চেয়ারে বসে আমি চুল আঁচড়াই । আমার মাথার চুল অন্ধকার রাতের মতো নিকষ কালো এবং পাতলা ঘুমের মতো স্বল্প, খাটো । চুলের শেষ প্রান্তে চিরুনী পৌঁছার পরপরই আমি আবার শুরু করি – উপর থেকে নিচে, পেছন থেকে সামনে, একবার, দশবার, এক শ’বার । আমার জন্য এটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় । মাথার খুলির নিচে রক্ত চলাচল করার জন্য ডাক্তার বলেছে আমি যেন প্রতি রাতে শক্ত হাতে নিদেন হলেও শত বার চুল আঁচড়াই । হয়তো এ কারণেই চুল পড়া বন্ধ হতে পারে । কিন্তু আমার মাথা থেকে আরো বেশি চুল পড়ে । আমি চুলগুলো
ড্রেসিং টেবিলের এক পাশে রাখি এবং এক এক করে গণনা করি । একসময় ক্লান্তিতে খেই হারিয়ে ফেলি এবং গণনা বন্ধ করি । ডাক্তার বলেছে আমি যেন অবশ্যই চুল গোণা বন্ধ করি । কেননা তা না করলৈ আরো বেশি দুঃশ্চিন্তা বাড়বে এবং আরো বেশি চুল পড়বে । প্রতি রাতেই ভাবি আজ শেষ । এক শ’, এক শ’ দশ, এক শ’ কুড়ি, এক শ’ …
ড্রেসিং টেবিলের এক পাশে রাখি এবং এক এক করে গণনা করি । একসময় ক্লান্তিতে খেই হারিয়ে ফেলি এবং গণনা বন্ধ করি । ডাক্তার বলেছে আমি যেন অবশ্যই চুল গোণা বন্ধ করি । কেননা তা না করলৈ আরো বেশি দুঃশ্চিন্তা বাড়বে এবং আরো বেশি চুল পড়বে । প্রতি রাতেই ভাবি আজ শেষ । এক শ’, এক শ’ দশ, এক শ’ কুড়ি, এক শ’ …
কিন্তু আমি ড্রেসিং টেবিলের উপর স্তুপাকারে পড়ে থাকা চুলগুলোর দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারি না। চুলের সংখ্যাই বলে দেয় দিনটা কেমন ছিল । চুলের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে সারাদিন ভীষণ বাজে ছিল । দিনটা যদি দুঃশ্চিতায় কাটে, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি চুল পড়বে এবং চুলের সংখ্যাও অধিক হবে ।
আয়নায় আমি আমার স্বামীকে দেখতে পাই । সে তার ডেস্কের দিকে হেঁটে যাচ্ছে । সে ডেস্কের সামনে বসে এবং একটা কলম ও কিছু কাগজ টেনে নেয় । কেমন করে সে নিজের কাজ এত বেশি ভালোবাসে ! আমি জানি । আমিও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি । তবে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই যে, সে আদৌ তা জানে কি না । কথাটা তাকে বলার জন্য আমি আরেকবার মুখ হা করি । কিন্তু আশ্চর্য্যভাবে কথাগুলো কন্ঠনালীতে আটকে গিয়ে শুধু গরগর আওয়াজ করে এবং অবশেষে বাইরে বেরিয়ে আসে না । হয়তো ঠিকই কথারা ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু আমার স্বামী তা শুনতে পায় না । আমি আরো একবার চেষ্টা করি । আমি দু’ঠোঁট ফাঁক করি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মন পাল্টাই এবং পুনরায় চুল আঁচড়াতে থাকি । এক শ’ কুড়ি, এক শ’ তিরিশ, এক শ’ …..
চুল পড়ার কারণ সাতাশিটা (নাকি আটাত্তরটা) ? তবে মাত্র কয়েকটা কারণ উদ্ভাবন করা গেছে, যেমন পুষ্টিহীনতা, ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগবালাই, হঠাৎ ওজন হ্রাস পাওয়া এবং স্নায়ুর অস্বাভাবিকতা । কিন্তু আমি শান্ত স্বভাবের মানুষ । আমার স্বামী তাই বলে । আমি জানি তার কাজ নিঁখুত এবং সুন্দর ভাবে করার জন্য শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশের প্রয়োজন – শান্ত পাড়া-পড়শী, শান্ত সংসার এবং শান্তশিষ্ট স্ত্রী।
চুলের স্বাভাবিক নিয়মই হলো একসময় মাথা থেকে পড়ে যাওয়া । দিনে ষাট থেকে এক শ’টা চুল পড়া মামুলি ব্যাপার । ডাক্তার বলেছে, ‘ভালো খাও এবং ভালো ঘুমাও ।’
ঘুম আসার জন্য আমি আকাশের বুকে তারা গুণি – একটি তারা, দু’টি তারা, তিনটি তারা … একসময় নিজের অজান্তেই আমার দৃষ্টি চলে যায় ড্রেসিং টেবিলের উপর । তারা গোণার বদলে আমি স্তুপিকৃত চুল গণনা অব্যহত রাখি: চারটি চুল, পাঁচটি চুল, ছয়টি …..
গত পরশু আমার এক বান্ধবী ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘তুমি কী তোমার করোটিতে দ্রুতপথ বানাচ্ছ ?’
আসলে আমার বান্ধবী ঠিকই বলেছে । চুল যত বেশি পড়বে, মাথার খুলিতে তত বেশি জায়গা অনাবৃত হবে । বান্ধবীর কথা শুনে আমার স্বামী অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে । অনেকদিন পরে আমি তাকে এমন শব্দ করে হাসতে দেখি । তার হাসি দেখে আমারও হাসি পায় । আমি অনেকক্ষণ হাসি । যাহোক, সেই রাতে চুল আঁচড়ানোর পরে আমি এক শ’ পয়তাল্লিশটি মরা চুল গুণেছি ।
আমার চুল পড়া আমি আর গুণবো না । অবশেষে আমি মনস্থির করেছি । বাড়ির আশেপাশে পায়চারি করার জন্য একসময় আমি উঠি । আমার স্বামী কাজের মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে । তার কলমের নিব থেকে কত দ্রুত শব্দ বেরিয়ে আসে ! আমি তার কাছে যাই । তার মাথার ঘন কালো কোকড়ানো চুল স্পর্শ করতে খুব ইচ্ছে করে । কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিই । পাছে ভয় হয় আকস্মিক বিস্ময়ে যদি সে ভড়কে যায় এবং তার স্মৃতি থেকে কথারা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে । আমি কিছুক্ষণ তার পাশে দাঁড়াই । কিন্তু সে কাজে এত গভীর ভাবে মগ্ন যে, আমার উপস্থিতি তাতে কোন ব্যাঘাত ঘটে না । সে বলে, ‘আমি যখন কাজে মশগুল থাকি, তখন আমার মন থাকে অন্য দুনিয়ায় ।’ আমি আয়নার সামনে ফিরে আসি । ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে আমি সব চুল ফেলে দিতে চাই । কিন্তু পারি না । আসলে চুল গোণা আমাকে ব্যস্ত রাখে এবং সময়টা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে । এক শ’ চল্লিশ, এক শ’ পঞ্চাশ, এক শ’ …..
পড়ে যাওয়া চুল আমাকে মৃত মানুষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, মৃত মানুষের কথা মনে হলে সব মৃত মায়েদের কথা মনে পড়ে, মৃত মায়েদের কথা মনে হলে আমার আপন মায়ের কথা মনে হয়, যিনি মারা যাননি এবং এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন । মা অনেক দিন আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন । আমি ভীষণ ভাবে তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করি ।
চেয়ার কঁকিয়ে উঠে এবং তৎক্ষণাৎ আমার সম্বিত ফিরে আসে । চট জলদি আমি চোখের পানি মুছি । আমি জানি আমার স্বামী কান্না মোটেও পছন্দ করে না । শিল্পীরা আসলেই তাই । তারা খুবই স্পর্শকাতর। তাদের মন খুব সহজেই নেতিয়ে পড়ে এবং অল্পতে তারা মানসিক ভাবে আহত হয় । আমার স্বামী তাই বলে এবং আমি তাকে বিশ্বাস করি । আসলে আমি তার সব কথাই বিশ্বাস করি । আমার মা-ও তাই বলেন । নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার আগে কিংবা নিদেন হলেও ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে স্তুপিকৃত মরা চুল সরানোর পূর্বে তাকিয়ে দেখি স্বামী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে । আস্তে করে আঙুলের ফাঁক গলিয়ে হাত থেকে চিরুনী পড়ে যায় এবং মেঝেতে আমার পায়ের উপর পড়ে । ভাগ্যিস, সে বুঝতে পারেনি ।
একসময় আমি বললাম, ‘তুমি কী জিতেছ, নাকি হেরেছ ?’
সে কোন কথা বললো না, শুধু নিঃশব্দে হাসল । আমি জানি, সে জিতেছে । আসলে সে সব সময়ই জয়ী । এক মুহূর্তের জন্য সে আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো করে চেপে ধরে । তারপর সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় । কিছুক্ষণ পরে স্বামী যখন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তখনো আমি ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত । বিছানার এক কোণে আমি জড়োসড়ো হয়ে আছি । আমার চোখের পাতা বন্ধ এবং আমি তার চপ্পলের আওয়াজ শুনতে পাই । সে পলকের জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায় । এই সময় সে টেবিলের উপর আমার এক গোছা মরা চুল দেখতে পায় । তারপর সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় এবং মুখটা বিকৃত করে চলে যায় । মরা মানুষ দেখে হাসার জন্য কঠিন হৃদয় লাগে । তারপরেও সে একজন কবি । কয়েক মুহূর্ত পরে আমি টয়লেটে পানির শব্দ শুনতে পাই । আমি আঙুলের ফাঁকে ধরে আরেকবার চিরুনী দিয়ে জোরে চুল আঁচড়াই:
এক শ’ ষাট, এক শ’ সত্তর, এক শ’ …..