আজ ২৭ নভেম্বর কবি জগন্নাথদেব মণ্ডলের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
(৮)
বন্ধুকে সর্ষে তেলের বাটি হাতে ঝুঁকে আসা কিনারায় দাঁড়া করিয়ে পুকুরজলে নেমেছিল বলরাম সর্দার। জলে নামতেই তাঁর কালো রোমশ দেহ বহন করে নিয়ে গেল নাগপুরুষেরা। কোনও আপত্তি না শুনেই সেখানে নহবত বাজিয়ে নাগকন্যা সুরবালার সাথে বিবাহ হল। ঘড়া ঘড়া উড়ে গেল পচানো আখের গুড় দিয়ে তৈরি মদ।
বিবাহের বছর কয়েক কাটতেই তিনজন সন্তান। ঢের বয়েস বেড়ে গেল তাঁদের। এখন জলের নীচে জেলিমাছ শখ করে পোষে প্রৌঢ় বলরাম, বুকের চুল পেকে গেছে। সুরবালা বোনে পশমের টুপি। বিকেলের মতো বিবর্ণ রঙ নেমে এসে গুলে যায়।
একদিন বলরাম উল্টে গেল শামুকে পা লেগে। বাঁধানো দাঁত ছিটকে গেল, আর সে পুকুরতল থেকে ডাঙায় ভেসে উঠল ভুস করে।
উপরে উঠতে দ্যাখে বন্ধু তেল ভর্তি বাটি হাতে তেমনি দাঁড়িয়ে। বেলা এতটুকু ঢলেনি। ওদিকে জলের নীচে বিবাহ, সংসার। ৩৫ বৎসর কেটে গেছে।
মাঝে মাঝে ভাবি আমি এমন বলরামের মতো জলে ডুবে নেই তো! কাকে অপেক্ষায় দাঁড়া করিয়ে রেখে এসেছি স্থলভূমিতে? এই নারী, নক্ষত্র, পুরুষ, পানলতা, খয়ের, মোতিহারি তামাকের বন সবটাই জলছায়া নয়তো?
একথা ভাবতেই আমার কঙ্কাল কেঁপে ওঠে, চোখের পাতলা মণি ফেটে যেতে চায় কাঁচের মতোন…
(৯)
জীবনে মাত্র ২ বার সে মদ্যপান করেছে। একবার বাড়িতে গঙ্গাপুজোর দিন পাঁঠার মাংস সহযোগে; আরেকবার বন্ধুরা মিলে কাঁচের গ্লাসে ঠান্ডা জামগাছের নীচে ভাঁটিখানায়।
প্রথমবার মদ খেয়ে নিজেকে তার মকরমাছ বলে মনে হয়েছিল। সে ভাবছিল ডাঙায় সাঁতার সম্ভব কিনা।
দ্বিতীয়বার মাঢ়ী যেন স্মৃতিপ্রবণ হয়ে গঙ্গামাটিতে তলিয়ে যেতে চাইছিল।
অথচ মরে যাওয়ার কথা বহু আগেই, তার জলে ফাঁড়া। প্রায়শই ইচ্ছে করত তালডোঙায় চড়ে নদীর গভীরে যেতে।
স্বপ্নে পাওয়া মাদুলি হাতে ধারণ করে করে, চ্যাং মাছ ভাজা খেয়ে খেয়ে সেই জলদোষ কাটিয়ে দিয়েছিল তার নিজস্ব মা।
আজ সে ভাঁড়ে ভাঁড়ে পান করছে তাড়ি।
আর মনে হচ্ছে এই পয়লা বৈশাখের দিন নেশার ভিতর জল থইথই করছে। সাঁতরে আসছে কালো এক মহিষ। মোষের পিঠে মুগুর হাতে এক কালো ষণ্ডা লোক।
লোকটি এসে দুধ দুইয়ে বালতি-উনুনে চা করছে, চিপে দিচ্ছে গন্ধরাজ লেবুর রস। বলছে-খেয়ে নিন বাবু, খুব নেশা হয়েছে তো, খোয়ারি কেটে যাবে!
রাঢ়দেশের মাটিতে শুয়ে মৃত্যুকে নিয়ে অপরূপ এই ঠাট্টায় অনেকদিন পর সে শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠছে। আর আকাশ হয়ে উঠছে বরিশালের মতোন। তিমির কাঁপিয়ে সাতখানি তারা উঠছে জ্বলজ্বল করে।
(১০)
উল্টোরথের দিন তোমার বুকে অন্য ছেলের ছায়া কেন দেখলাম সৈয়দদা?
তরমুজ বিচির চেয়ে একটু উজ্বল ফুলে ওঠে স্তনবৃন্তের কাছে ও কোন নরম কিশোর?
আমি কি তবে তোমার সবটুকু নই?
তাই মসজিদের পাশে সূর্য অস্ত যাক, হিলহিলে ঠান্ডা নামুক ঠান্ডা পানির ভিতর।
আর আমাকে আবার তোমাদের হিম বদনা, গোসলঘর, গোলপায়রা পার করে পেয়ারা গাছের পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলো। তোমার চাচির ছেলে তখন দুলে দুলে পড়া তৈরি করছে।
এদিকটায় কেউ আসবে না সুতরাং ইচ্ছে করে নিজস্ব লিঙ্গ দুহাতে পায়ের ভিতর চেপে যোনি বানাই। নারকেল মালা অথবা জলপুঁটলি দিয়ে নকল স্তন। চোখে কাজল দিই। মেহেন্দি। হাতে রঙিন কাচের চুড়ি।
কবরখানা, পাশে তিনটে জিওল গাছ, এবার একটি মুর্গি জবাই হোক। কিন্তু আজ রাতে খাব না বলে দিয়েছি।
এবারে আমাকে প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে আমূল নাও। তোমার দেহে স্থান দাও। আমাদের দেখতে অর্ধনারীশ্বর লাগুক।
বিছানার পাশে তেলের শিশিবোতল। কম পাওয়ারের ফ্যাকাশে আলো। দেয়ালে ছবি সাঁটা তীর্থস্থানের।
এর ভিতরে আমার অর্ধেক যেন আলতা রাঙা পা, হাতে আয়না, সিঁথি জুড়ে সিঁদুর, কোমরে বিছে আর তোমার জটায় আটকানো চাঁদ, দেহে ভস্ম, বাঘছাল সাপ দিয়ে বাঁধা।
সকালের বাসি সিমুই আমার অর্ধমুখে এবারে তুমি দিতেছ। তারপর পড়া করবার আছিলায় পাটি বিছিয়ে তোমার অর্ধেকদেহ পুরোনো খাতা খুলে বসতেই সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমার অর্ধ।
আর সারারাত দুজনে গেঁথে থাকছি। চোখে আনন্দজল। এই তো জল ভেঙে এল আমার। টসটস করছে গা কদম্বকাঁটায়। ভোররাতেও বিচ্ছিন্ন হতে ইচ্ছে করছে না।
কুয়াশায় এক হাত দূরের লোক অস্পষ্ট লাগছে। জামের পাতা হতেছে নরম। কুয়ো থেকে পানি তুলছে তোমার নানি। কবরের কাছটায় দাঁড়িয়ে ভোরের প্রথম কচি গন্ধ শুঁকছে আনন্দ-মোরগটি…
(১১)
এই একুশ বছরের যুবক-হাঁটু মুড়ে প্রায় সন্ধেয় ঘরের এক নির্জনে বসে নিরামিষ ভাত খাচ্ছি।
সাদা থান আড়াল করে আখায় শুকনো আইড়ীর শাখাপ্রশাখা জ্বেলে প্রেতের জন্য মাছ ভাজছে পিতা।
কুশের আংটি অনামিকায় পরে আতপ চাল, গঙ্গাজল, তিল, কলা চটকে পিণ্ড প্রস্তুত হয়েছে।
সমস্ত পুষ্করিণীতে ফেলে নেয়ে উঠেছি; দইভাণ্ড মাটিতে আছড়ে ভেঙে গড়াগড়ি দিয়েছি আঙিনায়।
এইভাবে কী সম্পূর্ণ ঠাকুমাকে ভুলে যাব?
অই ঘোলা ঘোলা চোখ, বেড়ালের জন্য মাছভাত রেখে দেওয়া ঠান্ডা হাত…
হিমদিনে তিনবার স্নানে শোক ধুয়ে গ্যাছে খানিক;
শীতবোধ আর খিদেই বরঞ্চ তীক্ষ্ণ হয়েছে।
মন্ত্র আর শান্তিজল তলতা বাঁশের বেড়া দিয়েছে গৃহের চারিদিকে; যাতে প্রেতকুয়াশা পেরিয়ে বুড়ি ফিরে এসে মিষ্টান্ন চাইতে না পারে আর…
কীর্তন বসছে নবদ্বীপ থেকে আসা রাধাশ্যাম
সম্প্রদায়ের। ঠাকুমার পাকা কলায় অরুচি চিরদিন, আতপচালে বিষণ্ণ। ফিরে যাচ্ছে মুখ নীচু করে।
আমি কি পাত্রে সাজিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন ভাত কুলের চাটনী নিয়ে যাবে জলার ধারে?
জানুয়ারী মাসের সাঁঝবেলা নামছে ধীরে লয়ে;
মনে পড়ছে শ্মশানে ঠাকুমা-পোড়া ঘ্রান;
উঠে আসা ডান পা সপাটে মেরে শুইয়ে দিয়েছিল ডোমের লাঠি।
এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঠাকুমা চলে যাচ্ছে ওর প্রতিদিনের শীতল গ্রিলের ঘর, উলকাঁটা, বেড়াল ছেড়ে…
(১২)
রোদের দিকে চাইলেই বোঝা যায় এ রোদ মাতৃহারা। তীব্র শোক যেন রাগসংগীতের মতো বিছিয়ে আছে চারিদিকে।
এ সব দিনেই কুলপুরোহিত গৃহে আসেন। স্বপাক খান। জাতক কাহিনী নিবিষ্ট মনে পাঠ করে ফলন্ত জবাগাছ অবধি গিয়ে ফিরে আসেন; তারপর ঠাকুমাকে জপমন্ত্র দিয়ে যান।
সাতাত্তর বছর সাত মাস সাত দিন পেরোতেই ঠাকুমা শয্যা নেন। শয্যায় বৈতরণী নদী, আস্তাবল আর পাবলিক পেচ্ছাপখানার গন্ধ পাওয়া যায়।
এরপর মধ্যদুপুরে টাকমাথা, কপালের কাছে আব-গজানো বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু স্কুটি চড়ে আসেন। বলে যান- আপনারা তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে খেয়ে নিন, বিকেল পেরুবে না..
প্রাণ চোখে এসে স্থির হয়। মায়াজল ত্যাগ করে ঠাকুমা। বিচালির বিছানায় সকলে বসে দুধগঙ্গাজল খাওয়ায়। শীর্ণ চোয়াল অতল গহ্বরের দিকে ঢুকে আসে। নাভিশ্বাস উঠল। শ্লেষার ঘড়ঘড় শব্দ…
মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রাণ। মুখ খোলা অবস্থায় মারা গেলেন। হা মুখে গুঁজে দেওয়া হল একমুঠো আতপ চাল।
নামাবলী, তুলসীমালায় মাছি এসে বসছে।
বাঁশের শয়নযানে করে নিয়ে আসা হল দেহ। শ্মশানের বটগাছে অজস্র কাক কালো হয়ে বসে আছে। হরিধ্বনিতে বুকের বাম পাঁজর কেঁপে উঠছে। গঙ্গা থেকে উঠে আসছে হিমঠান্ডা হাওয়া।
দাহ শেষ হলে তপ্ত নাইকুণ্ড ডোম খুঁজে খুঁজে মৃৎপাত্রে দিচ্ছেন।
বাবার গা গুলিয়ে বমি আসছে; তাই খানিক সুগন্ধি বকুল আঠার ধুনো দেওয়া হল তাতে…
একদা এই নাড়ির বন্ধন দাইমা ছিন্ন করেছিলেন গরমজল আর বাঁশের চোঁছে। আঁতুরঘরের পাশে মহানিম গাছ ছিল; সেই গাছের ঝিরিঝিরি পাতার ভিতর ছিল কুয়াশা জড়িত পক্ষীডিমের মতো চাঁদ…
আজ তেমনই রাত্রি, তেমনই চাঁদ। শেয়াল যাম ঘোষণা করছে।
আর এইসব মৃত্যু, এইসব দৃশ্য আমাকে আর একটু বিষণ্ণ, আর্ত, কাতর ও চাপা আনন্দিত করে তুলছে…