিকানা দেব, প্রতি মাসে সেখানে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবে। আর তোমার নামেই বা পরিবারের কোনো সদস্যের নামে দেবে , যাতে খবরে আসে মাননীয় মন্ত্রী নিজের মাইনে না নিয়ে সেই টাকা আশ্রমে দান করেন।

ওরে বাবা! ইরাবতী, তুমি আমাকে ঠাকুর দেবতার আশ্রমের জন্য দান করতে বলছ! একবার রটে গেলে আমাকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে। তখন আমার সব গেল।

এত ভয়? জানোতো গীতায় বলেছে, দানেই একমাত্র মুক্তি আসে। তবে আমি তোমাকে মন্দির-মসজিদ, চার্চে দানের কথা বলিনি। এই আশ্রমটা মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের। তাদের জন্য আমি সামান্য কাজ করার চেষ্টা করি, সেখানে তুমি যুক্ত হলে ভালো লাগবে। বলে ইরাবতী উঠে পড়ল। অনন্তকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল- আচ্ছা, তবে এই কথাই রইল। শুরু হলে জানিও। আমি যতটুকু পারি চেষ্টা করব।

গাড়িতে উঠে ইরাবতী অনন্তের মেসেজ পেল। তোমার তুলনা তুমি নিজেই ইরাবতী। তোমাকে আমার চাই-ই। তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে।

ইরাবতী বন্ধ গাড়ির জানলা ভেদ করে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিল আকাশের দিকে। একটা আধ খাওয়া চাঁদ উঁকি মারছে মেঘ সরিয়ে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত