অনুবাদ গল্প: প্রণয় । সাদাত সায়েম । অনুবাদক ইশতিয়াক ফয়সল
অনুবাদ: ইশতিয়াক ফয়সল
বিদ্রুপের একটা হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁটে। খুব তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে খোঁপাটা দেখছিলাম। নানান রকম ছোট ছোট সাদা ফুল দিয়ে সাজানো ওটা। কিছুক্ষণ ধরে চিনতে চেষ্টা করলাম কি ফুল ওগুলো। মেয়েটা বসে আছে মিরপুরগামী বাসটার তিন নাম্বার সারিতে জানালার পাশে, আর আমি তার পেছনের সারিতে।
মেয়েটার পাশে বসে থাকা ছেলেটা ক্রমাগত ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কিসব বলে চলেছে। আমি ঘাড় উঁচিয়ে মেয়েটার মুখ দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুখের বদলে দেখতে পেলাম ওর দুর্দান্ত ঘাড় আর বাঁ কানটা। আমার মনে হলো ওর বাঁ কানটা যেন ছেলেটার কথাগুলো শুনছে না। ওটা যেন ফাগুন বাতাসের প্রায় অশ্রুত গুঞ্জন শুনে চলেছে। দিনটা ছিলো ভ্যালেন্টাইনস ডে।
রামপুরা ব্রিজের কাছে এসে বাস থেকে নেমে গেলাম। নামার সময় বাঁ কাঁধের উপর দিয়ে ওই প্রেমিক জুটিটার দিকে তাকালাম- বিশেষ করে মেয়েটার দিকে। ওর চোখজোড়া হাসছে- চটপটে ছেলে বন্ধুটির বুদ্ধিদীপ্ত কোন কৌতুকে হবে হয়তো। দেখলাম মেয়েটার গালে টোল পড়লো।
আমি চল্লিশ ছুই ছুই একজন মানুষ। ডাক্তার বলে দিয়েছেন দৈনিক ন্যুনতম বিশ মিনিট হাঁটা আমার বাধ্যতামূলক। আসন্ন টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আগমন বিলম্বিত করতে ডাক্তারের এই নির্দেশ। তাছাড়া হাঁটা নাকি আমার অনিদ্রারও একটা চিকিৎসা হতে পারে। স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই রোগটাতে ভুগছি আমি।
যাহোক, হাতিরঝিলের একটা ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম আমার অফিসের দিকে। কিছুদূর যাবার পর প্রথম যে লোকটার সাথে দেখা হলো সে একজন ফুলবিক্রেতা। ওয়াকওয়ের উপর একটা ভ্রাম্যমান দোকানে লাল গোলাপ বিক্রি করছিল সে।
– ফুল লাগবে স্যার? লাল গোলাপ?
সতর্কতার সাথে লোকটার দিকে তাকালাম, যদিও অনিদ্রার কারণে আমার চোখের পাতা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক দ্রুতই পড়ছিলো। কিন্তু বাজপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো ওর চোখদুটো আমার নজর এড়ালো না। ছেলেটার বয়েস আমার থেকে বেশ কমই হবে। তার বাঁ কাঁধে পাটের তৈরী একটা ব্যাগ ঝুলছে।
টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা ফুলগুলোর দিকে তাকালাম। ছেলেটা ফুলগুলো এমনভাবে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছে যেন কোন দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য উৎসর্গ করছে।
-একদম টাটকা ফুল স্যার। সাভার থেকে আনা হয়েছে। দ্যাখেন এখনো কেমন শিশির মুড়ি দিয়ে ঘুমায় আছে। আপনি কি স্যার নেবেন কয়েকটা?
– নাহ্। লাল গোলাপ টোলাপ দেয়ার মতোন কেউ নেই আমার।
আমার চাঁছাছোলা এই উত্তরে ছেলেটা কেমন থতমত খেয়ে গেলো। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে সে তার পরবর্তি কথাগুলো গুছিয়ে নিতে থাকলো।
ওখান থেকে ঝিলের দিকে তাকালাম। দেখলাম সকালের ঝিরিঝিরি বাতাস ঝিলের জলে বিলি কেটে যাচ্ছে।
– ফুল কত করে? টেবিলে সাজানো গোলাপগুলোর দিকে ইংগিত করে বলে উঠলো এক যুবক।
– আমি সেই ভোর থেকে আপনার অপেক্ষায় আছি, স্যার। অন্যরকম এক খোশামুদে স্বরে বলে উঠলো ফুলবিক্রেতা।
আমার কাছে মনে হলো একদম সঠিক খদ্দেরের দেখা পেয়ে গেছে ছেলেটা আর তাতে বেশ সন্তুষ্টই মনে হলো তাকে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
‘স্যার’, পেছন থেকে আমাকে ডাকলো ছেলেটা। ‘যদি আমাকে আরো খানিকটা সময় দিতে পারেন, তাহলে আপনার সাথে অন্য আরেকটা ব্যাপারে একটু কথা বলতাম।’
এই ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীরা কত ফিকিরই না করে তাদের জিনিসগুলো মানুষকে গছিয়ে দিতে! তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম ওর অনুরোধে সাড়া না দিতে। কিন্তু ঠিক কি কারণে জানিনা, আমি ওকে না বলতে পারলাম না।
ফিরে গিয়ে ওর টেবিলের পাশে কংক্রিটের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম।
‘আমার কথায় যদি কিছু মনে না করেন, স্যার, ফুলের পাশাপাশি আমি প্রেমসঞ্জীবনী বিক্রি করি,’ সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে উঠলো সে।
‘প্রেমসঞ্জীবনী!’ অবাক হয়ে নিজের অজান্তেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলাম শব্দটা।
‘জী স্যার, আমি মূলত ওটাই বিক্রি করি। আমার কাছে বিভিন্ন ধরণের প্রেমসঞ্জীবনী পাবেন। সেখান থেকে আপনার পছন্দমত একটা বেছে নিতে পারবেন,’ এই বলে ছেলেটা তার কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগটার দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এক শিশিই যথেষ্ট, স্যার।’
‘প্রেমসঞ্জীবনী? বিভিন্ন ধরনের? বলেন কি!’
‘কোন কিছুর ধরন একটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, স্যার,’ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত অথচ সরল একটা হাসি দিয়ে ছেলেটা ব্যাখ্যা করতে থাকে, ‘ভালোবাসার সব রূপ আসলে একই রকম না, স্যার। মনে করেন আপনি গুইনিভিয়ের-লান্স্যলট ধরনটা পছন্দ করলেন। এতে খুব দ্রুত সফলতা আপনি পাবেন ঠিকই, কিন্তু তাতে সাংঘাতিক ঝুঁকিও থাকবে। আবার শিরি-ফরহাদ ধরনটা যদি পছন্দ করেন; তখন কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। হয়তো আপনার প্রেমযাত্রা হবে ভীষণ দীর্ঘ। জী স্যার, ভীষণ রকমের দীর্ঘ এক যাত্রা হতে পারে। পাহাড়ের বুক কেটে কেটে খোঁড়া সেই চল্লিশ মাইল খালের সমান। শিরিকে বিয়ে করবার জন্য যে খাল ফরহাদকে কাটতে হয়েছিল একা একাই।’
শিরি-ফরহাদের (শিরিন-ফরহাদ) বিষয়ে আমি শুনেছি। কিন্তু এই গুইনিভিয়ের-লান্স্যলট যে কারা সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাই নেই।
‘আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, স্যার, আমার এই সঞ্জীবনীটি চিরতরে মুছে দেবে আপনার চোখে থাকা নারীর প্রতি একই সাথে লালসা ও ঘৃণা,’ বলে চলল ছেলেটা, ‘এই সঞ্জীবনীটি আপনার হৃদয়ে আগুনের একটি শিখা জ্বালিয়ে দেবে। আপনার হৃদয়কে পুড়িয়ে পুড়িয়ে সোনায় পরিণত না করা পর্যন্ত সে নিভবে না। একজন নারীর প্রেমে পড়বার মধ্য দিয়েই অবশ্য এসবের শুরু হবে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই প্রেমের এক পর্যায়ে আপনি মানবাত্মার আনন্দ ও কান্না শুনতে শুরু করবেন। প্রাণিজগতের আনন্দ ও বেদনাও অনুভব করতে পারবেন। শুনতে পাবেন উদ্ভিদের হাসি-কান্না। তখনই, হ্যাঁ স্যার, একমাত্র তখনই প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য আপনার সামনে মেলে ধরবে। নেবেন এক শিশি সঞ্জীবনী, স্যার? যাদের আসলেই এটা প্রয়োজন, আমি কিন্তু তাদের কাছে দাম কমায়ে রাখি!’
কংক্রিটের বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একবার ফুলবোঝাই টেবিলটা আর একবার ছেলেটার কাঁধে ঝোলানো বিভিন্ন ধরনের প্রেমসঞ্জীবনী ভর্তি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। যেতে যেতে মনে হলো আমার পিঠে বিঁধে থাকা বাজপাখির ঠোঁটের মতো চোখদুটোর দৃষ্টির ধার যেন ক্ষয়ে গেছে ততক্ষণে।
আরো পড়ুন: তাসের ঘর । সাদাত সায়েম
সময়ের সাথে সাথে আমাদের স্মৃতির ধারও ভোঁতা হয়ে যায়, তাই না? ঊনিশ বছর আগে এমনই এক বসন্তে গভীর নীল একটি সাগর দেখেছিলাম আমি মুনের চোখে। আমার গলা জড়িয়ে চোখে চোখ রেখেছিলো ও।
ডান হাতের তালুটা আমার কপালে রেখে বলেছিলো, ‘একি! জ্বরে তো পুড়ে যাচ্ছো তুমি!’
বুকের ভেতরে অস্থির হৃদপিÐটা মুখে কিছুই বলতে দিলোনা আমাকে। আমি ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করলাম। পুরো দুনিয়াটা যেন একটা বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে ছিল কি এক রহস্য!
সেসময় মুনের চিবুক বেয়ে ক’ফোঁটা জল ঠিক কি কারণে যে গড়িয়ে পড়েছিল তা আমি আজও জানতে পারিনি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো মুন। ওর দুগালে টোল পড়লো। দুচোখ ভরা জল নিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো ও।
সেদিন যে ঠিক কি ঘটেছিলো তা আমি ঠিকঠাক মনে করতে পারবো না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে পরের কয়েকদিন আমার সমস্ত চিন্তা ও কাজকর্ম আচ্ছন্ন করে রাখলো মুন। আমার সমস্ত শরীরে ঘাম দিতো আর গন্তব্যহীন বাউÐুলের মতো সারাদিন চষে বেড়াতাম শহরের পথঘাট।
তারপর একদিন গেলাম ওর কাছে।
– মুন শোন, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।
– দয়া করে তোমার ঐ কিছুটা বলে ফেল, রায়হান!
ওর ঐ সাবলীল ভঙ্গি আর উচ্ছ¡ল চেহারা আমার চিন্তাাগুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিয়েছিলো তখন।
– আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
কথাটা আমি বললাম ঠিকই, কিন্তু ‘চাই’ শব্দটার উপর কেমন অস্বাভাবিক একটা জোর পড়লো।
– কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না।
ও বেশ চাঁছাছোলাভাবেই জবাবটা দিলো আর কোন কিছুই না বলে।
এর ঠিক সাত মাস পর স্নাতক করতে মুন ইতালী চলে যায় ওর ভাইয়ের কাছে। তিনি ওখানকার স্থায়ী নাগরিক, থিতু হয়েছেন। এরপর বেশ লম্বা একটা সময় আমার আর মুনের কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু কিছুদিন আগে ফেসবুকে ও আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
সেদিন কারওয়ান বাজারে আমার অফিসে পৌঁছার পর কোন কাজে মন দিতে পারছিলাম না। দুপুরের পর ঠিক করলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমাদের পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হবার পর মুনের পাঠানো মেসেজগুলো পড়বো।
আমি পড়তে শুরু করলাম।
‘আমার উপর তোমার ক্ষোভ রয়ে গেছে আমি জানি। আমার আগের তিনটা মেসেজের উত্তর তুমি দাওনি। রায়হান, আমি দাঁড়িয়ে আছি চারদিকে দ্বীপ দিয়ে ঘেরা ভ্যানেশিয়ান লেগুনের সৈকতে। মনে হচ্ছে আমিও যেন এই উপসাগরটার মতো। আমার অতীত চারপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে আমাকে।’
‘আমরা দূর সম্পর্কের আত্মীয়। একসাথে বড় হয়েছি ঢাকায়। তুমি তো জানোই আমি এমন একজন মেয়ে যে কোন কারণেই নিজের স্বত্ত¡াকে বিকোতে পারবে না। সেই বসন্তে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে। এটা কোন বিষয় না, কিন্তু সমস্যার শুরু হলো যখন আমি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম। তোমাকে জানতাম মানবিক ধ্যানধারণায় সমৃদ্ধ চমৎকার এক তরুণ হিসাবে। কিন্তু আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম। প্রত্যাখ্যাত হয়ে তোমার ভেতরের মানুষটাকে দেখালে তুমি। তোমার সিদ্ধান্তকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে আমার উপরে।’
‘আমি যদি তোমাকে বিয়ে করতাম, তা করতাম শুধুই ভালোবাসার জন্য। কিন্তু তোমার জন্য আমার সব ভালোবাসা উবে গেলো যখন বিয়ে করার জন্য তুমি আমাকে চাপ দিতে থাকলে।’
‘আমাকে যখন চড় মারলে, আমার গলা চেপে ধরলে, তোমার চোখে দেখেছিলাম শুধু হিংস্রতা। ওই বসন্তের আগে এত হিংস্রতা তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে? কিন্তু আমার মন একেবারেই ভেঙ্গে গেলো যখন তুমি আমাকে বেশ্যা বলে গাল দিলে। সেই ভেঙে যাওয়া মনটা আর কখনো জোড়া লাগেনি।’
‘এতগুলো বছর পর অতীত নিয়ে তোমাকে লেখাটা ঠিক উচিত হচ্ছে না আমার। মনে হয় অতীতের বোঝাটা হালকা করতেই কথাগুলো উগরে দিলাম। ঐ স্মৃতিগুলো বয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি।’
একটা সিএনজিতে চড়ে বসলাম আমি। উদ্দেশ্য সেই প্রেমসঞ্জীবনী বিক্রেতা। কিন্তু তার সাথে যে জায়গাটাতে সকালে কথা হয়েছিল সেখানটায় পৌঁছে ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না। ঐ জায়গায় আারেকটা ছেলে ফুল বিক্রি করছিলো।
‘সকালে যে ছেলেটা ফুল বিক্রি করছিলো এখানে তাকে কি আপনি দেখেছেন?’ জিজ্ঞেস করলাম নতুন ফুল বিক্রেতাকে। ‘হালকা পাতলা গড়নের কম বয়েসি একটা ছেলে। চোখ তার খুব বাঁকা আর সাথে চটের একটা ব্যাগ ছিল।’
‘বুঝতে পারছি না, স্যার, আপনি কার কথা বলতেছেন। জ্বী, সকালে অবশ্য আমার বড় ভাই ফুল বিক্রি করছিলো। সে খুব সকাল সকাল উঠে তাই দায়িত্বটা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর চোখ তো আমাদের আর সবার মতোই। বরং স্বীকার করতেই হয় ও একটু পাগল কিসিমের। কি করবেন বলেন, আপনার প্রেমিকা যদি আত্মহত্যা করে আপনি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করায়, তখন আপনার অবস্থা এর চেয়ে আর কী ভালো হতে পারে?’
আমার ভাইটা কিন্তু, স্যার, ভালো মানুষ। ও মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায় নাই কবি হবে বলে এই একমাত্র কারণে। ও চাইতো মেয়েটা ওর কবিতার অনুপ্রেরণাদানকারী হয়ে থাকবে কেবল। মেয়েটার পরিবার জোর করে ওকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এক ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা সেই ঘর করেনি। পালিয়ে আমার ভাইয়ের কাছে চলে আসে। কিন্তু ও মেয়েটাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে। মেয়েটার আত্মহত্যার পর আমার ভাইটা কবিতা লেখা ছেড়ে দেয়। যদিও সে এখনও কাঁধের ঝোলায় কবিতা লেখার খাতা আর কলম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর আবোল তাবোল কিসব বলে যার কোন মাথামুন্ডু নাই।’
‘ও, মানে আমার ভাইটা আসলে মারা গেছে, স্যার,’ বলে চললো ছেলেটা, ‘আপনি মানেন আর না মানেন, যে মানুষ শুধু তার অতীতেই বাঁচে, আমাদের মত ছোট বা বড় যে কোন ব্যবসাদারের কাছে সে মৃত। পাগল কিছিমের মানুষ এখনো জন্মায় দুনিয়াতে। ঐ মেয়েটাও পাগল ছিলো। আপনিই বলেন, স্যার, এই যুগে এক হবু কবির জন্য কেউ আত্মহত্যা করে?’
আমি ঝিলের দিকে তাকালাম। একটা মরা ঘুঘু ভাসছে জলে। সন্ধ্যার বাতাস তার দেহটাকে মৃদু দোলা দিচ্ছে।
আমার মানসপটে ভেসে উঠলো সেই প্রেমসঞ্জীবনী বিক্রেতার মুখ। মনে পড়লো সে বলেছিল-
‘প্রেম কোন যুদ্ধ নয়, স্যার। মানে যুদ্ধ আর প্রেমকে আপনি একই বাক্সে রাখতে পারেন না। এমনকি যুদ্ধেও আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না, স্যার।’
আমার চোখে জল এলো। কিন্তু চোখের জল একটা ভাঙা মন জোড়া দিতে অক্ষম।
তবু এই বসন্তে, শিল্পায়ন আরোপিত সমস্ত প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য্য দিয়ে বরণ করে নিতে চলেছে নতুন এক প্রেমিকযুগলকে। শহরের সমস্ত রাধাচুড়া আর কৃষ্ণচুড়া তাদের শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে উঠছে ফুল ফোটাবে বলে।
সাদাত সায়েম:
কবি, গল্পকার
প্রকাশিত বই:
কবিতা: পিপাসার জিনকোড (ইবুক)
ছোটগল্প: হাসিকান্না স্টোর
প্রণয় (Love) গল্পটি সাদাত সায়েমের প্রকাশিতব্য ইংরেজি গল্পগন্থ `Disgrace and Others’ অন্তর্ভুক্ত। গল্পটি ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে Dhaka Tribune Arts & letters – এ প্রকাশিত। অনুবাদটি ভাঁটফুলসূত্রে প্রকাশিত।
অনুবাদক