| 29 মার্চ 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

সুরা রোমের ভবিষ্যতবাণী কি ফলে ছিলো?।। সুষুপ্ত পাঠক

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
 
 
 
ইসলাম যে একটি সত্য ধর্ম এটি মুসলমানদের বিশ্বাস করানোর জন্য সুরা রোমে রোমানদের বিজয়ী হবার আগাম ঘোষণা ফলে যাবার যে কাহিনী প্রচলিত আছে সে কাহিনীর চিত্রনাট্যকারদের ভুলের কারণে স্বয়ং আল্লাহ ধরে খেয়ে গেছেন অস্বস্তিকরভাবে! যদিও তথ্য প্রমাণ সন্দেহ তৈরি করে যে, রোমান বিজয় হবার অনেক পরেই কুরআনের ভাষ্য পাল্টে দেয়া হয়েছিলো। তবু কুরআনের ৩ থেকে ৯ বছরের মধ্যে রোমানদের বিজয় হবার কথা বলা হলেও ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় পারস্যদের কাছে পরাজিত হবার ১৫-১৬ বছরের মধ্যে ফের রাজ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলো রোমানরা। তাই কুরআনের ভবিষ্যতবাণী জাতীয় বিতর্কিত অংশটি মেনে নিলেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়- কুরআনের দেয়া সময়কালের চেয়ে আরো ৬-৭ বছর কেন বেশি লাগল রোমানদের বিজয়ী হতে? আল্লাহ কেন তার ওয়াদা রাখতে পারলেন না? আসুন বিস্তারিত আলোচনা করি…।
 
 
শুরুতে দেখি সুরা রোমে কি বলা হয়েছে, “রোমানরা নিকটবর্তী ভূখণ্ডে পরাজিত হয়েছে। নিজেদের এই পরাজয়ের কয়েক বছরের মাঝে তারা বিজয়ী হবে। আসল এখতিয়ার আল্লাহরই রয়েছে পূর্বেও এবং পরেও। আর তা হবে সেইদিন, যেদিন আল্লাহর দেয়া বিজয়ে মুসলমানেরা আনন্দিত হবে” (সুরা রোম, আয়াত ২-৫)।
 
 
এই “কয়েক বছরের মাঝে” ঠিক কতদিন বুঝানো হয়েছে সেটা ইসলামি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কলার ইউসুফ আলী মতে ৩ থেকে ৯ বছর ধরতে হবে। তিনি বলেন, ‘”a few years,” Bidh’un, signifies a period of three to nine years’। ইউসুফ আলী নিজে বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলেননি। কারণ সহি হাদিসেও দেখা যাচ্ছে আবু বকর যখন কুরাইশ নেতা উবাইয়ের সাথে বাজি ধরছেন রোমানদের জয় নিয়ে ১০টি উটের বিনিময়ে তখন মুহাম্মদ তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘সতর্কতার জন্য তোমার এই বাজি রাখা উচিত ছিল ১০ বছরের জন্যে। কেননা  بِضْعِ শব্দের প্রয়োগ হয়ে তিন থেকে নয় বছরের উপর’ (ইবনে কাথিরের তাফসির, পঞ্চদশ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬২১)।
 
 
এবার দেখি ঐতিহাসিকভাবে পারস্যদের কাছে রোমানরা কবে পরাজিত হয়েছিলো। ইতিহাস বলছে ৬১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের কাছে জেরুজালেমের পতন ঘটেছিলো। এর ঠিক ১৫ বছর পর রোমানরা পুরোপুরি তাদের হত স্রামাজ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থ্যাৎ দীর্ঘ ১৫ বছর পর রোমানদের বিজয় ঘটেছিলো। অথচ কুরআন মতে সেটা ঘটবে ৩ থেকে ৯ বছরের মধ্যে! দেখা যাচ্ছে আল্লাহ একজেক্টলি সময়টা বলতে পারছেন না! এটা আসলে ঘটেছিলো মুসলিম তাত্ত্বিকদের রোমানদের বিজয় হওয়ার সন তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে। যে কারণে কথিত ৯ বছরের মধ্যে বিজয়ী হবার ঐশ্বী ওয়াদার বরখেলাপ ঘটে গেছে!
 
 
যারা এই তথ্য মানতে পারছেন না তাদের জানাই ইসলামী আদি সোর্স আল তাবারী আমাদের জানাচ্ছেন ৬২৮ সালে আবু সুফিয়ান সিরিয়া গিয়েছিলো মুহাম্মদের দলের কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার উপর লাগাতার আক্রমন ঠেকাতে করণীয় জানতে এক বৈঠকে যোগ দিতে। আবু সুফিয়ান জানান, তারা যখন মুহাম্মদের সঙ্গে যুদ্ধ কলহে ব্যবসা বাণিজ্যে লস খাচ্ছিলেন তখন সিরিয়া হয়ে গাজা যাচ্ছিলেন কয়েকজন কুরাইশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ থেকে মুক্তি পেতে বৈঠক করতে। তখন তারা জেরুজালেমে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিজয় দেখতে পেয়েছিলেন। সদ্য হেরাক্লিয়াসের জেরুজালেম মুক্ত করে সেখানে প্রার্থনা করেছিলেন। আবু সুফিয়ানের জবানে আল তাবারী লিখেছেন, We were merchant folk. The warfare between us and the Messenger of God had prevented us from journeying, so that our wealth became depleted. After the truce between us and the Messenger of God, we feared that we might not encounter security. I set out for Syria with a group of merchants of Quraysh. Our specific destination was Gaza, and we arrived at the time of Heraclius’ VICTORY over the Persians who were in his land – he expelled them and regained from them his Great Cross, which they had carried off. Having accomplished this against them and having received word that his cross had been rescued from them (he was staying at Hims), he set out from there on foot in thanksgiving to God for restoring it to him, to pray in Jerusalem. Carpets were spread out for him, and fragrant herbs were strewn on them. When he reached Jerusalem and performed his worship – with him were his military commanders and the nobles of the Romans – he arose troubled one morning, turning his gaze to the sky … (The History of Al-Tabari: The Victory of Islam, translated by Michael Fishbein [State University of New York Press, Albany 1997], Volume VIII, pp. 100-101)
 
 
আবু সুফিয়ানের এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা পরে দেখতে পাবো রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস কুরাইশদের ডেকে পাঠিয়েছেন। এতে করে তাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক থাকার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যে কারণে সুরা রোমে রোমানদের বিজয়ী হবার ভবিষ্যত বাণী করার কথা নয়। বর্তমান সুরা রোম পড়লে তাই অর্থগত খটকা লাগে। C.G. Pfande বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার al-Baidawi-কে উদ্বৃতি করে বলেন, আসল শব্দটির পরিবর্তে কিছু শব্দ غلبت এবং سيغلبون এর পরিবর্তে سيغلبون।বসান। এর ফলে বর্তমান আয়াতটা এরকম: “রোমানরা নিকটবর্তী ভূখণ্ডে পরাজিত হয়েছে। নিজেদের এই পরাজয়ের কয়েক বছরের মাঝে তারা বিজয়ী হবে”। কিন্তু অরজিনাল বাক্যটি ছিলো এরকম: ‘বাইজেন্টাইনরা (রোমানরা) দেশের নিকটতম অংশে জয়ী হয়েছে, এবং তারা কয়েক বছরের মধ্যে পরাজিত হবে’। অর্থ্যাৎ এখানে রোমানদের বিজয়ের কথা বলা হচ্ছে এবং তারা শীঘ্রই পরাজিত হবে বলে ভবিষ্যতবাণী করা হচ্ছে। এটাকে সঠিক ধরা হলে, উবাইয়ের সঙ্গে আবু বকরের ১০ উটের বাজির ঘটনা সম্পূর্ণ কল্পিত বানোয়াট কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মুসলিমরা বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করার বহু বছর আগেই উবাই মারা গিয়েছিলেন, এমনকি হেরাক্লিয়াস পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে জয়ী হবার বহু আগেই তিনি জীবিত ছিলেন না। তাহলে সুরা রোমের “আর শীঘ্রই তারা পরাজিত হবে”- এই অংশটি কি করে ভবিষ্যতবাণী ফলা ধরা হবে কারণ আমরা জানি রোমানদের পরাজিত করে মুসলমানরা ক্ষমতা দখল নেয় কয়েক শতাব্দী পর ওসমানীয়া খিলাফতের সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তাই দেখা যাচ্ছে এই সংক্রান্ত সমস্ত বিবরণই বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। al-Baidawi  বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বাইজান্টিনরা সিরিয়ার বিজয়ী হয়েছিল, এবং সুরা রোমে আসলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে মুসলমানরা শীঘ্রই তাদেরকে (রোমানদের) পরাজিত করবে। যদি এটি সঠিক হয় তাহলে হিযরতের ৬ বছর আগে রোমানদের বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করার কাহিনী সত্য নয়। উবাইয়ের সঙ্গে আবু বকরের বাজি ঘটনাও মিথ্যা। কারণ রোমানদের বিজয়ের অনেক আগেই সে মারা গিয়েছিলো। ইসলামের আদি সোর্সও আমাদের বলছে এই আয়াত রোমানদের সিরিয়া দখলের পর লেখা হয়েছিলো।
 
 
al-Baidawi বিবরণই বাস্তব সম্মত মনে হয় যদি আমরা সুরা রোমটা পড়ি। বর্তমান আয়াত পড়লে আসলে একটা খটকা লাগে। এখানে লেখা হয়েছে “রোমানরা নিকটবর্তী ভূখণ্ডে পরাজিত হয়েছে। নিজেদের এই পরাজয়ের কয়েক বছরের মাঝে তারা বিজয়ী হবে। আসল এখতিয়ার আল্লাহরই রয়েছে পূর্বেও এবং পরেও। আর তা হবে সেইদিন, যেদিন আল্লাহর দেয়া বিজয়ে মুসলমানেরা আনন্দিত হবে” (সুরা রোম, আয়াত ২-৫)। খুবই খিচুরি মনে হচ্ছে না? রোমানরা পরাজিত হয়েছে তারা আবার জিততে, আর এটা সেদিন হবে যেদিন আল্লার দেয়া বিজয়ে মুসলমানরা আনন্দিত হবে! আগা মাথা নেই। বরং al-Baidawi বর্ণনা সঠিক মনে হয়। তিনি লিখেছেন, বাইজেন্টাইনরা দেশের নিকটতম অংশে জয়ী হয়েছে, এবং তারা কয়েক বছরের মধ্যে পরাজিত হবে’। আবু সুফিয়ানের কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি যে তিনি রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তার সাহায্য চেয়েছিলেন। এর সত্যতা পাওয়া যায় “Narrated ‘ Abdullah bin ‘Abbas: That Abu Sufyan bin Harb Informed him that Heraclius called him and the members of a caravan from Quraish who had gone to Sham as traders, during the truce which Allah’s Apostle had concluded with Abu Sufyan and the Quraish infidels. (Sahih al-Bukhari, Volume 4, Book 53, Number 399)
 
 
কাজেই রোমানদের উপর মুসলমানদের রাগ থাকাই স্বাভাবিক। রোমানরা তখন সদ্য বিজয় লাভ করেছে পারস্যদের কাছ থেকে। আগেই হাদিস থেকে দেখিয়েছি ৬২৮ সালে আল তাবারী জানাচ্ছেন আবু সুফিয়ান সিরিয়া গিয়ে হেরাক্লিয়াস বিজয় প্রত্যক্ষ করে এসেছিলেন। হেরাক্লিয়াস আরব কুরাইশদের শ্যামদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবদের যোগ দেবার পরামর্শই দিয়েছিলেন। এসব থেকে স্পষ্ট রোমানদের বিজয়ে কুরআনে তাদের বিজয়ের সংবাদ দিয়েই পরের লাইনে তাদের পরাজিত করার উচ্চাকাঙ্খা জানিয়ে মুসলমানদের অপেক্ষা করতে বলেছে যেদিন আল্লাহ তাদের বিজয় দান করবেন সেদিন তারা আনন্দ লাভ করবে।
 
 
এটা স্পষ্ট যে ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে পারস্যদের কাছে সাময়িক পরাজিত রোমানদের বিষয়ে সুরা রোমে কিছু বলা হয়নি। এবং মুহাম্মদের ৩ থেকে ৯ বছরের মধ্যে তাদের আবার বিজয়ী হবার ভবিষ্যত বাণীও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুসলমানরা দাবী করে রোমানদের পরাজয়ে কাফেররা উল্লাস করেছিলো কারণ পারস্যরা ছিলো তাদের মতই অগ্নি পুজারী। পক্ষান্তরে রোমানরা খ্রিস্টান বিধায় মুসলমানদের নিকটবর্তী হওয়ায় রোমানদের পরাজয়ে মুসলমানরা দু:খ পেয়েছিলো। অথচ দেখুন ইসলামের সোর্স সহি বুখারী জানাচ্ছে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন। কুরাইশরা যদি পারস্যদের বিজয়ে উল্লসিত হবে তাহলে আবু সুফিয়ান কেন রোমানদের কাছে সাহায্য চাইতে যান? এসব কারণেই সুরা রোমের বর্তমান অর্থ অসংলগ্ন দুর্বল মনে হয়।
 
 
এখন প্রশ্ন উঠবে বর্তমানে সুরা রোমে এরকম পরিবর্তন ঘটেছে কেন? আগেই বলেছি, কুরআন শুরুতে হরফের চিহৃ ছাড়া লেখা হতো, পরবর্তীকালে এই ফোটাগুলো বসানোর কারণে ব্যাকরণগত পরিবর্তন ঘটেছিলো। যার ফলে আজ কোনভাবেই কোন ইসলামী স্কলারই বলতে পারবে না কুরআনে  আসল বক্তব্য কোনটি? কুরআনের কোন রূপটি সঠিক- আগেরটি নাকি পরে জের জবর পেশ বসানোর পর? এই পরিবর্তন আসলে সুরা রোমে কাদের বিরুদ্ধে বিজয়, কে কার বিরুদ্ধে জিতবে সে সম্পর্কে দুর্বোদ্ধ করে তুলেছে। এগুলো আমার কথা নয়। ইসলামের আদি সোর্স বলছে এ কথা। The original Quranic text had no vowel marks. Thus, the Arabic word Sayaghlibuna, “they shall defeat,” could easily have been rendered, with the change of two vowels, Sayughlabuna, “they (i.e. Romans) shall be defeated.” Since vowel points were not added until some time after this event, it could have been quite possible for a scribe to deliberately tamper with the text, forcing it to become a prophetic statement (দেখুন C. G. Pfander, Mizan-ul-Haqq – The Balance of Truth, revised and enlarged by W. St. Clair Tisdall [Light of Life P.O. Box 18, A-9503, Villach Austria)।
পাকিস্তান গঠিত হবার পর যেসব রাজনীতিবিদ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে, তাদের কথার ২৩ বছরের মধ্যে পাকিস্তান সত্যিই ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিন্তু তারা কেউ নবী ছিলেন না বা কোন ঐশ্বী বাণীও লাভ করেননি। এ হচ্ছে রাজনীতির দুরদর্শীতা। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ‘পল’ নামে একটা অক্টপাস নির্ভুলভাবে প্রতিটি ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারছিলো। সেই অক্টপাসটা কি কোন নবী ছিলো? নাকি জিব্রাইল ফেরেস্তা? এসবই কাকতালীয়। ভবিষ্যতবাণী বলতে কিছু নেই। এসব কারোর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাজেই তথাকথিত সত্য ধর্ম প্রমাণ করতে গিয়ে যে ভবিষ্যতবাণীর সৃষ্টি করা হয়েছিলো ইসলামের উমাইয়াদের আমলে, আজ তার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে ইসলামের ক্ষতিই হচ্ছে প্রতিদিন। আর এটা চলতেই থাকবে…।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত