জেসিন্তা কেরকেট্টা, এক সংগ্রামের কবিতা
জেসিন্তা কেরকেট্টা কুরুখর জাতির মেয়ে, কুরুক তাঁর মাতৃভাষা। যে মেয়েকে আমরা ওরাওঁ বলি। জেসিকার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘হিন্দু উচ্চবর্ণের সমাজ আমাদের ওরাওঁ নামটি দিয়েছে। আমাদের নিম্নশ্রেণীতে ফেলবে বলে। তাই আমি কুরুখর জাতির মেয়ে বলি নিজেকে। লোকে আমার মাতৃভাষা অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কেন, এই নিয়েই কিছুই বলল না এতদিন। কিন্তু যেই আমি হিন্দিতে লিখছি, অমনি প্রশ্ন তুলেছে। আমি হিন্দিতে লিখি কারণ, এতদিন আমাদের ওপর যারা অকথ্য অত্যাচার করেছে, আমাদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে, আমি তাদের ভাষাতেই লিখতে চাই, তাদেরকে জানাতে চাই, আমরা ওদের কী চোখে দেখি।‘
এরপরে অবশ্য এই মেয়ে বলেন, আমি নিজের ভাষাতেই লিখতে ভালোবাসি, এই ভাষায় মেয়েদের পক্ষে অবমাননাকর কোন শব্দই নেই। হিন্দি ‘রণ্ডি’ শব্দটিকেও আমার ভাষা অনেকটা সহানুভূতি দিয়ে দেখে। আমার ভাষায় এই শব্দের অর্থ বিধবা। হ্যাঁ, এরপরেও কিন্তু আমি হিন্দিতেই লিখতে চাই।‘
জেসিন্তা কবিতা লেখেন। সাংবাদিকতা করেন। তাঁর কবিতায় তাঁর গোপনে পুষে রাখা রাগ আগুন ঝড়ায়। একটি ছোট কবিতার অনুবাদ দিলাম নমুনা হিসেবে-
‘আমার পোষা কুকুরটাকে খুন করা হল
কারণ ও নাকি বিপদ দেখলে চিৎকার করত
মেরে ফেলবার আগে বলা হয়েছিল
ওর নাকি জলাতঙ্ক হয়েছে
এবং আমিও একজন নকশাল…
জনস্বার্থে প্রচারিত।‘
সারান্ডার জঙ্গলের কাছে কোয়েল নদীর ধারে পশ্চিম সিংভূম জেলার খুরপোশ গ্রামে জেসিন্তার জন্ম। তাঁর বাবা, জয় প্রকাশ কেরকেট্টা অল্প বয়সে ম্যারাথন অ্যাথলিট ছিলেন, সেই সূত্রে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি পান। তাঁর চাকরিসূত্রে জেসিন্তার ছেলেবেলা সাঁওতাল পরগনায় কেটে যায়। সেই সময়ে পশ্চিম চম্পারন জেলার বেতিয়ায় তাঁর পড়াশুনো। ১৯৯৯ সালে চাইবাসার কাছে চক্রধরপুরে এসে পড়েন তাঁরা। সেখানে ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত কাটে। সাঁওতাল পরগনাতে এসে জেসিন্তা প্রথম আদিবাসীদের ওপর অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের, শিক্ষক বা সহপাঠী যেই হোক, এক ধরণের অবমাননার দৃষ্টি লক্ষ্য করেন। মনের রাগ পুষে রাখতে থাকেন সেই সময় থেকে। এরপর যখন চক্রধরপুরের কারমেল হাই স্কুলের হস্টেলে থাকতে শুরু করেন, তখন সেখানে অনেক আদিবাসী মেয়েদের সহপাঠী হিসেবে পান। কিন্তু তারাও যেন জেসিন্তার আচরণে খুশি নয়। যেহেতু জেসিন্তা শুধু পড়াশুনোতেই মন দিয়েছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল, অন্যদের দেখিয়ে দেওয়া যে, একটি আদিবাসী মেয়েও বুদ্ধি, মেধায় কিছু কম নয়। তাঁর এই জেদ একসময়ে স্কুলের পরীক্ষায় তাঁকে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান নিতে সাহায্য করে। এতে অন্য আদিবাসী মেয়েরা তাঁকে যেন একপেশে করে দেয়। উপরন্তু স্কুলের শিক্ষক বা ছাত্রীরাও একজন আদিবাসীর এহেন মেধায় ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে। একা এবং একার জগত তাঁকে ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। সঙ্গে জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, বঞ্চনার ইতিহাস সাথী হয়। ক্লাস এইটেই তিনি প্রথম কবিতা লেখেন মাকে নিয়ে, ছেলেবেলা নিয়ে।
আর এই সময়েই জমি সংক্রান্ত এক বিবাদে তাঁর কাকা এবং তাঁর কাকার মা’কে মোহনপুরের উন্নত সম্প্রদায়ের ১০/২০ জন লোক এসে অত্যাচার চালায়। কাকাকে খুন করে আর ঠাকুমাকে জেলে পাঠায়। সেই সময়ে স্থানীয় কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী বলা হয়, কাকাকে নাকি আদিবাসী প্রথা অনুযায়ী বলি দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে তাদের পুরো গ্রামকে বছরের পর বছর সন্দেহের চোখে দেখত অন্যান্যরা। যদিও কার্যক্ষেত্রে একটি ধর্ষণের ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মিডিয়া এই ঘটনা সাজিয়েছিল। এরপরে জেসিন্তা তাঁর মায়ের সাহায্যে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে মাস কমিউনিকেসন নিয়ে ভর্তি হন। দৈনিক জাগরণ আর প্রভাত খবর নামের দুটি হিন্দি পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন।
জেসিকার তখন ১৩বছর বয়স, মোহনপুরের মিশনারি বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যাচ্ছেন, সেই সময়ে একদিন বাড়িতে এসে তাঁর মা, পুষ্পা অনিমা কেরকেট্টাকে তাঁর মদ্যপ বাবার হাতে মার খেতে দেখেন। এর আগেও দেখেছেন, কোথাও গেলে বাবার পিছন পিছন মাকে চলতে। বাবার খাওয়া না হলে, মা’র খেতে বসার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। যে বাবা আবার নিজেই পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আদিবাসী বলে হেনস্থা ভোগ করতেন। যে ভাইরা শিক্ষিত হয়ে উঠছিল, তারাও জেসিন্তার পড়াশুনোর জন্য বাইরে যাওয়া বা সাংবাদিকতা করাকে মেনে নিতে পারেনি। এই সমস্ত ক্ষোভ ৩২বছর বয়সে এসে তিনি উগড়ে দেন ‘বাওন্দার অউর দিশায়েঁ’ কবিতায়। ‘উন্নতি’র ধারায় যেন তারা এগিয়ে এসেছে এতটাই যে, কাউকে না কাউকে ত্যাগ করতেই হবে- এই কবিতার বক্তব্য ছিল এমনই। ৪১টি হিন্দি কবিতা নিয়ে তাঁর বই প্রকাশ করে আদিবানি ও সহযোগী জার্মান প্রকাশক। কবিতাগুলির মূল বিষয় ছিল আদিবাসীদের সংগ্রাম ও আশা নিয়ে, নিজের ছোট গণ্ডী থেকে যখন তারা বড় শহরে পা দেয়, তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, বঞ্চনা—এই ছিল কবিতাগুলিতে। তাঁর কবিতা ইংরেজি, জার্মানি এমনকি ইতালীয় ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে।
শহর কবিতায় তিনি লিখছেন-
‘মাটি আর খড়কাটার মেশিন
মাথার ওপরের ছাদ,
ঘর ছেড়ে চলে আসার পরে ওদের বলে
ও শহর!
তথাকথিত উন্নতির নাম করে
তুমি কি কখনও সেই প্রত্যন্ত শিকড়ের খোঁজে গেছ?’
বেশ কিছু কবিতা সারাণ্ডার জঙ্গল নিয়ে লিখেছেন তিনি। তাঁর গ্রাম খুরপোশের কয়লা খনি এলাকা নিয়েও লিখেছেন। মেয়েদের ওপর হিংসা নিয়ে, বাস্তুচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে, সরকারের বঞ্চনা নিয়ে তাঁর কলম সরব হয়েছে।
‘লাল নদীয়াঁ’ কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সারাণ্ডার জঙ্গল, জমি, খনি থেকে আসা ধুলোয় বিষাক্ত, বন্ধ্যা হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে ‘সাজিশোঁ কি সিক্স লেন’ নামে একটি কবিতায় তিনি লিখছেন-
‘সারাণ্ডার জঙ্গল থেকে উঠে এসে
গ্রামবাসীরা জড়ো হচ্ছে এখানে।
মেয়েরা পিঠে বেঁধে এনেছে শিশুদের,
বুড়োরা যেন নিজেদের খুঁজতেই এসেছে উপত্যকায়
আর পাহাড়ের ওপর জটলা করছে ছোকরার দল
বাচ্চারা সাকুয়া গাছ গুনতে গুনতে চলেছে-
এরা কোন প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে আসেনি
একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখতে এসেছে মাত্র
যেখানে জয়ী দলকে একটা ছাগল পুরস্কার দেওয়া হবে।‘
সিমডেগায় এক গ্রামে যেখানে কাছাকাছি এলাকায় চারটি বাঁধ রয়েছে অথচ কৃষকরা জমি হারিয়ে রিক্সা চালায়। যারা জমি ছেড়ে চলে যায়নি, তাদেরকেও সেচের জল নিতে দেওয়া হয় না। সাহেবগঞ্জে চাষীরা চাষ করতে পারে না, শুধুমাত্র ফ্লাই অ্যাশ উড়ে এসে তাদের জমি ভরিয়ে দেয় বলে। ‘আদিবাসীরা কি গরু, ছাগল যে সরকার এদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে?’-এই প্রশ্ন তোলেন জেসিন্তা। আর লেখেন-
‘এক ধূধূ, রুক্ষ জমিতে
ফুলো এখনও স্বপ্ন দেখে
তপ্ত বালিতে পুড়তে পুড়তে ভাবে
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পরে
যেন বীজ রুইতে বসেছে সে
কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে
প্রত্যেক বর্ষার আগে ফুলোর মা
বাঁধের ধারে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে
তার কৃষিকাজের কথা ভাবে।‘
জেসিন্তা বোঝেন আজকের এই ইন্ডাস্ট্রাইলেশনের কুফল ভোগ করতে হচ্ছে তাদেরই। বন্দুকের নল পয়সা জোগাচ্ছে সহজেই, তাই কিছু আদিবাসীরা সহজেও মাওবাদী হয়ে উঠেছে। আর যারা সেরকম কোন উগ্র মতবাদী হয়নি, তাদেরও বিনা কারণে, স্রেফ সন্দেহের বসে জেলে যেতে হচ্ছিল। তাঁর কবিতা ‘হল কি হত্যা অউর ডম্বরু কি আওয়াজ’-এ সিধু কানু ডহরের নাম করে একটি গাছের কন্ঠে বলেছেন- সেই গাছ সাক্ষী থেকেছে এই উত্থানের। ‘বন্ধ দরজা’ কবিতায় তিনি লিখছেন-
‘বন্ধ দরজার ছিদ্র দিয়ে
সে রোজ উঁকি দিয়ে দেখেছে
তার স্বপ্নগুলো কীভাবে সেই ফাঁক দিয়ে
সারা মাঠময় ছড়িয়ে পড়ছে।
আর সেই ফাটলগুলোই
আলো নিয়ে আসছে ভেতরে
আর তার শান্ত ঘরে এসে বসছে।
…………
দরজা তৈরির সময়ে
হাতুড়ি পেরেক পুঁতেছিল কিছু
এখন এক ধাক্কায় সেগুলো
মাটিতে পড়ে আছে।
আর সে আশ্চর্য হচ্ছে এই ভেবে-
ওদের মধ্যে কে বেশি দুর্বল,
বন্ধ দরজা নাকি ওর ইচ্ছাশক্তি?’
কবি ও কথাসাহিত্যিক
স্যালুট! তোমাকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা…… তোমাকে পড়ে জেসিন্তাকে জানলাম। ভালবাসা নিও, তুষ্টি।