| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী ছোটগল্প: জোড়াতালি । শ্রাবণী দাশগুপ্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

‘একী! আপনি?’

‘ওকী, অবাক হলি বুঝি খুব? তুই নিজেই মনে করলি, ডাকলি।’

‘আপনাকে? পাগল আমি?’

সুরমা আঁচল গুছিয়ে খাটের পাশে বিরাজমান কাঠের ভারী রকিং চেয়ারখানায় বসে পড়েন। গীতশ্রী হাঁ হাঁ করে ওঠে,

‘বসে পড়লেন যে ভারী সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং না মেনে! আর এই চেয়ারে —,’

মুখের কথা কেড়ে নেন সুরমা,

‘ইংরেজিতে কড়কড়িয়ে কী বললি তুই, অ্যাঁ? চেয়ারখানা তারকবাবুর, তা জানি না? হুহ্‌, বড্ড যে সুয়ো ছিলি শ্বশুরের। গা-ঘেঁষে বসে দিনরাত্তির ফুসুরফাসুর ভ্যাদরা প্যাচাল, আবার ইংরেজিতেও। গা জ্বলে যেত দেখলে।’

‘সে তো জ্বলবেই আপনার। আমায় দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, থাকগে বাদ দিন। আপনার কথা মেনে সব সময়ে- এখন আবার খোঁটা দিচ্ছে। আচ্ছা মহিলা! মনীশ কী যত্নে এটা রেখেছে জানেন? ক’মাস আগেই ভার্নিশ করাল। ভাগ্যিস করিয়েছে, তা না হলে আবার লক্‌-ডাউনের চক্করে পড়ত। সে বাদ দিন। আপনি এর মধ্যে এলেন কি করে?’

‘লকডাউন? সেটা আবার কি রে? বাপের জম্মে শুনিনি। বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি, ইংরেজি বুঝি না। তুই ডাকলি, তাই এলাম। হ্যাঁ রে, মানু কোথায় রে?’

‘সে ও-ঘরে ওয়র্ক ফ্রম হোম করছে ল্যাপটপে। আর দু’বছর বাদে রিটায়ার করবে, তাও কাজের চাপ কী!’

‘হোম ওয়ার্ক? এই বয়সে? তা বাপের মতো হয়েছে আর কী! খালি কাজ আর কাজ। জীবনে আর কিছু বুঝল না।’

গীতশ্রী নিঃশ্বাস ফেলে উন্মনা হয়ে পড়ে। মেঘে-মেঘে বেলা কম হয়নি তার, আষাঢ়ে পঞ্চান্ন ছুঁল। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছে ধুমধাম করে। দুই ভাসুর জা, ননদ, আত্মীয়বন্ধু মিলে জমজমাট বিয়ে, যেমন হওয়ার ছিল। ভাগ্যে কোভিডের থাবা তখনো চেপে বসেনি। ছেলে-বউমাও সেই যে মুম্বাই গেল, ভি-সি ছাড়া আর দেখার সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই। ভালো থাকার খবরটুকুন পেলেই হয়। জানালার বাইরে মেঘ জমে অস্বচ্ছ প্লাস্টিক-শীটের মতো আকাশ। ঝাড়া বৃষ্টি হয়ে গেলে পরিষ্কার হত। গীতশ্রীর ঝিমুনি আসছিল আবার, কপালের ওপরে নরম হাতের পাতা স্পর্শ করল।

‘ঘুম লেগেছে? তুই বরং ঘুমো। আমি বসে থাকি। বেশ পরিষ্কার রেখেছিস বাড়িঘর, যা অগোছালো ছিলি!’

‘বসবেন বসুন। সুযোগ খুঁজে নিন্দে না করলে আপনার হজমের গোলমাল হয় বরাবর দেখেছি। যাকগে, আর আমি ঘুমবো কি? পুরো চটকে দিলেন। সকাল থেকে রাত খালি কাজ করে যাই। আপনার ছেলেকে তো এক গেলাস জল ভরতেও শেখান নি। তার ওপরে বাড়ির মধ্যে অফিস!’

‘কেন কাজের লোক-টোক সব তুলে দিয়েছিস নাকি? আগে বিনির মা একদিন না এলে বাড়ি মাথায় করতিস আর আমাকে কথা শোনাতিস, আমি নাকি তাদের পায়ে তেল দিয়ে রাখি। আর দুপুরে আগে কই ঘুমোতিস না?

‘বয়স বেড়েছে, ক্লান্ত হয়ে পড়ব না? রান্না বাসন ঝাড়ুমোছা সব! সারাক্ষণ ধোওয়াধুয়ি, স্যানিটাইজ আর ভাল্লাগছে না। আপনি কোনো খবরই রাখেন না দেখি!’

‘এ্যাঁ কী বলিস রে তুই? শুচিবাই বলতিস আমাকে, এখন নিজে হয়েছিস? কালে-কালে দেখব কত! দেখছিস বয়স বাড়লে সক্কলেই ওই…। তবে তোর আর কাজ কি? আপ্নি-কোপ্নির সংসার। দাদুভাইও বউ নিয়ে আলাদা। একী আমাদের কাল? ষোলোবছর তিনমাসে বিয়ে আমার হয়েছিল নাইনে পড়তে পড়তে। সারাজীবন শ্বশুর-শাশুড়ি সংসার বুঝলাম। তাদের কথায় ওঠা আর বসা। ফেলে তো দেওয়া যায়না। তারকবাবু ছিল তাদের একমাত্তর শিবরাত্তিরের সলতে। আরও নাকি চার ছেলে জম্মেছিল, একটাও বাঁচেনি। তিনখানা জাঁদরেল ননদ মাসের পর মাস এসে থাকত বাপের বাড়িতে, তাদের ফরমাইশ খাটা, হাড়-মাস কালি হয়ে যেত আমার, মুখে রা কাড়তে পারিনি। তোদের মতো সুখের পায়রা ছিলুম না বাপু!’

‘তাই নাকি? আপনার বাজে একঘেয়ে লেকচার আমরা অনে-ক শুনেছি। আর আপনার সারাজীবন হয় কি করে? হিসাব করে দেখেছি আপনার বিয়ের বারো বছর পর আপনার শাশুড়ি বিধবা হন। তার দু’বছর পরে তিনি নিজেই সগ্গে যান। তাছাড়া বিয়ের প্রথম তিন বছর আপনি ভাগলপুরে বরের কর্মস্থলে একেশ্বরী ছিলেন, পরে কলকাতায় আসেন। আপনার সারা জীবনটা ক-বছরের হল শুনি? আর ননদের মধ্যে দুজন বাইরে থাকতেন, দু’বছরে একবার আসতেন। একজন কলকাতা। ওঁকে দেখেছি তো খুবই শান্ত মানুষ, বাবার মতো।’  

‘রাখ দেখি তোর হিসাব! আমি বাপের বাড়ি যেতে চাইলে আমার শাশুড়ি অসুখের ভান করত, বলেছি না?’

‘আপনিও রাখুন দেখি! কতবার এইগুলো ইনিয়ে-বিনিয়ে শুনিয়েছেন। আর আমরা যেতে চাইলে আপনিও কি কম অশান্তি করতেন?’

‘ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া কি ভালো? অশান্তি করতাম, তাও তুই যেতিস! বড়ো দু’বউমা কত বাধ্য ছিল, কক্ষনো আমার অমতে চলত না।’

‘তাতে কি? আমি ওদের মতো কেন হতে যাব? যখন ইচ্ছে যাব। আপনার মেয়ে কতবার আসত, গুণে বলুন দেখি?’

‘সেই তক্কো? আগের মতো মুখরা আছিস, বয়স হয়ে কোনো উন্নতি নেই। কথায় বলে না, স্বভাব যায় না ম’লে! ভাগ্যে নাত-বৌ আলাদা থাকছে, না হলে তোর মুখের জ্বালায় আলাদা হয়ে যেত অমনিই। জানিস তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয় আজকাল, ভালো ছিল মানুষটা। দুঃখ করে বলে, বেয়ান আমার মেয়েটা মেজাজী, আপনারা ভালোবেসে ক্ষমাঘেন্না করে নিয়েছেন এতেই আমি খুশি।’

‘মোটেই না! বাবা এরকম বলতেই পারে না। বাবা চাইত না মেয়ে কোনো অন্যায় মেনে নিক। নিজেও না করুক, আর অন্যায় হলে প্রতিবাদ করুক।’

‘তাই তো বলি সাহস যোগাত কে! বাপ আহ্লাদ দিয়ে মাথাটি খেয়ে রেখেছে! আমি ভাবতাম মা-মরা মেয়ে নরম-শরম হবে, তা না!’

চব্বিশ বছর সময় খুব কম নয়। সে ছিল নিত্যকার তুমুল রণরণি-ঝনঝনির দিনকাল। গীতশ্রী আলাদা হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কতবার, রাগ করে বাবার কাছে গিয়ে থেকেছে সপ্তাহের পরে সপ্তাহ। কখনো মনীশ, কখনো তারকবাবু গিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন। মনীশের কাতর মুখে বলেছে, আমার কি দোষ? ফিরে চল গীতি।

তাতেও রেগে চোখ পাকিয়েছে গীতশ্রী। এমন নিরীহ, ভ্যাবলাকান্ত, সাতে-পাঁচে-না-থাকা বর সে চেয়েছিল না কি? গত ছ’বছর একেবারে ফুরফুরে হাওয়ার মতো কাটছে, মাথার ওপরে কোনো চাপ নেই। তার সদাশিব বর আপন দুনিয়ায় ব্যস্ত। সে ব্যস্ততাবিহীন নিজের জগতে, বন্ধু-বান্ধব, অল্পস্বল্প আড্ডা-গল্প। কী জানি, তবু ফিরে আসে এক একটা উদ্ভ্রান্ত সকাল। গরম মুগের ডাল কড়াই থেকে বাটিতে ঢালতে গেলে পেছনে ফিসফিস শুনতে পায়,

‘দেখিস আবার সেরকম ফেলে দিস না, যা হড়বড় তোর! আদাবাটাটা এখন দিলি? নামানোর ঠিক আগে দিতে হত। সেদ্দো হলে তেমন বাস আসে না।’

সে চমকে উঠে দাঁত কিড়্‌মিড়্‌ করে,

‘খালি খিট্‌খিট্‌! রেঁধেরেঁধে বুড়ি হয়ে গেছি, জ্ঞান দেওয়ার বদভ্যেস আজও গেল না।’

ফোন ধরে বকবক করতে করতে দুধ বসিয়ে কতদিন ভুলে যায় গীতশ্রী। তলা ধরে যায়। মনীশ বাড়িতে থাকলে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,

‘কী বসিয়েছিলে গীতু? পুড়ছে নাকি?’

সে এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে গ্যাসের ওভেন বন্ধ করে কালো ঝাঁঝরা দুধের প্যান জলে বসায়। ছ্যাঁক করে আওয়াজ ওঠে। অলক্ষ্যের মুখঝামটা শুনতে পায়,

‘পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে শেষ করে দেবে! খালি নষ্ট খালি নষ্ট! অলক্ষ্মীর দিশা এগুলো অভ্যাস আর গেল না।’

সে পেছন ফিরে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে চেপে যায়, কথাগুলো গলায় জমে হেঁচকি ওঠে।

আগে সেই কত বিকেলে রাস্তার ওপরের ছোটো ব্যালকনিতে বসে হী হী করেছে দুজনে,

‘ওই দ্যাখ দেখেছিস ওই কাঁকলাস লোকটাকে? শুনলাম ঝিয়ের সঙ্গে পীরিতি! ওর বউ নাকি ডাইভোর্স করতে চেয়েছে।’

‘যতসব হাবিজাবি খবর কে দেয় আপনাকে, নিশ্চয়ই ও বাড়ির প্রতিভা কাকিমা? প্রাণের সখি কিনা! আর কী কী গল্প করেন আপনারা শুনি? কষে ছেলের বউয়ের নিন্দে, তাই না? বিশেষ করে ছোটোজনের? ডেঁপো, অবাধ্য, ঝগড়ুটে। তা করুন, পেটের গ্যাস কমবে।’

‘বেশ করি। তুই করিস না শাউড়ির নিন্দে? তোর তো আবার কত বন্ধু-টন্ধু-!’

তিন বউ আর মায়ের ম্যাটিনি শো-এর টিকিট কেটে দিয়েছে বড়ো ভাসুর, পৌঁছে দিয়ে গেছে মনীশ। চারজন গেছে ইন্দিরায়। সিনেমা দেখে চোখ মুছে অস্থির সুরমা। গীতশ্রী খেঁকায়,

‘ধ্যাৎ আপনি আসেন কেন? সিনেমা দেখাই মাটি। এত কান্নার কী হল?’

সুরমা ফ্যালফ্যালিয়ে হাসেন,

‘চল্‌ কবিরাজি কাটলেট খাই।’

‘চলুন।’

‘এই পয়সাটা আমিই দেব।’

‘দিন।’

খেতে খেতে বারবার গীতশ্রীকে দেখেন, গীতশ্রী বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকায়। সুরমা আর থাকতে না পেরে বলেন,

‘তুই সিনেমার নায়িকাটার মতো ঝগড়ুটে দেখছি। দেখতে ও রকম সুন্দর হলে কি হবে? তাই না বড় বউমা?’

‘খাওয়া শেষ হলে এবারে উঠুন। বাজে কথা খালি। ট্যাক্সি ধরি, বাড়ি যাবেন না?’

গড়িয়াহাটে পুজো বাজার সুরমা নিজে করবেন, বউদের নেবেন না। বউয়েরা অনেক বেশি দাম দিয়ে কেনে, দর করে না। শুধু পয়সা ধ্বংস করে। গীতশ্রী মুখ বাঁকায়,

‘আনবেন তো তিনজনের তিনটে পচাপচা শাড়ি। পছন্দ না হলেও ভালো বলতে হবে।’

‘কই আর দুই বউমা তো সোনামুখ করে নেয়। ইচ্ছে না হলে তুই পরিস না। তোদের বরেদের বাপু অনেক পয়সা, তাদের ঘাড় ভাঙিস। আমার এত নেই, দেওয়ার আছে দেব। আমার জন্যেও যেন দামী কেনা না হয় মনে রাখিস।’

‘বয়ে গেছে।’

তারকবাবু সামনে থাকলে বলেন,

‘কী যে তোমরা মা-বউমা সারাদিন নারদ নারদ করতে থাক!’

‘কে মা? ও আমাকে মা বলে নাকি? মা-মরা মেয়ে, ভেবেছিলাম মা-মা করে পায়ে পায়ে ঘুরবে!’

‘তা আর নয়? হুঁহ্‌ সে গুড়ে বালি। তার জন্যে যোগ্যতা লাগে।’

দুমদাম পা ফেলে সামনে থেকে সরে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে গীতশ্রী। সন্ধ্যের পর ধূমায়িত চায়ের ট্রের পাশে গরম সিঙারার থালা। গীতশ্রী নাক দিয়ে সুগন্ধ টানে। সুরমা চোখে হাসেন,

‘সবার একটা, তোর দুটো, খা।’

ফেলে-আসা সময়ের রিপ্লে নেই, তবু ফিরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কত বছরের বসবাস। তেতো বাদ-বিবাদ, অন্যায় কথাবার্তা। সম্পর্কের জোড়াতালি সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে আলো ফোটে, অমসৃণ ময়লা কী করে যেন ঝরে গেছে। গীতশ্রী চোখ ডলে বিছানায় উঠে বসে। বর্ষার মেঘাক্রান্ত ঘোলাটে সন্ধ্যে বেশ অন্ধকার। ঘরে কেউ নেই, রকিং চেয়ার অল্প দুলছে। তার আদরের বেড়াল ঘোঁতন ওটার ওপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। ড্রেসিংটেবল থেকে চিরুনি তুলে নিতে নীচু হয়। কানের গোড়ায় ফিসফিস শোনে,

‘জীবনে তো সিঁথেয় সিঁদুর ছোঁয়ালি না। আমার ভালোমানুষ ছেলে বলে, তাই।’

‘তাতে তার কোন্‌ ক্ষতি হয়েছে শুনি?’

‘নাত বউমা মা বলে ডাকে তোকে? এই মুখরা শাউড়িকে?’

‘না। আন্টি বলে আন্টি। তাতে আপনার কি শুনি?’

পেছন ফিরে ঝামড়ে উঠতে গিয়ে গীতশ্রী চুপ করে যায়। চোখ পড়ে ছেলে আর নতুন বউমার গলা জড়াজড়ি করা আহ্লাদী ফোটোতে। চোখ ফিরিয়ে কী যেন ভেবে একটু হাসে। বিড়বিড় করে বলে, ‘অনেক বছরের সম্পর্ক কিন্তু আপনার সঙ্গে! বুঝলেন মা?’

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত