নেশার ঘোরে ঢুলুঢুলু চোখ।
চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়েছে ফরহাদ।
ছোট্ট ব্যালকনিতে সে একা।
আধো আলো আধো অন্ধকারে ডুবে আছে, ক্লান্তিতে শরীর প্রায় অচল হয়ে আছে।
মন তার সচল, ভাবনার চাকার সঙ্গে ঘুরছে। সত্তর…আশি…এক’ শ কিলোমিটার বেগে ছুটছে মনের ইঞ্জিন।
শব্দ নেই, নিঝুম নিশুতি রাত, বারোটার বেশি হবে না।
নৈঃশব্দ্যের গাঢ় পর্দা ফুড়ে মসৃণ পথ মাড়িয়ে যেন সে উঠছে, কেবল উঠছে উপরে।
বিশটা লটারির টিকিট কিনেছে ফরহাদ।
যেন সে পেয়ে গেছে বিশ লক্ষ টাকার দামি এক ব্রিফকেস।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
দু-একবার শব্দ হলো, গুড়ুম গুড়ুম..। গুড়ুম গুড়ুম…
ভাবনার চাকা থেমে গেল। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল ফরহাদ। বুক উঁচিয়ে বের হলো দীর্ঘশ্বাস। লটারির নেশা কেটে গেল ওর।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল ফরহাদের চোখে ঘুম নেই।
শোবার ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে চমকে উঠে দেখল, চামেলি চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। পাশে শান্তিতে শুয়ে আছে ইড়া, এক বছরের শিশুকন্যা।
লাইট অফ করো, ঘুমাতে এসো। চামেলির কণ্ঠে ঝাঁঝ।
সরি, ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছ তুমি।
তা তো ভাববেই!
স্বর শুনে ধাক্কা খেলো ফরহাদ। ব্যস্ত হাতে লাইট অফ করে পাশে শুয়ে পড়ল।
ঘর জুড়ে অন্ধকার ছেয়ে গেছে, তার পরও মশারির ভেতরে একধরনের ঝিঁঝি আলো জমে আছে।
এ আলো কিসের ?
চোখের ? না মনের বুঝতে পারল না ফরহাদ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। অসহ্য নীরবতা তার বুকে চাবুক পেটাচ্ছে। নিজেকে সহজ রেখে আদুরে গলায় বলল, ঘুম আসছে না?
দেখতেই তো পাচ্ছ। বিরক্তিতে টানটান হয়ে আছে চামেলি।
শরীর খারাপ করেছে ?
না।
মন খারাপ?
না।
রেগে আছ মনে হচ্ছে?
না।
প্রতিবারের ‘না’-এর ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে ‘হ্যাঁ’। যেকোনো মুহূর্তে ফেটে পড়তে পারে ধৈর্যের বাঁধ, কতক্ষণ আর টিকে থাকবে এ বাঁধ।
ঝুরঝুরা একটা বেদনাবোধ তার কণ্ঠে চেপে বসল। স্বর দমে গেল। নিশ্চল পড়ে রইল মরার মতো। স্তব্ধতায় ডুবে গেল সময়।
জামাল ভাই এসেছিল আজ। চামেলি থমথমে গলার নীরবতা ভাঙল।
কখন?
সকাল দশটার দিকে।
সেকি! সে তো জানে তখন আমি বাসায় থাকি না।
সে জন্যই তো সকালে এসেছে। অনুরোধ করল তোমাকে বুঝিয়ে শান্ত রাখতে।
কী! কী বলল?
কী বলতে পারে বুঝতে পারছ না ? চামেলি মৃদু কণ্ঠে একটা বুলেট ছুড়ল। কণ্ঠ থেমে গেল ফরহাদের, যেন কৌশলে চামেলি তার টুঁটি চেপে ধরেছে।
বন্ধুকে ব্যবসার জন্য এক লাখ টাকা দিতে পারলে! আমাকে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলে না! আমি কি কেবলই তোমার শয্যাসঙ্গী ? ড্রয়িংরুমের সাজানো ফার্নিচার? জড়বস্তু?
ক্যানক্যানে গলায় ফরহাদ কী যেন বলতে যাচ্ছিল, ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল চামেলি।
ব্যবসা লাটে উঠেছে, নাকি এর সঙ্গে বন্ধুর অন্য কোনো তেলেসমাতি জড়িয়ে আছে জানি না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে। নতুন মডেলের চেইনটা সেই কবে অর্ডার দিয়ে রেখেছ, আনা হয়নি।
অস্থির হয়ো না, সব হবে।
হবে বললেই হলো? দুদিন ধরে লক্ষ করছি ঝিম মেরে থাকো, বাজার করার টাকা পর্যন্ত নেই তোমার। ব্যালেন্স নিশ্চয়ই ফুটো হয়ে গেছে। কয়েক দিন বাদেই ইড়ার প্রথম জন্মদিন। মেয়ের প্রথম জন্মদিন কি ফকিরের মতো পালন করবে?
অস্থির হয়ো না। হবে, সব হবে।
এত হবে হবে করছ কেন ? মনে হচ্ছে আলাদিনের সোনার চেরাগ পেয়ে গেছ?
পেতেও তো পারি।
হুঁহ্! তাচ্ছিল্য মাখা শব্দ ছুড়ে দিয়ে গোত্তা মেরে পাশ ফিরে শুলো চামেলি। গোত্তার ভেতর থেকে যেন হঠাৎ এক কালো দেয়াল বেরিয়ে এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেছে, আড়াল করে দিয়েছে দুজনকে।
পকেটের কথা ভাবতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল ফরহাদের। জামালের আচরণটাও অসহ্য লাগছে। ব্যবসার কথা বউয়ের কাছে বলতে এসে বিপদে ফেলেছে তাকে। মাথাটা বালিশে শক্ত করে সেঁটে ধরে সে চোখ বুজে আছে। বালিশ বরাবর তোশকের তলে আছে লটারির টিকিটগুলো। ঘাড়ে একটা শিরশির অনুভূতি টের পাচ্ছে, টিকিটের পরশে মৃদু উষ্ণতা সঞ্চারিত হচ্ছে; শিরদাঁড়া বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লটারির টিকিটগুলো ভাগ্যের চাকায় দিচ্ছে দুরন্তগতি। নিজের হতাশা, ব্যর্থতা এ মুহূর্তে ভাগ্যের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।
ভেবে ভেবে একটু শান্তি পেলো ফরহাদ। শরীরের গিঁটগুলো যেন খুলে খুলে ঝুলে আছে। অবসাদে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
অফিস আজ বন্ধ।
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে ফরহাদের।
চামেলি ডেকে দেয়নি তাকে।
চোখ খুলে শুয়ে রইল ও, ছাদের দিকে চোখ গেল তার। কোনায় কোনায় মাকড়সার জাল, কালো হয়ে আছে, বিশ্রী!
এসব তো আগে চামেলির চোখ এড়াত না, এখন এড়ায়। তবে কি চামেলির মনেও কালো আবর্জনা জমেছে?
এ জন্যই কি সে বাইরের ময়লা দেখতে পায় না?
কদিন বাদে ইড়ার জন্মদিন। আর তাই চামেলির ছোট ভাই মুকুলের আজ আসার কথা। মুকুল ফরহাদের খুব ভক্ত।
ভালো করে বাজার করতে হবে। এক্ষুনি বাজারে যাওয়া দরকার। আড়া মোড়া ভেঙে ওঠে সে।
মনটা হঠাৎ চনমন করে ওঠে।
কোনো সুখের ডাক আসছে কি! একটা ‘ইনটিউশন’ জাগে নিজের মনে, সুখের ‘ইনটিউশন’ কী!
পকেটে আছে কড়কড়ে একটা পাঁচশ টাকার নোট। পুরো মাসের এটাই সম্বল। মাস শেষ হতে এখনো ১২ দিন বাকি। কীভাবে চলবে পুরো মাস। বেতনের টাকা ছাড়া গতি নেই।
সাইড ব্যবসা তাকে দিয়ে হবে না। যেখানে হাত দিয়েছে সেখানেই আগুন, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ধিকিধিকি জ্বলছে বুক। জামালও শেষমেশ ডুবাল তাকে, একেবারে ফতুর করে দিয়েছে।
হেঁটে হেঁটে বাজারে এল ফরহাদ। কাঁচাবাজারে ঢুকে দেখে সবজির বিপুল সমাহার। চোখ বুলিয়ে যায় কেবল। ইচ্ছে করছে সব কিনে নিতে। ইচ্ছে দমিয়ে রেখে সে মাছের বাজারে ঢোকে।
বিরাট বিরাট রুই মাছ এসেছে। জ্যান্ত, লাফাচ্ছে। চারিদিকে ভিড়, বিক্রেতা হিমশিম খাচ্ছে।
মাসের শেষ সম্বল পাঁচশ টাকা পকেটে নিয়ে এসব মাছের সামনে দাঁড়ানোর সাহস থাকার কথা নয়। ফরহাদেরও সাহস ছিল না। হঠাৎ চোখ গেল সামনের দেয়ালে। লটারির পোস্টার সাঁটানো। বিশ লক্ষ টাকার প্রথম পুরস্কার। আজ ড্র’র ফলাফল পত্রিকায় ছাপা হওয়ার কথা। সকালে পত্রিকা পড়া হয়নি।
বুকের মধ্যে খলবলিয়ে উঠল কুড়ি লক্ষ টাকা। রুই মাছগুলোর মতোই যেন লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডের ভেতর।
তেজ ও সাহস আভিজাত্যের ঘুমন্ত ঘোড়া জাগিয়ে তুলল, ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াল ফরহাদ।
দাম কত?
একশ ষাট টেহা কেজি। বিক্রেতা দ্রুত উত্তর দিল।
এত! আভিজাত্যের খোলস খসে যাচ্ছিল, তবুও সামনে থেকে সরল না ও।
হ, নিলে নেন, না নিলে জায়গা দেন, সাব। বিক্রেতার ঠাঠা জবাব।
ফরহাদের সম্মানের খুঁটিতে আঘাত লাগল। ভেতরে ভেতরে গর্জে উঠল ও, নিজেকে সামলাল।
ওইটা ওজন করো। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ছোটখাটো একটা মাছ।
ওজন সাড়ে তিন কেজি।
পাঁচশ ষাট টেহা। দেন, সাব। তাড়াতাড়ি করেন, সাব। বিক্রেতার কর্মব্যস্ততা বাড়ে। দাম শুনে কপালে ঘাম জমে গেল ফরহাদের। তবু কোত্থেকে সাহস এসে যেন বাঁ হাতে জমা হলো। হিপ পকেটে হাত ঢোকাল সে। তারপরই একটা ভয়াবহ চিৎকার দিল।
পকেট খালি, মানিব্যাগ উধাও।
পকেটমারের দু’ আঙুলের কারসাজির কাছে তার সকল তেজ, সাহস, আভিজাত্য ধরাশায়ী। বিক্রেতা সব বুঝে গেছে, বাড়িয়ে দেওয়া মাছটা গুটিয়ে নিল।
এক পা পিছিয়ে এল ফরহাদ। ঘাম কমে যায়, দ্রুত সামনে হাঁটা শুরু করে। মুখে এক চিলতে অস্পষ্ট হাসি ফোটে।
টাকা হারানোর শোক নেই, সম্মান বেঁচে যাওয়ার জন্য মনে মনে ও পকেটমারকে ধন্যবাদ জানায়। ক্ষণিকের জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ স্থায়ী হয়।
চামেলির কথা মনে পড়ে। ইড়ার জন্মদিনের কথা মনে পড়ে। শ্যালক মুকুলের আসার কথা মনে পড়ে।
মাথা নিচু করে থমথমে মুখ নিয়ে বাসায় ঢুকল ফরহাদ।
চামেলি এগিয়ে এসে কড়া ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,
খালি হাতে কেন ?
ফরহাদ প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে। হাত-পা ছেড়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
চামেলি দমে যায়। ফরহাদের মুখের দিকে চোখ পড়তেই কেমন মিইয়ে গেল। বিপদের গন্ধ টের পেয়েছে সে।
চামেলির এ গুণটা খুব ভালো।
স্বামীর কষ্ট চট করে ধরতে পারল। তবে মাথা গরম থাকলে বিপদআপদ বোঝার শক্তি থাকে না তার। এখন আছে। কাছে বসে মাথায় হাত রাখে। আলতো করে জানতে চায়,
ব্যাপার কী ?
মানিব্যাগ উধাও, পকেট কাটা গেছে ভিড়ের মাঝে। মাথা ঘুরিয়ে বলল ফরহাদ।
চামেলি কিছু বলল না। অনিশ্চিত অর্থসংকট মাথায় নিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
ক্রিংক্রিং। কলবেলের শব্দ হচ্ছে।
চামেলি উঠে দরজা খোলে।
দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুকুল, চামেলির ছোট ভাই। মুকুলকে দেখে চামেলি সব দুঃখ ভুলে যায়। আদরের ভাইটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
মুকুল সবার জন্য গিফট নিয়ে এসেছে।
চামেলির জন্য শাড়ি, ফরহাদের জন্য শার্ট, ইড়ার জন্মদিনের কাপড়-চোপড়, খেলনাগাড়ি।
ব্যাগ থেকে সে আজকের একটা দৈনিক পত্রিকা বের করে।
ফরহাদ উঠে আসে। মুকলকে দেখে তার মনও ভালো হয়ে গেল।
দৈনিক পত্রিকা দেখে চমকে উঠল ফরহাদ। আজ লটারির ফলাফল ছাপানোর কথা, ভুলেই গিয়েছিল মানিব্যাগ হারিয়ে।
পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখল, ফলাফল ছাপা হয়েছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে পত্রিকাটা চোখের সামনে তুলে ধরল।
তোশকের তল থেকে টিকিট বের করে এনে মিলাতে লাগল।
প্রথম পুরস্কার ‘ঘ’ সিরিজের।
ফরহাদের পাঁচটা টিকিটই ওই সিরিজের।
বুক ঢিপঢিপ করছে।
ঘাম জমা হচ্ছে কপালে, জুলফি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে ঘাম। গালের দু’পাশ ভিজে উঠেছে।
এক.. দুই..তিন। তিন নম্বর টিকিটটির নাম্বার দেখে ভয়ানক এক চিৎকার দিল ফরহাদ।
এক হাতে পেপার, অন্য হাতে টিকিট।
মিলে গেছে, প্রথম পুরস্কার।
চামেলি ছুটে এল চিৎকার শুনে। ফরহাদকে ধরে। ওর মুখে কথা নেই, স্তব্ধ হয়ে গেছে ও। নড়ছে না, উঠছে না, চেয়ারের সঙ্গে ঠেস দিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে।
মাথার ওপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, অথচ ঘামছে। ঘাম কমার কথা, কমছে না, দরদর করে স্রোতের মতো তা নেমে আসছে ঘাড় বেয়ে।
ফরহাদের চোখে শূন্যতা। মুহূর্তের মাঝে গভীর শূন্যতা কেড়ে নিয়েছে ওর পুরো জগৎ। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে, ফ্যানের প্রতিটা ঘূর্ণন ওর বর্তমান মুহূর্তকে ঘোরাচ্ছে। দুলছে চেয়ার, দুলছে তিন তলা বাড়ি…
চামেলি এক হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় ফরহাদকে।
এই! কী হলো, এমন করছ কেন?
ফরহাদ নীরব।
কথা বলো! চামেলি আবারও ওর বাহু খামচে ধরে ঝাঁকি দেয়, ভড়কে যায়।
এ যেন ফরহাদ নয়, একটা পাথরের খণ্ড। জড়বস্তু, অনুভূতিহীন কাঠের রদ্দা।
চামেলি টিকিট দেখে, পেপার দেখে।
তারপর সেও গগনফাটা চিৎকার দেয়।
ছুটে গিয়ে ইড়াকে কোলে নেয়। তিন চক্কর খায়। মুকুলকে জড়িয়ে ধরে। চামেলি বুদ্ধিমতী। বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটেনি তার। নিজেকে সামলে নেয়। টিকিট ও পেপারটা নিজের হাতে নেয়। ওয়াড্রোবের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে ফরহাদের কাছে এসে ওকে টেনে তোলে; শোবার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়।
ইতিমধ্যে ডাক্তার আনা হয়েছে।
ডাক্তার ভালো করে পরীক্ষা করেছেন। সব ঠিক আছে, কেবল হার্টবিট বেশি। আর কোনো শারীরিক অসুবিধা নেই।
কীভাবে হলো এমন? ডাক্তার জানতে চায়।
একটা আনন্দ সংবাদ শুনে চিৎকার দিয়েছে, তারপরই এ অবস্থা। চামেলি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে।
কী ধরনের আনন্দ সংবাদ?
খুবই ব্যক্তিগত। চামেলি আসল তথ্য এড়িয়ে গেল।
ফরহাদকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে শিরায়। এখন ঘুমাচ্ছে সে। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার পর। উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাথরুমে যায়। পানি পান করে। এদিক-ওদিক তাকায়। চাউনির ভেতর কোনো প্রাণ নেই, মরা মাছের মতো ফ্যাকাসে ওর চোখ। খেতে বসে গোগ্রাসে গিলে। অন্য দিনের তুলনায় খায়ও বেশি। কেবল মুখে কোনো কথা নেই, নির্বাক।
আবারও ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। আবারও ঘুম। ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া। এভাবে দু’দিন চলে গেছে। অবস্থার তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। অস্থির হয়ে ওঠে চামেলি। ভালো চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন।
মনে মনে ঠিক করে, কালই যাবে সে কর্তৃপক্ষের অফিসে। লটারির টিকিট নিয়ে যাবে। টাকার দরকার, প্রচুর টাকা দরকার এখন।
অফিসে ঢুকে ভয় ভয় করতে লাগল চামেলির। বুকের ভেতর দুমদাম তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইউনিভার্সিটির অলরাউন্ডার ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি ছিল তার, স্মার্টনেসেরও অভাব নেই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ও।
সঙ্গে মুকুল আছে। ইড়াও আছে। ইড়াকে বাসায় রাখা সম্ভব হয়নি। বাসায় থাকলে সে ফরহাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই তাকেও নিয়ে আসা হয়েছে, এখন আছে মুকুলের কোলে।
চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল সে।
পিয়ন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
কী চাই?
চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করব।
কী কাজ?
ভেতরে গিয়ে বলুন একজন মহিলা দেখা করতে চায়, যান। চামেলির কণ্ঠে আভিজাত্যের ধমক। অনেকটা আদেশ করেই সে পিয়নকে ভেতরে পাঠাল।
আসুন, স্যার আপনাকে ডাকছে। ফিরে এসে বিনয়ের সঙ্গে বলল পিয়ন।
চামেলি রুমে ঢোকে। মুকুল বাইরে হাঁটছে ইড়াকে নিয়ে।
বসুন, প্লিজ।
চামেলি বসে। চুপচাপ থাকে।
আপনাকে তো চিনতে পারছি না। চেয়ারম্যানের মুখে বিগলিত ভাব।
আমি ব্যক্তিগত পরিচয়ে আসিনি।
ওহ্। আচ্ছা। বলুন কী উপকার করতে পারি?
চামেলির মুখে মৃদু হাসি ফোটে। এ হাসি যেকোনো পুরুষকে ক্ষণকালের মধ্যে ভেড়া বানিয়ে দিতে পারে, জানে সে।
নিজের রূপের ক্ষমতা বড় হওয়ার পর থেকে বুঝতে শিখেছে, এখনো বুঝল। চেয়ারম্যান বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
হ্যান্ডব্যাগের চেইন খোলে সে, পেপারকাটিং বের করে। বের করে একটা লম্বা খাম। খাম থেকে টেনে বের করে লটারির টিকিট।
তারপর নিথর শান্ত কণ্ঠে বলল, এটি আমার টিকিট, প্রথম পুরস্কার।
চেয়ারম্যান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। চকিতে উবে গেল তার মুখের গদগদ ভাব। পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসলেন তিনি।
চামেলির মুখে মৃদু প্রশান্তি লেগেই আছে। চেয়ারম্যানের পরিবর্তন টের পেল না সে।
আপনি কি গতকালের পেপার দেখেননি?
না তো!
প্রথম পুরস্কার গতকাল একজন ক্লেম করেছেন। পত্রিকায় তার ছবি ও টিকিট ছাপা হয়েছে, দেখেননি?
না। চামেলির মুখের হাসি মুহূর্তের মাঝে কেড়ে নিলেন চেয়ারম্যান। বেশ জোরেই সে ‘না’ উচ্চারণ করে, সঙ্গে সঙ্গে একধরনের একরোখা ভরাট তেজ বুকে জমা হয়েছে।
টিকিটটা সে চেয়ারম্যানের চোখের সামনে তুলে ধরল।
একটু ঝুঁকে ভ্রু বাঁকিয়ে চোখ কুঁচকে টিকিটের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। অনেকক্ষণ তাকিয়ে সোজা হলেন। খুব ঘাগু গোয়েন্দা অফিসারের মতো টিকিটটি পরীক্ষা করার সময় চামেলির মুখের প্রতিক্রিয়াও বোঝার চেষ্টা করলেন।
আপনি অপেক্ষা করুন প্লিজ। টিকিট আপনার কাছে রাখুন। বলেই টেলিফোন সেটের বাটন টেপেন, কাউকে ডাকলেন।
একজন স্মার্ট তরুণ অফিসার ভেতরে ঢুকল।
চেয়ারম্যান মুখে কিছুই বললেন না।
সাদা কাগজে কতক্ষণ খচখচ করে কী যেন লিখলেন। কাগজটা অফিসারের হাতে দিলেন। হাতে নিয়ে পড়লেন তিনি, চমক খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
কতক্ষণ সময় গেছে টের পায়নি চামেলি।
তিনজন সাদা পোশাকধারী লোক ভেতরে ঢুকল।
একজন তার কাছে এসে দাঁড়াল। শান্ত স্বরেই বলল, ম্যাডাম আমরা খুব দুঃখিত, আপনার টিকিট জাল, নকল।
অসম্ভব! লাফিয়ে ওঠে চামেলি।
জি না, ম্যাডাম। আমরা ঠিকই বলছি। স্যার ভুল করতে পারেন না।
তাহলে বাজারে জাল টিকিট বিক্রি হয়েছে?
বলতে পারছি না। জাল টিকিট আপনার কাছে পাওয়া গেছে। এখন আপনিই অপরাধী।
বাহ্! আপনি বলতে চাইছেন টিকিট আমিই নকল ছাপিয়েছি? একধরনের তাচ্ছিল্যমাখা ক্রুদ্ধতা জেগে ওঠে চামেলির কণ্ঠে।
লোকটি কথা বলল না আর। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে, পরিচয়পত্র। চোখের সামনে খুলে ধরে, চামেলির চক্ষু ছানাবড়া। লোকটি গোয়েন্দা পুলিশ।
ওঠেন ম্যাডাম, আপনাকে থানায় যেতে হবে।
কেন? থানায় কেন?
আইনের চোখে আপনি এখন একজন অপরাধী।
আমিই অপরাধী! চমৎকার! চমৎকার আপনাদের দক্ষতা! জাল টিকিট বের করবে একজন, অর্থ লুটবে চোরা পথে একজন, ভোগান্তি পোহাবে আর একজন, ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না আপনাদের।
আপনার যুক্তি কোর্টে দেখাবেন, আমাদেরকে যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই।
দেখুন আমার হাজব্যান্ড টিকিটটা কিনেছে। মাইক্রোবাসে ব্যানার লাগিয়ে, মাইক বাজিয়ে আপনাদের চোখের সামনে জাল টিকিট বিক্রি করা হয়, তাদের ধরবেন না, ধরবেন ক্রেতাদের ?
আপনার হাজব্যান্ড কিনেছেন?
জ্বি।
তিনি কোথায়?
বাসায়।
তিনি বাসায় আর আপনিই এলেন টাকা নিতে?
তিনি অসুস্থ।
গোয়েন্দা পুলিশ কটমট করে তাকাল, চামেলির কথা বিশ্বাস করল না। রহস্যের গন্ধ পেলেন তিনি।
নিরীহ জনগণের ওপর তদন্ত করতে গেলে তাদের গন্ধ পাওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। রুই কাতলাদের ব্যাপারে গন্ধ পান না, তখন তারা সর্দি রোগে ভোগেন। এখানেও তাই ঘটল।
পুলিশের স্বর ক্রমশ শক্ত হয়ে গেল। নিশ্চয় এর পেছনে কোনো একটি চক্র জড়িয়ে আছে, নেপথ্যে থেকে সুন্দরী মহিলাটিকে ব্যবহার করছে।
পকেট থেকে হাতকড়া বের করেন তিনি। হাতকড়া দেখে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল চামেলির।
কোনো রকমে বলল, বাইরে আমার ভাই আছে, বাচ্চা আছে।
দরজা খুলে বাইরে এসেছে চামেলি। তিনজন পুলিশ তাকে ঘিরে রেখেছে। চামেলি ছুটে গেল ইড়ার কাছে। মুকুলের কাছ থেকে ছোঁ মেরে ইড়াকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরল।
মুকুল স্তব্ধ হয়ে গেছে, ফ্যালফ্যাল করে কেবল তাকিয়ে আছে।
চামেলি বলল, মুকুল ভয় পাসনে। তোর দুলাভাইকে দেখিস, আব্বাকে খবর দিস। যা, বাড়ি যা। ওরা আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। টিকিটটা জাল।
চামেলিকে কয়েদি ভ্যানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইড়া মায়ের বুক জড়িয়ে ধরেছে।
ভ্যানটা যেন এক জ্যান্ত কবরস্থান। কবরস্থান জনারণ্যের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে।
তুঁত রঙের গাড়িতে বসে রাস্তাঘাট কিছুই দেখতে পাচ্ছে না চামেলি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কেবল ছাদের দিকে পাশ ঘেঁষে চারদিকে রয়েছে সরু রডের গ্রিল।
কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল আছে ভেতরে।
তারা দুচোখ দিয়ে কেবল গিলছে চামেলির শরীর।
ফরহাদের কথা মনে পড়ছে।
পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে বাকশক্তি হারিয়ে কেমন শিশু হয়ে গেছে ফরহাদ। কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে।
ইড়া কান্না শুরু করেছে। তার ক্ষিদে পেয়েছে। দুহাত ছুড়ে শাড়ির আঁচল টেনে ধরছে। এলোপাতাড়ি হাতড়াচ্ছে ব্লাউজ, এখনো বুকের দুধ টানে সে।
চামেলি পুলিশের দিকে পিঠ ফিরে বসে।
এ দুদিনে এতক্ষণে তার নজর পড়েছে ইড়ার প্রতি।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে আজ ইড়ার জন্মদিন।
এদিনে কত কিছু করার প্ল্যান ছিল।
ফরহাদের মুখটা ভেসে উঠছে বারবার।
দুচোখ ছাপিয়ে কান্নার ঢল নামে।
ঠোঁট কেঁপে ওঠে।
মনে মনে বলল, ইড়া, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
ইড়া দুধের বোঁটা পুরে নেয় মুখে। চুষতে শুরু করেছে।
ইড়া টেনে নিচ্ছে জন্মের স্বাদ। আর চামেলি অনুভব করছে জীবনের বিষাদ।
জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৬০ খ্রিঃ তিনি একজন কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও মনোশিক্ষাবিদ। শিশু সাহিত্য বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৪১৮ বঙ্গাব্দে শিশু একাডেমি প্রদত্ত অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।