| 10 অক্টোবর 2024
Categories
কবিতা সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

যবনিকা কম্পমান

কেহই কিংখাবে আর ঢাকে না বিরহ;
দাঁত নখ ইত্যাদি সবাই আজ
অনায়াসে দেখতে দেয়। পৃথিবীর নিখিল সন্ধ্যায়
গোপন থাকে না কিছু। যত কিছু
দেখিনি, এবারে সব দেখা হয়।
যেন পশুলোমে সব ঢাকা ছিল। গোলাপী কম্বল
তুলে নিলে স্পষ্ট হয় কিছু রক্ত, আর
পিত্তের সবুজ, পুঁজ, কফ, লালা,
গায়ের ইত্যাদি। সব গোলাপী কম্বলে চাপা দিয়ে
প্রত্যেকে দেখিয়েছিল এতকাল
গাত্রী, গোত্র, মেল।
অর্থাৎ মার্জিত পরিভাষার সুন্দর যবনিকা।
যবনিকা কম্পমান। দেখে যান বার্ট্রাণ্ড রাসেল।

 

প্রেমিকের ভূমি

চুলের ফিতায় ঝুল-কাঁটাতারে আরও একবার
শেষবার ঝাঁপ দিতে আজ
বড় সাধ হয়। আজ দুর্বল হাঁটুতে
আরও একবার, শেষবার,
নবীন প্রতিজ্ঞা, জোর অনুভব করে নিয়ে ধ্বংসের পাহাড়
বেয়ে টান উঠে যেতে ইচ্ছা হয়
মেঘলোকে। মনে হয়,
স্মৃতির পাতাল কিংবা অভ্রভেদী পাহাড়ের চূড়া
ব্যতীত কোথাও তার ভূমি নেই।
প্রেমিকের নেই। তাই অতল পাতালে
অথবা পাহাড়ে তার দৃষ্টি ধায়।
মনে হয়, অন্ধকারে কোটি জোনাকির শবদেহ
মাড়িয়ে আবার ঝুল-কাঁটাতারে চুলের ফিতায়
ভীষণ লাফিয়ে পড়ি। অথবা হাঁটুতে
নবীন রক্তের জোর অনুভব করে নিয়ে যুগল পাহাড়
ভেঙে উঠে যাই মেঘলোকে।
আরও একবার যাই, আরও একবার, শেষবার।

 

ঈশ্বর! ঈশ্বর!

ঈশ্বরের সঙ্গে আমি বিবাদ করিনি।
তবুও ঈশ্বর
হঠাৎ আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলেন?
অন্ধকার ঘর।
আমি সেই ঘরের জানলায়
মুখ রেখে
দেখতে পাই, সমস্ত আকাশে লাল আভা,
নিঃসঙ্গ পথিক দূর দিগন্তের দিকে চলেছেন।
অস্ফুট গলায় বলে উঠি:
ঈশ্বর! ঈশ্বর!

 

অন্তিম শ্রাবণসন্ধ্যা

বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে জলের গন্ধ রয়েছে এখনও।
আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হয়,
খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে সে আবার কাজে লেগে যাবে।
পাখিরা তা জানে, তাই কোনো
উৎসাহ তাদেরও নেই এই মুহূর্তে ডানা ছড়াবার।
দিকচিহ্নহীন
যে-বিশ্বে রঙের স্পর্শ এতক্ষণ কোথাও ছিল না,
মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব বিদায়ের ক্ষণে
সেখানে সামান্য রঙ ছড়িয়ে দিলেন।
জানালায় বসে দেখি শেষ হলো আরও একটি দিন
অন্তিম শ্রাবণে।

 

ফেরিওয়ালা

সাতসকালে একজন ফেরিওয়ালা এসে হাঁক পাড়ত,
`মুড়ির চাক, চিড়ের চাক!` আর
ভরদুপুরে, কাঁটাওয়ালা দড়ির বান্ডিল কাঁধে ঝুলিয়ে,
আর-একজন এসে গম্ভীর গলায় বলত,
`কুয়োয় পড়ে যাওয়া ঘটি-বাটি তোলাবে গো…`
আসলে ওরা দুজনেই যেন
মনে করিয়ে দিত যে, শহরে এসেছি বটে, তবে আমাদের
গ্রাম-জীবনের শেকড় এখনও
কাটা পড়েনি।
আবার রাত একটু বাড়তেই এই যে আর-একজনের
অনেক দূর থেকে ভেসে আসা
মিহি ও করুণ ডাক আমরা শুনতে পেতুম
`চাই বেইলফুল`,
সেই ফেরিওয়ালাটিও সম্ভবত আমাদের
বলতে চাইত যে, ফুলও যেখানে বিক্রি হয়, সেই
শহরের সঙ্গে সাবেক
গ্রাম-জীবনের শেকড় আর কখনও জোড়া লাগে না।
অনেক কাল আগের কথা। কিন্তু সেই তিন
ফেরিওয়ালার
তিন রকমের ডাক এখনও ভুলিনি।

 

বৃষ্টির পর

কিছুটা আলো কালো মেঘের
রেলিঙে ছিল ঝুঁকে।
কিছুটা ছিল আড়ালে, আর
কিছুটা সম্মুখে।
ছবিটা তবু পূর্ণ নয়,
খানিক ছিল বাকি,
পৃথিবী থেকে আকাশে তাই
উড়াল দেয় পাখি।

সারাটা দিন বৃষ্টি আর
বাতাসি আস্ফোটে
ছিল না যার চেতনা, যেন
ধীরে সে জেগে ওঠে।
দিনাবসানে মাঠকোঠার
দরজা ধরে ঠায়
দ্যাখো সে ওই দাঁড়িয়ে আছে
শ্রাবণ-সন্ধ্যায়।

যা কিছু দ্যাখে তাতেই যেন
ভারী অবাক মানে,
বোঝে না ছিল কোথায়, আর
এল সে কোনখানে।
এ যদি সেই পোড়া শহর
তা হলে বলো হেন
অঙ্গে তার এত বাহার
ঝলমলায় কেন।

পৃথিবী যেন পৃথিবী নয়,
আলোর সরোবর;
আলোয় ভাসে বৃক্ষলতা
সমূহ বাড়িঘর।
অবাক হয়ে আকাশে চেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে একা,
বোঝে না কেন এমন ছবি
হঠাৎ দিল দেখা।

আকাশে আলো ছড়িয়ে যায়,
বাতাস মধুময়।
নিরুচ্চার কে যেন বলে
চলছে: জয়, জয়!
যেখানে যায়, যেদিকে চায়,
আলোয় মাখামাখি।
সাঁঝবেলায় আলোর জলে
সাঁতার কাটে পাখি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত