| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

ইরানী অনুবাদ গল্প: কাঁচের মার্বেল । পারি মানসূরী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

মূল : পারি মানসূরী, ভাষান্তর : মাইনুল ইসলাম মানিক [পারি মানসূরী একজন ইরানী লেখক এবং অনুবাদক। জনপ্রিয় এই লেখক ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহন করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে এবং প্রায় দুই দশককাল তিনি ইংরেজি ভাষা বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। ১৯৭৬ সালে স্বামী এবং সন্তানসহ তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জর্জ এলিয়ট, ইভান তুর্গেনিভসহ বিভিন্ন লেখকের দশটির মতো বই তিনি অনুবাদ করেন। অনুবাদের পাশাপাশি সমান তালে লিখে চলেছেন উপন্যাস ও গল্প। তাঁর অসংখ্য ছোটগল্প এবং অনুবাদ ইরানসহ বিভিন্ন দেশের পার্সিয়ান জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি দুটি পুরষ্কার (মাদাম কুরি) লাভ করেন। তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। ‘ভালোবাসার উর্ধ্বে ও বাইরে’ তাঁর অন্যতম উপন্যাস। ‘কাচের মার্বেল’ এবং ‘সবটুকু জল হতে উদ্বেগ’ তার অন্যতম ছোটগল্প সংকলন। ‘কাচের মার্বেল’ গল্প সংকলনটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটি পাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন কর্তৃক একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাঠ্য করা হয়েছে। ]


দ্রুততার সাথে কালো ব্রিফকেসটি খুলে ভেতরের কাগজগুলো বের করে আনেন লোকটি। খুব সতর্কতার সাথে একটার পর একটা কাগজে চোখ বুলিয়ে তারপর শান্তচিত্তে সেগুলোকে ভেতরে রাখলেন। হলঘরে তাকে অনুসরণ করা মহিলাটি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘তুমি কি কিছু খুঁজছো?’ তিনি বললেন,‘না, আমার কাছে থাকা দুজন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসাপত্র ঠিকঠাক আছে কি-না নিশ্চিত হতে চেয়েছি। গতরাতে এই চিকিৎসাপত্রগুলো গবেষণা করার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম।’

তারপর তিনি কালো কোটটি পরলেন এবং গভীর কালো চোখে উদ্বিগ্নতামিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে বললেন,‘খুব তুষার! আজ আমাকে সকাল সকাল বেরুতে হবে, আর আজই কি-না এতো কুয়াশা! শুরুতে গাড়িটা চালু করতে চাইলাম, কিন্তু ইঞ্জিন হিম হয়ে আছে। এটা আসলে একরকম অকেজো হয়ে আছে। তুমি যখন রান্নাঘরে ছিলে, আমি একটা ভাড়ায় চালিত গাড়ি খোঁজ করেছিলাম। হাসান আগা অন্যান্য দিন দেখলেই খোশামুদি করত। অথচ আজ সে বলল,‘আপনি তো জানেনই আমরা ডাক্তারদের প্রতি কতোটা একনিষ্ঠ। কিন্তু এই জঘন্য তুষার ঠেলে আপনার রাস্তায় গাড়ি ঢোকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’ সে ঠিকই বলেছে। যাই হোক, আমাকে এখন গলির মাথা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে এবং গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।’ খুব সহমর্মিতা ও মায়াজড়ানো কণ্ঠে মহিলাটি বললেন,‘এখনও তো খুব একটা সকালই হয়নি। এসো, বের হওয়ার আগে কিছু খেয়ে নাও। হাসান আগা কখন গাড়ি পাঠাচ্ছে?’ ‘সিমিন, কিছু খাওয়ার সময় হাতে নেই। মন খারাপ কোরো না। আমি হাসপাতালে পৌঁছেই কিছু খেয়ে নেবো। সাড়ে ছ‘টায় গাড়ি আসবে। আজ খুবই ঠান্ডা এবং খুবই বাজে রকমের বরফ জমেছে রাস্তায়। আশা করি, ঘর হতে বেরুবার মতো আজ কোনো ছুতা নেই তোমার।’ মহিলাটি লক্ষ্য করলেন, রোজকার মতো লোকটি তারা সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীতে ডুবে আছেন। অথচ পুরুষটি এটুকু অনুধাবন করেন না, টেবিলের উপর খাবারগুলো পরিবেশন করার আগে কত ঘণ্টা সময় তাকে কতভাবে ব্যয় করতে হয়। তিনি লোকটির উপর রুষ্ট হলেন, কিন্তু নিশ্চুপ থাকলেন। লোকটি বুঝতে পারলেন কিছু একটা ভুল হয়েছে। তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলতে থাকলেন,‘ তোমাকে নিয়েও যেন দুশ্চিন্তা করতে না হয়। নিজের এবং তারানেহ্র দেখাশোনা করবে ঠিকমত।’

তিনি বেরুতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেসময় পাশের কক্ষ থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। বয়স চার কী পাঁচ। যখন মেয়েটি তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তাকে দেখে খেলা করা সাদা খরগোশের মতো মনে হলো। সে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,‘বাবা, বাবা, এক মিনিট দাঁড়াও! এখনই যেও না। আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই।’ মেয়েটিকে তিনি কোলে তুলে নিলেন, জড়িয়ে ধরলেন এবং গোলাপী গালে চুমু খেলেন। ঝরঝরে বাদামী চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,‘এত তাড়াতাড়ি তুমি জেগে উঠলে কেন? প্রিয় মা আমার, এবার বলো তোমার কী প্রশ্ন। হাতে সময় খুব কম। আজ আমাকে সকাল-সকাল বের হতে হবে।’ মেয়েটি মাথা নিচু করল এবং গোমড়ামুখে বলল,‘আমি তোমাকে এত সকালে বের হতে দেবো না। তুমি সবসময় খুব ভোরে বেরিয়ে যাও।’ হাত দিয়ে তিনি মেয়ের থুতনি ধরে উপরের দিকে তুললেন এবং মায়াভরা দৃষ্টিতে তার উজ্জ্বল বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘তারান্হে, লক্ষী মা আমার, এদিকে তাকাও। আমাকে খুব দ্রুতই বের হতে হবে। অনেক অসুস্থ ও আহত লোক হাসপাতালে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তোমার প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করো, মা।’ ‘এই অসুস্থ লোকেরা কখন সুস্থ হবে, বাবা? তারা তো দেখি সবসময়ই অসুস্থ।’‘না, তারান্হে, তারা সবসময় অসুস্থ থাকে না। তাদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে চলে যায়। দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধ চলছে, তাই প্রতিদিন অসংখ্য আহত মানুষ হাসপাতালে আসে।’ মেয়েটি বললো,‘আমি জানি। আমি তাদেরকে টেলিভিশনে দেখেছি। সেখানে সবসময়ই বোমা ফেলা হচ্ছে, বাবা। বোমা কি শেষ পর্যন্ত এখানেও এসে পড়বে?’

তিনি ভয়ার্ত একটা নিশ্বাস ভেতরে টেনে নিলেন এবং মেয়েকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,‘না! না! তারা এখানে বোমা ফেলতে আসবে না। তাদের সে সাহস নেই। কিন্তু তুমি আসলে আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলে? তুমি কী সেটা ভুলে গেছো?’ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,‘আমি জানতে চেয়েছিলাম তুমি কখনো রঙধনু দেখেছো কি-না।’ প্রশ্নটা লোকটিকে কিছুটা বিব্রত করে। এমন একটা সময়ে তিনি এধরনের একটা প্রশ্ন প্রত্যাশা করেননি। এমনকি তিনি তারানেহ্র প্রশ্নটা ঠিকঠাক শুনেছেন কি-না সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় পড়ে যান।  ‘হ্যাঁ, মা আমার । রঙধনু দেখেছি। কিন্তু তুমি এখন এই প্রশ্নটা জানতে চাচ্ছো কেন?’


আরো পড়ুন: ইরানের কবি আলি আবদোলরেজ়ায়েই-এর কবিতা


 

বলতে বলতে মেয়েটার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল,‘বানাফ্শে গতকাল এখানে এসেছিল। চমৎকার সব ছবি সম্বলিত একটি বই আছে ওর। ওটাতে একটা রঙধনুর ছবিও ছিল, বাবা। বানাফ্শে আমাকে বলেছে, কেউ কোনোদিন রঙধনু দেখেনি।’ ছোট্ট একটা নিরবতা কেটে গেল। ক্ষুদে বালিকাটিকে আবার চুমু খেলেন। ধীরে ধীরে তাকে কোল থেকে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,‘বানাফ্শে ভুল বলেছে, প্রিয় মা আমার। সবাই একটা রঙধনু দেখেছে। আমি নিশ্চিত তুমি আর বানাফ্শেও কোনো একদিন রঙধনু দেখতে পাবে। আমাকে এখন যেতেই হবে। তোমার আর কোনো প্রশ্ন থাকলে তোমার মা সেগুলোর উত্তর দিতে পারবে।’ *** হিম তুষারের উপর দিয়ে লোকটি সাবধানে হাঁটছিলেন, চেষ্টা করছিলেন শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে। কিন্তু মেয়ের প্রশ্নটি তার মনকে আড়ষ্ট করে রাখে, ঘুরপাক খেতে থাকে বারবার। বইয়ের ছবি ছাড়া আর কীভাবে সে রঙধনু সম্পর্কে জানতে পারত! কালো ধোঁয়ায় ঢেকে আছে এই শহরের আকাশ। রঙধনু নিয়ে তার নিজের স্মৃতিও প্রায় দূরের মরীচিকা। গলির মুখে সে যখন পৌঁছে, নিরাশাময় এক তীব্র আকুতিতে তখন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তার হৃদয়। গাড়িচালক আকবর আগা তাকে চিনত। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো এবং লোকটির জন্যে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। তারা দুজনে গাড়িতে বসলেন। আকবর আগা বসলেন হুইলের পেছনে চালকের আসনে। খুব দরদমাখা কণ্ঠে বললেন,‘শুভ সকাল, ডাক্তার। আশা করি আজ ভালো বোধ করছেন। আপনাকে বাড়ির সামনে থেকে আনতে পারিনি। অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন। এই ত্যাঁদড় তুষার আর বরফের কারণেই যত বিপত্তি।’ ‘দুঃখ কোরো না, আকবর আগা। সামান্য হাঁটাহাঁটি আমার জন্যে ভালো। বলো, তোমার পেটের অবস্থা কেমন এখন? শেষ যে ওষুধটা লিখে দিয়েছিলাম সেটা কি কিছুটা কাজ করেছে?’ আকবর আগা বললেন,‘ ও হ্যাঁ, আমি এখন যথেষ্ট ভালো আছি। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আপনাকে সবসময় আমাদের পাশে রাখেন। স্রষ্টা জানেন এটা খুব খারাপ সময়, ডাক্তার। পেটের পীড়ায় এখন প্রায় সবাই ভুক্তভোগী। আমার প্রায় সবটুকু ব্যাথাই সেরে গেছে। বউ-বাচ্চাদের ভরণপোষণের জন্যে কুকুরের মতো খাটতে হয়। গতমাসে বড় ছেলেটা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে। তাকে সদরে পাঠানো হলো। ওর বয়স মাত্র পনের বছর। তার মা কাঁদছিল এবং সারা মাসজুড়ে দুঃখ করছিল। সে অস্থির হয়ে ওঠে। এমনকি ঘুমাতেও পারে না। কুকুরের মতো খেটে ক্লান্তি নিয়ে আমি প্রতিরাতে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু তাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে গিয়ে আমি কেমন বোধ করি সেটা আমাকে ভুলে যেতে হয়। শেষ কয়েকটা দিন ধরে তার বেশ কাঁপুনি ও জ্বর। হরিদ্রার মতো হলুদ হয়ে গেছে মুখ। আসলে আমি একটা দিন ছুটি নিতে চাই, ডাক্তার। তাকে নিয়ে আসতে চাই আপনার হাসপাতালে। আমি জানি না এটা কী জ্বর। এটা কি ম্যালেরিয়া? এটা কি যক্ষাও হতে পারে? এটা কী জ্বর হতে পারে?’ লোকটি বললেন,‘দুুশ্চিন্তা কোরো না। কাল সকালে তোমার স্ত্রীর হাসপাতালে আসাটা নিশ্চিত করো। আমি তাকে খুব সতর্কভাবে পরিক্ষা করে দেখবো। যদি দরকার পড়ে, আমরা কিছু টেস্ট করবো এবং তার জন্য কিছু ওষুধ লিখে দেবো। আমি নিশ্চিত সে খুব দ্রুত সেরে উঠবে।’ *** গাড়ি চলছিল খুব ধীরে। পিছলে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্যে গাড়ির চাকার টায়ারে চেইন লাগানো ছিল। তবুও গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আকবর আগা খুব দক্ষতার সাথে গাড়ি চালাচ্ছিল, নিষ্ঠুর সময় নিয়ে তাৎক্ষণিক কথা বলছিল এবং ডাক্তারের প্রশংসা করে গানও গাইছিল। যদিও ডাক্তার তার প্রতিটি শব্দ যথাযথভাবে শুনছিলেন না। তিনি তার নিজের ভাবনায় ডুবে ছিলেন। তার মেয়ের প্রশ্ন, রঙধনুর ছবি তখনও তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। আচমকা তিনি বুঝতে পারলেন সবকিছু বদলে গেছে। তিনি নিজেও বদলে গেছেন অনেক। তার মনে পড়ে, প্রকৃতি কী সেটা অনেক বছর আগে তিনি নিজেও জানতেন। সপ্তাহান্তে তিনি খুব একটা নগরীতে থাকতেন না। বন্ধুদের সাথে সুখময় অনেকগুলো ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন পাহাড়ে। বন্ধুরাসহ সূর্যোদয়ের সময় বেরিয়ে পড়তেন। যখন সূর্যের প্রথম আলোকরশ্নি ছড়িয়ে পড়ত আকাশে, তখন তারা থাকতেন তোকাল পর্বতের চূড়ায়। কী নির্মল পাহাড়ি বাতাস তার হৃদয়কে ভরিয়ে দিত। পানি ও আলোর সঙ্গীত, পাখির গান আর জীবন তার সমূহ সত্ত্বাকে ছুঁয়ে যেত।

সে দিনগুলোর কথা ভাবলেই তার অন্তত মনে পড়ে যায়, তিনি সঙ্গীত ভালোবাসতেন, বিশেষ করে ধ্রুপদী সঙ্গীত। তিনি প্রায়ই কনসার্টে যেতেন। দশ বছর আগে সিমিনের সাথে তার প্রথম দেখা হয়। তিনি তখন হাসপাতালে ইন্টার্ণ ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলেন আর সিমিন শেষবর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন সঙ্গীত কলেজে। যে রাতে শিক্ষার্থীরা বিটোভেনের সিক্সথ সিম্পোনি পরিবেশন করছিল, সে রাতের কথা তার স্পষ্ট মনে পড়ে। সিমিন ক্লারিনেট বাজাচ্ছিল। তিনি তখনই সিমিনের প্রেমে পড়ে যান, আর তার এক বছর পর তাদের বিয়ে হয়।

তারপর আরেকটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল তার। বন্ধুরাসহ দেমাভেন্ড গ্রামে গিয়েছিলেন এসব বছরগুলোরও আগে। পাহাড়ে উঠতে শুরু করার আগেই হঠাৎ ঝড় ও বজ্রপাত আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং প্রবলভাবে বৃষ্টি শুরু হয়। যদিও বৃষ্টি শুরু হতে না হতেই আবার থেমে যায় এবং লাস্যময়ী সূর্যালোক মেঘকে ভেদ করে মাটিতে নেমে আসে, এটি নীলকান্তমনি আকাশে এক নান্দনিক রঙধনু অঙ্কন করে। তারা সবাই রংধনুর দিকে মুগ্ধ ও হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। সেটাই ছিল তার শেষবার রঙধনু দেখা। *** মন দুলতে দুলতে চলে যায় চার বছর বয়সের শৈশবে। তিনি তখন বড় ভাইয়ের সাথে ছিলেন। তারা বাগানে খেলছিলেন। গ্রীস্মের গোলাপের ঘ্রাণে বাগানময় ছড়িয়ে ছিল মদিরতা। তাদের দুজনেরই কিছু কাচের মার্বেল ছিল। তারা দুজনেই সেগুলোকে নিজেদের মধ্যে একটার পর একটা অদলবদল করছিলেন। তারপর একচোখ বন্ধ করে আরেক চোখে মার্বেল ধরে সূর্যের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন। সেই কাচের মার্বেলের মধ্য দিয়ে তারা হাজার হাজার সংযুক্ত রঙধনু দেখতে পাচ্ছিলেন। 

মনেমনে তিনি তার ভাইয়ের সাথে শেষ মার্বেলটি বদল করছিলেন। হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর গাড়িটি তার নিজস্ব পথ থেকে ছিটকে গিয়ে একটা গর্তে পড়ে যায়। তিনি শুধু আকবর আগার কণ্ঠে দু‘বার আর্তনাদ শুনতে পান,‘ওহ্, ঘামারেহ্ বনী হাশেম! ওহ্, ঘামারেহ্ বনী হাশেম!’ তারপর একটা নিরবতা। তিনি উঠে গিয়ে আকবর আগাকে সাহায্য করতে চাইলেন। সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করলেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। একটা লোহার রড ঢুকে গেছে তার শরীরে। তিনি অনুভব করতে পারছেন রড ঢুকে যাওয়া স্থান থেকে উষ্ণ তরল গড়িয়ে পড়ছে। চোখগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। খুবই দুর্বলতা অনুভব করছেন। খুব কষ্ট করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতা খুলতে সমর্থ হলেন। কপাল হতে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়া রক্তে ঢেকে যাচ্ছে চক্ষুযুগল, সমস্ত মুখ। যা ঘটেছে তা তিনি স্মরণ করতে প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন। কিন্তু মনের উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি অনুভব করলেন তার সমস্ত অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে কোনো এক কৃষ্ণগহ্বরে। তারপর হঠাৎ এক ভয়ানক ঝড়, শরীরের প্রতিটি অনু এক বিশাল মাঠে বিক্ষিপ্ত হয়। আবছা চোখে যেন তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন একটা কাচের মার্বেল আর সূর্যের উজ্জ্বল আভায় ভরে গেছে সমস্ত মাঠ। সিমিন ও তারান্হে তার পাশে বসে আছে। তারা সবাই দেখতে পাচ্ছিলেন, বালকেরা বড় বড় কাচের মার্বেল বেঁধে রেখেছে তাদের কোমরে। তারা খুব সুখী, খুবই তুষ্ট; তারা লাফাতে শুরু করে, পিছলে গড়িয়ে যেতে শুরু করে মাঠজুড়ে। তাদের প্রতিটি লাফের সাথে এক-একটি রঙধনু তৈরী হয়। সহস্রাধিক রঙধনুতে সমস্ত মাঠ সজ্জিত হয়ে ওঠে। তারপর বালকেরা হারিয়ে যায়। আলো আর ধুলো মিশে একাকার হয়ে যায়, উঠতে থাকে উপরের দিকে, অনেক অনেক উপরে, উঠতে উঠতে এক সময় মেঘ হয়ে যায়, সূর্য হয়ে যায়, চাঁদ হয়ে যায়, তারা হয়ে যায়। তারপর সবকিছু ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে অন্ধকার হতে আরও অন্ধকারে। অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে থাকে। মনে হয় এ যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহ, এ যেন অন্তহীন সময়ের শুরু কিংবা সম্ভবত সৃষ্টির আদিযুগ। সাইরেনের শব্দ শোনা যায়, সব কিছু ক্রমশ বিবর্ণ হতে থাকে, বিবর্ণ হতে থাকে… তারপর সমস্ত জগৎ স্থির হয়ে যায়।


অনুবাদক পরিচিতি: মাইনুল ইসলাম মানিক কবি ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৪ সালের ১১ মার্চ, চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলাধীন বলশীদ গ্রামে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে  স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিয়মিত লিখছেন জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন সাময়িকীতে। কবিতার কাগজ তরী’র নির্বাহী সম্পাদক ও ওয়েবম্যাগ তীরন্দাজ -এর সম্পাদনা সহযোগী। ‘ঘুম কুড়ানির দল’ তার তৃতীয় অনুবাদগ্রন্থ। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন গল্প (মাওলা ব্রাদার্স) ও দশ নোবেলজয়ী লেখকের সাক্ষাৎকার (পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স) নামে আরও দুটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নের শঙ্খচিল’ (২০১৪) প্রকাশিত হয়।


 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত