১
ঢাকা, গ্রীষ্মকাল, ১৯২৭। হাতে-লেখা ‘প্রগতি’ পত্রিকা ছাপার অক্ষরে রুপান্তরিত হ’লাে। শু’য়ােপােকার খােলশ ঝ’রে গেলাে, বেরিয়ে এলাে ক্ষণ–কালীন প্রজাপতি। কিন্তু শুধুমাত্র ক্ষণিক ব’লেই কোনাে-কিছু উপেক্ষণীয় নয় ; কারাে হয়তো অল্প সময়েই কিছু করবার থাকে, সেটুকু করে দিয়েই সে বিদায় নেয়।
‘প্রগতি’ র নিয়মিত লেখকদের মধ্যে রীতিমতাে বিখ্যাত ছিলেন একমাত্র নজরুল ইসলাম, আর অচিন্ত্যকুমার-যাঁর ‘বেদে’, ‘টুটা-ফুটা’ সবেমাত্র বেরিয়েছে —তাঁকেও বলা যায় সদা-সমাগত। এই দুজন ছাড়া অন্য সকলেই ছিলেন আসন্ন, অত্যাসন্ন, উপক্রমণিক ; বৃহত্তর পাঠকসমাজের সঙ্গে তাঁদের অপরিচয়ের ব্যবধান তখনও ভেঙে যায়নি। আর এঁদের মধ্যে-সম্পাদক দু-জনকে বাদ দিয়ে — যাঁদের রচনা সবচেয়ে প্রচুর পরিমাণে ছাপা হ’তাে, তাঁদের নাম জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে ।
বিষ্ণু দে প্রথম লেখা পাঠিয়েছিলেন ‘শ্যামল মিত্র’ বা ঐ রকম কোনাে ছদ্মনামে, নিপুণ ছন্দের কোনাে কবিতা । তারপর স্বনামে ও বেনামে, গদ্যে ও পদ্যে, তাঁর অনেক লেখাই ‘প্রগতি’ র পাতা উজ্জল করেছিলাে। তাঁর সাহিত্য- জীবনের সেটা প্রথমতম অধ্যায় ; লোকে তাঁর স্বনামকেই বেনাম ব’লে ভুল করেছে ; অনেকেই বিশ্বাস করছে না ‘বিষ্ণু দে’-র মতো সংক্ষিপ্ত ও সুশ্রাব্য নাম কোনাে বাস্তব মানুষের পক্ষে সম্ভব।
কিছুকাল পরে জীবনানন্দ দাশগুপ্ত স্বাক্ষরিত ‘নীলিমা’ নামে একটি কবিতা কল্লোলে আমরা লক্ষ করেছিলাম ; কবিতাটিতে এমন একটি সুর ছিলাে যার জন্য লেখকের নাম ভুলতে পারিনি। ‘প্রগতি’ যখন বেরােলাে, আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই লেখককে আমন্ত্রণ জানালাম, তিনিও তার উত্তর দিলেন উষ্ণ, অকৃপণ প্রাচুর্যে। কী আনন্দ আমাদের, তার কবিতা যখন একটির পর একটি পৌছতে লাগলাে, যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম – এক সান্ধ্য, ধূসর, আলােছায়ার অদ্ভুত সম্পাতে রহস্যময়, স্পর্শগন্ধময়, অতি–সূক্ষ্ম–ইন্দ্রিয়চেতন জগৎ — যেখানে পতঙ্গের নিশ্বাসপতনের শব্দটুকুও শােনা যায়, মাছের পাখনার ক্ষীণতম স্পন্দনে কল্পনার গভীর জল আন্দোলিত হয়ে ওঠে। এই চরিত্রবান নতুন কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে ধন্য হলাম আমরা।
প্রগতি’র প্রথম বছরের বাঁধানাে সেটটি আমার অনির্ভরযােগ্য ভাণ্ডার থেকে অনেক আগেই অন্তহিত হয়েছে, অন্য কোথাও তা সংগ্রহ করতেও পারলাম না। পত্রিকার সুত্রপাত থেকেই জীবনানন্দর লেখা সেখানে বেরিয়েছে এই রকম একটা ধারণা আছে আমার ; কিন্তু প্রথম বছরে কোন কোন লেখা বেরিয়েছিলো সেটা স্পষ্টভাবে মনে আনতে পারছি না। খুব সম্ভব তার মধ্যে ছিলাে ‘১৩৩৩’, ‘পিপাসার গান’ আর ‘অনেক আকাশ’। সৌভাগ্যত, দ্বিতীয় আর অসমাপ্ত তৃতীয় বছরের সংখ্যাগুলি এখনাে আমার হাতের কাছে আছে, আর তাতে — এখন পাতা উলটিয়ে প্রায় অবাক হ’য়ে দেখছি—প্রথম দেখা দিয়েছিলাে ‘সহজ’, ‘পরস্পর’, ‘জীবন’, ‘স্বপ্নের হাতে’, ‘পুরােহিত’ (পরবর্তী নাম ‘নির্জন স্বাক্ষর), ‘কয়েকটি লাইন’, ‘বােধ’, ‘আজ’, ‘অবসরের গান’ । ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র সতেরােটি কবিতার মধ্যে ‘পাখিরা’, ‘কল্লোলে’, ‘ক্যাম্পে’, ‘পরিচয়ে’, ‘মৃত্যুর আগে’, ‘কবিতা’য়, আর কোনাে-কোনােটি ‘ধূপছায়া’য় বেরিয়েছিলাে, কিন্তু অধিকাংশেরই প্রথম প্রকাশ ‘প্রগতি’তে, তার উপর যখন বই ছাপা হ’লাে তখন ধাত্রীর কাজও আমি করে ছিলাম ; তাই ঐ গ্রন্থটিকে আমার নিজের জীবনের একটি অংশ ব’লে মনে হয় আমার। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করি যে ‘আজ’ নামক স্তবকবিন্যস্ত দীর্ঘ কবিতাটি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে নেই, পরবর্তী অন্য কোনাে গ্রন্থেও গৃহীত হয়নি।
প্রগতি’তে, শুধু প্রকাশ করা নয়, নতুন সাহিত্য প্রচার করার দিকেও লক্ষ ছিলাে আমাদের। তার জন্যে মনের মধ্যে তাগিদ ছিলাে, বাইরে থেকেও উত্তেজনার অভাব ছিলাে না। দেশের মধ্যে উগ্র হ’য়ে উঠেছিলাে সংঘবদ্ধ, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, অপরিমিত, অনবরত বিরুদ্ধতা। যাঁরা যুদ্ধঘােষণা করলেন তাঁরা কেউ সাহিত্যের মহাজনি কারবারি, কেউ বা তাঁদের আশ্রিত, কেউ মহিলা, কেউ বড়াে ঘরের ছেলে, কেউ নামজাদা সম্পাদক অথবা লন্ডনে পাশ-করা প্রােফেসর, আর কেউ বা ফরাশি জার্মান আর এক লাইন রাশিয়ান জানেন। তুলনায় আমরা, যারা নেহাৎই কলেজের ছাত্র কিংবা সবেমাত্র উত্তীর্ণ, যে-কোনােরকম সাংসারিক বিচারে আমরা কত দুর্বল তা না-বললেও চলে; কিন্তু যেহেতু সংসারের নিয়ম আর সাহিত্যের বিধান এক নয়, সেহেতু নিন্দুকের লক্ষ কথাকে কীটের অন্নে পরিণত ক’রে একটিমাত্র কবিতার পংক্তি তারার মতাে জ্বলজ্বল করে, তাই আমরা হেরে যাইনি, ভেঙে যাইনি, স’রে যাইনি, দাঁড়িয়ে ছিলাম শরবর্ষণের সামনে, কিছু- কিছু, প্রত্যুত্তরও দিয়েছিলাম। সেই দু–বছর বা আড়াই বছর, যে-ক’দিন ‘প্রগতি’ চলেছিলাে, আমি বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিলাম, শুধুমাত্র সদর্থকভাবে নিজের কথাটা প্রকাশ না-ক’রে প্রতিপক্ষের জবাব দিতেও চেয়েছিলাম—সেই সব আক্রমণেরও উত্তর, যাতে আক্রোশের ফণা বিষাক্ত হ’য়ে উঠেছে, আর ইতর রসিকতার অন্তরালে দেখা যাচ্ছে পান-খাওয়া লাল-লাল দাঁত, কালচে মােটা ঠোঁট, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় দুঃশাসন ঘুর্ণিত, লােলুপ, ব্যর্থকাম দৃষ্টি। এই রকম আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিলেন জীবনানন্দ, আর তাতে আমার যেমন উত্তেজনা হ’তো নিজের বিষয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপে তেমন হ’তাে না ; যেহেতু তাঁর কবিতা আমি অত্যন্ত ভালােবেসেছিলুম, আর যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন সব অর্থে সুদূর, কবিতা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নিঃশব্দ, তাই আমার মনে হ’তাে তাঁর বিষয়ে বিরুদ্ধতার প্রতিরােধ করা বিশেষভাবে আমার কর্তব্য। ‘প্রগতি’র সম্পাদকীয় আলােচনার মধ্যে জীবনানন্দর প্রসঙ্গ, সমসাময়িক অন্য লেখকদের তুলনায়, কিছু বেশি পৌনঃপুনিক বলে মনে হয় ; তার অনেকটা অংশই যে প্রতিবাদ সে–কথা ভাবতে আজ আমার খারাপ লাগে। অবশ্য আমি অচিরেই বুঝেছিলাম যে প্রতিবাদ মানেই শক্তির অপব্যয়, আর পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে সেই অপব্যয় সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেছি, কিন্তু এখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হ’লো, তা না-হ’লে সেই সময়কার সম্পূর্ণ ছবিটি পাওয়া যাবে না। আজ নতুন ক’রে স্মরণ করা প্রয়োজন যে জীবনানন্দ, তাঁর কবিজীবনের আরম্ভ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত, অসুয়াপন্ন নিন্দার দ্বারা এমনভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন যে তারই জন্য কোনাে-এক সময়ে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রেও বিঘ্ন ঘটেছিলাে। এ–কথাটা এখন আর অপ্রকাশ্য নেই যে ‘পরিচয়ে’ প্রকাশের পর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির সম্বন্ধে ‘অশ্লীলতা’র নির্বোধ এবং দুর্বোধ্য অভিযোগ এমনভাবে রাষ্ট্র হয়েছিলাে যে কলকাতার কোনাে-এক কলেজের শুচিবায়গ্রস্ত অধ্যক্ষ তাঁকে অধ্যাপনা থেকে অপসারিত ক’রে দেন। অবশ্য প্রতিভার গতি কোনাে বৈরিতার দ্বারাই রুদ্ধ হ’তে পারে না, এবং পৃথিবীর কোনাে জন কীটস অথবা জীবনানন্দ কখনাে নিন্দার ঘায়ে মূর্ছা যান না — শুধু নিন্দুকেরাই চিহ্নিত হ’য়ে থাকে মূঢ়তার, ক্ষুদ্রতার উদাহরণস্বরুপ। মার্কিন লেখক হেনরি মিলার একখানা বই লিখেছেন, যার নাম Remember to Remember । এই নামটি একটি উল্লেথযােগ্য, কেননা আমাদের ব্যক্তিগত আর সামাজিক দায়িত্বের বড়ো একটা অংশ হ’লাে মনে রাখা। জীবনে যেখানে-যেখানে সুন্দরের স্পর্শ পেয়েছি সেটা যেমন স্মরণযোগ্য, তেমনি যেখানে কুৎসিতের পরাকাষ্ঠা দেখলাম সেটাকে যেন দুর্বলের মতাে মার্জনীয় ব’লে মনে না করি। যেন মনে রাখি, মনে রাখতে ভুলে না যাই।
২
‘প্রগতি’র পাতায় জীবনানন্দর কবিতা বিষয়ে যে-সব আলােচনা বেরিয়েছিলাে তার কিছু-কিছু অংশ এখানে তুলে দেবার লােভ হচ্ছে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে এই উদ্বৃতিগুলির লেখক আর বর্তমান প্রবন্ধকার ঐতিহাসিক অর্থে একই ব্যক্তি ; কিন্তু এর রচনাভঙ্গি, আর লেখার মধ্যে ইংরেজি শব্দের অবিরল ব্যবহার দেখে আজ আমার কর্ণমূল আরক্ত হচ্ছে। তবু, সব দোষ সত্ত্বেও, অংশগুলি অন্য কারণে ব্যবহার্য হ’তে পারে : প্রথমত, এতে বোঝা যাবে একজন প্রথম ভক্ত পাঠকের মনে জীবনানন্দর কবিতা কী-রকম ভাবে সাড়া তুলেছিলাে ; দ্বিতীয়ত, এই তিরিশ বছরে বাংলা কবিতা কত দূরে অগ্রসর হয়েছে তা বােঝার পক্ষেও এগুলাে কিঞ্চিৎ কাজে লাগতে পারে।
জীবনানন্দবাবু, বাঙলা কাব্যসাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে’ আমার মনে হয়। তিন এ-পর্যন্ত মোটেই popularity অর্জন করতে পারেননি, বরঞ্চ তাঁর রচনার প্রতি অনেকেই বােধ হয় বিমুখ ; — অচিন্ত্যবাবুর মত তাঁর এরি মধ্যে অসংখ্য imitator জোটেনি। তার কারণ বােধ হয় এই যে জীবনানন্দবাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলদ্ধি একট, সময়সাপেক্ষ,…তাঁর কবিতা, একটু, ধীর-সুস্থে পড়তে হয়, আস্তে-আস্তে বুঝতে হয়।
জীবনানন্দবাবুর কবিতায় যে–সুরটি আগাগােড়া বেড়েছে, তা’কে ইংরেজ সমালোচকের ভাষায় ‘renascence of wonder’ বলা যায়। … তাঁর ছন্দ ও শব্দযােজনা, উপমা ইত্যাদিকে চট করে’ ভালাে কি মন্দ বলা যায় না– তবে “অদ্ভুত” স্বচ্ছন্দে বলা যায়। … তাঁর প্রধান বিশেষত্ব আমরা এই লক্ষ করি যে সংস্কৃত শব্দ যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলে’ শুধু দেশজ শব্দ ব্যবহার করেই তিনি কবিতা রচনা করতে চাচ্ছেন। ফলে তাঁর diction সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিজস্ব বস্তু হয়ে পড়েছে— তা’র অনুকরণ করাও সহজ বলে মনে হয় না। ..[তিনি] এমন সব কথা বসাচ্ছেন যা পূর্বে কেউ কবিতায় দেখতে আশা করেনি – যথা, “ফেড়ে”, “নটকান”, “শেমিজ”, “থুতনি” ইত্যাদি। এর ফলে তাঁর কবিতায় যে অপূর্ব স্বাতন্ত্র্য এসেছে সে-কথা আগেই বলেছি; তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য তিনি একটি আলাদা ভাষা তৈরী করে নিতে পেরেছেন, এর জন্য তিনি গৌরবের অধিকারী। …
একথা ঠিক যে তিনি [জীবনানন্দ] পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আগাগােড়া রোমান্টিক। এক হিসেবে তাঁকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের anti–thesis বলা যেতে পারে। প্রেমেন্দ্রবাবু বাস্তব জগতের সকল রুঢ়তা ও কুশ্রীতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ, বাস্তব জীবনের নিষ্ঠুরতা তাঁকে নিরন্তর পীড়া দিচ্ছে। …জীবনানন্দবাবু এই সংসারের অস্তিত্ব আগাগোড়া অস্বীকার করেছেন, তিনি আমাদের হাত ধরে’ এক অপূর্ব রহস্যলােকে নিয়ে যান ; –সে মায়াপুরী হয়তাে আমরা কোনােদিন স্বপ্নে দেখে থাকবাে। … [সেইজন্যেই] আমি বলেছিলাম যে তাঁর কবিতায় “renascence of wonder” ঘটেছে। …
[তাঁর] ছন্দ অসমছন্দ হলেও “বলাকা”র ছন্দের সঙ্গে এর পার্থক্য কানেই ধরা পড়ে; —“বলাকা”র চঞ্চলতা, উদ্দাম জলস্রোতের মত তােড় এর নেই; —এ যেন উপলাহত মন্থর স্রোতস্বিনী — থেমে-থেমে, অজস্র ড্যাশ ও কমার বাঁধে ঠেকে-ঠেকে উদাস, অলস গতিতে ব’য়ে চলেছে। এতে প্রচুর উৎসাহের তাড়া নেই, আছে একটি মধুর অবসাদের ক্লান্তি। এই সুর যেন বহুদূর থেকে আমাদের কানে ভেসে আসছে। …
জীবনানন্দবাবুর … বহু কবিতায়–পরমবিস্ময়কর কথা-চিত্র পাওয়া যায়, সে ছবিগুলাে সব মৃদু রঙে আঁকা, তাঁর কবিতার tone আগাগােড়া subdued। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই ক’টি লাইন নেয়া যাক —
আমার এ গান
কোনােদিন শুনিবে না তুমি এসে, —
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,—
তবুও হৃদয়ে গান আসে !
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি, —
তবু ভালােবাসা
জেগে থাকে প্রাণে !
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান !
কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা.-জানি আমি–
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে
তবুও হৃদয়ে গান আসে !
এখানে যেন কথা শেষ হ’য়েও শেষ হয়নি; — কথা ফুরিয়ে গেলেও তাঁর বিষন্ন সুরটি পাঠকের মনকে যেন haunt করতে থাকে। একটি বা কয়েকটি লাইন পুনরাবৃত্তি করার … ফলে গােটা কবিতাটি যেন চট করে’ থেমে যায় না, ভ্রমরের পাখার মত গুঞ্জন করে’ ভেসে যায়।
(‘প্রগতি’ আশ্বিন, ১৩৩৫, সম্পাদকীয় মন্তব্য)
অনিল। … আজকালকার একটি কবির লেখা পড়ে’ আমার আশা হচ্ছে,
আর বেশি দেরি নেই, হাওয়া বদলে আসছে।
সুরেশ। কে তিনি?
অনিল। জীবনানন্দ দাশ।
সুরেশ। জীবানন্দ দাশ? কখনাে নাম শুনিনি তাে।
অনিল। জীবানন্দ নয়, জীবনানন্দ। নামটা অনেককেই ভুল উচ্চারণ করতে শুনি। তাঁর নাম না শােনবারই কথা! কিন্তু তিনি যে একজন খাঁটি কবি তার প্রমাণস্বরুপ আমি তােমাকে তাঁর একটি লাইন বলছি— ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে-আকাশে’। … আকাশের অন্তহীন নীলিমার দিগন্ত–বিস্তৃত প্রসারের ছবিকে একটি মাত্র লাইনে আঁকা হয়েছে-একেই বলে magic line । আকাশ কথাটার পুনরাবৃত্তি করবার জন্যই ছবিটি একেবারে স্পষ্ট, সজীব হ’য়ে উঠেছে ; শব্দের মূল্যবােধের এমন পরিচয় খুব কম বাঙালী কবিই দিয়েছেন।
সুরেশ। (অনিচ্ছাসত্ত্বে) লাইনটি ভালো বটে।
অনিল। এই কবি…উভচর ভাষা অবলম্বন করে’ আমাদের ধনবাদভাজন হয়েছেন। আজকালকার কবিদের মধ্যে তাঁর ভাষা সব চেয়ে স্বাভাবিক। সরল, নিরলঙ্কার, ঘরােয়া ভাষার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ শুনবে ? তুমি যদি অনুমতি করাে, প্রগতি থেকে জীবনানন্দর একটি কবিতার খানিকটা
পড়ে’ শােনাই।
সুরেশ। শুনি?
অনিল। (পড়িল)।
তুমি এই রাতের বাতাস,
বাতাসের সিন্ধু-ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর।
অন্ধকার — নিঃসাড়তার
মাঝখানে
তুমি আনাে প্রাণে
সমুদ্রের ভাষা,
রুধিরে পিপাসা
যেতেছ জাগায়,
ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে
ঝরিতেছ জলের মতন,
রাতের বাতাস তুমি–বাতাসের সিন্ধু—ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর।
এই passageটির একমাত্র weak point হচ্ছে রুধির কথাটা। তা ছাড়া, একেবারে নিখুঁত। এতে melody না থাকে, music আছে — একটা ক্লান্ত উদাস সুরের meandering । থেমে-থেমে পড়তে হয়— তবে সুরটি কানে ধরা পড়বে। যেমন— ‘রাতের, বাতাস তুমি। বাতাসের, সিন্ধু, ঢেউ ॥ তােমার, মতন কেউ। নাই আর।।’
সুরেশ। তা তাে বুঝলাম, কিন্তু ‘ছেঁড়া দেহ’।
অনিল। ঠিকই—দেহ কথাটা এখানে সঙ্গত হয়নি।••• শরীর কথাটাকে তাে তিনিই | জীবনানন্দ ] জাতে তুলে’ দিয়েছেন। তবে দেহ কথাটাও তাে কেবলমাত্র অভিধানগত নয়।
সুরেশ। দেহ সম্বন্ধে আপত্তি করবার কিছুই ছিলাে না, কিন্তু ছেঁড়া
অনিল। ছিন্ন না বললে মানে বােঝাে না নাকি?
সুরেশ। ছেঁড়া শুনলেই হাসি পায়।
অনিল। অনভ্যাস। সয়ে’ গেলেই এর সৌন্দর্য্য ধরা পড়বে। দ্যাখাে, এতদিনে আমাদের এ-কথাটা উপলব্ধি করা উচিত যে সংস্কৃত আর বাঙলা এক ভাষা নয়, সংস্কৃতের সঙ্গে বাঙলার নাড়ির বাঁধন বহুকাল ছিঁড়ে গেছে। বাঙলা এখন একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, সাবালক ভাষা-তা’র ব্যাকরণ তার বিধি-বিধান, তা’র spirit সংস্কৃত থেকে আলাদা। ••• অথচ, আশ্চর্যের বিষয় বাঙলা কবিতা এখন পর্যন্ত সংস্কৃত কথাগুলাের প্রতিই পক্ষপাত দেখাচ্ছে, সংস্কৃত convention গুলো এখনাে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের কবিতায় এখনাে সুন্দরীরা বাতায়ন-পাশে দাঁড়িয়ে কেশ আলুলিত ক’রে দেয়, মুকুরে মুখ দেখে, চরণ অলক্তক রঞ্জিত করে, শুভ্র ও শীতল শয্যায় শােয়। আমাদের নায়িকাদের এখনো হস্তে লীলাকমলমলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং ইত্যাদি, যদিও ওসব ফ্যাশান দেশ থেকে বহুকাল উঠে গেছে। সংস্কৃতের দুয়ারে এই কাঙালপনা করে’ আর কতকাল আমরা মাতৃভাষাকে ছােট করে’ রাখবাে? আমাদের ভুল জীবনানন্দ দাশ বুঝতে পেরেছেন বলে’ মনে হয় ; ভাষাকে যথাসম্ভব খাঁটি বাঙলা করে’ তোলবার চেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তিনি সাহস করে লিখেছেন :
সেই জল মেয়েদের স্তন
ঠাণ্ডা-শাদা-বরফের কুচির মতন।
শুনে তােমার–শুধু তােমার কেন? অনেকেরই – হাসি পাবে, বলবে — ‘ঠাণ্ডা-শাদা-এ আবার কী?’ কিন্তু ঐ শব্দ দুটো গদ্যে লিখতে পারি, মুখে বলতে পারি–আর কবিতাতেই লিখতে পারবাে না? কেন কবিতায় জানালাকে জানালা বলবাে না, বিছানাকে বিছানা ? …যত কথা আমাদের মুখের ভাষায় স্থান পেয়েছে…কাব্যসমাজ থেকে তাদের একঘরে করে’ রেখে কেন আমরা আমাদের কবিতাকে এক বিপুল শব্দ-সম্ভার থেকে বঞ্চিত করবাে ? মৌখিক ভাষার ইডিয়মগুলাে ব্যবহার করে’ কবিতাকে স্বাভাবিক ও সহজ করে’ তুলবাে না কেন?…আমি তাে বলি, ক্ষণিকার ভাষা, জীবনানন্দের কবিতার ভাষা purest বাঙলা, কারণ তা বাঙলা ছাড়া আর কিছু নয়।
( ‘প্রগতি’–ভাদ্র, ১৩৩৬, ‘বাঙলা কাব্যের ভবিষ্যৎ’ )
ইচ্ছে ক’রেই উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ করলাম, সেই সময়কার সাহিত্যিক আবহাওয়ার কিছু আভাস দেবার জন্য। আজকের দিনের পাঠক নিশ্চয়ই এ-কথা ভেবে অবাক হচ্ছেন যে কবিতায় ঠাণ্ডা’ বা ‘শাদা’ কথাটার ব্যবহারের সমর্থনের জন্য এতগুলাে বাক্যব্যয়ের প্রয়ােজন হ’তে পারে, কিন্তু এ-কথা সত্য যে গম্ভীর ভাবের কবিতায় দেশজ ও বিদেশী শব্দের এমন স্বচ্ছন্দ, সংগত ও প্রচুর ব্যবহার জীবনানন্দর আগে অন্য কোনাে বাঙালি কবি করেননি। মনে পড়ছে ‘পাখিরা’ কবিতা প্রথম পাঠেই আমাদের পক্ষে রোমাঞ্চকর হয়েছিলাে ‘স্কাইলাইটে’র জন্য, ‘প্রথম ডিমে’র জন্য, ‘রবারের বলের মতন’ ছােটো বুকের জন্য, আর সেখানে ‘লক্ষ লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে’ মৃত্যু ছিলাে ব’লে। ওটা যে ঐকাহিক চমক-লাগানাে ব্যাপার নয়, সপ্রাণ এবং সজীব নতুনত্ব, এতদিনে সেটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ হ’য়ে গেছে। এমনকি, মৌখিক ভাষায় প্রচলিত তৎসম শব্দেরও ব্যবহারজাত মালিন্য ঘুচিয়ে তাতে কাব্যের স্পন্দন তিনি এনেছিলেন; ‘তােমার— শরীর তা-ই নিয়ে এসেছিলে একদিন’, এই পঙক্তিটি প’ড়ে আমি ‘শরীর’ কথাটাকে নতুন ক’রে আবিষ্কার করেছিলাম। তার আগে নায়িকাদের কোনাে ‘শরীরে’র অস্তিত্ব আমরা শুনিনি, শুনেছি ‘দেহ’, ‘দেহলতা’, ‘তনুলতা’, ‘দেহবল্লরী’। এই উদাহরণ আমাদেরও রচনার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিলাে।
৩
কবে কোথায় জীবনানন্দকে প্রথম দেখেছিলাম মনে পড়ছে না। পাঁচ মিনিট দূরে থেকেও ‘কল্লোল’-আপিশে তিনি আসতেন না, কিংবা কদাচ আসতেন; অন্তত আমি তাকে কখনাে সেখানে দেখিনি। হ্যারিসন রােডে তাঁর বোর্ডিঙের তেতলা কিংবা চারতলায় অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে একবার আরােহণ করেছিলাম মনে পড়ে, আর একবার কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ের মধ্যে আমরা কয়েকজন তাঁকে অনুসরণ করতে-করতে বউবাজারের মোড়ের কাছে এসে ধ’রে ফেলেছিলাম। কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় এলেন একবার, মেঘলা দিনে মাঠের পথে ঘুরলাম তাঁর সঙ্গে; পরে, তাঁর বিবাহের অনুষ্ঠানে, ঢাকার ব্রাহ্মসমাজে উপস্থিত আছি অজিত, আমি, অন্যান্য বন্ধুরা। কলকাতায় চলে আসার পর রমেশ মিত্র রােডের একতলা ঠাণ্ডা ঘরে তার সঙ্গে ব’সে আছি, শীতকাল, বিকেল হ’য়ে এলো। হঠাৎ চেয়ার-টেবিল ন’ড়ে উঠলাে, আমরা বাইরে ছােট্ট বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বসলাম আবার । পরের দিন কাগজে পড়লাম উত্তর বিহারে ভূমিকম্পের খবর।
কিন্তু এই সবই ঝাপসা স্মৃতি, এদের মধ্যে কোনাে ধারাবাহিকতাও নেই। আসলে, জীবনানন্দর স্বভাবে একটি দুরতিক্রম্য দূরত্ব ছিলাে-যে-অতিলৌকিক আবহাওয়া তাঁর কবিতার, তা-ই যেন মানুষটিকে ঘিরে থাকতাে সব সময় – তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি, সমকালীন অন্য কোনাে সাহিত্যিকও না। এই দুরত্ব তিনি শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রেখেছিলেন ; তিন বা চার বছর আগে সন্ধেবেলা লেকের দিকে তাঁকে বেড়াতে দেখতাম— আমি হয়তাে পিছনে চলেছি, এগিয়ে গিয়ে কথা বললে তিনি খুশিও হতেন, অপ্রস্তুতও হতেন, আলাপ জমতাে না ; তাই আবার দেখতে পেলে আমি ইচ্ছে করে পেছিয়েও পড়েছি কখনাে-কখনাে, তাঁর নির্জনতা ব্যাহত করিনি। কখনাে এলে বেশিক্ষণ বসতেন না, আর চিঠিপত্রেও তাঁর সেই রকম স্বভাব-সংকোচ। যুদ্ধের তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে একবার আমরা পাক্ষিক সাহিত্যসভার ব্যবস্থা করেছিলুম ; তাতে, এ.আর.পি.র কর্মভার সত্ত্বেও, সুধীন্দ্রনাথ মাঝে-মাঝে আসতেন, কিন্তু জীবনানন্দ এসেছিলেন একবার মাত্র ; এসে, একটি কবিতা পড়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হ’য়ে, অথবা তারই ফলে, আমাদের একটু, অপ্রস্তুত ক’রে দিয়ে আকস্মিকভাবে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর মুখে তাঁর নিজের কবিতাপাঠ আমি কখনাে শুনিনি, যদিও শুনেছি ইদানীং তরুণদের কাছে তাঁর সংকোচ কেটে গিয়েছিলাে। অথচ, সেই ‘প্রগতি’র সময় থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সাহিত্যিক বন্ধুতা ও সাযুজ্য ছিলাে বিরামহীন ; দেখাশোনায় যেটুকু হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি গভীর ক’রে তাঁকে পেয়েছি তাঁর রচনার মধ্যে—যার অনেকখানি অংশের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রকাশের পূর্বেই ঘ’টে গেছে। এই সম্বন্ধ পঁচিশ বছরের মধ্যে শিথিল হয়নি ; ‘কবিতা’ প্রকাশের অন্যতম পুরস্কার ছিলাে আমার পক্ষে একসঙ্গে তিনটি-চারটি ক’রে পাঠানাে তার নতুন কবিতা পড়া; আনন্দ পেয়েছি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র প্রুফ দেখে, ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালায় ‘বনলতা সেন’ প্রকাশে তাঁর সম্মতি পেয়ে, তাঁর বিষয়ে লিখে, কথা ব’লে, তাকে আবৃত্তি ক’রে। বাংলা কবিতার যতগুলো পঙক্তি বা স্তবক আমার বিবর্ধমান বিস্মরণশক্তি এখনও হারিয়ে ফেলেনি, কিংবা পরিবর্তমান রুচি বর্জন করেনি, যেগুলােকে আমি বহুবছর ধ’,রে অনেকটা রক্ষাকবচের মতাে মনে–মনে বহন ক’রে আসছি, তার মধ্যে জীবনানন্দর পঙক্তির সংখ্যা অনেক। সেই সব কবিতা বেঁচে আছে আমার মনে, অন্য অনেক পাঠকেরও মনে-ভাবী কালেও বেঁচে থাকবে ; তবু আজ এই কথা ভেবেই দুঃখ করি যে আমাদের পক্ষে স্বল্প-পরিচিত সেই মানুষটিকে আর চোখে দেখবো না।
৪
জীবনানন্দর কবিতা নিয়ে ইতিপূর্বে কিছু-কিছু আলােচনা আমি করেছি ; আজ আবার প’ড়ে আরাে কিছু নতুন কথা আমার মনে হচ্ছে। এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে ইন্দিয়বােধের আনুগত্যে তিনি অতুলনীয়, রপদক্ষতাই তাঁর চরিত্রলক্ষণ — আর এ-সব কথা পাঠকমহলে যথেষ্টরকম জানাজানিও হ’য়ে গেছে এতদিনে। কিন্তু তাঁর কবিতার মধ্যে দুটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়, তারা যেন পরুল্পরকে পরিপূরণ ক’রে চলেছে। একদিকে আমরা রাখতে পারি তাঁর বিশুদ্ধ ইন্দ্রিয়ানুভূতির কবিতা বর্ণনাধর্মী, অনুষঙ্গময়, নস্টালজিয়ায় পরাক্রান্ত; যেমন ‘মৃত্যুর আগে’, ‘অবসরের গান’, ‘হাওয়ার রাত, ‘ঘাস’, বনলতা সেন’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’–পাঠক আরাে অনেক জুড়ে নিতে পারবেন—আমি ‘নির্জন স্বাক্ষর’ বা ‘১৩৩৩’ ধরনের প্রেমের কবিতাকেও এরই অন্তর্গত করতে চাই। অন্য দিকে আছে যে-সব কবিতা মননরুপী শয়তান অথবা দেবতার পরামর্শে লেখা, যেখানে লেখক বর্ণনার দ্বারা অন্য কিছু বলতে চেয়েছেন, যেখানে কবির আবেগ বাইরের জগতে প্রতিরুপ খুঁজে পেয়েছে, চিন্তার সঙ্গে গ্রথিত হ’য়ে আরাে নিবিড়ভাবে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ করব ‘বােধ’, ‘ক্যাম্পে’, আর সেই লাশ-কাটা ঘরের আশ্চর্য কবিতাটি, যার নাম দেয়া হয়েছিলাে ‘আট বছর আগের একদিন’। ‘কয়েকটি লাইন’কে বলা যায় ‘বােধ’-এর সঙ্গী-কবিতা—দুটিই কবির স্বগতােক্তি-প্রথমটিতে কবি নিজের শক্তির বিষয়ে সচেতন হ’য়ে ঘােষণা করছেন তাঁর নূতনত্ব (‘কেউ যাহা জানে নাই-কোনাে এক বাণী, / আমি ব’হে আনি’), ব’লে দিচ্ছেন তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য কোনখানে (‘উৎসবের কথা আমি কহি নাক’, / পড়ি নাক’ দুর্দশার গান / শুনি শুধু সষ্টির আহ্বান’); আর দ্বিতীয়টিতে তিনি জীবনের সঙ্গে কাব্যের দ্বন্দ্বে পীড়িত, তাঁর ‘বােধ’ আর- কিছু নয়, তাঁরই কবিপ্রতিভা, যার তাড়নায় ‘সকল লােকের মাঝে ব’সে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা’। আবার, তার আবেগরঞ্জিত বেদনাময় বর্ণনার কাব্যেও বিভিন্ন বিভাগ করা যায় : প্রথমত, সান্ধ্য বা নৈশ কবিতা, বা যে-কবিতায় সকল সময়কেই সন্ধ্যার মতাে মনে হয়, যেখানে আলো ম্লান, ছায়া ঘন, কুয়াশার পরদা ঝুলে আছে (‘মাঠের গল্প’, ‘হায় চিল’, ‘বনলতা সেন’, ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘শঙ্খমালা’); দ্বিতীয়ত, আলাে যেখানে উজ্জ্বল আর প্রবল অবয়ব নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে (‘অবসরের গান’, ‘ঘাস’, ‘শিকার’ ‘সিন্ধুসারস’), আর তৃতীয়ত, যে-সব কবিতায় একাধারে স্থান পেয়েছে আলাে আর অন্ধকার, রৌদ্র আর রাত্রি, কান্তি আর অবগুণ্ঠন। এই শেষােক্ত শ্রেণীর মধ্যে ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটিকে আমি ফেলতে চাই না, কেননা বাংলার পল্লী–প্রকৃতির এই চিত্রশালাটিতে ‘হিজলের জানালায় আলাে আর বুলবুলি’কে যদিও একবার দেখা যায়, আর ‘ধানের গুচ্ছের মতাে সবুজ সহজ’ ভােরবেলাটিকেও চিনতে পারি, তবু এর পক্ষপাত নৈশতার দিকেই, পড়তে-পড়তে আমাদের মন বারে বারেই ছায়াচ্ছন্ন গাঢ়তায় মন্থর হ’য়ে আসে। আমি ভাবছিলাম ‘হাওয়ার রাত’ বা ‘অন্ধকার’-এর মতাে কবিতার কথা, যেখানে তারা–ভরা অন্ধকারের কথা বলতে বলতে কবির হৃদয় ‘দিগন্তপ্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে’ ভ’রে যায়, যেখানে ‘অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে’ কবি হঠাৎ ‘ভােরের আলাের মূর্খ উচ্ছাসে’ জেগে ওঠেন, দেখতে পান ‘রক্তিম আকাশে সূর্য’ আর সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী’। ভাবছিলাম ‘নগ্ন নির্জন হাত’-এর বিস্ময়কর গঠনের কথা-কবিতাটির আরম্ভ অন্ধকারে, তার পটভূমিকাই ফাল্গুনের অন্ধকার, অথচ শেষের অংশে ‘রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ’ আর ‘রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ’ আমাদের মনে এমন একটি প্রদীপ্ত সমৃদ্ধির অভিঘাত রেখে যায় যে মনেই হয় না পরে কবিতাটিতে আলাে ছাড়া, উজ্বলতা ছাড়া অন্য কোনো প্রসঙ্গ আছে। যেমন ‘হায় চিল’-এ দুপুরবেলাতেই সন্ধ্যা নেমে আসে, তেমনি ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় অন্ধকারটাই আলাের উল্লাসে উতরােল হ’য়ে উঠলাে- মৃত্যুর আগে’র ছবিগুলাের মতাে এ-সব ছবি স্বপ্রতিষ্ঠ নয়, তারা কবির ভাবনা-বেদনারই প্রতিফলন।
আরো পড়ুন: বুদ্ধদেব বসুর প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ
৫
আলােচনার আরো অনেক ক্ষেত্র আছে। দেখানাে যেতে পারে, বিদ্রুপের শক্তি তাঁর হাতে কী-রকম আত্মস্থ আর গভীর হ’য়ে উঠেছিলাে ‘সােনার পিত্তলমূর্তি’ অথবা ‘অজর, অক্ষর অধ্যাপকে’র উদ্দেশে লেখা পঙক্তিগুলিতে, কিংবা কেমন ক’রে
তাঁর মধ্য পর্যায়ের কবিতার মাঝে-মাঝে একটি সংক্ষুব্ধ বিবমিষা লক্ষ করা যায়–আসলে তার আরম্ভ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র সময়েই, সেই সময়েই, ‘অন্ধকার’ কবিতা লিখেছিলেন, যেখানে ‘সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত পৃথিবীতে কোটি-কোটি শূয়ারের আর্তনাদে’র ‘উৎসব’ দেখে তিনি ‘অন্ধকারের অনন্ত মৃত্যু’র ভিতর মিশে যেতে চেয়েছিলেন। তারই কিছুকাল পরে ‘আদিম দেবতারা’ কবিতায় তীব্র হ’য়ে উঠলাে জীবন ও কবিতার দ্বন্দ্ববােধজনিত বেদনা:
অবাক হয়ে ভাবি, আজ রাতে কোথায় তুমি ? রুপ কেন নির্জন দেবদারু–দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না —
পৃথিবীর সেই মানুষীর রুপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত–হয়ে–ব্যবহৃত–ব্যবহৃত–ব্যবহৃত–ব্যবহৃত হ’য়ে
ব্যবহৃত–ব্যবহৃত–
আগুন বাতাস জল, আদিম দেবতারা হাে হাে ক’রে হেসে উঠল:
‘ব্যবহৃত–ব্যবহৃত হয়ে শূয়ারের মাংস হয়ে যায় ?’
‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’-এর অনেক কবিতাতেই এই বিবমিষা বা বিদ্রুপের আঘাত পড়েছে ; তাঁর প্রৌঢ় বয়সের রচনার মধ্যে এটিকে একটি প্রধান সুর বললে ভুল হয় না।
আলােছায়ার দৃশ্যমান জগৎ থেকে তিনি স্বপ্নগােচর অতিবাস্তবের মায়ালােকে প্রবেশ করেছিলেন ‘বিড়াল’, ‘ঘোড়া’, ‘সেই সব শেয়ালেরা’ ধরনের কবিতায়। শেলি, কীটস, পূর্ব–ইয়েটস আর কোথাও-কোথাও সুইনবার্নকে তিনি কেমন ক’রে ব্যবহার করেছিলেন তা তুলনার দ্বারা দেখানাে যেতে পারে ; সহজেই প্রমাণ করা যায় যে ইয়েটস-এর ‘0 Curlew’-র তুলনায় তাঁর ‘হায় চিল’ অনেক বেশি তৃপ্তিকর কবিতা, আর ‘The Scholars’-এর সঙ্গে ‘সমারূঢ়ে’র সম্বন্ধ যেমন স্পষ্ট, তার স্বাতন্ত্র্যও তেমনি নির্ভুল। ‘ওড ট, এ নাইটিঙ্গেল’-এর কোনাে-কোনাে পঙক্তি ‘অবসরের গান’-এ কেমন নতুন শস্য হ’য়ে ফ’লে উঠেছে, তাও সহজেই বােধগম্য। যদি কখনাে কোনাে পাঠক জীবনানন্দর অসংরক্ত, অ-মানবিক জপতে শ্রান্তি বােধ করেন, তাঁকে অনুরােধ করা যায় ‘ক্যাম্পে’ আর ‘আট বছর আগের একদিন’ পুনর্বার পড়তে— জীবনানন্দর সমগ্র কাব্যের মধ্যে এই দুটি কবিতা সবচেয়ে প্রাণতপ্ত ও স্তরবহুল ; এখানে তিনি মানুষের ঘুম আর জাগরণকে একই রকম ‘সচ্ছল’ভাবে মেনে নিয়ে তৃপ্ত হননি (‘জাগিবার কাল আছে-দরকার আছে ঘুমাবার ;/ এই সচ্ছলতা আমাদের’), নিজের কথা নিজে লঙ্ঘন ক’রে উৎসবের কথা বলেছেন, ব্যর্থতার গানও গেয়েছেন। ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় মৃগয়ার গল্প অবলম্বন ক’রে ‘প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ’ তুলেছেন তিনি, মানবিক প্রেমের, যৌন প্রেমের, যা ব্যাপ্ত হ’য়ে আছে ‘কোথাও ফড়িঙে কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে’, যার ক্ষমতার চাপে ক্ষমতাশালী মাংসাশী শিকারিদেরও হৃদয় গুলো ‘বসন্তের জ্যোৎস্নায় মৃত মৃগদের’ মতােই পাংশু হ’য়ে প’ড়ে থাকে। আর, ‘মৃত্যুকে দলিত ক’রে’ ‘জীবনের গম্ভীর জয়’ তিনি প্রচার করেছেন ‘আট বছর আগের একদিন’-এ। এই কবিতাটি এতই দ্যোতনাময় যে এটিকে ভাঁজে-ভাঁজে খুলে দেখালে আলােচনার সহায় হ’তে পারে । এক আরম্ভ— ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে/ নিয়ে গেছে তারে।’ ক্রমশ আমরা জানতে পারলাম যে কোনাে পুরুষ উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করেছে—আর এই খবরটি শুনেই কবি অনুভব করলেন—মৃত্যুকে নয়, তাঁর চারদিকে চাঁদ-ডুবে-যাওয়া অন্ধকারে ‘জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততা’কে :
তবুও তাে পেঁচা জাগে ;
গলিত স্থবির ব্যাং আরাে দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইসারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা
মশা তার অন্ধকারে সঙ্ঘারামে জেগে জীবনের স্রোত ভালােবাসে।
মনে পড়লাে বাঁচার ইচ্ছার, বাঁচার চেষ্টা অন্যান্য উদাহরণ :
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি ; সােনালি রােদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতাে দেখিয়াছি।…
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরন
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
কিন্তু এই প্রাকৃত প্রেরণা মানুষের পক্ষে তো সর্বস্ব নয় :
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু, একা-একা; যে-জীবন ফড়িঙেয়ে, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।
হয়তো গাছের ডাল প্রতিবাদ করেছিলাে, ভিড় ক’রে বাধা দিয়েছিলাে জোনাকিরা, থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা ইঁদুর ধরার প্রস্তাব এনে জীবনের ‘তুমল গাঢ় সমাচার’ জানিয়েছিলাে — কিন্তু চেতনার সংকল্পে প্রকৃতি বাধা দিতে পারলাে না।
এর পর অনিবার্য প্রশ্ন : কেন মরলো লােকটা? কোন দুঃখে ? কিসের ব্যর্থতায় ? না-কোনাে দুঃখই ছিলো না ; স্ত্রী ছিলাে, সম্তান ছিলাে, প্রেম ছিলাে, দারিদ্র্যের গ্লানিও ছিলাে না। কিন্তু —
জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়–প্রেম–শিশু–গৃহ–নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়—সচ্ছলতা নয়—
আরাে-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে ;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত — ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই …
যদি এই অচিকিৎস্য জীবন-ক্লান্তিতেই কবিতার শেষ হ’তাে, তাহ’লে এটি এত দূর পর্যন্ত আলােচ্য হ’তাে না। কিন্তু ঠিক শেষের ক-লাইনেই আবার আমরা অন্য একটি স্বর শুনলাম — যেন একটি ঢেউ স’রে যেতে-যেতে দ্বিগুণ বেগে ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লাে—কবি ফিরিয়ে আনলেন জরাজীর্ণ প্যাঁচাটাকে, যে আত্মহত্যায় বাধা দিতে পারেনি, কিন্তু জীবিতের কানে অবিরাম জ’পে যাচ্ছে তার প্রাণসত্তার আদিম আনন্দ। আর এই প্রগাঢ় পিতামহীর দৃষ্টান্তেই কবি উদ্বুদ্ধ হলেন—‘আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’—মৃত্যু পার হ’রে বেজে উঠলাে জীবনের জয়ধ্বনি, আর—সেইসঙ্গে—নির্বোধ ও পাশব জীবনের প্রতি চৈতন্যের বিদ্রপ।
৬
তাঁর উপমা, বিশেষণ ও ভাষাপ্রয়ােগ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচিত হ’তে পারে। যেহেতু তিনি মুখ্যত ইন্দ্রিয়বােধের কবি, তাই উপমা তাঁর পক্ষে একটি প্রধান অবলম্বন, তাঁর হাতে বিশেষণও অনেক সময় উপমার মতাে কর্মিষ্ঠ। ‘শিকার’ কবিতায় বত্রিশটি পঙক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে চোদ্দটি উপমা, ‘মতাে’ শব্দের তেরো বার ব্যবহার; ‘হাওয়ার রাত’-এ ‘মতাে’-র সংখ্যা আট। এতে যাঁরা আপত্তি করেন তাঁদের ভেবে দেখতে বলবাে, ভিন্ন বস্তুর সঙ্গে তুলনা বা সমীকরণ ছাড়া বর্ণনার কোনাে উপায় আছে কিনা, যে-কোনাে কবিতায় কতখানি ছবি থাকে, আর কবি যদি জ্ঞানের ভাষায় কথা বলতে যান তাহ’লে তিনি কবি থাকেন আর কতটুকু। আর দুটি কথা বিবেচ্য : জীবনানন্দ একটিও উপমা প্রয়ােগ না-ক’রে ‘আকাশলীনা’ (‘সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়াে নাকো তুমি’) বা ‘সমারূঢ়’ (‘বরং নিজেই তুমি লেখাে নাকে একটি কবিতা’) -র মতাে অজর কবিতা লিখেছেন ; আর তাঁর অনেক উপমাই সরল বা আক্ষরিক নয়, তা থেকে নানা স্তরে নানা ইঙ্গিত বিচ্ছুরিত হ’তে থাকে, যেমন গানের পরে অনুরণন। কাস্তের মতাে চাঁদ, রবারের বলের মতাে বুক, বরফের কুচির মতাে স্তন—এই সব উপমার উপর আমি জোর দেবাে না, কেননা এদের নির্ভর শুধু চোখে দেখা বা হাতে-ছোঁয়া সাদৃশ্যের উপর, তাঁর আগে কেউ ব্যবহার করেননি ব’লেই এরা স্মরণীয়। আমি উল্লেখ করবাে আরাে আগেকার লেখা একটি পঙক্তি —
আঁখি যার গোধূলির মতাে গােলাপি, রঙিন—
পড়ামাত্রই আমাদের মনে যে-নতুনত্বের চমক লাগে সেটা অচিরেই কাটিয়ে উঠে আমরা বুঝতে পারি যে এখানে ঠিক লাল রঙের চোখটাকে বােঝানাে হচ্ছে না, সন্ধ্যারাগের মদির আবেশের দিকেই এর লক্ষ্য, আর সঙ্গে-সঙ্গে মনে প’ড়ে যায় গোধুলির সঙ্গে বিবাহ-লগ্নের সংযােগ। ‘মােরগ ফুলের মতাে লাল আগুন’— এটা হ’লাে চাক্ষুষ উপমা, কিন্তু সেই আগুনেই যখন সূর্যের আলােয় ‘রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে’ হ’য়ে যায়, তখন শুধু ফ্যাকাশে চেহারাটাই আমরা চোখে দেখি না, মনের মধ্যেও নির্বাপণের বেদনা অনুভব করি। কী উপমায়, কী বিশেষণে, একটি ইন্দ্রিয়ে আঘাত দিয়ে অন্য ইন্দ্রিয় জাগিয়ে তােলেন তিনি—‘ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতাে পান’ করতে হ’লে বর্ণ, গন্ধ আর আস্বাদকে পরস্পরের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হয় ; ‘বলীয়ান রৌদ্র’ বললে রােদ যেন আয়তন পেয়ে ঋজু হ’য়ে দাঁড়িয়ে ওঠে, আবার সেই রােদকেই ‘কচি লেবুপাতার মতো’ নরম আর সবুজ বললে তাকে দেখা যায় তখনও-শিশির-শুকিয়ে-না যাওয়া মাটির উপর সুগন্ধি হ’য়ে শুয়ে থাকতে। এরই পাশে-পাশে ‘পরদায় গালিচায় রক্তাভ রৌদের স্বেদ’ আর সন্ধ্যাবেলায় ‘জাফরান রঙের সয্যের নরম শরীর’ চিন্তা করলে রােদ বস্তুটাকে আমরা যেন কোনাে স্থাপত্যকর্মের মতাে প্রদক্ষিণ ক’রে-ক’রে দেখে নিতে পারি। তেমনি, রাত্রি কখনাে ‘বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে’, কখনো ‘জ্যোৎস্নার উঠানে খড়ের চালের ছায়া’ টুকুর মধ্যে স্তব্ধ ও সংহত, কখনাে ‘নক্ষত্রের রুপালি আগুনে’ উজ্জ্বল, আর কখনাে দেখি সন্ধ্যার অন্ধকার ‘ছােটো-ছােটো বলের মতো’ পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়লাে। যে-দুটো বস্তু স্বভাবতই খুব কাছাকাছি তাদের মধ্যে উপমাসম্বন্ধ অপ্রচলিত কিন্তু জীবনানন্দ কখনো-কখনাে তাদের একত্র ক’রে দুটোকেই আরো স্পষ্ট ক’রে ফোটাতে পেরেছেন (‘কাঁচা বাতাবির মতাে ঘা’, ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা’ ); আবার, যে-দুটো বস্তু অপরিমেয়রূপে অ-সদৃশ, তাদেরও একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে তাঁর বিরাট কল্পনাশক্তি, যার ফলে আমরা পেয়েছি ‘চীনে বাদামের মতাে বিশুষ্ক বাতাস’, ‘পাখির নীড়ের মতো’ বনলতা সেনের চোখ, আর আত্মঘাতীর জানলার ধারে ‘অদ্ভুত আঁধারে…উটের গ্রীবার মতো কোনাে এক’ প্রবল নিস্তব্ধতা। এ-সব উপমা ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম ক’রে ভাবনার মধ্যে আন্দোলন তােলে, সাদৃশ্যের সূত্ৰগুলি ছড়িয়ে পড়ে অনুভূতির রহস্যলােকে। বউবাজারের নৈশ ফুটপাতে, যেখানে কুষ্ঠরোগী, ‘লােল নিগ্রো’ আর ‘ছিমছাম ফিরিঙ্গি যুবকে’র ছায়াছবির উপর ইহুদি গণিকার আধাে-জাগা গানের গলা ঝ’রে পড়ছে, সেখানকার বাতাস নেহাৎই প্রাকৃত অর্থে শুকনাে নয়, যুদ্ধকালীন বিশৃঙ্খলার চাপে দেশের মধ্যে সমস্ত রস শুকিয়ে গিয়ে চীনেবাদামের খােলার মতাে শূন্য আর ভঙ্গুর হ’য়ে উঠলাে, এই রকম একটা ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যায়। কোনাে মহিলার চোখের আকার নিশ্চয়ই পাখির বাসার মতাে হয় না, কিন্তু ক্লান্ত প্রাণের পক্ষে কখনাে কোনাে চোখ আশ্রয়ের নীড় হ’তে পারে। যে-মানুষ আপন হাতে মরতে চলেছে তার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলাে ‘উটের গ্রীবার মতাে’ নিস্তব্ধতা, এই অপরিচিত ও অপ্রত্যাশিত ছবিতে আসন্ন আত্মঘাতের আবহাওয়াটা আরাে থমথমে ও ঘনিষ্ঠ হ’য়ে উঠলাে। হয়তো এখানে আরাে কিছু, ইঙ্গিত আছে, এই ‘উট’ যেহেতু মৃত্যুর দিকেই প্রলুব্ধ করছে, তাই মনে হয় উপমাটি সেই প্রাচীন কাহিনী থেকে আহৃত, যেখানে উট এসে প্রথমে শুধু ঘাড়টুকু রাখার অনুমতি চাইলাে, তারপর প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে সমস্ত ঘর জুড়ে গৃহস্থকেই বহিষ্কৃত ক’রে দিলে। অনেক বিশেষণও এই রকম মনস্তত্ত্বঘটিত : আত্মহত্যার উদ্যােগের সময় অশ্বত্থের ‘প্রধান আঁধার’, জীবনপ্রেমিক মশক-সংঘে সমাকীর্ণ ‘যূথচারী আঁধার’, শিকারের পরে শিকারিদের ‘নিরপরাধ’ ঘুম, ‘প্রগাঢ় পিতামহী’। প্যাঁচার জীবনস্পহার ‘তুমুল গাঢ় সমাচার’।
‘সমাচার’ কথাটাও লক্ষণীয়। মিশনারিরা ‘গসপেল’-এর আক্ষরিক অনুবাদ করেন সুসমাচার’—এ-কথা মনে রাখলেই ধরা পড়ে যে শব্দটিতে এখানে খবরের চাইতে অনেক বেশি কিছু বােঝাচ্ছে। শুধু বিশেষণে নয় বিশেষ্যপদেও, আর সাধারণভাবে ভাষাব্যবহারে তাঁর দুঃসাহসী আক্রমণ বারেবারেই রত্ন ছিনিয়ে এনেছে। বিদেশী শব্দ, গেঁয়ো শব্দ, কথ্য বুলি, অপ্রচলিত শব্দ, আর যে-সব শব্দকে আশাহীনরপে গদ্য ব’লে আমরা জেনেছি—এই সব ভান্ডারের উপর সহজ অধিকার তাঁর কাব্যের একটি প্রধান লক্ষণ। ছন্দব্যবহারে বৈচিত্র্য নেই, আপাতরমণীয়তাও নেই, কিন্তু সেজন্যে কোনাে অভাববােধও নেই আমাদের; যা আছে, তার সম্মােহন এত ব্যাপক যে তিনি আজকের দিনেও অনায়াসে এবং অনাক্রমণীয়ভারে ‘ছিল-দেখিল’ মিল দিতে পেরেছেন, যা অন্য কোনাে কবির পক্ষেই সম্ভব হ’তো না। তাঁর কাব্যের পাঠক শুধু, বিশেষণের প্রভাবে আবিষ্ট হবেন বার-বার, শিহরিত হবেন পুনরুক্তির আঘাতে (‘এইখানে সরােজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে শুয়ে আছে কিনা’ ; ঘাসের উপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস / অথবা সবুজ বুঝি ঘাস’), মুগ্ধ হবেন যখন হঠাৎ এক-একটি অত্যন্ত চেনা আর গদ্যধর্মী কথার প্রভাবে পুরো পঙক্তিটি আলােকিত হ’য়ে ওঠে।
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
বিয়ােবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে;
ভব্য সমাজে অনুচ্চার্য একটি ক্রিয়াপদের জন্যই হেমন্ত ঋতুর এই ছবিটি এমন উজ্জ্বল হ’তে পারলাে। তেমনি, বিকেলের আলাের স্বচ্ছ গভীরতায়, শুধু বাইরের প্রকৃতি নয়- আমাদের হৃদয় সুদ্ধ ডুবে গেলাে শুধু, একটা ‘মাইল’ শব্দ আছে ব’লে —
অকূল সুপুরিবন স্থির জলে আলাে ফেলে এক মাইল শান্ত কল্যাণ হয়ে আছে।
দৃশ্যটিকে ‘এক মাইলে’র মধ্যে সীমিত করা হয়েছে ব’লেই এখানে অসীমের আভাস লাগলাে।
উদাহরণ আর বাড়াতে চাই না, কিন্তু এটুকু না-বললে আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ হয় না যে তাঁর কাব্যে গদ্য ভাষা এমনভাবে নিবিষ্ট হয়েছিলাে যে রীতিমতো বিপজ্জনক শব্দও তাঁর আদেশে বিশ্বস্ত ভৃত্যের মতো কাজ ক’রে গেছে —
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমোবে সে শিশিরের জলে
প্রেম ছিলাে, আশা ছিলো,… তবু সে দেখিল
কোন ভুত?
বলা বাহুল্য, ‘ভূত’ বা ‘ঠ্যাং’-এর মতো শব্দের ব্যবহার অন্য যে-কোনাে কবির পক্ষে হাস্যকর হ’তাে।
৭
তার অনন্যতা বিষয়ে অনেক পাঠকই আজকের দিনে সচেতন, আর তিনি যে আমাদের ‘নির্জনতম’ কবি, অত্যধিক পুনরুক্তিবশত এই কথাটার ধার ক্ষ’য়ে গেলেও এর যথার্থ্যে আমি কখনও সন্দেহ করি না। ‘আমার মতন কেউ নাই আর’-তাঁর এই স্বগতােক্তি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য। যৌবনে, যখন মানুষের মন স্বভাবতই সম্প্রসারণ খোঁজে, আর কবির মন বিশ্বজীবনে যােগ দিতে চায়, সকলের সঙ্গে মিলতে চায় আর সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চায় নিজেকে, সেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের ঋতুতেও তিনি বুঝেছেন যে তিনি স্বতন্ত্র, ‘সকল লােকের মধ্যে আলাদা’, বুঝেছেন যে তাঁর গান জীবনের ‘উৎসবের’ বা ‘ব্যর্থতার’ নয় অর্থাৎ বিদ্রোহের, আলোড়নের নয় – তাঁর গান সমর্পণের, আত্মসমর্পণের, স্থিরতার । ‘পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত’ রােমান্টিক হ’য়েও, তাই তিনি ভাবের দিক থেকে রােমান্টিকের উল্টো ; আধুনিক বাংলা কাব্যের বিচিত্র বিদ্রোহের মধ্যে তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। বস্তুত, তাঁকে যেন বাংলা কাব্যের মধ্যে আকস্মিকরূপে উদ্ভূত ব’লে মনে হয় ; সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের ক্ষণিক প্রভাবের কথা বাদ দিলে — তিনি যে মহাভারত থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রবাহিত তাঁর পূর্বজ স্বদেশীয় সাহিত্যের কোনাে অংশের দ্বারা কখনাে সংক্রমিত হয়েছিলেন, বা কোনাে পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁর একাত্মবােধ জন্মেছিলাে, এমন কোনাে প্রত্যক্ষ পরিচয় তাঁর কাব্যে নেই বললেই চলে । এ থেকে এমন কথাও মনে হ’তে পারে যে তিনি বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যস্রোতের মধ্যে একটি মায়াবী দ্বীপের মতাে বিচ্ছিন্ন ও উজ্জল; এবং বলা যেতে পারে যে তাঁর কাব্যরীতি-‘হুতোম’ অথবা অবনীন্দ্রনাথের গদ্যের মতাে — একেবারেই তাঁর নিজস্ব ও ব্যক্তিগত, তাঁরই মধ্যে আবদ্ধ, অন্য লেখকের পক্ষে সেই রীতির অনুকরণ, অনুশীলন বা পরিবর্ধন সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, এ-বিষয়েও সন্দেহ নেই যে চলতিকালের কাব্যরচনার ধারাকে তিনি গম্ভীরভাবে স্পর্শ করেছেন, সমকালীন ও পরবর্তী কবিদের উপর তার প্রভাব কোথাও কোথাও এমন সূক্ষ্মভাবে সফল হ’য়ে উঠেছে যে বাইরে থেকে হঠাৎ দেখে চেনা যায় না। বাংলা কাব্যের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আসনটি ঠিক কোথায় সে-বিষয়ে এখনই মনস্থির করা সম্ভব নয়, তার কোনাে প্রয়ােজনও নেই এই মুহূর্তে ; এই কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের ঈর্ষাভাজন সেই সব নাবালকদের হাতে, যারা আজ প্রথম বার জীবনানন্দর স্বাদুতাময় আলাে-অন্ধকারে অবগাহন করছে। আপাতত, আমাদের পক্ষে, এই কথাই কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মর্তব্য যে ’‘যুগের সঞ্চিত পণ্যে’র ‘অগ্নিপরিধি’র মধ্যে দাঁড়িয়ে যিনি ‘দেবদারু গাছে’ ‘কিন্নরকণ্ঠে’ শুনেছিলেন, তিনি এই উদভ্রান্ত, বিশৃঙ্খল যুগে ধ্যানী কবির উদাহরণস্বরূপ।
[কালের পুতুল, ১৯৫৫]