ঈশানী রায়চৌধুরীর গল্প আলোছায়া দোলা

Reading Time: 5 minutes

 

আলোছায়া দোলা

(এক)

ছাদে মাদুর বিছিয়ে অন্ধকারে শুয়ে ছিল অঞ্জলি। আজকাল শীতের মুখে মুখে বড় তাড়াতাড়ি বেলা ফুরিয়ে আসে। শরীরটা ভালো নেই তার। গা ঢিসঢিস করে খুব। অবিশ্যি শাশুড়ি বলেন, এ সময়টায় নাকি সব মেয়েদেরই এমন হয়। উফ, আর কত দিন এমন চলবে কে জানে! সময় যেন কাটতেই চায় না! সবে আট মাস চলছে এখন। তার এতদিন ছেলেপুলে হয়নি, সে একরকম কষ্ট ছিল। খোঁটা খাওয়ার কষ্ট। কিন্তু এই অস্বস্তি রীতিমতো অসহ্য! একটু একটু হিম পড়া শুরু হয়েছে। শিরশিরে ভাবটা নেহাত মন্দ লাগছিল না তার।গজগজ করতে করতে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন সরমা। ঠান্ডা পড়লেই হাঁটুর ব্যথাটা এমন চাগিয়ে ওঠে! ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে হবে, সেও এই বয়সে তাঁকেই উদ্যোগ নিতে হয়। ছোট বউমাটি পোয়াতি হওয়া ইস্তক কুটো নেড়ে দুটো করে না। তাঁর নিজেরও তো দুটি সন্তান! কই, এমন গা এলিয়ে শুয়ে থাকার কপাল তো ছিল না কখনও!—অঞ্জলি, কী আক্কেল তোমার! ভর সন্ধেবেলা এই অবস্থায় চুল এলিয়ে মাদুরে গড়াচ্ছ! খোলা ছাদে! লেখাপড়া তো শিখেছ মা অনেক, তা এটুকুও কি শিখে আসনি?অঞ্জলির মাথায় ঝাঁ করে রক্ত উঠে যায় এসব ঠেস দেওয়া কথা শুনলে। সে উঠে বসতে বসতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,—কোথা থেকে আর শিখব বলুন! আমাকে বাপ-মা মরা জেনেই তো ঘরে এনেছিলেন!ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও চুপ করে থাকলেন সরমা। আজ রাতের প্লেনে বড় ছেলে আর বড় বউমা আসছে কয়েকদিনের জন্য। মনের খুশিতে আগুন ধরাতে আজ আর ইচ্ছে করছিল না তাঁর।নয়নিকা, অর্থাৎ সরমার বড় বউমাটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। সরমা বোঝেন, তাঁর অনেক কিছু অপছন্দ করলেও সামনাসামনি সে নিয়ে কোনও অসন্তোষ প্রকাশ করে না নয়নিকা। তার বাকশক্তি সরব না হলেও চোখের অবজ্ঞা বুঝিয়ে দেয় সরমার যুক্তিবুদ্ধি বা মেয়েলি কূটকচালির সীমাবদ্ধতা।নয়নিকা হাতমুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে গল্প করছিল অঞ্জলির সঙ্গে। সরমার কানে এল দু-জায়ের আলাপ-আলোচনা।নয়নিকা বোঝাচ্ছে অঞ্জলিকে,—এখন তোর শরীর বেজুত বলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে বুঝি। তুই এক কাজ কর। ভালো ভালো বই পড়, গান শোন…। বাচ্চার পক্ষে ভালো।—পড়ি তো! এখন যেমন রাজশেখর বসুর মহাভারত পড়ছি।আবছা হেসে নয়নিকা বলল,—তুই যা গোলমেলে লোক! নির্ঘাত কুরুক্ষেত্র পর্ব পড়ছিস! মন দিয়ে রোজ শান্তিপর্ব পড়বি, কেমন?এই প্রথম অঞ্জলি ফুঁসে উঠল না। একটু অবাকই হলেন সরমা। কিন্তু এসব কী বলছে অঞ্জলি? সরমা শুনতে পেলেন অঞ্জলির তাচ্ছিল্য করে বলা কথা ক’টি,—দূর, ছাড়ো তো! আমার পেট থেকে সাপ বেরবে, না ব্যাঙ বেরবে, ভগবান জানেন, তার জন্য আবার শান্তিপর্ব!

(দুই)

সেদিনই নয়নিকার বুকটা কেঁপে উঠেছিল আশঙ্কায়। এভাবে কেউ কথা বলে? আর ঠিক যে ভয়টা দু-হাতে প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছিল সে মন থেকে, ঠিক সেটাই সত্যি হয়ে গেল। অঞ্জলির মেয়েটা জন্মের সময় থেকেই অপুষ্ট, পঙ্গু। সরু সরু হাত-পা, হাড়ের বৃদ্ধি নেই, সবকিছু করিয়ে দিতে হয়; এমনকী পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়। অথচ মুখখানি টুলটুলে ভরন্ত। বিয়ের দশ বছর অপেক্ষার পরে এমন দুর্ভাগ্য!আশ্চর্য ব্যাপার হল, বাড়ির অন্য সকলে ছটফট করছে, দুশ্চিন্তা করছে, কষ্ট পাচ্ছে, সরমা তো দিন নেই রাত নেই পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই ঠাকুরঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন, শুধু অঞ্জলির কোনও হেলদোল নেই। এক আশ্চর্য উদাসীন কাঠিন্য লেগে থাকে তার চোখেমুখে।সে যন্ত্রমানবীর ক্ষিপ্র পারদর্শিতায় বাচ্চার দেখভাল করে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাকে সন্তানের অযত্ন করতে দেখেনি কেউ একতিল, তেমনই কখনও আদর করতেও দেখেনি। সংসারের কাজে তেমন কোনওদিন গা না পাতলেও মেয়ের সব খুঁটিনাটি কাজ কিন্তু নিজের হাতেই করে অঞ্জলি। শুধু মাঝেমাঝে ফুরসত পেলে দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।এ বাড়ির সামনে তাকালে অনেক দূরে একটা ঝকঝকে আয়নার মতো পুকুর চোখে পড়ে। তার স্বচ্ছ জলে আবছা নীল ছায়া। আকাশের। অঞ্জলি যতদূর পারে চোখ ছড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। জল দেখে খুব মন দিয়ে। মুখ তুলে আকাশও দেখে। নীল ধনেখালি শাড়ি আকাশ। সদ্য পাটভাঙা। অঞ্জলির নিজের শাড়িতে শুধু অসুস্থ শিশুর গন্ধ লেগে থাকে চব্বিশ ঘণ্টা।শিশুটির কোনও ভালো নাম ছিল না। আসলে দরকারও পড়েনি। স্কুলে ভর্তি করা হয়নি কখনও। অথচ জন্মের পরে একটা সুন্দর ডাকনাম রাখা হয়েছিল। নিশ্চয়ই ওর জন্মের আগে অঞ্জলি আর প্রীতমের ভাবনাতে ছিল যে, স্কুলে ভর্তির সময়ে বাচ্চার একটা সুন্দর ভালোনামও দিতে হবে। কিন্তু সে সব ইচ্ছের কুঁড়ি আর ফুল হয়ে ফোটার অবকাশ ছিল না। কারণ ও জন্ম থেকেই ‘অন্যরকম’।কী যে ভয়ঙ্কর শব্দ এই ‘অন্যরকম’। এই মূলস্রোত থেকে ব্রাত্য করে দেওয়া মানুষজন। স্কুলে যেত না ও। কোন স্কুলে যাবে, কে ওই চাপ নেবে? প্রীতম চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, অঞ্জলি অমন অদ্ভুত আর সরমা যত দিন যাচ্ছে, জবুথবু হয়ে পড়ছেন ক্রমশ। নয়নিকারা আসে বছরে একবার কী বড়জোর দু-বার। কিন্তু এসে কেমন ‘যাই যাই’ করে।আসলে কিছুই নয়, অস্বস্তি আর অপরাধবোধে ভোগে। কারণ তার সন্তানটি পুত্রসন্তান এবং ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে সম্পূর্ণ সুস্থ আর নীরোগ।

(তিন)

চলে গেলেন সরমা। যাওয়ার সময় যে এগিয়ে এসেছে, সেটা তো জানাই ছিল। শুধু সেটা যে ঠিক কবে, তার কোনও আগাম সতর্কবার্তা ছিল না। আর একজন মানুষ কমে গেল এই মস্ত বাড়িটার ভেতর থেকে। নয়নিকা আর অংশুমান বরাবরের প্রবাসী। তাদের একটি মাত্র ছেলে বিদেশে পড়াশুনো করছে। বোঝাই যায় যে সে আর ফিরবে না। নয়নিকা আর অংশুকে যত দেখে, অবাক লাগে অঞ্জলির। তার অসুস্থ অপুষ্ট মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে যাবে ঠিক একদিন, এটা ভেবে সে মন শক্ত করছে একটু একটু করে আর এদিকে এদের দেখো! সুস্থ সবল ছেলেটা কোন বিদেশে পড়ে রইল, তা নিয়ে কোনও মনখারাপের বালাই নেই! এত বড় বাড়ি, বাগান সব এখন ভূতের মতো আগলে রাখার দায় প্রীতম আর অঞ্জলির। অংশুমান তো দাবিদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আচ্ছা, এত বড় বাড়ি দিয়ে হবেটা কী? তার চেয়ে বাড়ি বেঁচে একটা ফ্ল্যাট কিনে খাস কলকাতায় চলে গেলেই তো ভালো হতো। টাকাপয়সা যা আছে, গুছিয়ে মেয়েটার ভবিষ্যতের একটা সংস্থান করাটা কি উচিত ছিল না প্রীতমের? অঞ্জলির ভাবতেই তো হাড় হিম হয়ে যায়, তাদের অবর্তমানে এই মেয়ের কী হবে! তাহলে কি একটু বড় হওয়ার পরে কোনও হোমে দিয়ে দিলেই ভালো হতো? কেমন যেন আটকে রইল মেয়েটা! ডানাভাঙা মুখ-থুবড়ানো পাখির মতো। জীবনের অন্ধগলিতে।দিন কাটছিল নিজস্ব নিয়মে। বয়স সর ফেলছে প্রীতম আর অঞ্জলির শরীর জুড়ে। তাদের চোখের কোণে কাকের পায়ের ছাপ। অঞ্জলির খুব ভয় করে আজকাল। ফট করে তাদের কিছু হয়ে গেলে বুবাইকে দেখার লোক নেই। এখন অহরহ ভয় আঁকড়ে বেঁচে থাকা তাদের স্বামী-স্ত্রীর। মাথার উপরের এতকালের আত্মবিশ্বাসের ছাতার শিক দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিচ্ছে এই সময় ফুরনোর ভয়। এখন যেন মনে হয় ছাতার কাপড়টাও ছিঁড়তে শুরু করেছে।এত দম্পতি সুস্থ সুন্দর শিশুর মা-বাবা হয়, আর তাদের দুজনের কপালটাই মন্দ! এত বছর পরে যদি বা ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন, বুবাই সেই জন্মের সময় থেকেই এমন! সে যে কন্যাসন্তান, সেও তো বড় কম জ্বালা নয়! পড়াশুনো তো সম্ভব ছিল না, সে চেষ্টাও করেনি প্রীতম আর অঞ্জলি। তারা খেয়াল করেছে, মেয়েটা গান বড্ড ভালোবাসে। তাই ভালো মিউজিক সিস্টেম রাখা আছে ঘরে। অগুনতি সিডিও। নয়নিকারা এলে ভালো ভালো সিডি কিনে ঘর বোঝাই করে দেয়। গান বাজানো হলেই বুবাইয়ের ঝকঝকে চোখ দু’টি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কথা যদিও সামান্য জড়ানো, কিন্তু অবোধগম্য পুরোপুরি নয়। সে জানালা দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে। একদিন দু’দিন, বছরের পর বছর। বুবাই এখন দশ বছরের।

(চার)

প্রতিবার দুর্গাপুজোর বোধন হয়, ঢাকে কাঠি পড়ে। এক তলার জানালার ধার ঘেঁষে রাখা পালঙ্কে শুয়ে থাকে বুবাই। ছেলে বুড়ো সব্বাই ওই জানলার পাশটি দিয়ে প্রতিমা দর্শনে যায়। পাড়ার চেনা রিকশাওয়ালা সাধ্যসাধনা করে, মামণি চলো, সাবধানে নিয়ে গিয়ে তোমাকে আজকের দিনে মায়ের মুখটি দেখিয়ে আনি। তোমার কষ্ট হবে না।শৈশব পেরিয়ে বালিকা এখন বুবাই। সে বেরতে চায় না বাইরে। তার দিকে তাকিয়ে অঞ্জলি রিকশাওয়ালাকে বলে, পাগল হলে? লোকে ঠাকুর ফেলে আমার হাবা মেয়েটাকে দেখবে!বুবাইয়ের গোটা পৃথিবী ওই আয়তাকার চৌহদ্দিতে বন্দি। ২৪ বর্গফুট। তার ঠাকুমার বিয়ের সময়কার লতাপাতা আঁকা খাঁটি বার্মা টিকের নকশি-খাট!মুখে হাসিটি অটুট কিন্তু তার।সময় পেরিয়ে যায় অজান্তে। পেরিয়ে যায় একটা একটা করে ক্লান্তিকর দিন এবং রাত। অঞ্জলি আর প্রীতমের বয়স এগয়। বরং বলা ভালো, ছোটে। তাদের দু’জনের মুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। কে দেখবে বুবাইকে? কিন্তু মৃত্যু তো মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। সে নিজের মর্জি মাফিক আসে। উড়িয়ে পুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়।এই সব সন্তান সচরাচর দীর্ঘজীবী হয় না। বুবাইয়ের বেঁচে থাকার সলতেটিও খুব ক্ষীণ শিখায় জ্বলে। জ্বলতেই থাকে। অঞ্জলি আজকাল মাঝে মাঝে মুখে বলেও ‘আমরা থাকতে থাকতে ও চলে যাক’। কিন্তু অবচেতনে আবার শিউরে উঠে ঠিক, ‘ষাট ষাট, ঠাকুর, ওকে রক্ষা কোরো’।এই পরস্পরবিরোধী কথায় অন্তত এই ক্ষেত্রে অবচেতন হারিয়ে দেয় যুক্তিবুদ্ধিকে। বুবাই বেঁচে থাকে। হিসেবের বাইরে অনেক ক’টা দিন। বাড়তি।

(পাঁচ)

তারপর সেই দিনটি আসে। যে দিনটি আসার কথা তো ছিল অনেক আগেই, কিন্তু ঘরে ঢোকার আগে চৌকাঠে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল মৃত্যু। প্রথমে মৃত্যুর হাল্কা শ্বাস শোনা যাচ্ছিল, তারপর একেবারে দামাল ঝড়। বুবাই চলে গেল।খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল অংশুমান আর নয়নিকা। নয়নিকাই এই সেদিন কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বড় অদ্ভুত একটি কথা বলল।‘জানো, দুঃসংবাদ পেয়ে আমরা যখন পৌঁছলাম, ওর দু’টি শীর্ণ হাতের ঠান্ডা আঙুল জড়িয়ে ধরে রেখেছে অঞ্জলি আর প্রীতম। আমার শাশুড়ি-মায়ের বিয়ের পালঙ্কতে শুয়েছিল বুবাই। বাবা আর মা, ওর দু-পাশে দু’জন বসে। কেউ কোনও কথায় নেই, কেউ কোনও কান্নায় নেই। শুধু…কী আশ্চর্য, দু-জনেরই মুখে ঠিক মাঝবরাবর লম্বালম্বি, প্রায়-অদৃশ্য একটি সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা। ঠিক যেন সরু তুলি দিয়ে আঁকা। যে রেখার একপাশে যে মুখের অংশ তাতে আলো পড়েছে… সে আলো স্বস্তির আর নিশ্চিন্ততার। মুখের অন্য পাশটিতে কালচে সবুজ সরের মতো ছায়া… ব্যথার, সব ফুরিয়ে ফেলার, সব ফুরিয়ে যাওয়ার।’নয়নিকার কথা শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম, আমরা ছায়ার হাত ধরে আলোয় পৌঁছই, নাকি আলো পেরিয়ে ছায়ায়?

[প্রচ্ছদ কৃতজ্ঞতা কল্লোল হাজরা]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>