যে জীবন ফরিদীর

Reading Time: 4 minutes

হুমায়ুন ফরিদী। বাংলাদেশের অভিনয় জগতে এক মহাপুরুষের নাম। নিজের অভিনয় প্রতিভায় যিনি ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকেই। অভিনেতা হিসেবে তিনি যেমন শক্তিমান, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনন্য।

বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনে হুমায়ুন ফরীদি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চে সমান দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। অর্জন করেছেন দেশ-বিদেশের লাখো-কোটি ভক্তের ভালোবাসা। দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ও রোমান্টিক মানুষ হুমায়ুন ফরীদি আশির দশকের শুরুতে বেলি ফুলের মালা দিয়ে ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন। তাঁর এ বিয়ে সে সময় সারা দেশে বেশ আলোচিত ছিল। সে সংসারে দেবযানী নামে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। পরে হুমায়ুন ফরীদি সংসার শুরু করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। ২০০৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর থেকে একাকী জীবন যাপন করে গেছেন তিনি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে হুমায়ুন ফরীদি তাঁর অভিনয় দিয়েই মুগ্ধ করে রেখেছিলেন অগুনতি দর্শক-সমালোচককে।

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়।

১৯৬৫ সালে পিতার চাকুরীর সুবাদে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময় মাদারীপুর থেকেই নাট্য জগতে পদার্পণ তাঁর। হুমায়ুনের নাট্যঙ্গনের গুরু বাশার মাহমুদ। তখন নাট্যকার বাশার মাহমুদের শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামের একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কল্যাণ মিত্রের ‘ত্রিরত্ন’ নাটকে ‘রত্ন’ রত্ন চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয় তিনি সর্বপ্রথম দর্শকদের সামনে অভিনয় করেন। এরপর এই সংগঠনের হয়ে ‘টাকা আনা পাই’, ‘দায়ী কে’, ‘সমাপ্তি’, ‘অবিচার’সহ ৬টি মঞ্চ নাটকে অংশ নেন।

১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর পিতার চাকুরীর সুবাদে চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ফরীদি নাট্যচর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব নাট্যকার সেলিম আল দীনের ঘনিষ্ঠ সহচার্য পান।

১৯৭৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্য উৎসব আয়োজনেরও প্রধান সংগঠক ছিলেন ফরীদি। এ উৎসবের মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গনে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে একজন মেধাবী ও শক্তিমান নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন ফরীদি, তাঁর সেই উচ্চতায় এ দেশের খুব কম মানুষই পৌঁছতে পেরেছেন।

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবে তিনি গ্রাম থিয়েটারের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হিসেবে শুধু ঢাকাতেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে গৌরবান্বিত করার ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।

হুমায়ুন ফরীদি মঞ্চ, টিভি ও সিনেমায় অভিনয় করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্মাণে সক্ষম হয়েছিলেন। ফরীদি তাঁর কয়েক দশকের কর্মময় জীবনে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ফরীদি অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘শ্যামল ছায়া’, ‘জয়যাত্রা’, ‘আহা!’ , ‘হুলিয়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দহন’, ‘সন্ত্রাস’, ‘ব্যাচেলর’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল নকশার সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘ভবের হাট’, ‘শৃঙ্খল’ প্রভৃতি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’ নাটকে ফরীদির অনবদ্য অভিনয়ের কল্যাণে ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

অসাধারণ অভিনয় আর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ বছর পূর্তি উৎসবে তাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। পরিচিতজন ও ভক্তদের মতে, হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটা যুগের অবসান হয়েছে। তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ে মুগ্ধ ও বিস্মিত হননি এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। শুধু একবার তাঁর অভিনয় দেখার জন্যই টিভির সামনে বসে থেকেছেন কত শত মানুষ।

অভিনয়ের জন্য ২০১৮ সালের একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন হুমায়ুন ফরিদী। এছাড়াও ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

তাঁর কোনো বিশেষ কাজ বা বিশেষ অবদান উল্লেখ করতে যাওয়া নিতান্তই হাস্যকর। ‘মানুষ তাঁকে অমুক নাটকে, অমুক ছবিতে তমুক চরিত্রের জন্য মনে রাখবে’- এসব বলারও কোনো মানে নেই। যা কিছু করেছেন, যখন যেভাবে করেছেন- সবই শ্রেষ্ঠ। ওয়ান অ্যান্ড ওনলি হুমায়ুন ফরিদী শো। এ দেশের অভিনয় জগতে তাঁকে শ্রেষ্ঠতম চরিত্রাভিনেতা কিংবা মেথড অ্যাক্টর- যেটাই বলুন না কেন, একবাক্যে মেনে নেবেন সবাই। বিচিত্র, বেখেয়ালি, বেসামাল আর বেপরোয়া ব্যক্তিজীবনের মতোই বিস্তৃত তাঁর অভিনয়জীবন। নায়ক, খলনায়ক, মহানায়ক- সব সময়ই চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন আবার চরিত্রেই বিলীন হয়েছেন- এ কারণেই তিনি হুমায়ুন ফরিদী। এটা হয় তো একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। আর মানুষ ফরিদী রাখঢাক করে কথা বলতেন না, সোজাসাপ্টা আর চাঁছাছোলা শব্দ তাঁর প্রতিনিয়ত ভাষ্য। আর এর সঙ্গে অসামান্য সেন্স অব হিউমার! তাঁর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে কিবোর্ডে উঠে আসা এ শব্দগুলো দেখলেও নির্ঘাৎ মশকরা করতেন, আর ভুবন কাঁপানো হাসিতে আন্দোলিত করে তুলতেন চারপাশ!

হুমায়ুন ফরিদীর হাসি কানে বাজছে। খোলা গলার, উদাত্ত হাসি।

.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>