।।ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।।
কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) মূলত প্রাবন্ধিক না হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা লিখেছিলেন যার প্রতিটি অত্যন্ত মৌলিক চিন্তা-ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর প্রবন্ধের সংকলন “কবিতার কথা” প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর; ১৩৬২ তে। এতে তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত পনেরটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধগুলি বহুল পঠিত। এই বিখ্যাত পনেরটি প্রবন্ধের বাইরেও জীবনানন্দের আরো কিছু প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সমালোচনা রয়েছে। এই রচনাসমষ্টির সংখ্যা কত তা’ নিশ্চিত জানা নেই। তবে ইতোমধ্যে অধিকাংশেরই হদিশ করা গেছে এবং গ্রন্থস্থ হয়েছে।
১৯৫৪’র অক্টোবরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ’র মৃত্যু হয়। জীবনানন্দ’র বোন সুচরিতা দাশের সহায়তা নিয়ে তরুণ কবি ভূমেন্দ্র গুহ এই গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন। গ্রন্থের প্রচ্ছদনাম নির্বাচন করেছিলেন জীবনানন্দ’র অনুজ অশোকানন্দ দাশ। সিগনেট প্রেস গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল। কবিতার কথা’য় তাঁর জীবদ্দশায় ১৩৪৫ (১৯৪৩ খ্রি.) থেকে ১৩৬০ বঙ্গাব্দ (১৯৫৩ খ্রি.) এই কালপরিসরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত পনেরটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল। প্রতিটি প্রবন্ধই অত্যন্ত মৌলিক চিন্তা-ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে; এই প্রবন্ধগুলি বহুল পঠিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে কবির মৃত্যুর পর কলকাতার ময়ুখ পত্রিকার জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যায় (১৩৬১-৬২ বঙ্গাব্দ) সর্বপ্রথম কবির অগ্রন্থিত প্রবন্ধাদির একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। এতে ময়ূখে’র অন্যতম কাণ্ডারী মেডিকেল কলেজের ছাত্র কবিযশোপ্রার্থী ভূমেন্দ্র গুহের বিশেষ অবদান ছিল। বোধগম্য কারণেই তালিকাটি ছিল অসম্পূর্ণ। কবিতার কথা’র বাইরে কয়েকটি প্রকাশিত-অপ্রকাশিত প্রবন্ধ ছাড়াও প্রবন্ধধর্মী রচনার নিদর্শন স্বরূপ জীবনানন্দ লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকা, পুস্তক সমালোচনা এবং কয়েকটি চিঠি-পত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সব মিলিয়ে ১৯৯০ সালে ঢাকার দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র। এতে পত্রস্থ কবিতার কথা বহির্ভুত রচনার সংখ্যা ২৯ (অর্থাৎ কবিতার কথা সহ সর্বমোট ৪৪) । পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থেরই দ্বিতীয় সংস্করণে কবিতার কথা বহির্ভুত রচনার সংখ্যা উন্নীত হয় ৩২ এ। ১৯৯৯-এর শুরুর দিকে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রবন্ধবলি। এতে বাংলা-ইংরেজী মিলিয়ে কবিতার কথা বহির্ভুত নানাবিধ ৪৮টি রচনা সংকলিত হয়। উল্লেখ্য যে, কবিতার কথা এবং জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রবন্ধবলি-তে সংকলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়েই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ‘গতিধারা’ প্রকাশ করে ‘প্রবন্ধসমগ্র’, এতে সম্পাদক হিসেবে দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের নামোল্লেখ ছিল। স্বয়ং ভূমেন্দ্র গুহ ২০০৯-এ প্রকাশ করেন “সমগ্র প্রবন্ধ”। এতে লেখার খাতা থেকে উদ্ধারকৃত জীবনানন্দের আরো কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধের খসড়া সংযোজিত হয় এবং সব মিলিয়ে গ্রন্থিত রচনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৮।
জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধবলী, শিক্ষা বিষয়ক কয়েকটি নিবন্ধ, বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকা, জীবনানন্দকৃত বিভিন্ন গ্রন্থের সমালোচনা, আত্মপ্রাসঙ্গিক কিছু রচনা, এবং নিজ কবিতা নিয়ে তিনটি লেখা এবং কয়েকটি খসড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সংগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের উৎস প্রসঙ্গে দুটি কথা উল্লেখ করা দরকার। প্রথমতঃ উল্লেখ করা দরকার যে, কবিতার কথা’য় অন্তর্ভুক্ত ‘কবিতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামীয় প্রবন্ধটি মূলতঃ একটি চিঠি। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর (বাংলা ১৩৫৩) বরিশালে অবস্থান কালে প্রভাকর সেনকে লিখিত চিঠিটিই কিছুটা সম্পাদিত হয়ে প্রবন্ধ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এ চিঠিটি ময়ুখ পত্রিকার জীবনানন্দ স্মৃতি-সংখ্যায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তবে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে জানা যায় পূর্বাশা পত্রিকার কার্তিক ১৩৫৩ সংখ্যায় আলোচ্য ‘কবিতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামীয় প্রবন্ধটি ‘কবিতা প্রসঙ্গে জীবননান্দ’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়েছিল। অনুমিত হয় চিঠি হিসেবে লিখিত হলেও এর তাত্ত্বিক মূল্য অনুধাবন করে জীবনানন্দ দাশ তা’ পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছিলেন। উপর্যুক্ত জীবনানন্দের প্রবন্ধ সমগ্রে (১৯৯০) কবির আরো একটি চিঠি ‘আমার কথা’ শিরোনামে গ্রন্থস্থ করা হয়েছে।
২.
জীবনানন্দ দাশের প্রাবন্ধিক পরিচয় অদ্যাবধি বিশেষ কোন স্বীকৃত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় নি। তাঁর যে গদ্য রচনাগুলো পাওয়া যাচ্ছে তার সর্বপ্রথমটি একটি শ্রাদ্ধসভার জন্য লিখিত। প্রথম সাহিত্যিক রচনা একটি বুদ্ধদেব বসুর কংকাবতী কাব্যগ্রন্থের আলোচনা যা কবিতা পত্রিকায় ১৩৪৪-এ মুদ্রিত হয়েছে। কার্যতঃ জীবনানন্দের অধিকাংশ গদ্যরচনাই ফরমায়েশী। তথাপি প্রাবন্ধিক জীবনানন্দের দৃষ্টি কোন্ কোন্ বিষয়ে আকৃষ্ট হয়েছিল তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম এরকম: ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বংলা কাব্য’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসাবে কবিতা শ্বাশত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশকাল ও কবিতা’, ‘সত্যবিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘কেন লিখি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘শরৎচন্দ্র’, ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘শিক্ষা ও ইংরেজি’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’, ‘শিক্ষার কথা’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা’ ইত্যাদি।
এই সূত্রে জীবানানন্দ’র সমসাময়িক আধুনিক কবিরা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে কোন্ কোন্ বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন তা’ জিহীষার জন্ম দেয়। প্রথমেই কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্তের প্রবন্ধের তালিকায় রয়েছে: ‘কাব্যের মুক্তি’, ‘ধ্রুপদ-খেয়াল’, ‘ডি.এইচ.লরেন্স ও ভার্জিনিয়া উল্ফ’, ‘উপন্যাসে তত্ত্ব ও তথ্য’, ‘ফরাসীর হার্দ্য পরিবর্তন’, ‘মাক্সিম্ গর্কি’, ‘বার্নার্ড শ’, ‘উইন্ডাম্ ল্যুইস ও এজ্রা পাউন্ড’, ‘ঐতিহ্য ও টি.এস.এলিয়ট’, ‘ডব্লিউ.বি.ইয়েটস’ ও ‘কলাকৈবল্য’, ‘রবীন্দ্র্রপ্রতিভার উপক্রমণিকা’, ‘রবিশস্য’, ‘ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘সূর্যাবর্ত’, ‘দিনান্ত, ‘উক্তি ও উপলব্ধি’, ‘চোরাবালি’, ‘শিল্প ও স্বাধীনতা’, ‘প্রগতি ও পরিবর্তন’, ‘বিজ্ঞানের আদর্শ’, ‘অনার্য সভ্যতা’ ইত্যাদি।
কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রবন্ধাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির শিরোনাম এরকম : ‘শিল্পদৃষ্টি’, ‘কাব্যে ধারণা শক্তি’, ‘কাব্যের টেকনিক’, ‘কাব্যাদর্শ’, ‘এজরা পাউন্ড’র কবিতা’র দরবারে পত্রাঘাত’, ‘এলিয়টের নতুন কবিতা’, ‘কবি য়েট্স্’, ‘জয়েস্ প্রাসঙ্গিক’, ‘প্রমথ চৌধুরীর গল্প’, ‘যুগ সংকটের কবি ইকবাল’, ‘ইকবাল-কাব্যের নতুন প্রসঙ্গ’, ‘নতুন কবিতা’, ‘কবিতার চেয়ে বেশি’, ‘গানের গান’, ‘গীতাঞ্জলি ও সত্য কবিতা’, ‘শেষ লেখা’ ইত্যাদি।
জীবনানন্দের প্রধান পৃষ্টপোষক বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সংকলনে রয়েছে : ‘রবীন্দ্রনাথ : বিশ্ব কবি ও বাঙালি’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প’, ‘কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ’, ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’, ‘নজরুল ইসলাম’, ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : কবি’, ‘অমিয় চক্রবর্তীর পালা বদল’, ‘রামায়ণ’, ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’, ‘সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ’, ‘শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা’, ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব, ‘চার্লস চ্যাপলিন’, ‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি’ ইত্যাদি।
কবি বিষ্ণু দে’র কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম এরকম : ‘জনসাধারণের রুচি’, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতি’, ‘বাংলায় শিল্পচর্চা’, ‘বাংলা সাহিত্যের ধারা’, ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘বীরবল থেকে পরশুরাম’, ‘রাজায়-রাজায়’, ‘আঁরাগ’, ‘পরিবর্তমান এই বিশ্বে’, ‘পিকাসো’, ‘সোভিয়েট শিল্প-প্রদর্শনী’, ‘লোকসংগীত’, ‘বুদ্ধিবাদী উপন্যাস’, ‘বাংলা গদ্য কবিতা’, ‘হাল্কা কবিতা’, ‘এলিয়টের মহাপ্রস্থান’, ‘এলিয়ট প্রসঙ্গে’, ‘বাংলা সহিত্যে প্রগতি’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’, এবং ‘রিচার্ডসের কল্পনা’।
মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ জীবনানন্দের অগ্রজ। এঁদের মধ্যে কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের প্রবন্ধের তালিকায় রয়েছে: ‘মেঘনাদবধ-কাব্যের নারী-চরিত্র’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও “কবি-উপন্যাস”, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ট্র্যাজেডী-তত্ত¡’, ‘বিহারীলাল চক্রবর্তী’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘মৃত্যুর আলোকে শরৎচন্দ্র’, ‘সাহিত্য-বিচার’, ‘কাব্য ও জীবন’, ‘সাহিত্যের ষ্টাইল’, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, ‘নবযুগ ও স্বামী বিবেকানন্দ’ ইত্যাদি।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের স্থপতিদের অন্যতম। তিনি প্রবন্ধ সাহিত্যে নতুন গদ্যরীতির প্রচলন করেন। বিষয়-আশয়েও তিনি প্রবন্ধের পরিধিকে অনেক বিস্তৃত ক’রে দিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধের তালিকায় রয়েছে ‘জয়দেব’, ‘সনেট কেন চতুর্দশপদী’, ‘বঙ্গ সাহিত্যের নবযুগ’, ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘বই পড়া’, ‘রামমোহন রায়’, ‘কাব্যে অশ্লীলতা আলংকারিক মত’, ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা’, ‘ভারতবর্ষের ঐক্য’, ‘বাঙ্গালি-পেট্টিওটিজম’, ‘মলাট-সমালোচনা’, ‘প্রত্নতত্ত্বের পারশ্য-উপন্যাস’ ইত্যাদি শিরোনামে বিচিত্র বিষয়ের প্রবন্ধ।
তালিকাসমূহের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, জীবনানন্দ তাঁর দৃষ্টি অনেকখানি প্রসারিত করেছেন সাহিত্য, বিশেষভাবে, কবিতার তাত্ত্বিক আলোচনায়। কিন্তু তিনি একা নন, তিরিশের সতীর্থদের অনেকেই কবিতা সম্পর্কে ভেবেছিলেন। সতীর্থদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র আর সে কারণেই বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাদের স্বাভাবিক অবহিতি ছিল, ইয়োরোপ-আমেরিকার সমকালীন সাহিত্য ভাবনা তাদের অধিগত ছিল। তারা নিজেরাও স্বীয় সাহিত্য ভাবনা প্রবন্ধে-নিবন্ধে প্রকাশ করেছিলেন।
৩.
বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। এ প্রবন্ধের শুরু এই ভাবে :
সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।
জটিল ভাষায় সুগভীর বক্তব্য নিয়ে প্রথম থেকেই প্রবন্ধলেখক জীবনানন্দ স্বতন্ত্র হয়ে গেছেন। এর পর পরম বিশ্বাসে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধে তিনি সৎ ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার শর্ত নিরূপণ করেছেন, আধুনিকতার সঠিক পরিচয় নির্ণয় করেছেন এবং কখনো কখনো সমসাময়িক কবিতার মূল্যমান নির্ণয় করেছেন।
কবিতার নানাদিক নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা করলেও জীবনানন্দ ব্যক্তিকেন্দ্রিক আলোচনা করেন নি তা’ নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে তিনি পৃথক প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্য দিকে সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র বিষয়েও তিনি লিখেছেন যথেষ্ট। সমকালীন সমস্যা নিয়ে তিনি বিশেষ ভাবিত ছিলেন যার প্রতিফলন ঘটেছে কয়েকটি প্রবন্ধে। শিক্ষা বিষয়ক পাঁচটি প্রবন্ধ জীবনানন্দ’র গভীর সমাজমনস্কতার বিশিষ্ট অভিজ্ঞান। লক্ষ্য এড়ায় না যে সাহিত্যতত্ত্বীয় প্রবন্ধগুলোর তুলনায় এগুলোর ভাষা সহজতর, যুক্তি পারম্পর্য ও বিন্যাস স্বচ্ছতর; ফলে তুলনামূলকভাবে সহজপাঠ্য।
যা হোক জীবনানন্দের প্রবন্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাঁর কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো। কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে জীবনানন্দের কবিতা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে নিরেট পরিসরে। সমসাময়িককালে ইউরোপীয় ধাঁচে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার প্রবর্তন হয়, সে সম্পর্কে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ খুবই লক্ষ্যভেদী। কবিতাবিষয়ক চিন্তায় জীবনানন্দ’র দৃষ্টিভঙ্গি অভিনব বললে অত্যূক্তি হবে না। যুগ যুগ ধ’রে কবিতা বিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্র হলো: কবিতা কী, কী গুণে একটি রচনা কবিতা হয়ে উঠতে পারে। পরিবর্তে জীবনানন্দ সর্বাগ্রে কবি’র সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করাই শিরোধার্য করছিলেন, তিনি সর্বপ্রথমেই লিখলেন: “সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি….।”
কে কবি? জীবনানন্দ জানালেন, কবির হৃদয়ে থাকবে কল্পনা ; সে কল্পনার ভিতরে থাকবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা। অধিকন্তু, জীবনানন্দ’র মতে, একজন কবির পশ্চাৎপটে ক্রিয়াশীল থাকে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক কবিদের বিভিন্ন কাব্যপ্রয়াস। এ কারণে, যার হৃদয়ে কল্পনার প্রতিভা নেই—আর কল্পনা যদিওবা থাকে, যদি না-থাকে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্রিক নির্যাস—তবে জীবনানন্দ তাঁকে, হতে পারেন তিনি বহুলপ্রজ এমনকী খ্যাতিমান কবিতালেখক, ‘কবি’ বলতে প্রস্তুত নন।
কল্পনার প্রতিভা কি—তা স্পষ্ট করেন নি জীবনানন্দ। ইমানুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) সময় থেকেই শিল্পসৃষ্টিতে কল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কান্ট যেমন ইঙ্গিত করেছেন, কল্পনার প্রতিভা হলো—যা দৃশ্যমান নয় তা প্রত্যক্ষ করবার—এবং একজন শিল্পীর জন্য—চিত্রায়নের ক্ষমতা; কবির জন্য ‘বোধ’ সৃষ্টির; তা হতে পারে স্মৃতিসঞ্জাত বা অভিজ্ঞতাপ্রসূত এমনকী হতে পারে, আলেকজান্ডার বমগার্টেনের (১৭১৪-১৭৬২) ভাষ্যে অভ‚তপূর্ব, অর্থাৎ অনদৃষ্ট, যা—এমনও হতে পারে—কেবল কবিতার মধ্য দিয়েই উপলব্ধ হবে। স্বীয় অভিজ্ঞতার গহন থেকেই উঠে আসে কল্পনালব্ধ বোধ, কবি তাকে ধারন করেন শব্দপুঞ্জে। তাহলে, জীবনানন্দের ভাষ্য ব্যাখ্যা ক’রে বলা যেতে পারে কবি তিনি যিনি অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারেন এবং পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন এই অনুপলব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
কবির কাজ কবিতা সৃষ্টি করা কিন্তু কবি ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখে ফেলতে পারেন না কেননা কবিতা ‘চিন্তার ব্যায়াম’ নয়। কবিতার জন্মরহস্য বর্ণনাতীত একটি ঘটনা। কোনও কবির পক্ষেই বলা সম্ভব নয়, আজ আমি একটি কবিতা লিখবো। কবিতা লেখার শর্ত হলো কবির মনে বিশেষ একটি ভাবনা বা চিন্তার স্বয়ম্ভূ স্ফূরণ। অনেক কবিই বলেছেন, প্রথমতঃ একটি পংক্তি হঠাৎ ক’রে জন্ম নেয়। জীবনানন্দের ভাষ্যে: কবিতা কোন এক বিশেষ মুহূর্তে কবিমনের সততাপ্রসূত অভিজ্ঞতা ও কল্পানপ্রতিভার দৈব সন্তান। কবিতার সংজ্ঞার্থে ‘দৈব সন্তান’ কথাটি অনিবার্য। দৃশ্যতঃ কবিতা মানুষের অধিগম্য শব্দসমষ্টির বিন্যাস মাত্র, কার্যতঃ গভীর সৌন্দর্যের উৎস। কবিতা শব্দের সমষ্টি হলেও মানুষের অনুভ‚তিতে সৃষ্টি করে বিশেষ একটা রস, সঞ্চারিত করে বিশেষ একটি আবেগ যা মানুষের উপলব্ধিতে জাগিয়ে তুলতে পারে বিশেষ তৃপ্তিবোধ এবং অনির্বচনীয় আনন্দোচ্ছলতা। কিন্তু কবিতা সকলের জন্যে নয়, অনেকের জন্যেও নয়। কবিতা কেবল কবিতাবোদ্ধাদের জন্য; জীবনানন্দ নিঃসংশয়ে মনে করেন শ্রেষ্ঠ কবিতা হলেই তা গণমানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠবে তা নয়।
জীবনানন্দ কাব্যের এবম্বিধ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অভিন্নমত পোষণ করেন নি। কবি শেলীও করেন নি। জীবনানন্দের মতে ‘কবিতা’ এবং ‘পদ্য’ অভিন্ন হতে পারে না; ‘পদ্য’ —যার ভিতর সমাজ-শিক্ষা, লোকশিক্ষা ও মতবাদের অধিষ্ঠানই মুখ্য—কবিতা থেকে পৃথক; পদ্যের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী, পাঠককে দিতে পারে না সম্ভোগানন্দ; পাঠক বড়জোর নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করতে পারে। সাংবাদিকী ও প্রচারমর্মী রচনার সঙ্গে কবিতার পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত জিনিসগুলোর ভিতর অভিজ্ঞতাবিশোধিত ভাবনা-প্রতিভার মুক্তি, শুদ্ধি ও সংহতি কিছুই নেই ; কবিতায় তা আছে।
কবির বৈশিষ্ট্য, কবিতা ও কবিতাসৃজন প্রক্রিয়া এই তিনটি বিষয় নিয়েই স্বীয় উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন জীবনানন্দ বিভিন্ন রচনায়। এক পর্যায়ে জীবনানন্দ সিদ্ধান্ত করেছেন, “কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুইরকম উৎসারণ”। ১৯৫৪ তে প্রকাশিত “শ্রেষ্ঠ কবিতার” ভ‚মিকায় তিনি লিখেছেন, “ . . . কবিতা অনেক রকম।” তিনি আরও লিখেছেন, “কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদেও উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য।” নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা-ও প্রণিধানযোগ্য, “আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মনে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আ্যখা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য–কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যেও কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।”
অন্যদিকে ‘লোকোত্তর রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন, “…রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়ে আজ যে আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম — বাংলা সাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙ্গে ফেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এরকম অজ্ঞাতকুলশীল জিনিষ নয়। ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে যুগে ঘুরে ফিরে সেক্সপীয়র-এর কেন্দ্রিকতার থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা ক’রে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা ক’রে তাই করবে — এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপেক্ষ বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসঙ্গত বলে প্রমাণিত হবে না — এই আমার মনে হয়।” মোদ্দা কথা কেবল ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো নয়, জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাবনা অন্যান্য প্রবন্ধ-নিবন্ধেও পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য প্রবন্ধেও কবিতা ব্যাখ্যা এবং কবিতার মূল্যায়ন সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের আকর্ষণীয় উপলব্ধির অভিজ্ঞান রয়েছে।
৪.
আজ সম্ভবত বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে নি:সংকোচে একমত হতে আর কারো আপত্তি নেই যে জীবনানন্দ দাশ নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র কাব্য-ভাষা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর গদ্য ভাষারীতিও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর প্রবন্ধগুলোর বাক্য গঠনরীতি সমসাময়িককালে সুপরিচিত ছিল না। এমনকী মনোযোগী পাঠকের কাছেও তা জটিল প্রতীয়মান হতে পারে। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, প্রবন্ধের ভাষায় জীবনানন্দ দাশ প্রায়শঃ একটি বাক্যের ভেতরে একাধিক অনুবাক্যকে ধারন করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে বাক্য কেবল দীর্ঘায়িত হয়নি, এর গঠনে অনুপ্রবেশ করেছে জটিলতা। তিনি বিশেষ ক’রে মূল বাক্যের জরায়ুতে যতি-চিহ্ন-চিহ্নিত নতুন বাক্য জুড়ে দিয়ে বক্তব্যকে সংহত রূপ দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। একটি বাক্যের শর্তসাপেক্ষে কমা বা সেমিকোলন দিয়ে আরেকটি বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়, পূর্ণরূপ বাক্য শেষে সেমিকোলন দিয়ে নতুন বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছে, পরবর্তী বাক্য পূর্ববর্তী বাক্যের বিশেষণ হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে বাক্য দীর্ঘ ও জটিল রূপ লাভ করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো একটি বাক্যের সমর্থনে আরেকটি বাক্য অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া যার উদাহরণ প্রথম বাক্যেও ‘কবিতার কথা’ নামীয় প্রবন্ধের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ।
ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে বা বিংশ শতকের প্রথমাংশে কা’র হাতে বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম উপর্যুক্তরূপ বাক্যকাঠামো প্রবর্তিত হয়েছিল তা’ গবেষণাসাপেক্ষ। বিদ্যাসাগর যে গদ্যভাষার শিলান্যাস করেছিলেন অদূরবর্তী ভবিষ্যতেই তা’ নানা হাতে নানা রূপ লাভ করতে শুরু করেছিল। কার্যত এ ছিল মৌখিক ভাষা থেকে ভিন্ন ও জটিলতর একটি লেখ্য রীতির প্রবর্তনা। তবে নি:সংকোচে বলা চলে যে এর ফলে বাঙলা গদ্যের আঙ্গিক ও স্বাদ বহুলাংশে বদলে গিয়েছিল।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এর ফলে বাঙলা গদ্য লাভ করেছিল বক্তব্য প্রকাশের বিস্তৃতিতর অবকাশ ও গভীরতর শক্তি। জীবনানন্দের গদ্য এই ঘরানারই উচ্চতর বিকাশ। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর গদ্যভাষাতে অনুরূপ দীর্ঘ ও জটিল বাক্যে বহুতর বক্তব্য ধারণের প্রয়াস। অত্যূক্তি হবে না যে এভাবেই বাংলায় প্রবন্ধের যথোপযুক্ত একটি শক্তিধর গদ্যভাষার প্রবর্তনা হয়েছিল ; প্রবন্ধ যা কি-না মানুষের গভীর চিন্তনকে ধারণ ও প্রকাশ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে গদ্যের লালিত্য, সৌন্দর্য ও প্রাঞ্জলতা বিকশিত হয়েছিল বিভিন্ন আঙ্গিকে। এরই সূত্র ধ’রে গত একশত বৎসরে ক্রমশ: সৃষ্টি হয়েছে সুনির্দ্দিষ্ট কিছু গদ্যশৈলী বা স্টাইল যার সাংজ্ঞার্থিক বর্ণনা দুরূহ হলেও বিভেদক পার্থক্য নিরূপণ সজাগ পাঠকের জন্য সুকঠিন কোন কাজ নয়। রসজ্ঞ পাঠক বিশিষ্ট কোন গদ্যশৈলী চিনতে ভুল করে না।
ভাষা চিন্তা ও উপলব্ধির বাহন, অতএব চিন্তা ও উপলব্ধির গভীরতার ওপর নির্ভর করে ভাষার চারিত্র্য। বক্তব্য যে ক্ষেত্রে সরল সে ক্ষেত্রে সরল ভাষাভঙ্গীই লেখকের জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে জটিল, দৃঢ় ও দীর্ঘ বাক্যের সমর্থন ব্যতিরেকে গভীর ও জটিল বক্তব্য প্রকাশ সম্ভব হয় না। নির্দ্বিধায় বলা চলে যে জীবনানন্দ স্বীয় গভীর মননশীলতা এবং নিবিড় অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি স্বতন্ত্র গদ্যভাষা প্রণয়নে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর গদ্যকাঠামো কেবল জটিল বাক্য গঠনরীতির ওপর স্থিত নয়, বক্তব্য সংস্থাপনার ক্রমও এর নিয়ামক। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শব্দচয়ন রীতি। প্রণিধানযোগ্য যে, স্বীয় ধারণা ও উপলব্ধিকে সঠিকভাবে প্রকাশের জন্য জীবনানন্দ প্রায়শঃ সমাসবদ্ধ শব্দ গঠন করেছেন। এ পর্যায়ে জীবনানন্দ থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে ; উদ্ধৃটি দীর্ঘ হলেও জীবনানন্দীয় গদ্যভঙ্গীর অনেক বৈশিষ্ট্যই এতে অবধৃত ও পরিস্ফুট :
‘. . . আমি বলতে চাই না যে কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনো সম্বন্ধ নেই ; সম্বন্ধ রয়েছে, কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকট ভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুই রকম উৎসারণ ; জীবন বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি তার ভিতর বাস্তব নামে আমরা সাধারণত যা জানি তা রয়েছে, কিন্তু এই অসংলগ্ন অব্যবস্থিত জীবনের দিকে তাকিয়ে কবির কল্পনা-প্রতিভা কিংবা মানুষের ইমাজিনেশন সম্পূর্ণ ভাবে তৃপ্ত হয় না ; কিন্তু কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্তনা পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়। কিন্তু সাধারণত বাস্তব বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পুর্ণ পুনর্গঠন তবুও কাব্যের ভিতর থাকে না ; আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায়, তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাক্সক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধুলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে। যা কাব্য ;- অথচ জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুড়ঙ্গলালিত সর্ম্পূর্র্ণ সম্বন্ধ ; সম্বন্ধের ধূসরতা ও নূতনতা। সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যা কিংবা প্রভ‚ত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথাও যেন ছিল ; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে, আরো অনেকদিন পর্যন্ত, হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রলোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে ; এই সবের অপরূপ উদগীরণ ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভুতির জন্ম হয়, নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনি বস্তু-সঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতরে ; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয় ; এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনো কোনো মানুষের কল্পনামনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে, কাব্য জন্ম লাভ করে।’ (‘কবিতার কথা’)
উদ্ধৃতাংশ ব্যবচ্ছেদ ক’রে দেখতে পাওয়া যায় এক দিকে জীবনানন্দ দাশ একই বাক্যে ধারণ করেছেন বক্তব্যের নিহিতার্থ ও এর শর্ত ; অন্যদিকে একই বাক্যে রয়েছে বক্তব্য ও এর তাৎপর্য। আবার কোন বাক্যে একটি বক্তব্য শেষে জুড়ে দেয়া হয়েছে তার বিশেষায়িত টীকা। অর্থাৎ একটি বাক্যের এক প্রান্তে রয়েছে মূল বক্তব্য অন্য প্রান্তে রয়েছে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। পূর্ণ বাক্য শেষে পূর্ণ যতি’র পরিবর্তে জীবনানন্দ দাশ অর্ধ-যতি বিশেষ করে সেমিকোলন ব্যবহার ক’রে যুক্ত করেছেন আরেকটি পূর্ণ বাক্য ; ফলে বাক্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অনুপ্রবেশ করেছে জটিলতা। সন্দেহ নেই এর ফলে ভাষার অর্থনির্মলতা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে তাঁর গদ্যভঙ্গীতে প্রোথিত হয়েছে নিবিড় গভীরতা ও দার্ঢ্য যা গভীর ও সূচিন্তাসূত্রকে ধারণ করতে সক্ষম। এই গদ্য রীতির সঙ্গে ইয়োরোপীয় বিশেষ করে ইংরেজী প্রবন্ধ সাহিত্যের গদ্যরীতির সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়।
তথাপি লক্ষ্যণীয় যে, জীবনানন্দে তাঁর গদ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাক্যে-পদ-স্থাপনার রীতি অনুসরণ করেছেন। বস্তুত: তার মূল অবদান একই বাক্যের কাঠামোতে যুক্তিসম্মত বিবিধ বাক্য, অনুবাক্য ও বাক্যাংশের সমাবেশ। ফলে ভাষার লৌকিক রীতি সর্বাংশে পরিত্যাক্ত হয়েছে ; প্রণীত হয়েছে এমন একটি বাক্যকাঠামো যাতে একই বাক্যে একটি জটিল অথচ পূর্ণাঙ্গ চিন্তাসূত্র সংস্থাপিত হতে পেরেছে। লৌকিক ভাষায় বক্তব্য প্রকাশের যে পরম্পরা আমরা লক্ষ্য করি, জীবনানন্দের গদ্যভাষা প্রবাহিত হয়েছে তার বিপরীত মুখে। লৌকিক ভাষার স্বভাবী শিথিলতা দূরীভূত ক’রে জীবনানন্দ দাশ বাংলা গদ্যকে দিয়েছেন গভীর মননশীল বক্তব্য প্রকাশের অপরিমেয় শক্তি।