ঝিনুক অন্ধ হয়ে গেছে

Reading Time: 9 minutes

এটা ঝিনুকের গল্প। ববিতার মতো দেখতে ঝিনুক!

ঝিনুক আমার ছোটবেলার বন্ধু। ছোটবেলা মানে হাইস্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত আমি ছিলাম তার যাবতীয় অপকর্মের সঙ্গী। এরশাদ আমলে আমাদের ছোট থানাসদর, উল্লাপাড়ায় মেয়েদের অপকর্ম করে বেড়াবার সুযোগ তেমন ছিল না। কিন্তু আমাদের দলটার শয়তানি শিখতে ও করতে কিছু বাড়তি সুবিধা যোগ হয়ে গেছিল।

ঢাকা তখন অনেক দূর, যমুনায় ব্রিজ পড়ে নাই! ঢাকা ফেরত বলে কোনো কথা চালু ছিল না, কিন্তু ভাবটা ছিল। কেউ ফেরি দিয়ে ঢাকা রওনা করার আগে তিনদিন ধরে বিদায় বিদায় আবহাওয়া বানাত আর দোয়া সংগ্রহ করত

আমাদের ঢাকা লাগত না। জেলা-সিরাজগঞ্জ শুধু লিখতামই, চেনাচিনি ছিল না তেমন। তাই বলে পুরা উল্লাপাড়া থানার এক স্ট্যাটাস ছিল না কিন্তু। মূল থানা সদর থেকে কোন গ্রাম কত দুর্গম এলাকায় তার উপরে আমাদের আভিজাত্য নির্ভর করত। স্কুলে আসতে যাদের নৌকা লাগত, তারা সবচেয়ে বেশি খ্যাত।

সে হিসাবে ঝিনুক ছিল সবচেয়ে অভিজাত। থানা সদরের বুকের উপর ছিল ওদের বাসা, হাইস্কুল আর কলেজ দুইটাই বাসা থেকে দেখা যেত আরো আছে- ওর বাবা মা দুজনেই চাকরি করতহেলথ, ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসব শব্দ ওর কাছেই প্রথম শেখা আমাদের শয়তানিক সুবিধার সবচেয়ে বড় পয়েন্টটা বলে ফেলেছি কিন্তু, খেয়াল করেছেন? হ্যাঁ ঝিনুকদের বাসা খালি থাকত!

যে হাইস্কুলে পড়তাম, ওটা গার্লস স্কুল ছিল। বিরাট গেট, মানে স্কুলে একবার ঢুকে গেলে আর চার পাচজনে একসঙ্গে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না হঠাৎ কোনোদিন স্কুল আগে ছুটি হয়ে গেলে আমরা ঝিনুকদের বাসায় যেতাম বিড়ি সিগারেট দিয়ে হাতেখড়ি। কলেজে উঠলে যে আমরা কত স্বাধীন হব, সেই আলাপে মশগুল হয়ে যেতাম। দলের একেকজন একেক বিষয়ে পারদর্শী। আমি পড়ুয়া, যেখানে যে গল্পের বই পাই, পড়ে ফেলি। প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ। ফলে নারীপুরুষ বিষয়ে জ্ঞান বিতরণের দায়িত্ব ছিল আমার। মিতুর দ্বায়িত্ব ছিল সিগারেট জোগাড় করা। ওদের বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে ওর পঙ্গু চাচার পান-বিড়ি-চানাচুর-বিস্কুটের দোকান ছিল। সেখান থেকে একটা দুইটা বিড়ি চুরি করত, কবে আমাদের আড্ডা বসবে তার নাই ঠিক, ফলে সিগারেট দীর্ঘদিন কীভাবে না পোতানো আবস্থায় রাখা যায়, সেটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ছিল ওর। নাইন পর্যন্ত এটুকুই ছিল এডভেঞ্চার।

নাইনে উঠে পেলাম মৌসুমিকে! ঢাকায় থাকত ওরা, অনেক ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট ও বাবা আর্মিতে ছিল, একবারে উল্লাপাড়া চলে এসেছিল ওরা। কী কারণ তা ভালো করে বুঝি নাই হয়ত এরশাদ গদি থেকে নেমে গেছিল বলে। কেন ওরা হঠাৎ উল্লাপাড়া চলে এলো, সেটা নিয়ে মাথাও খাটাই নাই মৌসুমিকে নিয়েই দিশেহারা আমরা তখন আমাদের বয়সী একটা মেয়ে এত পাকা হতে পারে, ধারনা ছিল না। আমরা রীতিমত ওর পায়ের কাছে পয়সা ফেলে মুরিদ হয়ে গেলাম। ঝিনুক প্রথমে এতদিনের লিডারশীপ ছাড়তে চায় নাই, পরে মৌসুমির তাপে ওর মোমও গলে গেল। মৌসুমির হাত ধরে আমরা ঢুকে গেলাম সিনেমার জগতে। মৌসুমিদের বাসায় ওর নিজের একটা ঘর ছিল, সে ঘরে বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতে পারত ও! জবরদস্ত সব হিন্দি প্রেমের সিনেমা দেখা শুরু হয়েছিল, ভিসিয়ার এ। ক্লাস টেনে উঠে আমরা প্রেমে পড়তে শুরু করেছিলাম, আর ঝিনুকদের বাসায় ছেলেদের নিয়ে আসতে শুরু করেছিলাম চুমু টুমু ডিঙ্গিয়ে আরো এগিয়ে যেতে সাহস জোগাত মৌসুমি।

কলেজে উঠে ঝিনুক বলেছিল, ওই শয়তানি যা করার কর, কিন্তু মনে রাখিস লেখাপড়া না করলি এই উল্লাপাড়ায়ই পড়ে থাকা লাগবি, ঢাকা- রাশশাই আর চোখে দেখা লাগবি না!’ আমরা জোরে জোরে মাথা নেড়ে একমত হয়েছিলাম, হ্যাঁ অন্তত বড় শহরে যেতে হলেও লেখাপড়া করতে হবে। আমাদের তখন সবকিছুতে স্পিড, বদমায়েশি আর পড়া একসঙ্গে দিব্যি পারি। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার সিরিয়াস প্রেমে পড়ে গেল। তাদের লেকচার দিয়েছিল মৌসুমি- ‘ওই দুনিয়ায় কত পোলা জানছ? কত রকম কিছিম তাদের জানছ? এক পোলা লইয়া জীবন পার? ছি ছি!’  সবচেয়ে জোরে মাথা নাড়িয়েছিলাম আমি আর ঝিনুক, অন্তত হরেক কিসিমের পোলা দেখতে চাইলেও আমাদের উল্লাপাড়া থেকে বেরোতে হবে। আর উল্লাপাড়া থেকে বেরোতে চাইলে লেখাপড়া করতেই হবে। ফলে আমাদের এঁদো কলেজের সর্বকালের সেরা রেজাল্ট হয়েছিল। সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে এসেছিলাম আমরা প্রায় বিশজন কিন্তু ট্র্যাজেডি হল, কোথাও দুইজন একসঙ্গে চান্স পাই নাই মৌসুমি জগন্নাথে চান্স পেয়েও কারমাইকেলে ভর্তি হইয়েছিলওর কেন ঢাকাভীতি বলে নাই কোনোদিন। ভ্যাটেনারি, এগ্রিকালচার এসবের তখন খুব ডিমান্ড। ওসবে ভর্তি হয়েছিল কয়েকজন ঝিনুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি জাহাঙ্গীরনগরে।

যা হয়, সবার সঙ্গেই যোগাযোগ কমে গেল। ছুটিতে বাড়ি গেলে অল্প কিছুক্ষনের জন্য দেখা হত। শুধু ঝিনুকের সঙ্গেই নিয়মিত দেখা হত, ও চলে আসত আমার হলে, দুই একদিন থেকেও যেত। তারপর সবই কমে গেল। পাশ করে বেরিয়ে দুই হাজার পাঁচ সাল নাগাদ আমরা চাকরি-বিয়ে-সংসার নিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম। আমাদের বরেদের সঙ্গে নিয়ে একবার উল্লাপাড়ায় গেট টুগেদার করলাম। সেখানেই ঝিনুকের সঙ্গে আমার বর পাভেলের দেখা। পরে পাভেল বলেছিল, ‘ঝিনুক অদ্ভুত!’ সেটা নিয়ে ঝিনুককে ফোন করে আমি খুব হাসাহাসি করেছিলাম- ‘ওই আমার বর তোরে অদ্ভুত কইছে!’ ঝিনুক বলেছিল- ‘দাড়া অরে পায়া লই!’

তারপর আরো অনেকদিন গেছে। আমরা সব চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। পনেরো সালের দিকে একদিন ঝিনুক ফোন করে বলল, ‘আমার কিছুই ভালো লাগেনা!’ আমি বেশি পাত্তা দিলাম না। বললাম, ‘চল্লিশ ছুঁই ছুইয়ে এমন হয়, ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর ওর কলেজ, দুই মেয়ে আর বরের খোঁজ নিয়ে কথা শেষ করার আগে বললাম- ‘আর প্রেমে ট্রেমে পড়ে থাকলে, বেরিয়ে আয় বাপু’ আর অনেকদিন কথা হয় নাই। তারও প্রায় ছয়মাস পরে একদিন পাভেল বাসায় এসে বলল, ‘ঝিনুক অন্ধ হয়ে গেছে!’ নাটক সিনেমায় যেমন দেখা যায়, দুঃসংবাদ শুনে হাতের গ্লাস, প্লেট, বাটি পড়ে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যায়, ঠিক সেরকম আমার হাতের কাঁচের গ্লাস মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। পুরা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল। এত কষ্ট হল যে, কথা বলতে দীর্ঘ সময় লাগল। শান্ত হয়ে এলে জানলাম, পাভেল আজ গেছিল ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ওর এক কলিগকে নিয়ে। সেখানেই ঝিনুককে দেখেছে। আরো যেন কী কী বলল, আমার কানেই গেল না সেসব শুধু বললাম, ‘আমি কয়েকটা দিন ঝিনুকের সঙ্গে থাকব’ আমার শুধু মনে হতে লাগল, এই ঢাকা শহরেই থাকি দুইজন, তবু আমি ওর খোঁজ রাখি নাই, কি যেন বলতে চেয়েছিল ভালো করে শুনিও নাই

ঝিনুক থাকে বাসাবো, ওর শ্বশুরের পুরান ধরনের একটা দোতলা বাড়ি শাশুড়ি, দেবর, ননদ সবাই আছে মেয়েদের নিয়ে তাই বেশি ঝামেলা নাই ওর মাঝখানে কয়েক বছর নরসিংদীর একটা কলেজে পোস্টিং ছিল মেয়েদের দাদী, ফুপুই সামলেছে এখন পুরান ঢাকার কি জানি একটা কলেজে আছে আমি গেছি ওদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার শেষ দুই বছর যাওয়া হয় নাই

পাভেল বলল, ‘আমি কয়েকদিন ছুটি নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঘুরে আসি, তুমি ঝিনুককে নিয়ে আমাদের বাসায়ও থাকতে পার

আমি মৌসুমিকে ফোন করলাম, জানতে চাইলাম ইদানিং ঝিনুকের সাথে কথা হয়েছে কিনা মৌসুমি বলল, ‘হ্যাঁ ফোন করেছিল একদিন, কি কি যেন বলল, খুব ব্যাস্ত ছিলাম, মন দিয়ে শুনি নাই কেন, কী হইছে?’ হিসেব করে দেখা গেল সেটাও প্রায় ছয়মাস আগে বললাম, ‘কই তুই? আজই ঢাকায় আসতে পারবি?’

মাথা পুরাপুরি ঝিনুকে ভর্তি হয়ে না গেলে মৌসুমিকে এটা বলতে পারতাম না মৌসুমি থাকে রংপুর, তবু সন্ধ্যাবেলা আমি ওকে বলতে পারলাম, আজই ঢাকায় আসতে পারবে কিনা! আর একবার বলে ফেলতে পারলে দেশ পর্যন্ত স্বাধীন হয়ে যায় রাত দশটার সময় মৌসুমি আমার বাসায় চলে এলো এসেই বলল, ‘হারামজাদা, তোকে লাত্থি মারব!’ আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘ঝিনুক অন্ধ হয়ে গেছে!’ ও আবার বলল, ‘হারামজাদা, তোকে লাত্থি মারব’ আমাদের অবস্থা দেখে পাভেল বলল, ‘তোমরা খেয়ে নিয়ে ঝিনুককে ফোন করো’ খেয়ে দেয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে চলে গেল পাভেল আমি আর মৌসুমি গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না এবার ঝাপিয়ে পড়ল আমরা ঝিনুক ঝিনুক করে কাঁদলাম কতক্ষণ তারপর আমার মনে পড়ল মৌসুমি এত তাড়াতাড়ি এলো কীভাবে? বলল, ‘আইসাই তো পড়ছি, আর জাইনা কী করবি? সৈয়দপুর গেছিলাম একটা কাজে, যখন ফোন করলি তখন এয়ারপোর্টের পাশ দিয়া যাইতেছিলাম, গাড়ি থাইকা নাইমা দৌড় দিছি, টিকিটও পাইছি

সাড়ে এগারোটার সময় ফোন করলাম ঝিনুকের বর আনিস ভাইকে কেমন আছেন বলতে গিয়ে নিজের গলায় ঝাঁঝ টের পেলাম মানে মনে মনে সবকিছুর জন্য অলরেডি তাকে দায়ি করে ফেলেছি ঝিনুক ঘুমিয়ে পড়েছে জানিয়ে আনিস ভাই আমাদের সঙ্গে কথা বললেন, জানলাম, খুব দ্রুত কমেছে চোখের জ্যোতি প্রথমে চশমার পাওয়ার বাড়ছিল দ্রুত, প্রায় প্রত্যেক মাসে চশমা বদলাতে হয়েছে ডাক্তার বারবার বলেছেন, এটা অস্বাভাবিক, ছানি নাই, ব্যাথা নাই, কিচ্ছু নাই এরকম হওয়ার তো কথা না! সকালে আমরা আসব জানিয়ে আমি বললাম, কয়েকটা দিন আমরা তিনজন কোথাও থেকে ঘুরে আসব, ঠিক আছে আনিস ভাই?

‘আচ্ছা’ বলে বললেন, ‘কলেজে যায় এখনও, আমি দিয়ে আসি, নিয়ে আসি পড়াতেও পারে, অনেক বছর ধরে পড়াচ্ছে তো কিন্তু খাতা কীভাবে দেখবে, বলো?’ ‘কেমন যেন একটা হাসি হাসি গলা হারামজাদা আনিসের!’- ফোন রেখে বলল মৌসুমি মানে আমরা দুইজনেই মনে মনে আনিস ভাইকে দায়ী করছি! অবশ্য মৌসুমির হারামজাদা শুনে বোঝা যায় না কিছুই, ওর আদর, ভালোবাসা, রাগ সবই হারামজাদা।

রাতে পাশাপাশি শুয়ে মনে হল, কোনোদিন মৌসুমির সঙ্গে রাতে থাকা হয় নাই। অনেক অনেক দিন পর আবার সিগারেট খেলাম, মৌসুমি খায়ই বলল, ‘আজ পাঁচ ট্রাক চাল ঢাকায় রওনা করানোর কথা ছিল, সৈয়দপুর আসছিলাম সেই কাজে। আজমকে সব বুঝাইয়া দিয়া আসছি, কী করছে কে জানে!’ আমি বললাম, ‘গুল্লি মার তোর চালের ট্রাকে

পুরা চালের ব্যাপারীদের মতই বিড়িতে টান দিয়ে মৌসুমি আবার বলল, ‘তোরে লাত্থি মারব, হারামজাদা, ঢাকায় থাকিস তাও ঝিনুকের খোঁজ রাখিস নাই ক্যান? কাজবাজ তো নাই কোনো, বালের লেখক হইছ!’

সকালে জামা কাপড় ভরলাম একটা ব্যাগে। মৌসুমি প্রায় এক কাপড়ে চলে এসেছে, গোসল করে আমার জামা পরল। মেয়েকে বললাম, ‘কয়েকটা দিন বাবার সঙ্গে থাক, আমি একটু যাই?’ মেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার বন্ধু ভালো নাই, বাবা বলেছে।’

ঝিনুকের বাসায় পৌঁছালাম দশটার দিকে। তার আগে ফোন করে টরে মৌসুমি তার চালের ডিলার এক লোককে পাঠিয়ে একটা বার্থ জোগাড় করল চিটাগংয়ের দুপুরের ট্রেনের। প্রায় দুই বছর পর ঝিনুকের সঙ্গে দেখা, মৌসুমির সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছর পরে। ঝিনুককে দেখে মৌসুমি কথা বলতে ভুলে গেল। হারামজাদা বলে আদর করল না। বুড়া হয়ে গেছে আমাদের ববিতার মতো ঝিনুক! অর্ধেক চুল পাকা, জামা কাপড় আর চেহারায় রাজ্যের অযত্ন! আমি সব ভুলে ওর চোখের দিলে তাকিয়ে রইলাম! কী হয়েছে সেখানে? যেন সারারাত অনর্থক জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে বাতি। মৌসুমি পুরা চুপ হয়ে গেছে। আমি ঝিনুকের মেয়েদের সঙ্গে কথা বললাম, আদর করলাম, ওর শাশুড়ি আর বাড়ির অন্যদের সঙ্গেও কথা বললাম, আনিস ভাই সবাইকে আগেই বলে রেখেছেন কয়েকদিন ঝিনুক আমাদের সঙ্গে থাকবে। ট্রেনের সময়ের ঘন্টাখানেক আগে বেরোলাম আমরা, ঝিনুকের বড় মেয়ে মায়ের ব্যাগ গুছিয়ে দিল।

ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর কথা বলল মৌসুমি, ‘একটুও দেখিস না ঝিনুক?’

‘শুধু সবুজ রঙ দেখি!’ বলল ঝিনুক। এবার আমি বললাম, ‘শুধু সবুজ রঙ দেখিস মানে কী? চোখ বন্ধ করলেও দেখিস? ডাক্তারকে বলছিস এটা?’ তিন প্রশ্ন একসঙ্গে করে ফেলে দেখি মৌসুমি রাগ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে নিজের গালে চড় কষালাম, জীবনভর গাধা আমি! মৌসুমি বলল, ‘কী হইছে ঝিনুক, বলবি না আমাদের?’ ঢাকা থেকে চিটাগং যেতে যেতে ঝিনুক আমাদের যে গল্প বলল, সেটা নিজের ভাষায় বলার সাধ্য নাই আমার। ওর বয়ানেই সেটা শুনতে হবে।

‘তার নাম আমি তোদের বলব না, আমি ডাকি মধু। ডাকি মানে ডাকতাম, ছয়মাস হল আর ডাকতে পারি না। ডাকতে না পেরে গলা শুকিয়ে আসে আমার!’

এটুকু বলে থামল ঝিনুক। কষ্টে নাকি রাগে বিকৃত হয়ে গেছে ওর মুখ। আমি আর মৌসুমি কোনো কথা বললাম না। কিছুক্ষণ পর আবার কথা বলতে শুরু করল ঝিনুক, “যখন নরসিংদী পোস্টিং ছিল তখন ট্রেনে যাতায়াত করতাম মধুর সঙ্গে প্রথম দেখা ট্রেনেই। সেদিন আমার পাশের ছিটে যে ভদ্রমাহিলা বসেছিলেন তাকে সি অফ করতে এসেছিল সে। খুব যত্ন করে তাকে বসিয়ে দিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিল, স্টেশনে যেন তাকে নামতে সাহায্য করি। মহিলা তার ফুপু। সারাপথ আমি ওর ফুপুর সঙ্গে গল্প করতে করতে গেলাম। তিনি শুধু মধুর গল্পই করলেন! তার গল্প শুনতে শুনতে দুনিয়া বদলে গেল আমার! স্টেশনে নেমে তিনি মধুকে ফোন করে জানালেন ঠিকমত পৌঁছানোর খবর। আমাকে বললেন, বাসায় এসো অবশ্যই আর তোমার ফোন নম্বরটা আমার ফোনে লিখে দাও। আমি তার ফোন নিয়ে আমার নম্বর সেভ করে দিয়ে, মধুর নম্বরটা মুখস্থ করে ফেললাম

মধুর ফুপুকে রিকশায় তুলে দিয়ে আমিও রিকশা নিয়ে কলেজে যেতে যেতে মধুর নম্বর সেভ করলাম আমার ফোনে। পরের দিন ট্রেনে উঠে আমার শুধু ওকেই মনে পড়তে লাগল। নিজেকে ফোন করিস না, করিস না বলতে বলতে ফোন করে বসলাম। তারপর থেকে কথাই বলতে লাগলাম শুধু, দিন নাই রাত নাই, সকাল নাই সন্ধ্যা নাই, কথা আর কথা। কখনও ফোনে গলা শুনে শুনে, কখনও লিখে লিখে। তারপর শুরু হলো দেখা হওয়া। সপ্তাহে এক দিন সে ট্রেনে করে আমার সঙ্গে নরসিংদী যেত, ফুপুর সাথে দেখা করে টরে আবার আমার সাথেই ফিরত। তারপর শুরু হল কলেজ ফাঁকি দিয়ে ওর বাসায় চলে যাওয়া। আপাদমস্তক আমার জীবন হয়ে গেল মধুময়। নানান অজুহাতে আনিসকে শারিরীকভাবে এড়াই, ভাল্লাগেনা মধুছাড়া আর কারো স্পর্শ! মনে হতে থাকে পৃথিবীর সবকিছু স্থগিত হয়ে গেছে, শুধু আমার মধুময় জার্নি চলছে। মধু মাঝেমাঝে জানতে চাইত আনিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন, আমি বলতাম চমৎকার। অন্যকোনো অ্যাফেয়ার আছে কিনা, ছিল কিনা তাও জানতে চাইত, বানিয়ে বানিয়ে বলতাম আছে, ছিল সে খুব উৎসাহ দিতমাঝেমাঝে মনে হত সে আমাকে খুব ভালোবাসে, আবার মনে হত বাসেই না।

দুই বছর গেছে এমন করে। তারপর একদিন মধু বলল, আমাদের থামা উচিত, প্রথমে এসো সাতদিন চেষ্টা করে দেখি। আমিও বললাম, আচ্ছা। সাতদিন খুব কষ্ট হল, তবু ফোন করলাম না। এই ভেবে ভেবে কাটিয়ে দিলাম যে, সাতদিন পরে বলব, আমি পারব না। ভাবলাম, মধুও বলবে আমিও পারব না। সাতদিন পরে আমিই ফোন করলাম প্রথমে, ফোন নট রিচাবল। ভাইবার, হোয়াটসাপ, মেসেঞ্জার কোথাও নাই সে। বাসায় গিয়ে দেখি বাসা ছেড়ে দিছে! ফুপুর বাসায় গিয়ে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তিনি উঠে গেলে, তার ফোনটা নিয়ে খুঁজে দেখি অন্য কোনো নম্বর মধুর নামে সেভ করা আছে নাকি, নাই! ফুপু নিজে থেকেই বললেন- ছেলেটা কেন যে ফোন করতেছে না। তারপর থেকে শুরু করলাম খোঁজ। ফোনটা সারাক্ষণ আমার হাতে। অনলাইন হয় কিনা তাকিয়ে থাকি। পাঁচ মিনিট পরে পরে ফোন করি। ছবি নিয়ে হাসপাতালে গেলাম, থানায় গেলাম। কোথাও নাই। ফোন থেকে এক মুহূর্ত চোখ সরাই না। দিনের পর দিন ঘুমাই না। রাতের পর রাত কাটে ফোনের দিকে তাকিয়ে। মাসখানেক পরে দেখি চোখে ঝাপসা দেখি, চশমা বদলালাম। তারপর প্রত্যেক পনেরোদিনে চশমা বদলাতে হল। তারপর এক সময় দেখি কিছুই আর দেখি না।

আমার ভেতরটা এত খালি খালি লাগতে লাগল! এর মধ্যে আব্বা মারা গেল, আমার তখন মধুকে হারানোর বেদনাই একমাত্র অনুভুতি। আব্বার চলে যাওয়ার কষ্ট টেরই পেলাম না!’’

দীর্ঘ পথ ঝিনুকের কথা শুনতে শুনতে বধির হয়ে গেলাম আমরা ওর ফোনে ছবি দেখলাম লোকটার খুব সাধারন চেহারা, শুধু চোখ দুইটা খুব তীব্র প্রেম কাহিনী শুনে মৌসুমি পর্যন্ত বলল না, ‘তোরে লাত্থি মারব হারামজাদা

চিটাগং স্টেশনে ঝিনুককে কোলে করে নামাল মৌসুমি। হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম ঢাকা থেকেই। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে রিশেপশন থেকে চাবি নেওয়ার সময় খেয়াল করলাম, রিশেপ্সনিষ্ট মেয়েটা অবাক হয়ে আমাদের দেখল। তিনজন প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই ভদ্রমাহিলা বেড়াতে এসেছে, তাদের একজন আবার অন্ধ!

পরেরদিন সকালে গেলাম পতেঙ্গা। বীচে বসে মৌসুমি বলল, ‘কী চাস ঝিনুক? মধুকে খুঁজে বের করে তোর কাছে এনে দেই?’

ঝিনুক বলল, ‘হ্যাঁ!’

মৌসুমি বলল, ‘আচ্ছা!’

আমি অবাক হয়ে মৌসুমিকে দেখছি, ওকে দেখেই মনে হচ্ছে, যেখান  থেকে হোক মধুকে খুঁজে আনবে! একবারও ঝিনুককে বলল না, বর আছে, বাচ্চা আছে, সংসার আছে, মধুকে ভুলে যা। আমি সাহস করে বললাম, ‘মধুকে পেলে কী করবি, ঝিনুক?’ ঝিনুক বলল, ‘খুন করব!’

মৌসুমি হাসতে হাসতে বলল, ‘চোখে তো দেখিস না, তারপর পিস্তল নাই, কীভাবে খুন করবি?’ ঝিনুক বলল, ‘গলা টিপে মারব!’ আমরা তিনজনে মিলে ঠিক করলাম কীভাবে খুন করব মধুকে।

মৌসুমি বলল, ‘একমাস সময় দে আমাকে!’ ঝিনুককে দেখে মনে হল, খুব শান্তি পাচ্ছে ও

তিনদিন পরে আমরা ফিরে এলাম ঢাকায় মৌসুমি চলে গেল রংপুর আমি প্রত্যেক সপ্তাহে ঝিনুকদের বাসায় যাই প্রত্যেকবার ঝিনুক জানতে চায়, ‘মৌসুমি মধুকে পেয়েছে?’

চিটাগাং থেকে ফেরার পর চতুর্থ সপ্তাহে গেছি ঝিনুকের কাছে, গল্পে গল্পে বলছি, ‘মৌসুমি ব্যাবসার কাজে ইন্ডিয়া গেছে, ফিরেই ঢাকা আসবে’ তখনই ফোন করল মৌসুমি ইন্ডিয়া থেকে আমাকে বলল, ‘মধুকে পাইছি! কোলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি, এইডস হইছে হারামজাদার!’ আমার প্রথমেই মনে হল, তাহলে ঝিনুকেরও হয়েছে? চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া এইডসের কারণে?

আমি ঝিনুকের হাতে ফোনটা দিলাম মৌসুমি ওকে কী বলল, জানিনা আমি

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>