| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সাহিত্য

জীবনানন্দ দাশের প্রেমের চালিকাশক্তি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

‘পরস্পরকে ভালোবেসে একটি শরীর’ হওয়া অনেক আগের কথা।

অনেক চিন্তা ও রীতির ক্ষয় হয়ে গেছে তারপর।

এখন ‘মানুষকে সব বুঝে নিতে হয়’।

জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন ধরে এই ভালোবাসা তথা প্রেমকে নিজের মতো করে বুঝে নিতে চেয়েছেন।

কেমন সেই অনুভব?উপলব্ধি?পথরেখা?

কোনও আড়াল নয়, কল্পনা নয়,দিশাহীন কোনও মাস্তুল নয়। জীবনানন্দ দাশের মেয়েমানুষ, মানুষী, রমণী, মহিলা ও নারী তাদের স্বনামে আসে।তীব্র সেই উপস্থিতি।তাঁর কবিতা গল্প উপন্যাস ও ডায়েরিতে তারা ছড়িয়ে পড়ে।আর এই প্রেক্ষাপটে কবির নিজের অবস্থানটি যে ‘ধুলোকণা’ ও ‘কালের জলকল্লোলে জলকণা’ তা-ও তিনি জানেন।

সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুদর্শনা, সবিতা, সুচেতনা, বিনতা, কল্যাণী, বিভা থেকে শুরু করে নীহারিকা মিত্র, অরুণিমা সান্যাল এবং বনলতা সেন।যেন আকাশ ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে।আকাশে আকাশে পরাগরেণু ওড়ে।সম্ভবনা ওড়ে।

একজন ‘রুরাল গার্ল’ ও ‘কান্ট্রিসাইড ওম্যান’-এর কথা লেখেন জীবনানন্দ তাঁর ডায়েরিতে।মেয়েমানুষ সে।মনিয়া নাম তার।মনিয়ার ঘরে তাঁর রাত কেটেছিল।মনিয়ার ঘরে ‘শিশিরের জল’ নেমে এসেছিল।কখন শিশিরের জল বাইরে থেকে ঘরে নামে?

জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রেম মনিয়া।তাঁর সারাজীবনের সমস্ত লেখা এই মনিয়ার উজ্জ্বল উদ্ধার। এই মনিয়া বাংলাকে ‘philosophising’ করে।এই মনিয়া ‘রূপসী বাংলার’ প্রতিটি ছত্রে ছত্রে।তবে শুরুতেই অবদমন।মনিয়া বাড়ির পরিচারিকার মেয়ে।জীবনানন্দ যে নীলনয়না মনিয়ার সঙ্গে মিলিত হবেন তাতে নিশ্চয় সমাজের স্বীকৃতি ছিল না।

অকালে মনিয়া গঙ্গাসাগরে ডুবে মারা গেল৷ (আত্মহত্যা? তাকে মারা হল?) আর জীবনানন্দ তাঁর কল্পনার শিয়রে মনিয়াকে চিরকালের জন্য ঠাঁই দিলেন।মনিয়াকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ছক কষলেন।

কবিতায় তখন ‘খড় ছড়াতেছে’! খুব স্পষ্ট নয় কী এই উচ্চারণ, ‘তোমার শরীর তাই নিয়ে এসেছিলে একবার’ তারপর তো ‘তোমাকে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে’! আর এখন কবি নক্ষত্রের তলে বসে আছেন। ‘সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া’।

রূপসী বাংলা তো মনিয়া-ই।থোড়ের মতো সাদা ভিজে হাত, কপালে কাঁচপোকা টিপ, শরীরে কল্কাপাড় শাড়ি।হলুদ করবী ফুল ছিঁড়ে নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ায়।মনিয়ার সঙ্গে কঙ্কাবতী, চন্দ্রমালা, মানিকমালা ও শঙ্খমালা ‘juxtaposition’ করে।একটি উপন্যাসে জীবনানন্দ মনিয়াকে আমেরিকান অভিনেত্রী রুথ চ্যটারটনের সঙ্গে তুলনাও করেন।

ডিব্রু নদীর ধারে যার সঙ্গে প্রেমের শুরু,কাকার মেয়ের সঙ্গে,বিশেষত শরীরী প্রেম, সেই ওয়াই, বিওয়াই, বেবি বা শোভনা সারাজীবন জীবনানন্দ দাশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

আর এখানেও সেই অবদমন।কেননা আমাদের সমাজ এখনও এই প্রেমকে স্বীকৃতি দেয় না।এতটাই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন জীবনানন্দ যে আত্মহত্যার কারণ হিসেবেও এই ওয়াইকে বারবার চিহ্নিত করেছেন ।তিনি জানতেন ‘তোমাকে ভালবেসে রাত ফুরুলে পদ্মপাতায়’।জানতেন ‘পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল’! ক্ষণস্থায়ী তবু কি আশ্বাস আহা মানুষটার।

‘তুমি তো জান না কিছু, না জানিলে — আমার সকল গান তোমাকে লক্ষ্য করে’!

এই বিক্ষত হৃদয় নিয়েই তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন।

তাই ‘বাসররাত’ কে তাঁর ‘ভৌতক’ মনে হবে।মনে হবে আমাকে খোঁজ না তুমি বহুকাল, আমিও তোমাকে!সরাসরি লিখছেন ‘রোমান্স মরে গেছে’।

সত্যিই কী আর মরে গেছে।তবু কেন বউ ও শিশুকন্যাকে দেশের বাড়িতে রেখে ৩২/৩৩ বছরের একজন যুবক দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম জেনেও দারোয়ানকে দিয়ে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা ১৭/১৮ বছরের ওয়াইয়ের কাছ স্লিপ পাঠায়।

গল্প উপন্যাসে বারবার তো এই পরিনতিহীন পরিনতির কথা লিখেছেন।

ভালোবেসে দেওলিয়া হওয়ার কথা লিখেছেন।কতবার।কতভাবে।ইনিয়েবিনিয়ে। কখনও মেয়েটির ‘লোকাতীত খোঁপা’ দেখছেন! কখনও ভাবছেন ‘সোফার ওপর’ আর সম্ভব যা একদিন ‘বকমোহনা নদীর ধারে’ হয়েছিল?

ক্রমশ তাঁর প্রেমভাবনা একটা আইডিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে।

‘শরীরে ননীর ছিরি, ছু্ঁয়ে দেখো, চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত।হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয়-মমতা ছিল কই?’ কিংবা ‘সব বাসি সব বাসি — একেবারে মেকি!’ একবার ‘বাসি’ লিখে ক্ষান্ত হচ্ছেন না, দুবার লিখছেন।এতটাই বিতৃষ্ণা?

রিলিফ চাইছিলেন।

মোনালিসা বা বিয়াত্রিচের মতো কোনও নারীর কাছে আশ্রয়।

দু’দণ্ড শান্তি চাইছিলেন কবি।কোথাও একটা পৌঁছাতে চাইছিলেন। জাস্টিফাই করতে চাইছিলেন তাঁর প্রেমকে।

করুণা দিয়ে, মমতা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে ও সর্বোপরি জ্ঞান দিয়ে প্রেমকে পেতে চাইছিলেন।’জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই’ যিনি জানেন তিনি তো এই আপ্তবাক্যে পৌঁছাবেন-ই!

…ভালোবাসা, তোমাকে ভালোবাসা
না হলে সব জ্ঞানের নিষ্ফলতা।

আমরা অবাক হয়ে দেখি কী অবলীলায় জীবনানন্দ দাশের নায়ক সত্যেন তার প্রেমিকা শেফালি ও স্ত্রী মাধুরীকে নিয়ে লেখেন:

ও-রকম হবে একদিন — হবেই — হবেই —- শেফালিকে নিয়ে —- হয়তো মাধুরীকে নিয়ে — দু’জনকে নিয়েই — অনেককে নিয়ে —অনেক প্রিয়বস্তু নিয়ে — কবরের ভিতর নয় —- অনেকগুলো নক্ষত্রের মধ্যে….

কী? শুয়ে থাকতে পারবে।দু’জনকে নিয়ে শুয়ে থাকা বা অনেককে নিয়ে শুয়ে থাকা তো জীবনানন্দ দাশের ‘egoisms’ থেকে ‘altruism’ -এ যাত্রা।এক নয়, জীবনানন্দ দাশের প্রেম, বহুধায় ছড়িয়ে পড়বার সাধনা।

উৎপলা আসলে মাল্যবান যা চায় ততটুকুই।একতিলও বেশি বা কম নয়।মাল্যবান চায়, ওপরের ঘরে উৎপলা ও অপরেশ, এবং অপরেশ ‘আঁশটে দুধরাজের মতো ঝিকিয়ে’ উঠুক ‘দোতলার ঘরে।’

আমার তো একেকসময় মনে হয় সত্যি সত্যি অপরেশ আসে তো উৎপলার ঘরে নাকি মাল্যবানের চাওয়া ‘হ্যালুশিনিয়েশন’ হয়ে ওঠে।

জীবনানন্দ দাশের নায়িকাই তো স্বামী বা প্রেমিকাকে পাশে শুইয়ে রেখে পরপুরুষের সঙ্গে জৈবলীলায় মেতে উঠতে পারে কিংবা পাশের বাড়ির ছেলেটির সঙ্গে স্ত্রীকে সিনেমায় পাঠিয়ে গোপনে তাদের কথোপকথন শোনে বা স্ত্রীকে সাদা সিঁথিতে বেশি কুমারী দেখেন।কিংবা শবের সঙ্গে প্রেমের গল্প শুনিয়ে যৌনইচ্ছা জাগিয়ে তোলেন জীবনানন্দের নায়ক।

কী অদ্ভুত সব গল্প লেখেন জীবনানন্দ।স্ত্রী মন ‘খিঁচড়ে’ দিয়েছে তাই ‘ছেনাল’ করে বেড়াবার সাধ জাগে।’ ছেনালপনা’ অবশ্য সবসময়ই ভালো লাগার জিনিস।তবে মেয়ে ‘পটকানো’ অত সহজ নয়।তাছাড়া রক্ত-মাংস বিবেচনা বুদ্ধি বিবেকের ‘হালু-হালু’ কামড় আছে।তাই ‘গয়ারাম’ সেজে বসে থাকতে হয়।

এই জীবনানন্দ দাশকে গ্রহণ করা যায়?করতে অসুবিধে হয়?

রাতদুপুরে স্ত্রী লাবণ্যর হাঁপানির টানে প্রবল শ্বাসকষ্ট। জীবনানন্দ বিছানা ছেড়ে একতিলও নড়ছেন না।ভাবছেন, লাবণ্য হার্টফেল করে মারা যাবে নাতো!আর তারপরই, ‘driven to the last resource I begin to pray to God’।এই অবধি তবু মানা যায়।তারপর কী লিখছেন?

মাস্টারবেশন ও সুন্দরী মহিলাদের প্রসঙ্গ টেনে কৃষ্ণ ও খ্রিস্টিয় পথের তুলনা করেছেন।

কৃষ্ণ তাঁর কাছে, ‘more rational and congenial’!

তাই তিনি লেখেন:

‘Christian literature and churches are seem somehow to be mythical and futile in comparison with Krishna as when masturbating may seem futile in comparison with Lila Bhattacharya, Amiya Dutta, Fulu Dutra, Anjali Banerjee, Soraja Mukherjee, Jharna Chatterjee, Biva Bose, Malina Banerjee.’

এত অকপটে এত ভয়ঙ্কর গোপন কথা বিশ্বসাহিত্যেই বা ক’জন লিখেছেন।শুধু ডায়েরি তো নয়, লেখায় দখল নিচ্ছে এইসব ভাবনা।

একজন হতভাগ্য ও ভ্যাবাচ্যাকা প্রেমিক এই জীবনানন্দ।

সারাজীবন ধরে ঠিক করতে পারেননি কোথায় ওলোন যন্ত্র রেখে প্রেমের ভরকেন্দ্র ঠিক করবেন।

কবিতায় লিখছেন:

‘তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা’!

ডায়েরিতে লিখবেন:

‘যৌনক্ষিদে আমার উদ্দীপনা জাগাল: তোমার সব হারিয়েছে: তুমি কি আর সমর্থ হবে!’

নীচে রুথের মতো মনিয়া, ওয়াই ও লাবণ্য।এই তিনজন জীবনানন্দ দাশের প্রেমের চালিকাশক্তি।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত