ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত [Ishwar Chandra Gupta] (জন্ম: ৬ মার্চ, ১৮১২-মৃত্যু: ২৩ জানুয়ারি, ১৮৫৯) যুগসন্ধির কবি। বিখ্যাত সাহিত্যসাময়িকী ‘সংবাদ প্রভাকর’-র সম্পাদক। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের পরেই মধ্যযুগের শেষ হয়। ভাষারীতির পরিবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক যুগের সূচনার ক্ষেত্র তৈরি করেন। পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে আধুনিক যুগ শুরু। আধুনিক ও মধ্যযুগের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসাবে দাঁড়িয়ে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। মধ্যযুগের ধারা বজায় রাখার পাশাপাশি আধুনিক ভাবধারাও চালু করার প্রয়াস তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। বলা যায় যে, তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন শেষের পথে, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে কবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মানুষ, মানবতা নিয়ে ভাবনার বহিঃপ্রকাশ পাই। এক্ষেত্রে তিনি রূপকাশ্রয়ীও হয়েছেন। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, প্রচুর যমকের ব্যবহার, রূপকের মাধ্যমে সামসময়িক রাজনীতি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা। ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তোপসে মাছ’ ইত্যাদি সহজেই রূপক হিসাবে কবিতায় ব্যবহার করেছেন; এবং তা সার্থকভাবেই।
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের এ ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। মুখে মুখে রচিত হতো কবিগান। পাশাপাশি শ্রোতাদেরকে চমক লাগানো ও মনঃসংযোগের লক্ষ্যে এতে শব্দ-ব্যবহারের কলা-কৌশলও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। কবিগানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,একই শব্দ একাধিকবার অল্প ব্যবধান বা ব্যবধান ছাড়াই ব্যবহার করে ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি করা, একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা, ছন্দভঙ্গির পরিবর্তন করা। এসব বৈশিষ্ট্য আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপের কবিতায় দেখতে পাই। ‘যমক’-র ব্যবহার ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি কাব্যকৌশল।
১।‘ভাবে নাহি ভাবি ভাবি- (১ম ভাবি-ভাবনা করি; ২য় ভাবি- ভবিষ্যৎ)
২। ‘প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভ দিন দিন- (১ম দিন- দিবস; ২য় দিন- প্রদান করুন)
৩। ‘মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে-(১ম ভ্রমে-ভুলে; ২য় ভ্রমে- ভ্রমণ করে)
৪। ‘দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ, নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ- (১ম দেহ প্রদান কর; ২য় দেহ- শরীর)
৫। ‘কয় মাস খাও মাস উদর ভরিয়া’-(১ম মাস-৩০ দিন; ২য় মাস- মাংস)
৬। ‘সেতার অনেক আছে, সে তার ত নাই- (সেতার= বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, সে তার- সেই তন্ত্র)
৭। ‘তানপুরা আছে মাত্র, তান পুরা নাই’-(তানপুরা- বাদ্যযন্ত্রবিশেষ; তান পুরা- সম্পূর্ণ তান)
৮। ‘অতনু শাসনে তনু তনু অনুদিন’- (১ম তনু দেহ; ২য় তনু কৃশ)
৯। ‘আনা দরে আনা যায় কত আনারস’- (১ম আনা টাকার ১/১৬ অংশ; ২য় আনা, আনয়ন করা)
১০। ‘চিত্রকরে চিত্র করে করে তুলি তুলি’-(চিত্রকরে- চিত্রকর+ ৭মী বিভক্তি। চিত্র করে- ছবি আঁকে। করে- হাতে। ১ম তুলি – উত্তোলন করে, ২য় তুলি- আঁকার কাঠি)
১১। ‘আছি গুপ্ত পরিশেষে গুপ্ত হব ভবে/বল দেখি গুওত কোথা রবে?/ গুপ্ত হয়ে যখন মুদিব আমি/তখন এ গুপ্ত-সুতে কিসে দিব ফাঁকি।'(নির্গুণ ঈশ্বর)। এখানে গুপ্ত শব্দটির নানাব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কখনও নিজে, কখনও গোপন/লুপ্ত বুঝাচ্ছে।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয় সহজভাবে প্রকাশ করতেন। আমরা তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিষয়টি প্রবলভাবে লক্ষ্য করি। ব্যঙ্গ কবিতা, প্রচুর যমকের ব্যবহার, রূপক শব্দাবলি ব্যবহারে সমাজের অসঙ্গতির প্রতিবাদ করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ব্যঙ্গ অনেক সময় বিদ্বেষপ্রসূত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন ব্যতিক্রম। বলা হয়ে থাকে যে, ঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং ঈশ্বর গুপ্ত Satirist। ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে কিছুমাত্র বিদ্বেষ নেই। ইচ্ছে করে তিনি কাউকে গালি দেননি। তবে মেকির ওপর রাগ ছিল। এমন উদাহরণ দিই-
(১)‘তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব পোষা গোরু,/শিখি নি সিং বাঁকানো,/কেবল খাব খোল বিচালি ঘাস।/যেন রাঙ্গা আমলা, তুলে মামলা,/গামলা ভাঙ্গে না।/আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,/ঘুসি খেলে বাঁচব না।’-(পাঁঠা)। এখানে রূপকের মাধ্যমেই সমাজের স্তরবিন্যাস(উঁচু-নিচু) ও ভোগের বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন।
(২)‘কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।/গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥/মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।/মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥/পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।/সমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥-(তপসে মাছ)
একদিকে আধুনিকতার প্রতি অনুরাগ অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কারের প্রতি দুর্বলতা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের দ্বৈতসত্তার বিষয়টিকে অনেক সময় কবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তারপরও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক চিন্তাকেই গ্রহণ করে কাব্যসাধনায় বিভিন্ন বিষয়কে কবিতার উপাদান করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম এবং নীতিমূলক কবিতাগুলোই অধিক জনপ্রিয় ছিল। অনেক কবিতা আমরা কথাপ্রসঙ্গে তুলে ধরে থাকি। এমন কিছু কবিতাংশ-
(১) ‘বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,/সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।/বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,/সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।/বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,/হিতাহিত বোধ যার,বিজ্ঞ বলি তারে। বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে, নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে।’- (কে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
(২)‘চেষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব।/আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব।।/ভক্তিমতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।।/পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।/চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা।/যতনে হৃদয়েতে সমুদয় বাসা।।/স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?’- (মানুষ কে?, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
(৩)‘গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।/ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে॥/রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।/ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম॥/ পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।/মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?/শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম। বেলাক নেটিভ লেডি শেম শেম শেম…’-(ইংরেজি নববর্ষ)
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি ‘কবিগুরু’ হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি, শুক্রবার (১৬ মাঘ, ১২৩৭ বঙ্গাব্দ)। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন তিনি। ১৮৩১ সালে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসেবে এটি চালু হয়। ১৮৩৯ সালে এটি একটি দৈনিক সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হয়। এটিই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। বাংলার নবজাগরণ ও নীল বিদ্রোহের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে এই সংবাদপত্রের বিশেষ প্রভাব ছিল। ১৮৫৩ সাল থেকে পত্রিকাটির মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মাসিক সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন বাংলার কবিয়াল ও গীতিকারদের জীবনী ও কর্মগাথা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবা বিয়ে ও কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রভাকরের অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। সাহিত্যমূল্য বিচারে সংবাদ প্রভাকর ছিল অনন্য। সেই সময়ের একটি প্রথম শ্রেণির পত্রিকা ছিল এটি। বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্রের মতো অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকের সাহিত্যজীবনের সূচনা হয়েছিল এই পত্রিকার মাধ্যমে।
ঈশ্বর গুপ্তের দেশপ্রেমও ছিলো তীব্র ও বিশুদ্ধ। তাঁর পূর্বে বাংলাভাষায় কোনও কবির তীব্র দেশপ্রেমের কবিতা কমই পাওয়া যায়-
(১) ‘জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি/ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে।/তোমার কুমার যত সকলেই জ্ঞানহত/মিছে কেন মর ভার বয়ে?’
(২) ‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে,/প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।/কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,/বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া…’-(মাতৃসম মাতৃভাষা)
(৩) ‘মিছা কেন কুল নিয়া কর আঁটাআঁটি।/এ যে কুল কুল নয় সার মাত্র আঁটি।।/কুলের গৌরব কর কোন অভিমানে।/মূলের হইলে দোষ কেবা তারে মানে’-(কৌলীন্য)
সজনীকান্ত দাশ তার ‘‘বাংলার কবিগান’’ গ্রন্থে লেখেন, ‘বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম। এই ধারাগুলির নাম বহু বিচিত্র তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই,দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা সাহিত্য গবেষকগণ কবিগান নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত প্রমুখ কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করেছেন প্রকাশ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পরবর্তীকাল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করেছেন তিনি।
আরো পড়ুন: বিখ্যাত লেখকদের জীবনে বিচিত্র সব অভ্যেস
সমাজ-সংসারের নানান অসঙ্গতি,কপটতা নিয়েও কবিতা লিখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ‘তত্ত্ব’ শিরোনামীয় কবিতাংশ-‘কুল মান জাতি ধর্ম্ম নাহি জান কোন কর্ম্ম/নাহি থাক দলাদলি ঘোঁটে/পরকাল নাহি মান রাজপীড়া নাহি জান/তাই খাও যখন যা জোটে’। বড়দিন, স্নানযাত্রা প্রভৃতি কবিতায় কলকতার বিচিত্র সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’-র অনুপ্রেরণা আছে বলে মনে করা হয়। ইংরেজ-টোলা, ফিরিঙ্গি, বাবুদের বর্ণনা পাই এমন-‘ইচ্ছে করে ধন্না পাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে/কুক হয়ে মুখখানি লুক করি সুখে…/তেড় হয়ে তুড়ি মারে টপপা গীত গেয়ে/গোচে গাচে বাবু হয় পচা শাল খেয়ে…'(সংক্ষেপিত, বড়দিন)
ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় আছে অবিসংবাদিত দেশপ্রেম। পুরাতন কবিদের পুনর্জীবিত ও নবীন কবি সৃষ্টিতে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছেন। তাই তো তিনি যুগসন্ধির কবি। নুতন-পুরাতন দুই যুগকে ধরে রাখাই তাঁর অনন্যতা। ইতিহাস সচেতনতায় তাঁর কবিতায় আধুনিকতার প্রকাশ দেখা যায়।
তথ্য ঋণ:
(১) বাংলাপিডিয়া
(২) বিশ্বকোষ/উইকিপিডিয়া
(৩) বিভিন্ন পত্রিকা
(৪) নবীন কবিদের অভ্যুদয়, প্রভৃতি গ্রন্থ

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট