অংকুর সাহা
আমেরিকা মহাদেশ অভিবাসীদের দেশ — যাঁরা এদেশের আদি মানব অর্থাৎ প্রাচীন ইন্ডিয়ান জাতি ও উপজাতি, তাঁরা মূলত: উত্তর পূর্ব এশিয়ার মানুষ — আজ থেকে ১৫,০০০ বছর আগে তাঁরা চিন, মংগোলিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে স্থলপথে উত্তর আমেরিকার আলাস্কা অঞ্চলে আসতে শুরু করেন এবং ছড়িয়ে পড়েন মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ইয়োরোপ থেকে এই অঞ্চলের প্রথম আগন্তুক লিইফ এরিকসন (আনুমানিক ৯৭০ – ১০২০) আইসল্যান্ড থেকে পালতোলা নৌকায় রওনা হয়ে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড অঞ্চলে এসে পৌঁছান ১০০০ সাল নাগাদ এবং সেখানে একটি ছোটো উপনিবেশ গড়ে ওঠে।
এর প্রায় ৪০০ বছর পরে ক্রিসতোবাল কলোন (১৪৫১ – ১৫০৬) এর আমেরিকা “আবিষ্কার” এর পর ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন এবং ফ্রান্স থেকে অভিবাসীরা আসতে শুরু করেন এখানে এবং বাস করেন আমেরিকার পূর্ব উপকূলে। তারপর ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডের প্লিমাথ বন্দর থেকে মেফ্লাওয়ার জাহাজটি রওনা হয় নতুন দেশে — ১০২ জন যাত্রী এবং ৩০ জন নাবিক। ১৬০৭ সালে জেমস নদীর ধারে জেমসটাউন শহরের প্রতিষ্ঠা — উপনিবেশটির নাম দেওয়া হয় ভার্জিনিয়া আর পুরো অঞ্চলটির নাম নিউ ইংল্যান্ড। ১৬১৯ সালে জেমসটাউনের পরিষেবার জন্যে আফ্রিকা থেকে বলপূর্বক নিয়ে আসা হয় ২০ জন ক্রীতদাস — সেই কলংকিত প্রথা চলে আরো ২৫০ বছর।
কিন্তু অশ্বেতকায় মানুষদের ছিল এই মহাদেশে আসার নিষেধ। ১৯৬৫ সালে সেই নিষেধের অবসান ঘটলে এশিয়ার দেশগুলি থেকে আমেরিকায় নিয়মিত অভিবাসনের সূচনা। গত পঞ্চাশ বছরে চিন ও ভারতবর্ষ থেকে দলে দলে মানুষ এখানে এসেছেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির খোঁজে — তার মধ্যে ছিলেন বাঙালিরাও। এমনই এক অভিবাসী রোড আইল্যান্ড রাজ্যের লাহিড়ী পরিবার।
।।১।।
মার্কিন সাপ্তাহিকী ‘দ্য ন্যু ইয়র্কার’ এর ২০ এপ্রিল ১৯৯৮ সংখ্যায় এক আনকোরা লেখিকার প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হয় — “আ টেম্পোরারি ম্যাটার” এবং ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় সাহিত্যপ্রেমী মহলে। উত্তর পূর্ব আমেরিকার শহরতলীতে বসবাসরত এক বাঙালি দম্পতির গল্প, যদিও ভুল বানানে — শোভা (shoba) এবং সুকুমার (shukumar)। দুজনেই উত্তর তিরিশ — ছ’মাস আগে শোভা জন্ম দিয়েছে মৃত সন্তানের — সেই সন্তাপের অভিঘাতে দুজনেই পীড়িত। মুছে গিয়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাবলীলতা এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাদের রক্তহীন দাম্পত্য। শোভা তার প্রুফ রিডারের কাজে যায়; ৬ বছর ধরে গবেষণারত সুকুমার বাড়ি বসে থিসিস লেখার কাজে ব্যস্ত থাকার ভান করে। লেখিকা অল্প কথায় জানিয়ে দেন কিভাবে সন্তান হারানোর পর এই দম্পতি একে অন্যকে হারাতে উদ্যত; কিভাবে তারা “…..had become experts at avoiding each other in their three-bedroom house, spending as much time in separate floors as possible.” তারপর একদিন বিদ্যুৎ কোম্পানি চিঠি দিয়ে যায় সেই সপ্তাহে প্রতিদিন সন্ধেবেলা এক ঘন্টা করে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকবে। সেই অন্ধকার সন্ধেগুলিতে তাদের জীবনে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসে — এলোমেলো হলেও কথাবার্তা আদানপ্রদান শুরু করে তারা; কয়েকদিনে অল্প অল্প করে হলেও বাড়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক সান্নিধ্য। কিন্তু সপ্তাহের শেষে বন্ধ হয়ে যায় আলো নেভা — উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর নীচে আবার তারা নগ্ন বাস্তবের মুখোমুখি। শোভা স্বামীকে জানায়, সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, অন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া এমনকী অগ্রিম টাকা জমা দেওয়াও সেরে ফেলেছে সে। স্বচ্ছ অথচ তীক্ষ্ণ ভাষা নির্মাণের জোরে এই সাদামাটা গল্পটি আমাদের মনে গেঁথে যায়। ভাষার পরিমিতি এই করুণ গল্পটিকে সফলতা দেয়, তাকে দু:খের পাঁচালিতে পরিণত করে না।
খুব সম্ভবত: ‘দ্য ন্যু ইয়র্কার’ পত্রিকায় বিশুদ্ধ বাঙালি চরিত্রের প্রথম সমাবেশ এটি। কিন্তু সেখানেই শেষ নয় — আট মাস পরে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সংখ্যায় লেখিকার আরেকটি গল্প প্রকাশিত হল — “সেক্সি”। সেখানে অভিবাসী বাঙালি ও মার্কিন চরিত্রের ক্রস-পলিনেশন। বিবাহিত বাঙালি ভদ্রলোক দেবজিৎ মিত্র ওরফে দেব মিরান্ডা নামে ২২ বছর বয়েসি এক মার্কিন তরুণীর সঙ্গে শরীরী প্রেমে লিপ্ত। ভাষার প্রসাদগুণে গল্পটি একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল, কিন্তু পাশাপাশি অনেক দুর্বলতাও চোখে পড়ে। দেব এর স্ত্রী রূপে মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে তুলনীয় — গল্পের কোথাও ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করা হয় নি তাদের বিবাহিত জীবনের সমস্যা কী? সেইজন্যে কাহিনীটিকে উদ্ভাবিত ও দিশাহীন বলে মনে হতে পারে। মিরান্ডার একমাত্র বন্ধুর নাম লক্ষ্মী সে ভারতীয় এবং তার তুতো বোনের বাঙালি স্বামীও এক ইংরেজ ললনার প্রেমে হাবুডুবু — অর্থাৎ শ্বেতকায় ও বাঙালির যৌনসম্পর্কই যেন গল্পের মেরুদন্ড। প্রাথমিক মাধুর্যটুকু মিলিয়ে যাবার পরে গল্পটি প্রায় অভিঘাতহীন। কাহিনীর পরিকল্পিত সমাপতনগুলি অনেকটাই দৃষ্টিকটু লাগবে পাঠকের — তবে গল্পটি ঢেউ তোলে মার্কিন পাঠক মহলে।
প্রায় ছ’মাস পরে জুন ২১, ১৯৯৯ সংখ্যায় লেখিকার তৃতীয় গল্পটি বেরোয় — ‘দ্য থার্ড অ্যান্ড ফাইনাল কন্টিনেট’ — নস্টালজিয়ায় আকীর্ণ এই গল্পটিও সাড়া জাগায় এবং সেই সঙ্গে আমরা জানতে পারি লেখিকার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশ হবে সেই বছরের শেষ নাগাদ। মূল চরিত্র এক বাঙালি; প্রথম মহাদেশ এশিয়াতে তাঁর জন্ম ও ছেলেবেলা, তারপর বি.কম ডিগ্রির জন্যে ইংল্যান্ডে যাত্রা (দ্বিতীয় মহাদেশ, ইয়োরোপ), সেখানে, “On weekends, we lounged barefoot in drawstring, pajamas, drinking tea, smoking Rothmans or get to watch cricket at Lord’s”; সেখানে কয়েক বছর কাটিয়ে তৃতীয় মহাদেশ আমেরিকায়। উত্তম পুরুষে লেখা সাধারণ মানুষের সুখদু:খের, দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা কাহিনী — কিন্তু তার গদ্যরীতি আগের দুটি গল্পের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা; ভাষার চমৎকারিত্ব তার একটি প্রধান আকর্ষণ। অন্যান্য রচনার মতন পরিশীলিত মার্কিন ইংরেজি ভাষা নয়; শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবর্ণের বাঙালির ভাষা — গল্পটি পড়তে পড়তে মাঝে মধ্যেই আমার মস্তিষ্কে পি.কে.দে সরকারের ব্যাকরণ বই এর গন্ধ ভেসে আসে। গল্পের পার্শ্বচরিত্রগুলিও জীবন্ত, আগের গল্পের মিরান্ডার মতন একমাত্রিক নয় — শতায়ু বাড়িউলি মিসেস ক্রফট, যিনি কথায় কথায় ‘splendid’ বলে ওঠেন এবং ৬৮ বছর বয়েসি কন্যাকে বেঁধে রাখতে চান বালিকাসুলভ কড়া শাসনে; কলকাতা থেকে সদ্য এসে উপস্থিত নববধূ মালা — এইসব মিলে আমেরিকায় নতুন জীবনযাপন সূত্রপাতের অম্লমধুর কাহিনী। পাঠক উদগ্রীব হয়ে থাকেন পরবর্তী সাহিত্যকর্মের জন্যে — এবার কোন দিকে মোড় ফিরবেন তিনি। মার্কিন সাহিত্যজগতে এক নতুন প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছে — সেই নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।
আমেরিকার প্রথম শ্রেণীর কবি সাহিত্যিকদের একটা বড় অংশ হয় অভিবাসী অথবা অভিবাসী বংশোদ্ভূত; এবং তা মূলত: ইয়োরোপের। রুশ-মার্কিন লেখক ভ্লাদিমির নবোকভ (১৮৯৯ – ১৯৭৭) অথবা আলেকসান্দার সলঝেনিৎসিন (১৯১৮ – ২০০৮); অথবা জার্মান-মার্কিন লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক (১৮৯৮ – ১৯৭০), হেনরি মিলার (১৮৯১ – ১৯৮০) অথবা জন স্টাইনবেক (১৯০২ – ১৯৬৮)। কেবল খলিল জিব্রান (১৮৮৩ – ১৯৩১) এক ব্যতিক্রম — তিনি লেবানীয়-মার্কিন, তাও দেশটি ইওরোপের সীমান্তে। গত এক দশকে কিন্তু বদলে গিয়েছে চিত্রটি — নতুন প্রজন্মের অভিবাসী লেখকেরা নানান বিচিত্র দেশের — জুনো দিয়াজ (১৯৬৮) দোমিনিকান-মার্কিন লেখক; এদুইজ দান্তিকা (১৯৬৯ -) হাইতি-মার্কিন লেখিকা — প্রমুখের রচনা বৈচিত্র্যময়। এই নবীন লেখককূলের নেতৃত্বে আমাদের আলোচ্য বাঙালি-মার্কিন লেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ী।
।।২।।
নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ীর জন্ম ইংল্যান্ডের এক বাঙালি পরিবারে ১৯৬৭ সালে। খুব ছোটবেলায় মা-বাবার হাত ধরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন — রোড আইল্যান্ড রাজ্যের কিংস্টন শহরে। পাসপোর্টে ও বার্থ সার্টিফিকেটে তাঁর সেই নাম, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বিপত্তি ঘটে, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষিকা তাঁর দীর্ঘ জটিল নামদুটির উচ্চারণে দিশেহারা হয়ে চালু করে দেন তাঁর “ঝুম্পা” ডাকনামটিকে এবং সেই নামেই তিনি পরিচিত স্কুলে, কলেজে এবং লেখিকা হিসেবে।
সাত বছর বয়েসে তাঁর গল্প লেখার শুরু — অল্প স্বল্প লেখা চালিয়ে যান স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। বার্নার্ড কলেজ থেকে ঝুম্পা ইংরেজি সাহিত্যে BA পাশ করেন। তারপর মা-বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাকুরি — প্রথমে একটি পুস্তকালয়ে ক্লার্কের কাজ এবং পরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টের পদে। এই কর্মের সূত্রে তাঁর ডেস্কে আসে একটি কমপিউটার এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেই কমপিউটারেই তাঁর সিরিয়াস ও নিয়মিত সাহিত্যচর্চার সূচনা — একটির পর একটি গল্প। শুধু তাই নয়, তিনি নাম লেখালেন বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পঠন পাঠনের জন্যে। সেখানে পর পর কয়েকটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, যেগুলি তাঁর বাবা-মা সস্নেহে সাজিয়ে রেখেছেন ঘরের দেয়ালে। তাঁর নিজের কথায়, “An absurd number of degrees”। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন অধ্যাপক লেসলি এপস্টাইন (১৯৩৮ -) যিনি নিজেও সফল উপন্যাসিক। ঝুম্পা গল্প লেখায় হতাশা অথবা আত্মবিশ্বাসের অভাব প্রকাশ করলে তিনি উৎসাহ ও উপদেশ দিতেন — “Never forget you are a fiction writer”। লেখিকার নিজের কথায়, “Such comments were like a life boat in a cold, unfriendly ocean”।
একদিকে চলতে লাগলো “রেনেসাঁ স্টাডিজ” বিষয়ে ডক্টরেটের কাজকর্ম, অন্যদিকে নিয়মিত গল্প লেখা। দু বছরের ফেলোশিপ পেলেন প্রভিন্স্টাউন শহরের ফাইন আর্টস ওয়ার্ক সেন্টারে। তার পর প্রায় অলৌকিক ভাবেই ঘটতে লাগলো একের পর এক ঘটনা — সুখ্যাত “দ্য ন্যু ইয়র্কার” পত্রিকায় প্রকাশিত হল প্রথম গল্প, যোগাড় হল তাঁর নিজস্ব সাহিত্য-এজেন্ট। চুক্তি হ’ল প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের — সবই অতি অল্প সময়ের মধ্যে। গল্পের মতন আবিশ্বাস্য মনে হলেও পুরোপুরি বাস্তব ঘটনা।
১৯৯৯ সালের শেষ নাগাদ প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, “ব্যাধির প্রতিবেদক” (“Interpreter of Maladies”) — বিভিন্ন স্বাদের ছোট ও বড় ন’টি গল্পের সংকলন — সবচেয়ে ছোটটি ১৫ পাতা, সবচেয়ে বড়টি ২৮। সরাসরি পেপারব্যাক হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল গ্রন্থটি। যদিও লেখিকা প্রায় তাঁর সারাজীবন মার্কিন দেশে কাটিয়েছেন এবং সম্ভাবনাময় মার্কিন কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর সুনাম, গ্রন্থটি বিপণনে প্রকাশক হিউটন মিফলিন কিন্তু তাঁকে হয় ভারতীয় লেখিকা অথবা এক বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর (Ethnic) লেখিকা বলে জ্ঞাত করতেই আগ্রহী।
ঝুম্পার গল্পের চরিত্রগুলি সাবলীলভাবে ঘোরাফেরা করে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে কলকাতায় — সেখান থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বে, “নবীন ইংল্যান্ড” অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে। প্রধান চরিত্রগুলি বেশির ভাগই অভিবাসী, তার মধ্যে পশ্চিমে বসবাসকারী অর্থনৈতিক অভিবাসী বাঙালিই সিংহভাগ, তবে বুড়িমার মতন পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আসা রাজনৈতিক কারণে ছিন্নমূল অভিবাসীও আছেন। তিনটি গল্পের পটভূমি ভারতবর্ষ, বাকীগুলির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ছোটবেলায় লেখিকা মা-বাবার সঙ্গে ছুটি কাটাতে নিয়মিত কলকাতায় গিয়েছেন — সেই অভিজ্ঞতার রসে জারিত হয়েছে তাঁর ভারতীয় চরিত্রগুলি; এ ছাড়া রয়েছেন মার্কিন দেশে অভিবাসী বাঙালিরা, যাঁদের সাহচর্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন; আর মূলত: গল্পের প্রয়োজনে পাদপূরণের মতন এসেছে কিন্তু মার্কিন চরিত্রও। কলকাতা শহরটি তার ভাল-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত মিলে বার বার ফিরে আসে ঝুম্পার রচনা। গ্রন্থটির সমসাময়িক এক সাক্ষাৎকারে কলকাতা বিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তরে লেখিকা জানিয়ে ছিলেন, “I went to Calcutta neither as a tourist or as a former resident — a valuable position, I think, for a writer. I learned to observe things as an outsider and yet I also know that, as different as Calcutta may be from Rhode Island, I belonged there in some fundamental way. In the ways, I did not seen to belong in the US.”
বইটি পড়ে শেষ করার পর গল্পগুলির কোন একটি বা দুটি আলাদা করে মনে লেগে থাকে না — সব কেমন মিলেমিশে এক হয়ে যায়; কেবল মনে থাকে একঝাঁক অভিবাসী বাঙালি চরিত্রের একটি রঙিন কোলাজ — তাদের জীবন, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা। দু:খ, প্রেম, প্রবঞ্চনা — সব কিছু। তারা কিভাবে ঘরে ঢুকেই জুতোজোড়া খুলে সযত্নে সরিয়ে রাখে, বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেয়ে যায় কাপের পর কাপ চিনি-দুধ-মেশানো চা — আমরা তাদের বসার ঘরে বা শোবার ঘরে এক ঝলক উঁকি মেরে দেখ নিই তাদের জীবনচর্যা। এই সব বাঙালি চরিত্রদের রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আমরা নিয়মিতই দেখে থাকি দৈনন্দিন মধ্য আমেরিকায় — আপিসে, গ্রন্থাগারে, মাছের বাজারে, প্রাইস-কস্টকোর চেক আউট কাউন্টারের লম্বা লাইনে, দুর্গাপূজায় পার্টিতে, হিন্দি সিনেমার প্রেক্ষাগৃহে, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা কথক নাচের কনসার্টে। এঁরা সুখী, তৃপ্ত, সামাজিক দায়িত্ব, চার-শয়নকক্ষের বাগান শোভিত গৃহ, একজোড়া হন্ডা অথবা ভোলভো এবং স্টক-আপশান সম্পন্ন রুচিবান নারীপুরুষ। ঝুম্পা কিন্তু মৃদু, আবেগহীন কন্ঠে বলে যান তাঁদের জীবনযাত্রার আলোকিত এবং অন্ধকার খুঁটিনাটি। তাঁর স্বচ্ছ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয় তাঁদের গভীর অবচেতন এবং জীবনযাপনের জটিলতা। যদিও আশাপূর্নার গভীরতর মর্মবেদনা অথবা মহাশ্বেতার ব্যঙ্গ-কশাঘাত-বিদ্ধ সমাজ সচেতনতা সেখানে অনুপস্থিত — লেখিকার বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বের অভিবাসী বাঙালি জীবন থেকে সেঁচে নেওয়া মণিমুক্তাগুলি গল্পের উপভোগ্যতা বাড়ায়।
।।৩।।
তিনটি গল্পের কথা আগেই সাতকাহন বলেছি — তারা গ্রন্থের আদি (প্রথম) মধ্য (পঞ্চম) ও অন্ত (নবম)। দ্বিতীয় গল্পটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত এবং লিলিয়া নামে দশ বছর বয়েসি এক বালিকার জবানীতে বর্ণিত। বস্টন শহরের উত্তরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে বসবাসকারী বাঙালি পরিবারে নিয়মিত খেতে আসতেন বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক মি: পিরজাদা — তখন ১৯৭১ সালের হেমন্ত ও শীতকাল। ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ এবং পরিবারটি অতিথিকে একান্ত আপন করে নেয়। পর্যবেক্ষণ শক্তি (গৃহিণী মুলো দিয়ে পালংশাকের চচ্চড়ি রান্না করছেন) এবং ভাষার গুণে চরিত্র গুলিকে রক্তমাংসের বাঙালি মনে হয়, যদিও মি: পিরজাদার পক্ষে হ্যালো-উইনের কুমড়ো চিনতে না পারার ব্যাপারটি অস্বাভাবিক।
নামগল্পের (“ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস”) পটভূমি ভারতবর্ষ। গল্পটি ও. হেনরি পুরষ্কার এবং সেরা মার্কিন ছোটগল্প পুরষ্কারের জন্যে নির্বাচিত হয়েছিল। আমেরিকার ন্যু জার্সি রাজ্য থেকে পুরী ভ্রমণে এসেছেন এক বাঙালি পরিবার রাজ ও মিনা দাস এবং তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে রনি, রবি ও টিনা। গন্তব্য তাঁদের ঐতিহাসিক কোনারকের সূর্যমন্দির — সঙ্গে ড্রাইভার ও ট্যুরগাইড মাঝবয়েসি মি: কাপাসি — ভাল ইংরেজি বলতে পারার জন্যে যিনি বিদেশের ট্যুরিস্টদের নিয়ে বেড়ানোর ভার পান। এটি অবশ্য তাঁর অবসরের কাজ, মূল জীবিকা পুরী শহরে এক ডাক্তারের চেম্বারে — ওড়িয়া ডাক্তারের প্রচুর গুজরাতি রুগি — ভাষার দূরত্ব রুগিদের চিকিৎসার পথে বাধা — তিনি সেই রুগিদের “ব্যাধির প্রতিবেদক” — গুজরাতি উপসর্গগুলির তিনি অনুবাদ করে দেন উড়িয়া ভাষায়। লেখিকা এই ছ’জন নারী পুরুষ শিশুকে ভরে দেন পেটমোটা এক সাদা অ্যামবাসাডার গাড়িতে এবং পুরী থেকে কোনারক, প্রতিদিকের ৫২ মাইল যাত্রায় গল্প জমে ওঠে — তার মধ্যে নাটক, ঘাত-প্রতিঘাত এবং প্রায় অবিশ্বাস্য এক স্বীকারোক্তি! ডিটেলের একটি প্রমাদ রয়েছে গল্পে, যেটা মার্কিন পাঠকের কাছে মনে হতে পারে — “close enough!” মি: কাপাসি কথা বলেন “Orissi” নামে একটি ভাষায় — এই নামে কোন ভাষার অস্তিত্ব নেই। “Odissi” একটি নৃত্যের নাম এবং “Oriya” হল উড়িষ্যা রাজ্যের অধিবাসীদের মাতৃভাষা।
আরও দুটি গল্পের পটভূমি ভারতবর্ষ; “আ রিয়েল দারোয়ান” গল্পের মূল চরিত্র ফ্ল্যাটবাড়িতে আশ্রিতা এক বুড়িমা — সিঁড়ি ধোয়ামোছার ফাঁকে ফাঁকে তিনি পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেন। মেলোড্রামাকীর্ণ, করুণরসের গল্পটি মনে তেমন দাগ কাটে না। আমার মতে এটি গ্রন্থের দুর্বলতম গল্প। অন্য গল্পটিও তথৈবচ (“দা ট্রিটমেন্ট অফ বিবি হালদার”) — এক মৃগি রোগগ্রস্ত অনূঢ়া মেয়ের গল্প। এরকম গল্প বাংলায় লেখা হয় প্রতিদিন, আমার মনে পড়ে সাতের দশকে প্রকাশিত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের “রাণীর বাঁধের বৃত্তান্ত” গল্পের কথা। গল্প দুটিই দুর্বল, কিন্তু ভাষার গুণে এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। মার্কিন পাঠকদের অবশ্য অন্যরকম লাগতেই পারে।
অভিবাসী মানুষের গল্পই ঝুম্পার কলমে খোলে সবচেয়ে ভাল — “মিসেস সেন’স” গল্পটি গ্রন্থের উজ্জ্বলতম — প্রধান চরিত্রের বসবাস নবীন ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয় শহরতলিতে, সন্তানহীনা তিনি, স্বামী ব্যস্ত মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সময় কাটাতে তিনি বেবি সিটারের কাজ নিয়েছেন — একাদশ বর্ষীয় এলিয়টকে তিনি স্কুলের পর দেখাশোনা করেন। এলিয়ট উৎসুক চোখে দেখে বঁটি দিয়ে তাঁর সব্জি কাটা — “Instead of a knife, she used a blade that curves like the prow of a Viking skip, sailing to battle in distant areas”. গল্পটি মজার কিন্তু দম্পতির বিবাহিত জীবনের অপূর্ণতার কথাও লেখিকা অল্প কথায় সম্পাদকীয় মন্তব্য ছাড়াই জানিয়ে দেন। মাছের মুড়ো নিয়ে এই কথোপকথনের সঙ্গে আমেরিকার অনেক বাঙালিই একাত্ম বোধ করবেন —
“You want this cleaned, Mrs. Sen?”
She nodded. “Leave the heads on, please.”
“You got cats at home?”
“No cats. Only a husband.”
গল্পটি নাটকীয়তাবিহীন, কিন্তু ভাষার প্রসাদগুণে দীপ্যমান — ভারতীয় ও মার্কিন মূল্যবোধের সংঘর্ষে প্রাণময় হয়ে ওঠে।
অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লেখা “দিস ব্লেসড হাউস” গল্পটি সংকলনের অন্য গল্পের থেকে একেবারে আলাদা — মধুর অথবা করুণ রসের কোন রেশ নেই সেখানে। নবদম্পতি সঞ্জীব এবং অণিমা ওরফে টুইংকল তাদের নতুন বাড়িতে এসে সংসার পাতায় উদ্যত। টুইংকল বাড়ির বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কার করতে থাকে লুকিয়ে রাখা যিশুখ্রীষ্টের মূর্তি ও খ্রিষ্টিয় ধর্মের অন্য নানান সামগ্রী। সেই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ বাধে, তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। আমেরিকায় বসবাসকারী মানুষজনের সামাজিক জীবনে খ্রিষ্ট ধর্মের যে অমোঘ প্রভাব, তার একটি চোরা স্রোত রয়েছে এই গল্পে। পশ্চিমের সভ্য ও উন্নত দেশগুলির মধ্যে আমেরিকাতেই মৌলবাদীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ২০১৮ সালের আমেরিকাতেও অন্ত নেই ধর্মান্ধতার — একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে আমেরিকা খ্রিস্টীয় মানুষের দেশ। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়টিতে লেখিকা পরে কখনও ফিরে আসেন নি।
২০০০ সালে খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই গ্রন্থটি পুলিৎসার পুরস্কারে ভূষিত হয়। ফলে তরুণ, শক্তিশালী, নতুন লেখকের তালিকায় ঝুম্পা লাহিড়ীর নামটি চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে। তাঁর কাছে পাঠকের এবং প্রকাশকের প্রত্যাশাও হয়ে দাঁড়ায় আকাশছোঁয়া। সংবাদে প্রকাশ পায় তিনি একটি উপন্যাস রচনার কাজে হাত দিয়েছেন।
।।৪।।
“সমনামী” (“The Namesake”) উপন্যাসের একটি নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হয়েছিল দীর্ঘ গল্প হিসেবে “ন্যু ইয়র্কার” পত্রিকার জুন ১৬, ২০০৩ সংখ্যায় “গোগোল” নামে। বেশির ভাগ বাঙালির যে একটি ডাকনাম এবং একটি ভালো নাম থাকে, গল্পটি কাহিনীর সাহায্যে সেই রহস্যের দীর্ঘ ব্যাখ্যা; তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় একটি ট্রেন দুর্ঘটনা এবং প্রধান চরিত্রের প্রায় অলৌকিক জীবন রক্ষা। এবং নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা কিভাবে ঝুম্পা হলেন তারও খানিকটা আভাস পেয়ে যাই আমরা।
অশোক নামে এক এনজিনিয়ারিং এর ছাত্র হাওড়া থেকে জামসেদপুর যাওয়ার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েন। দুর্ঘটনার মুহূর্তে অশোক তাঁর বার বার পড়া প্রিয় গল্প নিকোলাই গোগোল (১৮০৯ – ১৮৫২) রচিত “ওভারকোট” পড়ছিলেন। গুরুতর ভাবে আহত হলেও অশোক প্রাণে বেঁচে যান অলৌকিকভাবে। পরে তিনি লেখাপড়ার জন্যে আমেরিকায় আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। পরে অশোক ও অসীমা (Ashima) তাঁদের প্রথম সন্তানের ডাকনাম রাখেন “গোগোল”। “Being rescued form that shattered train had been the first miracle of his life. But here, now, reposing in his arms, weighing next to nothing but changing everything, is the second”.
তার ভালো নাম নিখিল, কিন্তু পাকেচক্রে স্কুলে গোগোল নামটিই স্থায়ী হয়ে দাঁড়ায়। দুই নামের, দুই অস্তিত্বের টানাপোড়েনে কাটে তার ছেলেবেলা। যুবক পুত্রের কাছে থ্যাংকসগিভিং এর সন্ধেয় অশোক বর্ণনা করেন প্রথমবারের মত তার নামের ইতিহাস এবং তাঁর নিজের প্রায় — মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার কাহিনী।
কিছুটা অতিনাটকীয়তা থাকলেও এক টানটান, অপরূপ ও সুখপাঠ্য গল্প — এই প্রৌঢ় অভিবাসী বাঙালিরও দু চোখ আর্দ্র হয় গল্পটি পড়তে পড়তে। অশোক ও অসীমার চরিত্রদুটি খুব সম্ভবত লেখিকার বাবা-মা অমর ও টিয়া লাহিড়ীর আদলে রচিত এবং এইরকম একটি ট্রেন দুর্ঘটনাও ঘটে তাঁদের এক নিকট আত্মীয়ের জীবনে। বোঝা যায় যে পুলিৎসার পুরষ্কার প্রাপ্ত নবীন লেখিকা তার গল্প বলার যাদুটি তখনও বজায় রাখতে পেরেছেন। কিন্তু কাহিনীর একটু গভীরে নামলে গোল বাধে। ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ঘাটশিলা এবং ধলভূমগড়ের মাঝামাঝি একটি গ্রামের কাছে — কিন্তু লেখিকা অবলীলাক্রমে অঞ্চলটিকে বসিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। পঞ্চাশের দশকের কবিদের কল্যাণে এবং “অরণ্যের দিনরাত্রি” চলচ্চিত্রটির সূত্রে যে কোন বাঙালি পাঠকই জানবেন ধলভূমগড় কোন রাজ্যে। আর ১৯৬০ এর দশকের কলকাতায় আলীপুরের মতন সম্ভ্রান্ত অঞ্চলে বাড়িতে কলের জল নেই (“No running water”) এটাও বিশ্বাস করা মুশকিল। ত্রুটিগুলি দেখিয়ে দিয়ে আমি চিঠি লিখেছিলাম “দ্য ন্যু ইয়র্কার” কাগজে।
কয়েক মাস পরে সেপ্টেম্বর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হল হিউটন মিফলিন প্রকাশনা সংস্থা থেকে — প্রায় তিনশো পাতার উপন্যাস — দ্য ন্যু ইয়র্কারে প্রকাশিত বড়গল্পটির কাঠামোতে প্রচুর মাংস-মেদ-মজ্জা লাগিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয়তা এবং সুসমালোচনা — নাম উঠলো বেস্টসেলারের তালিকায় এবং অনেক পত্রপত্রিকায় সমালোচকের মতে ২০০৩ সালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মীরা নায়ারের পরিচালনায় চলচ্চিত্রও নির্মিত হ’ল কয়েক বছরের মধ্যে। এক বাঙালি অভিবাসী পরিবারের জীবনের তিন দশকের কাহিনী অবলম্বনে বাণিজ্য সফল মার্কিন গ্রন্থ এই প্রথম।
অভিবাসী বাঙালি জীবন থেকে সেঁচে নেওয়া অনেক মর্মস্পর্শী দৃশ্য রয়েছে এই গ্রন্থে — প্রথম পৃষ্ঠাতেই অন্ত:সত্ত্বা অসীমার ঝালমুড়ি বানানোর প্রচেষ্টা — রাইস ক্রিস্পি, প্ল্যান্টার কোম্পানির বাদাম, লাল পেঁয়াজ আর লেবুর রস দিয়ে। প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি স্বামীকে ডাকছেন, “… instead of saying Ashoke’s name, she utters the interrogative that has come to replace it. Which translates roughly as “Are you listening to Me”.
কাহিনী এগিয়ে চলে এবং উন্মোচিত হয় অভিবাসী বাঙালি পরিবারের দৈনন্দিন জীবন, পূর্ব ও পশ্চিমের যুগলবন্দী; দুই নৌকায় পা রেখে মোহানার দিকে অবিরাম যাত্রা। ২১ শতকের মার্কিন কথাসাহিত্যিকদের বদলে ঊনবিংশ শতকের রুশ লেখকের মতন তার অভিঘাত — হয়ত সেই জন্যেই মার্কিন পাঠকের কাছে তার চমৎকৃত নূতনত্ব। “For being a foreigner, Ashima is beginning to realize, is a sort of lifelong pregnancy — a perpetual wait, a constant burden, a continuous feeling out of sort. It is, an ongoing responsibility, a parenthesis in what had been an ordinary life, only to discover that that pervious life has vanished, replaced by something more complicated and demanding”.
আমার মতে উপন্যাসটির প্রধান দুর্বলতা হল অশোক, অসীমা ও গোগোল ছাড়া অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রগুলি। প্রধান চরিত্রগুলি লেখিকা যেমন মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, গোগোলের বোন সোনালি (পরে সোনিয়া) এবং তার স্ত্রী মৌসুমী (Moushumi) চরিত্রগুলি অসম্পূর্ণ এবং অগভীর। শেষোক্ত চরিত্রের বিবাহ বহির্ভূত পুরুষসঙ্গের কোন সঙ্গত কারণ বা পটভূমিও গড়ে তোলা হয়নি। ক্ষণস্থায়ী প্রণোদনা ছাড়া তার অন্য ব্যাখ্যা করা মুশকিল। গোগোলের স্কুলের বন্ধুদের এবং তার বান্ধবী/প্রেমিকাদের চরিত্রগুলিও একমাত্রিক ও শোণপাংশু। গোগোল ছাত্রাবস্থা পেরিয়ে প্রাপ্ত বয়েসে তার কর্মজীবন শুরু করলে গল্পটি কেমন খেই হারিয়ে ফেলে। সব মিলিয়ে এই সুপাঠ্য উপন্যাসটি কোনো নতুন পালক যোগ করে না লেখিকার উষ্ণীষে — বরং আগে পড়া সফল গল্পগুলির দীর্ঘতর সংস্করণ হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যতে লেখিকা কোনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেন কিনা তাঁর সাহিত্যে, সে জন্যে আমাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত তাঁর রচনা পড়ে মনে হয় যে উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্পের মাধ্যমেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ।
দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, “We all come out of Gogol’s overcoat”. আক্ষরিক অর্থে এই প্রথম একটি উপন্যাসের জন্ম হ’ল গোগোলের ওভারকোট থেকে।
।।৫।।
“দ্য ন্যু ইয়র্কার” সাময়িকপত্রে ঝুম্পার সাহিত্যজীবনের শুভ নান্দীমুখ; যদিও গত এক দশকে তিনি “অগ্নি”, “হারভার্ড রিভিউ”, “স্যালামান্ডার” প্রমুখ সাহিত্য পত্রে গল্প লিখেছেন, এই একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা নিয়মিত পড়লেই লেখিকার সাহিত্যিক চিন্তাভাবনার ক্রমান্বয়ে অগ্রগতির একটা স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে। উপন্যাসটির অভাবিত সাফল্যের পর পাঠক মহলে ঔৎসুক্য বাড়লো তাঁর রচনার বিষয়ে।
উপন্যাসটি প্রকাশের পরের বছর দ্য ন্যু ইয়র্কার কাগজের মে ২৪, ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হ’ল তাঁর নতুন গল্প “হেল-হেভেন”, চরিত্রেরা অভিবাসী বাঙালি এবং বস্টন অঞ্চলের অধিবাসী — অর্থাৎ লেখিকার করতলের আমলকী। বাবা-মা-মেয়ের সংসারে নতুন আগমন প্রণবকাকুর — কলকাতার ধনী পরিবার থেকে নতুন বিদেশে আসা উজ্জ্বল ছাত্র। সুলিখিত হলেও সাদামাটা গল্প — বিষয়বস্তুর নতুনত্ব নেই। তবে লক্ষ করা যায় যে মার্কিন চরিত্রগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি এবং কাহিনীতে তাদের স্থান দৃঢ়তর। শেষ পর্বের চমকটিও আহামরি কিছু নয় — বরং আবেগবহুলতায় ক্ষতি হয়েছে গল্পের। অভিবাসী বাঙালি চরিত্রগুলি দক্ষতার সঙ্গে অংকিত, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সম্ভাবনা ছিল একটি অভিবাসী “নষ্টনীড়” গড়ে ওঠার, কিন্তু সাধারণ একটি করুণ রসের কাহিনী হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তী তিন বছরে আরো দুটি গল্প — তাদের মূল চরিত্রগুলি এক হেমা এবং কৌশিক — প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বাঙালি। একই সাপ্তাহিকের মে ৮, ২০০৬ সংখ্যায় “ওয়ান্স্ ইন এ লাইফটাইম”; দুজনের ছেলেবেলার কাহিনী, মূলত: হেমার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রচিত। দুই বাঙালি পরিবারের বাস কেমব্রিজ শহরে, হেমা ও কৌশিকের খেলার সাথী। ১৯৭৪ সালে কৌশিকের বাবা-মা দেশে ফিরে যান — হেমার বয়েস ছয়, কৌশিকের নয়। ১৯৮১ সালে কৌশিকের পরিবার ফিরে আসে আমেরিকায় এবং প্রথমে ওঠে হেমাদের বাড়িতে। ত্রয়োদশী হেমা প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেলে কৌশিককে। একই গৃহে অল্প কিছু দিনের জন্যে দুই পরিবারের বসবাস এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়েই গল্পটি গড়ে ওঠে। আগের ঘনিষ্ঠতা আর পুরোপুরি ফিরে আসে না। জানা যায় যে কৌশিকের মা স্তনের ক্যানসারে আক্রান্ত এবং তাদের আমেরিকায় আসা চিকিৎসার জন্যে যতোটা না, তারও বেশি নির্বিঘ্নে মৃত্যুর জন্যে। দেশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মানুষের অকালমৃত্যু কোলাহলের কারণ হয় অনেক বেশী। এক পরিমিত, সংবেদনশীল মেজাজে এগিয়ে চলে গল্পটি। দ্বিতীয় গল্পটি (“ইয়ার’স এন্ড”) প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২৪, ২০০৭ সংখ্যায়। কৌশিকের জবানীতে গল্প — সে এখন কলেজে, মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা আবার বিয়ে করেছেন এক বিধবা স্কুলশিক্ষিকাকে, তাঁর আগের পক্ষের দুই কন্যা, রূপা এবং পিউ। বড়দিনের ছুটিতে কৌশিক বাড়ি আসে এবং ছুটির মধ্যে বয়েসে অনেকটাই ছোট দুই সৎ বোনের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতেও কিভাবে হঠাৎ ভেঙে যায় এবং কৌশিক খড়কুটোর মতন ভেসে চলে উত্তর পূর্ব আমেরিকার বিভিন্ন অপরূপ, নির্জন অঞ্চলে — সেই নিয়েই গল্পটি। লেখক পরিচিতি থেকে জানা যায় যে পরবর্তী গল্প -গ্রন্থটির নাম “অনভ্যস্ত ধরা” (“Unaccustomed Earth”) এবং আলফ্রেড এ ক্লথ প্রকাশনাসংস্থা থেকে প্রকাশিত হবে ২০০৮ এর বসন্তে। গ্রন্থটির ভূমিকায় উত্তরপূর্ব আমেরিকার একই অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বসবাসকারী লেখক ন্যাথানিয়েল হথর্ণ এর (১৮০৪ – ১৮৬৪) “রক্তবর্ণ চিঠি” (“The Scarlet Letter”) উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় থেকে একটি উদ্ধৃতি — “Human nature will not flourish, any more than a potato, if it be planted and replanted, for too long a series of generations, in the same worn-out soil. My children have had other birthplaces, and, so for as their fortunes may be within my control, shall strike their roots into unaccustomed earth”. সেখান থেকেই গ্রন্থের নামকরণ — অনভ্যস্ত ধরায় প্রোথিত চারাগাছের মতই অভিবাসী বাঙালি-মার্কিন চরিত্রগুলির দিনযাপন। আটটি গল্প নিয়ে এই সংকলন, তার মধ্যে পাঁচটি গল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ, বাকী তিনটি গল্প হেমা ও কৌশিককে নিয়ে; প্রথম দুটির কথা আগেই বলেছি, তৃতীয় গল্পটির নাম “গোয়িং অ্যাশোর” — সেখানে প্রায় দু’দশক পরে ইতালিতে দুজনের দেখা। হেমার বয়স ৩৭, সে ওয়েলেসলি কলেজের অধ্যাপিকা এবং কাজের ছুতো করে এসেছে ইতালি, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এখানে কাটিয়ে ফিরে যাবে কলকাতায় সেখানে নবীন নামে এক পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে। কৌশিক আলোকচিত্র-সাংবাদিক, পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো তার কাজ। নতুন প্রজেক্টের কাজে থাইল্যান্ডে যাবার আগে কিছুদিনের ছুটিতে রোমে। সেখানে দুজনের দেখা এবং পুরানো পরিচয় মানিয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক। দুই পুরুষকে নিয়ে হেমা দোটানায় পড়লে সমাধান করে দেয় থাইল্যান্ডের সুনামি, কৌশিকের মৃত্যু হলে এক হৃদয় অপরাধবোধ নিয়ে নতুন দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে হেমা। ত্রিকোণ সম্পর্কের নারী পুরুষের গল্প রচিত হচ্ছে মানব সভ্যতার সূত্রপাত থেকে, কিন্তু এক্ষেত্রে তার সমাধান করতে সাহায্য নিতে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের — সুসংগঠিত কাহিনীর এটাই একমাত্র দুর্বলতা।
অন্য গল্পগুলিতেও হথর্নের উপমা অনুসরণ করে ঝুম্পা দুই প্রজন্মের বাঙালিকে পথ দেখান — অভিবাসী বাঙালি ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা। তাদের সুখ-দু:খ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কাহিনী। অন্য চরিত্রগুলিও শ্বাস ফেলার সুযোগ পায় — প্রণবের স্ত্রী ডেবোরা, রুমার স্বামী অ্যাডাম, সঙ্গীতার স্বার্থপর ও আত্মাভিমানী বয়ফ্রেন্ড ফারুক, রুমমেট পল — এরা রক্তমাংসের মানুষ। তবে ঝুম্পার চরিত্রেরা এখনও শিক্ষিত, মার্জিত, মার্কিন সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ। সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত আমেরিকা এখনও তাঁর সাহিত্যের বৃত্তে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
।।৬।।
“দ্য ন্যু ইয়র্কার” পত্রিকার জুন ১০, ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ঝুম্পার নতুন দীর্ঘ গল্প “ব্রাদারলি লাভ” — সঙ্গে ট্রাম লাইন এবং অ্যামবাসাডর গাড়ি সমেত কলকাতার ছবি। দুই ভাই এর গল্প — একজন নকশাল আমলের কলকাতায় আর অন্যজন ডক্টরেট ডিগ্রির সন্ধানে আমেরিকায়। গল্পটি লেখিকার প্রকাশিতব্য নতুন উপন্যাস “নীচু জমির দেশ” (দ্য লোল্যান্ড”) এর নির্বাচিত অংশ — গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তিন মাস পরে সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩। উপন্যাসটি ওই বছরের ম্যান বুকার পুরষ্কারের বাছাই-তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরষ্কারটি প্রায় অন্য একটি গ্রন্থ।
লেখিকা একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে কলকাতায় আত্মীয় স্বজনের মুখে শোনা একটি মর্মান্তিক ঘটনা এই উপন্যাসের অনুপ্রেরণা। তাঁর পিতামহের বাড়ির থেকে কয়েকশো গজ দূরে পুলিস হত্যা করেছিল দুই ভাইকে নকশাল অভিযোগে এবং তাঁদের বাড়ির লোককে বাধ্য করেছিল দেখতে। “That was the scene that when I first heard of it, when it was described to me, was so troubling and so haunted me — and ultimately inspired me to write the book”.
উপন্যাসের দুই ভাই উদয়ন এবং সুভাষ, বয়েসে ১৫ মাসের তফাৎ, কিন্তু চেহারার মিলের জন্যে অনেকেই ভাবেন, তারা যমজ। তবে তফাৎ রয়েছে তাদের স্বভাবে — উদয়নের সহজাত ক্ষমতা নেতৃত্ব দেবার, সে ঝুঁকি নিতে ভালবাসে; সুভাষ শান্ত, নির্বিরোধী ও নির্ভরযোগ্য। দুই ভাই এর ভীষণ ভাব, সব সময় তাদের দেখা যায় একসঙ্গে — তবে স্কুলের পড়া শেষ করে তাঁরা যোগ দেয় বিভিন্ন কলেজে। উদয়ন জড়িয়ে পড়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনে, কিন্তু সুভাষের নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক সত্তা নেই, সে ভাইকে বলে, “It is not my place to object”. কলকাতার লেখাপড়া শেষ করে সে রসায়নে উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রাজ্যে আসে। সেখানে দু বছর কাটানোর পরে সে বাড়ি থেকে আসা টেলিগ্রামে উদয়নের মৃত্যু সংবাদ পায় এবং মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে কলকাতা রওনা হয়।
বাড়িতে এসে সে জানতে পারে পুলিসের হাতে উদয়নের নৃশংস হত্যার বিবরণ এবং জানতে পারে যে উদয়নের স্ত্রী গৌরী অন্ত:সত্ত্বা। নিজের চোখে দ্যাখে গৌরীর প্রতি তার মা-বাবার অবহেলা এবং দুর্ব্যবহার; বুঝতে পারে যে সন্তানের জন্ম দেবার পর তার সেই বাড়িতে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সে অন্য কোনও উপায় না দেখে গৌরীকে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে আসে। লেখিকার জীবনের অনেকটাই কেটেছে রোড আইল্যান্ডে — সেখানকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার বর্ণনায় তিনি সিদ্ধহস্ত — কাহিনি এগিয়ে চলে নিউ ইংল্যান্ডের বিষণ্ণ, জলজ, উপকূলবর্তী প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে।
উপন্যাসের প্রথম তৃতীয়াংশের অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে নকশালবাড়ী এবং ১৯৬০ এর দশকের ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন — আছেন কানু সান্যাল ও চারু মজুমদার, সঙ্গে অবশ্যই চেয়ারম্যান মাও; রয়েছে দেশব্রতী, লিবারেশন এবং মে দিবসে সিপিআই (এম.এল) এর সৃষ্টি। কিন্তু লেখিকা একটি রাজনৈতিক উপন্যাস লেখার পথে যান নি — তাঁর উপজীব্য মানব সম্পর্কের টানাপোড়েন। লেখকের নিজের জবানীতে — “তারা ছেলেমানুষ”; I mean, they are college students. And so one can see how a certain ideology can be very attractive, and appear to be the solution, and appear to be the key to solving an enormous problem in a country and society.” তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলীকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন গৌরীর মাধ্যমে, যার ভূমিকা প্রথমে সাহায্যকারী এবং পরে নীরব দর্শকের; কিন্তু সেই ঘটনাগুলোই বদলে দেয় তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ। “I wanted to understand what is might have been like to witness something like that, and what the consequences will be of witnessing something like that; I mean, she is a 23 year old woman. She is in love with her revolutionary husband. She watches him shot in cold blood. She discovers after the fact that she is carrying a child. How does one move on from that?”
সেই নিয়েই উপন্যাসের বাকী দুই তৃতীয়াংশ — সমুদ্রের ওপারেও পুরানো স্মৃতি তাদের তাড়া করে বেড়ায়। গৌরীর কন্যা বেলার জন্ম হয়, সে জানে না তার পিতৃপরিচয় — সুভাষের স্নেহ মমতা ঘিরে থাকে তাকে; গৌরী দর্শনশাস্ত্রের পড়াশোনা করে যোগ দেয় তার নিজস্ব কর্মজীবনে। কেটে যায় আরও সাড়ে তিন দশক — উপন্যাসের সমাপ্তিকালে বেলার বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি — সে অবিবাহিত ও একটি কন্যার জননী; তার গোড়ালিতে রঙিন উল্কি আর আর বাড়ির পেছনের বাগানে হেঁসেলের আবর্জনা থেকে সার বানানোর “কমপোস্ট বিন”। কিন্তু গল্প দানা বাঁধে না — গৌরী ও সুভাষ এবং গৌরী ও বেলার মধ্যে ভৌগোলিক ও মানসিক দূরত্ব বাড়তে বাড়তে অসীমে পৌঁছায়। দ্বীপের মতন বিচ্ছিন্ন তিনটি মানুষ উৎকন্ঠা ও আবেগহীন মানসিক পীড়ায় দিন কাটায়।
নকশাল আন্দোলনের নৈতিক বা তাত্ত্বিক পটভূমির বর্ণনায় লেখিকা ব্যর্থ — সেখানে সফলতা আশা করাও অন্যায় — পাঠকের মনে হতে পারে পুরানো সংবাদপত্র পড়ে লেখা — রাজনৈতিক বিক্ষোভ, গোপন সভা, পুলিস হত্যা, বোমা বানানোর অসফল প্রচেষ্টা, দেয়ালের স্লোগান — সবই রয়েছে; কিন্তু স্বপ্ন দেখার সাহসে এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আমাদের প্রজন্মের একটা গভীরতম ট্র্যাজেডির মূল সুরটি সেখানে অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে একটি সুপাঠ্য উপন্যাস, কিন্তু ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশাব্দের সেই যুবকমেধ যজ্ঞকে বুঝতে হলে জীর্ণ হয়ে আসা “হাজার -চুরাশীর মা” ই আমাদের ভরসা।
।।৭।।
ঝুম্পা লাহিড়ীর বয়েস ৫১; এখন পর্যন্ত তাঁর ১৭টি গল্প এবং দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ছোটোগল্প আমাদের বিদ্ধ ও প্রাণিত করে, তাঁর উপন্যাসের অভিঘাত সেই তুলনায় কম। লেখিকার প্রথম গল্পগ্রন্থটি এখন আমেরিকার অনেক হাইস্কুলেই আধুনিক সাহিত্যের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর পরবর্তী ছোটোগল্প এবং গল্প সংকলনের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকবো।
একজন লেখককে কি উপন্যাস লিখতেই হবে? হয়ত বাণিজ্যিক কারণে না লিখে উপায় নেই। কিন্তু ছোটোগল্প এবং উপন্যাস সাহিত্যের দুটি বিভিন্ন মাধ্যম — তাদের জন্যে প্রয়োজন আলাদা আলাদা দক্ষতা ও মেজাজের। বাংলায় প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় অথবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁদের ছোটোগল্পের জন্যেই বিখ্যাত। গল্প বনাম উপন্যাস নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে লেখিকা জানিয়েছিলেন, “I don’t make a huge distinction in terms of what they require, because I think an idea is either working or it is not”. এই উক্তির সঙ্গে একমত হওয়া মুশকিল।
কানাডার লেখিকা মেভিস গ্যালান্ট (১৯২২ – ২০১৪) তাঁর জীবনের শেষ চার দশক কোনও উপন্যাস লেখেন নি, কেবলমাত্র ছোটোগল্পের জন্যেই তিনি সম্মানীয় ও বিশ্ববিখ্যাত। কানাডার আরও এক লেখিকা অ্যালিস মনরো (১৯৩১ -) কেবলমাত্র ছোটোগল্প লিখেই নোবেল পুরষ্কার পেলেন ২০১৩ সালে। অতএব উপন্যাস না লিখেও সফল লেখক হওয়া সম্ভব।
বাঙালি অভিবাসীর জীবন অবলম্বনে ঝুম্পা লাহিড়ীর সাহিত্য জীবনের সুচনা; পরবর্তীকালে অন্য মানুষের সুখদু:খও উঠে আসছে তাঁর রচনায়। মানব সম্পর্কের ঘাত প্রতিঘাত বর্ণনায় তাঁর দক্ষতা অপরিসীম। তিনি ঋদ্ধ করেছেন পৃথিবীর সাহিত্যকে।
(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)