| 29 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

জোড়া উপন্যাসঃ মিথ-পুরানের গদ্য কাব্যে মানুষের প্রতিচ্ছবি

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

নাই ঠিকানা ঠিক-ঠিকানা

মাইনষে খোঁজে ঠিকানা,

আন্ধার জলে সান্তার দিলাম

না পাইলাম কূল-কিনারা।

চোখ থাকিতে চোখ পেরেশান

দেখলাম না ভাই কারখানা,

আন্ধার রাইতে ধস্তাধস্তি

জনম আজব কারখানা। (জন্মজাতি)

এই ‘জনম আজব কারখানার’ধ্রুব প্রশ্নের আদি উত্তরের শিল্পীত প্রকাশ মুহম্মদ নুরুল হুদার ‘জোড়া উপন্যাস’। নিরন্তর একটা জিজ্ঞাসা জুড়েনৃতাত্ত্বিক এবং জন্মরহস্যের ধাঁধাঁ, মিথ আর কিংবদন্তি,  জাদুবাস্তব ও উত্তরাধুনিকতার প্রান্তমুক্ততার জাতক ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’। মনুষ্য চরিত্রের পাশাপাশি প্রকৃতিও এখানে সমভাবে প্রাধান্য বিস্তারী চরিত্র; ঠিক যেভাবে উপন্যাসের পুরো অংশজুড়ে পুরাণ-কিংবদন্তি-লোকজ উপাদানকেও চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ঔপন্যাসিক। এখানে রমনীদাস, কিশোর, সোনাবিবি, আমীর মৌলবি,বদনী বুড়ি, ফিরুজাবিবি-মন্নুমাঝিরা যেভাবে আছে, ঠিক সেভাবেই সমান্তরালে প্রদক্ষিণ করেছে চাঁদ-সূর্য-পাহাড়-দরিয়া; সেভাবেই স্থান করে নিয়েছে কিংবদন্তি, পুরাণ, লোক উপাদানের হানিফা-সোনাবিবি, সোহরাব-রুস্তম, মৈনকুমার-মৈনকুমারী,  ইয়াজুজ-মাজুজ, নবি বলী, খোয়াজ খিজির বা অন্যান্যরা। পাহাড়-দরিয়ার সাথে মানবজাতির ইতিহাসের, বিবর্তনেরযে সখ্যতা, প্রাত্যহিকতা, আনন্দ-বিরহের যে সমন্বয় তার উত্থান-পতনের কাহিনী মুহম্মদ নুরুল হুদার‘জোড়া উপন্যাস’ ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jora-upanyas--jonmmojati-moynopahar

মানুষ নামের প্রজাতির সহজাত প্রবণতাগুলোর- হোক তা পশু মানব, তরু মানব বা আলোক মানবের–সব সহজাতকেই লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন তিনি। রমণীদাসের মাধ্যমে যেমন প্রকৃতির সাথে একাত্মতার-অনুভবের বিষয়টি এসেছে, ঠিক তারই বিপরীত প্রান্তে এসেছে থইল্লা ঘোনার ঘটনাদুটি, জয়নব-লোকমান-জমিরালি ও তিনপুত্রের ঘটনাটি, নুন কোম্পানি বা নবি বলীর কৌশলের জয়ে, ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনী।সবগুলোর মুলসূত্র কিন্তু মনুষ্য স্বভাবের সহজাত প্রবণতার ভিন্ন রূপান্তর মাত্র। মানুষ যে শেষপর্যন্ত অন্যসব প্রাণীর মতোই একটা প্রজাতি, বিবেকবোধ থাকলেও তার নিউরোনেও যে প্রত্যহ ডাক দেয় ‘কীকীক’, ‘কীকীক’ বানরের সিগন্যাল, কোষে কোষে সাড়া জাগে, DNA কোডে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে পশুভাব- তাই যেন প্রতিষ্ঠিত হয় ছাগীর সাথে উপগত হওয়ার মাধ্যমে, বা মোষের লড়াই রক্তারক্তি দেখে আনন্দ প্রকাশে, আহত মোষকে জবাই করে তার পৈশাচিক আনন্দ গ্রহণে বা চাঁদের মতো কিরিচের কোপে প্রাণ হরণে, ছলুর সাথে বা যে কোনো উপায়ে যৌনতায়।

উপন্যাসের প্লটজুড়ে রয়েল বেঙ্গলের ডোরাকাটার মতো পাওয়া যাবে উত্তরাধুনিকতা ও জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ। একেবারে বিস্তৃত নয়, তবে ফেলনাও নয়। জাদুবাস্তবতার প্রয়োগে পরিমিতিবোধ উপন্যাসের সোন্দর্যই বাড়িয়েছে। সোনাবিবির বা আমীর মৌলবির জিনের রহস্যে, আরশিবিবি বা আরশি ফকিন্নির আয়নায় দেখানো সূত্র বা তার তথ্যের পথ ধরে কিশোরের যাত্রার মধ্যে যে জাদুবাস্তবতা লেখক দেখিয়েছেন তাতে তার মুন্সিয়ানাই প্রকাশ পায়। গ্রামীণ বাস্তবতায় এসব কুটিলতর চক্রান্তকারী বা স্বার্থ হাসিলের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে যে রহস্য বপণ করা হয় এবং তাতে দৈনিক পানি ঢেলে চর্চা করে বিশ্বাস স্থাপন করে একদল যে স্বার্থ হাসিল করে তার অনুপম চিত্রায়ণ করেছেন নুরুল হুদা।

রুপান্তরবাদ এখানে একটা গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। সম্ভবত উপন্যাস দুটি মিলে এই যে আদিমতার মুলসুর পুরো প্লটজুড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে চলেছে, সেই সোয়েটারের মূল সুতোটি যেটি ধরলে পুরোটা খুলে আসে, সেটি আসলে রূপান্তরবাদ। বিবর্তনের আদিসত্য বা অভিব্যক্তিবাদও । আর সেখানে অবধারিতভাবে চলে এসেছে ‘ Natural selection‘ বা ‘transmigration of the soul’ এর বিষয়টিও। তবে প্রতিপাদিত এখানে প্রকৃতপক্ষে‘transmutation of spieces’।নিজের ইচ্ছার অধীনতার এ বিষয়টি সম্ভবত প্রথম পেয়েছিলাম আমরা রবীন্দ্রনাথে। চিত্রাঙ্গদায় কী আশ্চর্যভাবে এ রূপান্তরবাদ ছিল! লৈঙ্গিক রূপান্তর ইচ্ছার মতো আধুনিক একটা বিষয় তখনই রবীন্দ্রনাথ এনেছিলেন তাতে। মৈনপাহাড়েও আমরা পাই এমন মৈনকুমার-মৈনকুমারীর কিংবদন্তি।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jora-upanyas--jonmmojati-moynopahar

রূপান্তরবাদের তত্ত্বটি লেখক উপন্যাসের প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রকে আরোপ করেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল ছিল অবশ্যই কিশোর। তবে অন্যেরাও কম যায় না। একজম রমণী দাস, যিনি লাল রক্তের হয়েওকরতে চেয়েছেন সাদা রক্তরসের অর্জন, হতে চেয়েছেন তরুমানব না আলোমানব। কিশোর তো পেশার পরিবর্তন পর্যন্ত করে ফেলে রূপান্তরের ফাঁদে। আক্তার মাঝির ছেলে পরিণত হয় জেলে কিশোরে। যে আক্তার মাঝিকে টেনে নিয়ে যায় স্থলের নিয়তি, সেই মাঝির ছেলে টেনে নিয়ে আসে দরিয়ার কোরালের নিয়তি। রুপান্তরবাদের প্রধানতম দিকই হচ্ছে ‘যৌনতা ও সংমিশ্রণ’।  জন্মজাতি’ বা ‘মৈনপাহাড়’ উপন্যাস জোড়াতে যুগপতভাবে সেই আদিমতার ঘ্রাণই আমরা পাব। এ ঘ্রাণ অবশ্যই শহরের পালিশ করা সেই পারফিউমের ঘ্রাণ নয়, আদিম-উমত্ত-মাতাল বুনো হাতির মস্তের মতো তীব্র ঝাঁঝালো শারীরীয় ঘ্রাণ। শুধু সমকামিতা নয়, শারীরিয় অন্য প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলো যেমন, হস্তমৈথুন এমনকি গৃহপালিত পশুর সাথে করা অনাচারকেও বুনে দিয়েছেন উপন্যাসের কাহিনীতে। যদিও শারীরিয় বর্ণনাগুলোর একটা আলাদা প্যাটার্ন আছে নুরুল হুদার। বিশেষ করে এ ব্যাপারে তিনি কোনো রাখঢাক রাখেননি, মানেননি কোনো ট্যাবু। প্রাণীর একমাত্র আদিম এই প্রবণতা যার মাধ্যমে পৃথিবীর সৃষ্টিশীলতা  চলমান থাকে, বহমান থাকে প্রাণের কলরব। তাই ঔপন্যাসিক শারীরকে প্রকৃতির অংশ বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইমেজগুলোও তাই তৈরি করেছেন সেভাবেই-

১। মৌলবি রা-টি করে না। তার খুব ভয় করে।ইহকালের ভয়, পরকালের ভয়, মান-ইজ্জতের ভয়। সোনাবিবি তার বুকের সোনা মৌলবির মুখে পুরে দেয়। মুখ ভরে যায়।সোনা পিচ্ছিল হয়ে যায়। ততক্ষণে ফুঁসে ওঠা দাঁড়াশ সাপটিও পোষ মানে। অবলীলায় গর্তে মুখ লুকায়।একসময় নারীর কবরে পুরুষের মুর্দা সেঁধিয়ে যায়। (জন্মজাতি)

২।বিছানায় দুটি ছায়া নড়ে। একটি ছায়া উপরে, একটি নিচে। নিচের ছায়াটিকে মনে হয় ছোট্ট একটা সাম্পান। তার আকিল আছে, আছে পাছিল। পাছিলের দিকটায় দুইপা উঁচু করে ছায়া-সাম্পান। সেই সাম্পানের পাছিলে বসে আছে আরেক ছায়া। মাঝি-ছায়া। ছায়া-সাম্পানের পাছিলে সওয়ারী সেজেছে মাঝি-ছায়া। সে দাঁড় বায়। উঠ-বস করে। সেই দাঁড়ের শব্দ পাওয়া যায়। লগির ঘাইয়ের শব্দ। সাম্পান শব্দ করে ক্যাঁৎ-কোঁত।ছায়ার সঙ্গে ছায়ার কুস্তি। দুস্তি। দু দোস্তের লড়াই। সেই লড়াইয়ের হুঙ্কার। ছায়া-হুঙ্কার। (জন্মজাতি)

ফিরুজাবিবি বা মন্নুমাঝির মিলনের দৃশ্যটি এর চেয়ে শিল্পীত হয়ত করা যেত না। প্রকৃতির আশ্রয়ে বা বস্তুগত বিররণে আকারে ইঙিতে তিনি আদিমতার যে চিত্রগুলোঅঙ্কন করেছেন, প্রত্যেকটিই এমন গোছানো এবং অবশ্যই সরল চিত্রকল্পে, কোনোরকম ডেথ ইমেজ বা কমপ্লেক্স ইমেজ ব্যবহার না করেই।

আমাদের সাহিত্যে নারী যেভাবে এসেছে বা নারীর দেহের বর্ণনা যেভাবে বিস্তারিত, ইনিয়ে-বিনিয়ে বা ইঙিতে এসেছে ঠিক সেভাবে তো দূরের কথা তার তিল পরিমাণও আসেনি পুরুষের দেহজ বর্ণনায়। নারীও যে পুরুষের দেহবায়বের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, আগ্রহী হয়ে ওঠতে পারে বা পুরুষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে-পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে তা উঠে আসতেই পারেনি। উল্লেখযোগ্যহারেঅবস্থার পরিবর্তনের পরেও, যেহেতু বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন যুগ থেকে নারী লেখকের সংখ্যা কম ছিল, ফলে সাহিত্যে নারীর শরীর যে মোহনীয়তা নিয়ে, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে , যে অবয়ব, উত্তেজনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, পুরুষ দেহ ততই অনুপস্থিত। অথচমনুষ্যজাতি প্রজাতি হিসেবে নারী তো শুধু অর্ধ একটা অংশ, যার পূর্ণতা আসে প্রজাতির অন্য অংশ পুরুষ দ্বারা। প্রজাতির ইতিহাস রক্ষায় নারী-পুরুষ দুটোর অংশগ্রহণই সমান মর্যাদাপূর্ণ। ফলে সাহিত্যেও পুরষতান্ত্রিকতার যে সূক্ষ্ম আগ্রাসন তারই ফল বাংলা সাহিত্যে পুরুষের শরীরের অনুপস্থিতি।তবে সেসব থেকে ‘জন্মজাতি’ বা ‘মৈনপাহাড়’ একেবারেই আলাদা।  নুরুল হুদা যেন একেবারে উলটো পথেই হাঁটা ধরলেন। শুধু নারী-পুরুষের দেহজ ব্যাপার নয়, দুই প্রজাতির আকাঙ্ক্ষা, প্রজনন, শারীরিয় চাহিদা এবং তার স্বীকৃতি তিনি যে সাহসিকতার সাথে দিয়েছেন, তা এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে এতটা সাবলীলভাবে আসেনি। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা আরো সহজ করা যায়। সোনাবিবির চোখে আমীর মৌলবিকে লেখক চিত্রায়ণ করছেন এভাবে_

সোনাবিবি প্রথমে মৌলবির পায়ের দিকে তাকায়। বেশ পুরুষ্টু দুটি পা। ফরসা। মৌলবির লুঙ্গি গোড়ালির উপরে। বলা যায়, হাঁটু ও গোড়ালির মাঝখানে। লুঙ্গি গোড়ালির নিচে পড়া মাকরূহ। তাতে লুঙিতে না-পাক জিনিস লেগে যেতে পারে। গোড়ালির দিকটা যত ফরসা, উপরের দিকটা তার দেড়্গুণ ফরসা। নিশ্চয়ই লুঙিতে ঢাকা উপরের অংশ আরো ফরসা। হাঁটু ও গোড়ালির মাঝখানটা বেশ মাংসল। তার পরের অংশ দেখা যায় না। তবে যেটুকু দেখা যায়, তা থেকে অনেক কিছু আন্দাজ করা যায়। বোঝা যায়, হাঁটুটাও হবে বেশ গোলগাল। হাটুঁর উপরের অংশটা কেমন হবে? হাতির দাঁতের মতো ফরসা আর পুরু হবে নাকি? হবে হয়তো-বা। তবে হাঁতির দাঁতের মতো শক্ত হবে না নিশ্চয়ই। হলেও বা ক্ষতি  কী? পুরুষের শরীর তো শক্ত হওয়াই ভালো। নারী হবে কলাগাছের মতো।নরম, তুলতুলে। হাতের কাছে পেলেই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হবে। আর পুরুষ হবে গর্জন কাঠের মতো। শক্ত, সুঠাম আর দীর্ঘ। আমীর মৌলবি অবশ্য দীর্ঘদেহী নয়। পুরোপুরি গর্জন নয়। তবে প্রায়-গর্জন।

মৌলবি ঘরে ঢোকার আগে দরোজার সামনে রাখা কাঠের গুঁড়ির উপর দাঁড়ায়। এখন আবার পায়ে পানি ঢালতে হবে।  শেষবারের মতো পাক-সাফ হতে হবে। পা ধোয়ার জন্য বিশেষ ভঙিতে সামনে নত হওয়ার কারণে মোলবির কোমর ও পেছনের অংশটা স্পষ্ট দেখা যায়। বেশ দশাসই। যেন যুগলটিলা। তার মাঝ বরাবর কাপড়টা একটু দেবে আছে। আরেকটু নিচে কই যেন ঠেকে আছে। একটু উঁচু মতো। কী যেন ফুঁড়ে বেরুতে চায়।বাজারের থলিতে রাখা ঝিঙে বা চিচিঙা বা পটলের মতো।  সোনাবিবি একটু লজ্জা পায়। কিন্তু চোখ ফেরায় না। কেন যেন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। হঠাত অস্তগামী সূর্যের আলোকচ্ছটা উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। সেই আলোতে মৌলবির বাঁকানো শরীর রামধনুর মতো বর্ণিল হয়। আকাশের রামধনু নেমে আসে ধরার ধুলায়। সেই রামধনুর দিকে লোভাতুর চোখে তাকায় এক মানবী। মানবীর নাম সোনাবিবি।

এই যে আমীর মৌলবির শারীরিক বর্ণনা এবং সোনাবিবির তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, এর পুরোটাই তো শরীর বৃত্তি থেকেই। নারীরও যে এই শরীর বৃত্তিকাজ করতে পারে, পুরুষের শরীরকে এভাবে বর্ণনার চোখে বয়ানে আনতে পারে, তার বিবরণ ‘জন্মজাতি’র অনন্যতা নিঃসন্দেহে।

শারীরিয় বর্ণনার ব্যাপারে তার যে কোনো ট্যাবু নেই, তার অন্যতম প্রমাণ কিশোর। কিশোর চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’ উপন্যাস দুটিকে সংঘবদ্ধ করেছেন। আদিমতায় লেখক কতটা সাহসী তার প্রতিবিম্ব কিশোর চরিত্রটি। লেখক ছলুর সাথে কিশোরের সম্পর্কের ব্যাপারটিকে ‘জন্মজাতি’ তে ইঙিতে রাখলেও ‘মৈনপাহাড়’ এ লেখক আর কোনোরকম তোয়াক্কাই করলেন না যেন, একেবারে রগরগে সমকামিতার বর্ণনা আনলেন। কিশোরের শরীরের বন্য পশুত্বের কাছে অসহায়ত্ব আর ছলুর অর্থনৈতিক অসহায়ত্বকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক আদিম আখ্যান তৈরি করে, যার দমকে দরিয়ায় মাঝে মাঝেই দুলে উঠে কিশোরের নৌকা_

ছলু গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। সে ঘুমোচ্ছে উপুড় ভঙিতে। লুঙিটা পিঠের উপর উঠে গেছে।দুইপা ফাঁক হয়ে আছে সুবিধে মতো।থম্বুর কথা মনে পড়ে।তার চলে যাবার কথা। দুলে –ওঠা পেছনের  কথা।

চোখের সামনে সর্ষে ফুল।

চোখের সামনে জুনিপোকা।

কিশোর তার কাজ শুরু করে।

নৌকাটা এমনভাবে দুলে ওঠে, যেন জালে বড়সড় একটা মাছ পড়েছে। ছলু একটু গাঁইগুঁই করে। সামান্য ককিয়ে উঠেই থেমে যায়। সে চোখ খোলে না। চোখ খোলার দরকার পড়ে না।  ব্যাপারটা এমনিতেই টের পেয়ে যায়। সে জানে, এখন প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না। সে বরং পা দুটো আরেকটু ফাঁক করে কোমড় উঁচু করে রাখে।

কয়েক মুহূর্ত।

তারপরেই নেতিয়ে পড়ে কিশোর। শরীরের সেই বদরাগী সাপটা পোষ মানে। তরতর করে জল হয়ে বয়ে যায়।  (মৈনপাহাড়)

প্রকৃতপক্ষে মানুষের আদিমতার এক অসাধারণ গদ্যকাব্যগাঁথা নুরুল হুদার ‘জোড়া উপন্যাস’। ‘জন্মজাতি’ বা ‘মৈনপাহাড়’ আক্ষরিক অর্থেই মানুষের সহজাত প্রবণতাগুলোর শিল্পীত প্রকাশ। উপন্যাস দুটি জুড়েই নানা জনের সাথে এই যে সম্পর্কের নানা জাল বুনেছেন লেখক, রমনীদাসের সাথে প্রকৃতির, ফিরুজাবিবির সাথে আক্তার মাঝি বা মন্নুমাঝির, আমীর মৌলবির সাথে সোনাবিবির, কিশোরের সাথে মন্নু মাঝি বা ছলুর বা কল্পনার থম্বুর, এ সবই শেষ পর্যন্ত একটা বিন্দুতে এসে মিলে যায়_ প্রাকৃতিক শারীরিয় বৃত্তিতে। মানুষের আদিম সেই বিন্দুতেই গিয়ে শেষ্পর্যন্ত সব মিলিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়ে যায়।

জন্মজাতির জন্য রমণী দাস যদি হয় ট্রাম কার্ড, কিশোর চরিত্রটি তবে লেখকের লম্বা রেসের ঘোড়া। কারণ, কিশোরের মাধ্যমেই লেখক ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’কে কার্যকরণসূত্রে বেঁধেছেন।কিশোর আসলে ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়ের’ মাঝের সংযোগস্থাপক সেতু।  রমণী দাসকেই ‘জন্মজাতি’র প্রধান চরিত্র বলা যেতে পারে। ঝিকঝিক রমণী দাসের লুসাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসকুলের দপ্তরি রমণীদাসে রূপান্তর যেন একটা বিস্ময়।একটা ইঙিতও কী রাখেন লেখক? দেহজ কামনা থেকে মুক্ত হতে পারলেই কেবল হওয়া যায় তরুমানব বা আলোকমানব?এই যে বরকেতা গাইন চরিত্রটি যে উপন্যাসে সশরীরে কোথাও উপস্থিত না থেকেও পুরো উপন্যাসে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে চরিত্রগুলোকে, রমণী দাস বা কিশোরকে, তার চরিত্রায়ণ করেছেন আগাগোড়া লালনের মতো করে। সম্ভবত শারীরিক উপস্থিতি না রেখেও উপন্যাসযুগলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র এই বরকেতা গাইন। বাউল দর্শনের দেহতত্ত্বের ব্যাপক প্রভাব রমণীদাসের মধ্যে স্পষ্ট। আমিষ বর্জন, শারীরিয় কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক প্রাণের সাথে একাত্ম অনুভব করার মধ্য দিয়েই যে বৈষ্ণব বা সুফি ঘরানা ও বৌদ্ধ সংমিশ্রণের প্রভাব বাউলতত্ত্বে আছে, তারই প্রতিফলন রমণীদাস। ঔপন্যাসিক তাঁর স্বভাবসুল্ভ সরল গদ্যে রমণীদাসের সাধনা সম্পর্কে বলছেন_

তরুলতার দেহে মানুষের মতো লাল রক্ত নেই।যা আছে তা অত প্রগাঢ় নয়। তরুলতা তাই রক্তাক্ত হয় না। যে রক্তাক্ত হয় না, সে অত কষ্ট পায় না। কথাটা রমণীদাসের মনে ধরে। সে-ও নিজেকে ঐ তরুলতার স্বগোত্রীয় ভাবতে চায়। সেই থেকে তরুগোত্রীয় হওয়ার সাধনাই রমণীদাসের সাধনা।

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো এখানে সবাই এক শৃঙ্খলে বন্দি এবং পারস্পারিক অসহায়ত্বে  একে-অপরের সাথে যুক্তও বটে। নিয়তির এক অসামান্য গ্রন্থিত গদ্য ’জোড়া উপন্যাস’। সেখানে জলের কোরাল আর স্থলের বাউলের মধ্যে এক অরূপ কল্পনা করেন ঔপন্যাসিক। তাই টাংগি জালের ফাঁদে আটকে পড়া কোরালের নিঃশেষিত শক্তির নিয়তি মেনে নেবার সাথেতাই একাত্ম হয়ে যায় বাউল সাধকের উদাসীন দৃষ্টি।  চিত্রকল্পে তাদের খোঁজ, তাদের চোখের সীমানা যেন তখন এক হয়ে যায় নীল সীমানায়।  কিশোরের হাতে বন্দি-পরাজিত এই কোরালটার মুক্ত থাকার কথা নীল দরিয়ায় কিংবা পাখিরাও থাকবে মুক্ত নীল সীমানায়; কিন্তু তারাও চক্রাকারে বন্দি হয়-নিয়তির হাতে ধরা দেয়। খাদ্যশৃঙ্খলে আটকে পড়া এই পৃথিবীর সব জীবের অসহায়ত্ব, তাদের একে-অপরের সাথে জুড়ে যাওয়ার  বৈজ্ঞানিক সত্যের এক দারুণ ইঙিত রয়েছে উপন্যাসে।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jora-upanyas--jonmmojati-moynopahar

রমণীদাসের ঝিকঝিক থেকে একেবারে দেহজ কামনা থেকে মুক্ত হওয়ার পর, অর্থও দান করে দেন স্কুলের জন্য। আমিষ গ্রহণ করা ছেড়ে দেন প্রাণ হরণের মায়া থেকে। খুঁজতে থাকেন জন্মের রহস্য বা অতিলৌকিক বিষয়ে। আমিষজাত লাল রক্ত থেকে তিনি হতে চান শ্বেত বা সাদা রক্তের প্রাণ, পশুর রক্তের পাশবিকতা থেকে মুক্ত হয়ে হতে চান মানবিক, সৃষ্টশীল তরু না আলোকমানবে এবং জন্মজাতির শেষদিকে তাকে তরুমানুষে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটা বৃহৎ ইঙিত রেখে যান লেখক। কারণ, রমণীদাসকে তিনি গৃহী করে তোলেননি, সম্পূর্ণ এক মুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যার কোনো বন্ধন নেই, দেহজ বাসনা নেই, আছে শুধু প্রকৃতিতে একাত্ম হবার বাসনা। সে অর্থে রমনী দাস যেন হয়ে উঠেছে বিংশ শতাব্দীর গৌতম বা চৈতন্যদেব। বৈষ্ণব বা ব্রহ্মাচারীদের মধ্যেও এমন আমিষ বর্জনের এই দিকটা পাওয়া যায়। শারিরীক উত্তেজনাকে প্রশমনের জন্য, পাশবিকতাকে নমনের জন্য বাউলতত্ত্বেও দেহবাদের অংশে তা পাওয়া যায়। এই আলোকমানব বা বৃক্ষমানব এর ধারণা কিন্তু কোরিয়ান ঔপন্যাসিক হ্যান কাঙ এর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ (২০১৫) এর ইয়াঙ-হাই চরিত্রেও আমরা ব্যাপকভাবে পাই। তবে তার পরিণতি এবং ব্যবহারে সে দেশের  সংস্কৃতির প্রভাবতীব্র, যা রমনীদাসে নেই। এক শান্ত, সৌম্য এবং প্রভাব বিস্তারী চরিত্র হিসেবে আমরা রমনীদাসকে পাব জন্মজাতিতে। মৈনপাহাড়ে যার উত্তরসূরী হিসেবে পাব আমরা কিশোরকে। প্রত্যেকে লেখকেরই উপন্যাসে কাঙ্খিত একজন চরিত্র থাকে বা উপন্যাসে এমন একটি চরিত্র স্থান পায়, যাতে লেখকের ব্যক্তি চরিত্রের অভিজ্ঞতার ছাঁয়া পড়ে। সম্ভবত ‘জন্মজাতি’তে রমনীদাস ও ‘মৈনপাহাড়’এ কিশোর ঔপন্যাসিকের সেই চরিত্র। রমণীদাস তার আকাঙ্ক্ষা আর কিশোর তার বাস্তবতার।রমনীদাস যেমন মুক্ত হয়ে যাচ্ছে দেহজ বাসনা থেকে, কিশোর তেমন তা অস্বীকার না করে বরং জৈবিক বিষয়টিকে বাদ দিচ্ছে না, হস্তমৈথুন করছে, সমকামি হচ্ছে, নারীদেহ নিয়ে কল্পনায় লিপ্ত হচ্ছে, সোনাবিবির দারস্থও হচ্ছে-এবং মেনে নিচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। যে কিশোর জন্মজাতিতে মন্নুমাঝি অর্থাৎ তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে গ্রহণ করতে পারছে না, সেই আবার মৈনপাহাড়ে ভাবতে শিখছে_

না, কারো কোনো দোষ নেই। কিশোরের কেমন যেন স্বাভাবিক মনে হয় সবকিছু। যে আকস্মিক যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে রাতবিরেতে জাপটে ধরে আরেকটা শরীর, সেই যন্ত্রণা থেকে সঙ্গতভাবেই মুক্ত নয় অন্যরাও। অন্য কোনো মানুষ। অন্য কোনো নর বা নারী। (মৈনপাহাড়)

অলৌকিকতার প্রতি একধরনের সন্ধানের প্রবণতা দেখা যায় পুরো উপন্যাস জুড়ে। ধরা দেয়, আবার দেয় না। বাউলদের সঙ্কেত ভাষার মতো। ধোঁয়াশা, পুরোটা বুঝে শুধু সাধকজন। অনেকটা চর্যাপদের সেই সান্ধ্যভাষার মতো। বিশেষ করে বরকেতা গাইন চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সেই খোঁজ একটা দর্শনে উপনীত হয়। তার গাঁথা কথামালার মধ্য সেই লৌকিক ধাঁধা জড়ানো হেয়ালিপূর্ণ পদের মধ্যে লালনের প্রভাব সুস্পষ্ট। ফলে সেগুলো আরলৌকিকতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং বহন করেছে এক গূঢ় অর্থ। এই যে নবী বলির কাহিনী নিয়ে বরকেতা গাইন পদ বাঁধলেন-

নাইরে জিতা নাইরে হারা

নাই ভাতিজা, চাচা,

ঘুইজ্জা দায়ের নাচন আছে

নাইরে মরা-বাঁচরে

আইস্যেরে ঘোর কালি,ছ

দুই নয়নে নয়ন ঠুলি,

নয়নদিঘির নোনা পানি,

তার ভিতরে পরাণকলি

ও ভাই, কাঁদের ভোমরাকলি।

বা গেয়ে উঠলেন_

ভবের মানুষ, ভাবের মানুষ

দুই জগতের ভাই

একের জগত অন্যে পোষে

দোষে দুজনাই।

ভব করিলে থাকে পাখি

ভাব করিলে যায়,

খাঁচার ভিতর থাইক্যা পাখি

খাঁচা ভেঙে যায়।

এই যে ইশারায় খাঁচার পাখির সাথে ভাব, খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যাওয়া, প্রাণভোমরার নাচানাচি, তার কাঁদা-হাসার কথা বলেছেন, সে ইঙিত কিন্তু সবাই বুঝবে না, তবু সাধারণ মানুষের এই নয়নদিঘির নোনাজলের প্রাণভোমরার কাঁদনে মন খারাপ হয়, তাদের স্পর্শ করে। কিন্তু এই পাখি কেনই বা ভাব জমায়, কেনই বা খাঁচা ভেঙে পালায় বা কোথায় সেই পরাণভোমর, কোথায় সেই নয়নদিঘি?প্রকৃতপক্ষে লালনের সেই পরমাত্মার খোঁজার ব্যাপারটি  বরকেতা গাইনের পদে বারবার স্রোত পেয়েছে, উসকে দিয়েছে এক অলৌকিক খোঁজের সন্ধানকে। এমন অসংখ্য শিল্পগুণ সম্পন্ন পদ পাওয়া যাবে উপন্যাসটি জুড়ে।  এই এক নিরন্তর ধ্রুব প্রশ্নের উত্তর উপন্যাসের পুরটা জুড়েই চলেছে। প্যারালাল জগতের মহাজাগতিক বিষয়গুলোকেও তুলে আনতে চেয়েছেন লেখক। মহাশুন্যের নিরন্তরতার অসীম  এক জিজ্ঞাসার হাতছানি রয়েছে সেখানে। লেখক তাই চরিত্রকে নিয়ে ভাবিয়ে নিচ্ছেন-

রাহুটা যখন এগোয়আর পিছোয়, তখন মনে হয়য় দুইটা ঘুইজ্জা দা (অর্ধচন্দ্রাকৃতির দা) পরস্পরকে আঘাত করছে। হঠাত কিশোরের মনে হয়, এই দুই দায়ের পেছনে নিশ্চয়ই দুটি অদৃশ্য হাত আছে। ওরা দুই শত্রু। সেই দুই শ্ত্রু কী তবে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছে? (জন্মজাতি)

রাহুর গ্রাস-চন্দ্র- সূর্য-সৃষ্টিরহস্য-খাদ্যশৃঙ্খল-অলৌকিকতার সমন্বয়ে এ যেন একটা মহাকাব্যিক ছোয়া আছে উপন্যাস জোড়ায়, বিশেষ করে ‘জন্মজাতি’তে। চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ বা মহাকর্ষ, অভিকর্ষ বল কোথা থেকে উতপন্ন হয়! কেই বা বসে আছে তার কেন্দ্রে?‘মৈনপাহাড়’এ তিনি সেখান থেকে সিক্যুয়ালি যেন নেমে এসেছেন মাটির দুনিয়ায়। ‘জন্মজাতি’তে যে চরিত্রগুলো প্রস্ফুটিত হয়েছিল, তাদের বিকাশ ও পরিণতি পর্ব ‘মৈনপাহাড়’। সেঅর্থে উপন্যাস দুটিকে সার্থক জোড়া উপন্যাস বলা যেতে পারে। কিশোরের মধ্যে তারাশঙ্করের ‘কবি’র ছায়া পাওয়া যায় অনেকটা। একজন নিম্নজীবী থেকে কীভাবে সে কবি হয়ে ওঠে, তার যে যাত্রা, মনের আকুলি-বিকুলি, সেই রূপান্তরের অনেকটা ইমেজ পাওয়া যায় আক্তার মাঝির ছেলের পেশা পরিবর্তন করে জেলে কিশোরের বোহেমিয়ান জীবনে প্রবেশ করার মধ্যে বা মনের অজান্তেই রমনীদাসের , বরকেতা গাইনের মতো মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে তার পদ মেলানোর মধ্য দিয়ে।

কিশোর আর সোনাবিবি চরিত্র দুটোকে দুর্দান্ত খেলিয়েছেন লেখক।  কিশোরের কাঁধে ভর করেই জেলে জীবনের দুঃখ, কষ্ট, সংস্কার অনেকটাই ডালপালা পেলে স্থান পেয়েছে এখানে। বিষবৈদ্যর উপর বিশ্বাস, তাদের উদ্ভট মন্ত্র, তার উপর আস্থা, জলকে ঘিরে নানান সংস্কার-কুসংস্কার ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।কৈন মাছের আক্রান্ত জেলের মন্ত্রের সাথেও আমাদের পরিচিত করান লেখক, তুলে আনেন সমুদ্রের জেলেদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস_

         

আইসসে কইন ভাইসিসে কইন

          রাজারানী  হাতি কইন।

          দাইনে কইন বাঁইয়ে কইন

মইন কইন জাতি কইন

পীর আউলিয়া দরবেশ কইন

বাপদাদা বড়দাদা কইন

খৈয়াজ খিজির নবী কইন

জারগৈ কইন বিষাল কইন

মাইনসর সঙ্গে মিশাল কইন

নামের কইন ঘামের কইন

কামরূপকামাখ্যার কইন

বৈদের কথা মানের কইন…

দুই বৈদের মন্ত্র এক নয়, তবে দুজনের ছন্দ এক। এক এক বৈদ্য শেখে এক এক ওস্তাদের কাছে। দরিয়ারজেলে জীবনের এক নিখুঁত চিত্র লেখক কিশোরের মাধ্যমে তুলে এনেছেন, জীবনের পরিভ্রমণের এক গল্প দিয়েছেন তাকে। যা নিয়তি এর কর্মের যুগল সুঁতোয় পেঁচিয়ে দড়ির মতো শিল্পীত রূপ দিয়েছেন লেখক। কিশোরকে কাজে লাগিয়েই চিত্রায়ণ করেছেন সাধারন মানুষের মিশ্র সংস্কৃতির, লোকধর্মের কথা। এ ভূ-পৃষ্ঠের মানুষ আবহাওয়া-জলবায়ুর কারণে কখনোই তেমন উগ্র ছিল না। তার উপর বিভিন্ন জাতি-বর্ণের মানুষের দ্বরা শাসিত-শোষিত হবার ফলে  বিচিত্র এক সংমিশ্রণ শুধু তাদের ডিএনএ কোডেই হয়নি, তার ছাপ পড়েছে তাদের আচার, সংস্কার ও সংস্কৃতিতে। ফলে এখানকার মানুষ আদতে যে ধর্মই পালন করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা লোকধর্মই পালন করে। হিন্দুরা যেমন এখানে মাজারে শিন্নি দেয়, মাজার জিয়ারত করে, মানতও করে। আবার, মুসলমানেরাও বিশ্বাস করে বিয়ের দেবতা প্রজাপতি গায়ে বসলে বিয়ের ফুল ফুটবে। লোকাচার, আচারিত পার্বণ, নানা তত্ত্ব-বিশ্বাসের মিশ্রণ এখানে এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে, সেগুলোকে আর একটি নির্দিষ্ট ধর্মের, গোত্রের আলাদা করে ভাবা যায় না। শাস্ত্রের সাথে এখানে মিশে যায় লৌকিক কাহিনী, কিংবদন্তি এমনকি জনশ্রুতিও।  ফলে একজন মুসলমান কিশোর যেমন আল্লাহ, নবী বলি, খিজিরের নামের মহিমায় বিশ্বাস করে তেমন বিপদে বা মনের দুর্বলতায়, ভয়ে  নৌকায় মনসা দেবীর চোখ আঁকা থাকায় স্বস্তি পায় বা বলীর কৌশলের উপর আস্থা থাকে তার, আর সরল মনে বিশ্বাস করে কবুতরেও। ফলে কিশোর অজান্তেই  তার লৌকিক বিশ্বাসের কারণেই দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে ফেলে। অন্তর্গত বিশ্বাস বা  মতিষ্কের প্রোথিত মজ্জাগত সংস্কারই তাকে মনে করিয়ে দেয় খিজির বাবার কথা বা নবি বলির কৌশলের কথা_

থই থই নেচে বেড়ায় জল। সেই জলের উপর গঙাকইতর ওড়ে। শাদা শাদা গঙ্গাকইতর। লোকে বলে, বিনয়বাবুর আত্মা কইতর হয়ে ওঠে। একটা পাখি এসে কিশোরের নৌকায় বাঁশের ডগায় বসে।  কিশোরের মন খুশিতে ভরে যায়। গঙ্গাকইতর মানে সৌভাগ্য। আজ নিশ্চ্যয়ই ভালো মাছ পাওয়া যাবে।   ( জন্মজাতি)

২। আল্লাহর নাম, নবীর নাম, বাপদাদার নাম, সবশেষে আবার খোয়াজ খিজিরের নাম নেয় কিশোর। দইজ্জার রাজা খোয়াজ খিজির। ডুবেও থাকেন, ভেসেও থাকেন। ডুবে-ভেসে শাসন করেন জলমহাল।  কিশোর দইজ্জার জল হাতে নিয়ে নিজের কপালে ঠেকায়। (জন্মজাতি)

৩। সবকিছুর আগে চাই দেবীর কৃপা। বলেই দেবীর উদ্দেশে প্রণাম ঠোকে। হ্যা, দেবীরই কৃপা। মনসা দেবীর। মনসা দেবী হলো নাগমাতা। পৃথিবীর ভয়াল দয়াল সব পাপই তাঁর আজ্ঞাবহ। সেই নাগমাতার স্মরণ নিলে এর ভয় নেই। নাগের হাতে মরণ নেই।  (জন্মজাতি)

পুরুষ চরিত্রগুলোর পাশাপাশি নারী চরিত্রগুলোও এখানে বেশ শক্তিশালী। শুধু উপন্যাসের অবস্থানগত দিক দিয়ে নয় বরং আত্মশক্তির মহিমায় এবং মানসিকভাবে চরিত্রগুলো বেশ শক্তপোক্ত। নারীর চিরন্তনী সতী-সাব্ধী রূপের চেয়েও এখানে প্রাধান্য পেয়েছে বাস্তব রক্ত-মাংসের নারীর ঘুরে দাঁড়ানো।  সোনাবিবি যৌন ব্যাপারেও আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীন। সে সমাজের লক্ষী, সতীর রূপ চায়নি। এমনকি যৌনজীবিকা গ্রহণ করলেও  সে ব্যাপারেও নিজের পছন্দের জায়গায় অটল। ফলে কাবলিওয়ালাকে সে প্রত্যাখান করে, কিন্তু মৌলবির রূপে-অবয়বে সে মৌলবির সাথে মিলিত হয় নির্দ্বিধায়। চারিত্রিক এবং মানসিক যে সামর্থ লেখক সোনাবিবি বা সোনাফুফুকে দিয়েছেন তা অন্য চরিত্রগুলোর মধ্যেও কম নয়। ফিরুজাবিবির কথাই ধরা যাক। সেও আক্তার মাঝির তিরোধানের পর গ্রহণ করেছে ছেলের বয়সী মন্নুমাঝিকে। একমাত্র নারীর চিরন্তন সতী, সাব্ধী রূপ তিনি এঁকেছেন বদনী বুড়িতে। সকল কিছু হারাবার পরে যে সারাজীবন শুধু অপেক্ষাই করে গেছে। সম্ভবত, নারীর প্রাচীনকালীন এবং বৈপীরত্বসম্পন্ন দুটো রূপকে পাশাপাশি তিনি ইচ্ছে করেই রেখেছেন, যেন তাতে শরতচন্দ্রের চরিত্রহীনের পারস্পারিক বৈপীরীত্বের এন্টি-প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের স্বার্থ উদ্ধার হয়। ফলে, জোড়া উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো আমাদের নতুন সমাজের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে আয়নাবিবি ও সোনাবিবিকে কাজে লাগিয়ে জাদুবাস্তব ও পরাবাস্তবের যে খেলা নুরুল হুদা করেছেন, তা প্রশংসনীয়। গ্রামে ব্ল্যাক ব্যবসার হোতা বা প্রশয়দাতা হিসেবে , জিন-পরির মিথকে কাজে লাগিয়ে তারা যে অনৈতিক কাজ পিঠ-পিছে চালিয়েছে তার চিত্রায়ণ দুর্দান্ত। প্রাচ্যের, ভারতীয় পুরাণ, এর কিংবদন্তির ব্যবহারে সুললিত কাব্যগদ্যের ব্যবহার আমার মনে হয় ‘জোড়া উপন্যাস’ এর সবচেয়ে বড় পাওয়া। কবি বলেই হয়ত চিত্রকল্পের ব্যবহারে তিনি এত অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখাতে পেরেছেন। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস, অথচ পুরো উপন্যাসে  কোথাও ডেথ ইমেজের ব্যবহার পাওয়া যাবে না। উপমাগুলোও ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। সহজ, ছোট এবং সাবলীল। জটিল বাক্যের অনুপস্থিতি এবং সরল বাক্যের সুললিত ব্যবহার, ভাব অনুযায়ী কবিতা, ছড়া, পদের ব্যবহার, প্রাকৃতিক উপমার প্রতি ঝোঁক, প্রবাহমানতা, ছোট ছোট কাহিনী বলে ঘটনাকে জেনারালাইজকরণের দক্ষতা, সাবপ্লটের ব্যবহার, ইঙিতময়তা তাঁর গদ্যকে দিয়েছে এক কাব্যিক রূপ। এ যেন আমাদের মহাজীবনের পথে যাত্রা। এমনকি শারীরিয় বর্ণহাগুলোকেও এমন কাব্যিক গদ্যে, উপমায়, চিত্রকল্পে ব্যঞ্জনা নিয়ে সামনে এনেছেন যাকে পাঠক এর যাই বলুন, যৌন সুড়সুড়ি বলতে পারবেন না।

প্রকৃতপক্ষে তাঁর জন্ম আতুঁড়্ঘর দরিয়ানগর-দইজ্জার সঙ্গে মৈনপাহাড়ের পারস্পারিক বৈপরীত্যের এক দারুণচিত্রায়ণ উপন্যাস দুটিতে করেছেন। যেখানে এক হয়ে গেছে পাহাড় এর সমুদ্রের রহস্যের হাতছানি আর লোকালয়ের প্রাণের কোলাহল। এককথায় জড়-জীবের সমন্বয়ে ব্রহ্মাণ্ডকেই যেন নির্দেশ করেছেন ফাঁকতলে।সাথে আবার মিলিয়ে দিয়েছেন মহাজাগতিক অসীমতাকেও।প্রকৃতপক্ষে আমাদের বর্তমান এই ট্যাগিং সময়ে কাউকে একটা পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করতে আমরা বদ্ধ পরিকর। মতিষ্কের সরলীকরণ প্রথার ফাঁদে পড়েই আমরা এটি করে থাকি বলে বহু কবি-সাহিত্যিকের শিল্পগুণসম্পন্ন সাহিত্য আমরা হাতে পেয়েছি অনেক পরে। বনফুল বা জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস থেকে শুরু করে আরো অনেকের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। মুহম্মদ নুরুল হুদাও আমাদের কাছে কবি বলেই খ্যাত। আর সেজন্যই হয়ত তাঁর গদ্য ঠিক ততটা আমাদের সামনে আসেনি, যতটা সমাদৃত হবার কথা ছিল। ‘জোড়া উপন্যাস’ ঠিক ততটাই সুখপাঠ্য যতটা তাঁর কবিতা। ঔপন্যাসিকের আলাপচারিতায় জানা গেছে তিনি এই জোড়া উপন্যাসের তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রায় উপনীত হতে চান। পাঠক হিসেবে আমরাও চাই, বাংলা সাহিত্য তাঁর হাত দিয়ে এমন সুললিত গদ্য দ্বারা আরো ঋদ্ধ হোক। কবির ভেতরের গদ্যের আরতি অপূর্ব ও তীক্ষন দক্ষতায় কেমন করে নির্বাণ লাভ করে তাঁর প্রমাণ থাকুক সাহিত্যে। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত