জসিন্তা কেরকেট্টা’র ‘আঙ্গোর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ
ঝাড়খণ্ড ও ওড়িষার সীমান্তে ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলার, সারান্ডার জঙ্গল ঘেরা মনোহরপুর ব্লকের অন্তর্গত খুদপোস গ্রামে জসিন্তা কেরকেট্টা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালে।
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দী বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা ‘পরিচয়’-এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় জসিন্তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে দিল্লী থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘নয়া জ্ঞানোদয়’, যুদ্ধরত আম আদমি’, ‘শুক্রবার’ও রয়েছে।
২০১৪ সালে আদিবাসী মহিলা সাংবাদিক হিসেবে আদিবাসীদের স্থানীয় বিদ্রোহের ওপর এক রিপোর্টের জন্য এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপল’স প্যাক্ট, থাইল্যান্ড, জসিন্তাকে ইন্ডিজেনাস ভয়েস অফ এশিয়া পুরস্কার দেয়।
২০১৪ সালেই ওয়ার্ল্ড ইন্ডিজেনাস দিবসে ঝাড়খণ্ডের ইন্ডিজেনাস পিপল ফোরাম তাঁকে তাঁর কবিতার জন্য পুরস্কৃত করেন।
এই বছরেই ন্যাশনাল লেভেল ইউএনডিপি ফেলোশিপ পান ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট হিসেবে।
ছোটনাগপুর কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন এই বছরেই তাঁকে নবীন কবি হিসেবে প্রেরণা সম্মান প্রদান করেন।
২০১৫ সালে নবীন ও সম্ভাবনাময় কবি হিসেবে ডঃ রবিশঙ্কর উপাধ্যায় মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট, বেনারস থেকে তাঁকে রবিশঙ্কর মেমোরিয়াল ইউথ পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
বর্তমানে জসিন্তা কবিতা রচনার পাশাপাশি সোশ্যাল ওয়ার্ক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায় নিযুক্ত। এ পর্যন্ত তাঁর দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথম সংকলন ‘আঙ্গোর’ প্রকাশ হয়েছে কলকাতার আদিবাণী প্রকাশনী থেকে এবং ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সংকলন ‘জড়ো কী জমীন’ প্রকাশ হয়েছে নয়াদিল্লির ভারতীয় জ্ঞানপীঠ থেকে। দুটি সংকলনই হিন্দি ও ইংরেজি উভয় ভাষায়ই একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। দুটি বইয়ের জার্মান অনুবাদ যথাক্রমে ‘গ্লুট’ ও ‘টিফহ বর্জুলেন’ নামে দ্রৌপদী বেরলাগ থেকে প্রকাশিত। ২০১৮ সালে ‘আঙ্গোর’ সংকলনের ইতালীয় অনুবাদ ‘ব্রাচে’, তুরিনোর মিরাজী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। ওই বছরেই এই সংকলনের সাঁওতালি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল।
১)
মানুষ আর শব্দ
গ্রামে খড়ের ঘরের ছাদে রাখা
ঝুড়ির ভেতরে পড়ে থেকে
পূর্বজদের খেতে তৈরি হওয়া শব্দ
শীতের শিশিরে সারারাত ভিজতে থাকে।
ভোর বেলায় নিঃশব্দে মা
এক চুপড়ি শব্দ পেড়ে নিয়ে আসে,
তাদের খোসা ছাড়িয়ে আঁখের গায়ে চাপিয়ে দেয়
শব্দগুলোকে ভালো করে ঝাঁকিয়ে
সরই পাতায় মুড়ে
বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দেয়।
জঙ্গলের সাখু গাছের মতোই
শব্দরা বংশধরদের শিরায় শিরায়
শনশন করে বইতে থাকে,
কংক্রিটের জঙ্গলেও শব্দ জন্মায়!
রঙবেরঙের, চকচকে, ধূসর আর গাঢ় শব্দরা
দেখায় খুব ভালো, যদিও অন্তঃসারহীন,
সৌন্দর্যের মুকুল কিন্তু শূন্যতার বীজে ভরা।
এখানে মানুষ আর সমবেদনার বীজ
মিলেমিশে এক হয়ে আছে।
ভাবনারা কোথাও যেন হারিয়ে গ্যাছে,
বেঁচে আছে শুধু সংবেদনশীল শব্দরা!
# সরই, সাখু, সখুয়া প্রচলিত অর্থে শালগাছকে বলা হয়।
২)
ঝড় ও দিশা
এক মুঠি দানা
বেঁচে আছে পৃথিবীতে
এই জন্য শস্য মাড়াইয়ের উঠোনে
প্রতিটি গ্রাম ঝুড়ি হাতে
গরম হাওয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে
খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
এইরকম ব্যস্তসমস্ত এক সন্ধেতে
কুপির আলো খাপড়ার চালের
ফুটো দিয়ে দেখল
পাকদণ্ডি বেয়ে নিশ্চুপে
ঝড় এগিয়ে আসছে।
রোদের আগুন থেকে ঋণ হয়েছে কিছু
ধানের তাজা গন্ধ পেয়ে
তাই দৌড় দিয়েছে হাঁসুয়া
ঝড়ের বুক ফালাফালা করে দেবে বলে
থমকে দাঁড়িয়েছে হাওয়া,
নিজের ধারাল ছুরি দিয়ে
গ্রামবাসীর জমাট বাঁধা ঘা চিরে ফেলে
নিজের রাস্তা করে নেয়
ওদেরই ইতিহাসের ছেঁড়াফাটা চিত্র
আর ও নিজেকে ধীরে ধীরে
নিঝুম অন্ধকারে লুকিয়ে নিয়ে
সঠিক দিশা দেখিয়ে ভরসা জাগায়।
তখন দিশা
আলোর প্রতিজ্ঞা করে
ঝড়ের মাঝে
ওদের ধাক্কা দেয়
আর হাত ঝেড়ে নিয়ে
বলে-
পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য
কাউকে না কাউকে তো
বলিদান করতেই হয়।।
৩)
কবরের ওপর মডুয়ার অঙ্কুর
গ্রামে মাটির টিলার ওপরে
মডুয়ার এক অঙ্কুর বেরিয়েছে।
ও শুধু মাটির টিলা নয়,
খিদেয় মরে যাওয়া
সুগনা’র কবর।
ভয়ে লুকিয়ে থাকা ওই বীজ
এখন জন্ম নিয়েছে
শিশিরে ভিজে ভিজে।
ওর অনাথ বাচ্চারা ছটফট করে
গোবর লেপা আঙিনায়
কাঁচা মাটির ঠাণ্ডা উনুনে
ধানের অঙ্কুর জন্ম নিয়েছে।
আর ওর বিধবা,
খালি ডেকচি উপুড় করে রেখে দিয়েছে
যার কালি মাখা পিছন দেখে মনে হয়
খিদের আগুনে ও পুড়ে গ্যাছে।
এবার সুগনার বউ আর বাচ্চারা
খিদেয় মরবে না,
কিন্তু আত্মহত্যা করবে ঠিক,
ওরা জেনে গ্যাছে খিদেয় মরে গেলে
তর্কবিতর্কের কোন ক্ষেত্র তৈরি হবে না।
আত্মহত্যা করলে এটুকু অন্তত গ্যারেন্টি আছে,
যে ওদের লাশের ছবি সব কাগজের পাতায় ছাপবে
মরার কারণ খুঁজতে গিয়ে ওদের ঘরের সঙ্গে
গ্রামের আরও কিছু ঠাণ্ডা উনুনের তল্লাশি করা হবে।
ওদের লাশ দুনিয়াকে বলতে পারবে
কিছু হতভাগ্য ক্ষুধার্তর গল্প
লাখ লাখ নোট ছড়িয়ে ভোটে জিতেছে
কেউ স্রেফ ইলেকশন জেতার জন্যই,
আর ওদিকে অন্ধকারে তড়পে
মরে গ্যাছে সুগনা খিদে নিয়ে।
সুগনার আওয়াজ
বাইরের দুনিয়া পর্যন্ত পৌঁছবে ঠিক।
এটা বলার জন্যই জন্ম নিয়েছে
কবরের ওপর, ওই মডুয়ার অঙ্কুর।।
# মডুয়া বা মুডুয়াকে সাধারণ ক্ষেত্রে রাগি বা finger millet বলা হয়। ফাইবার সমৃদ্ধ গরীবদের এই খাবার আবার বিস্কুট হিসেবে ডায়াবেটিকদের কাজে লাগে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক