আমরা যাঁরা জীবনানন্দর সঙ্গে জেমস জয়েসের তুলনা দেখে আতকে উঠি তাঁরা বোধহয় লক্ষ করি না রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিশেষত পঞ্চাশ দশকের কবিদের তারটা ইউরোপের ঘাটে বাঁধা ছিল।
না হলে জীবনানন্দ থেকে মাত্র দু’বছরের ছোটো অমিয় চক্রবর্তীর প্যারিসের এক কুয়াশাচ্ছন্ন অপরাহ্নে কেন মনে হবে,যাই জয়েসের কাছে।
জয়েস তখন ‘ফিনেগানস্ ওয়েক’ লিখছেন? ঘরে পুরু কার্পেট, ঘন পর্দা, বহু আলো জ্বালা।জয়েসের চোখে অত্যন্ত মোটা চশমা,অস্বচ্ছ দৃষ্টির কাচে যেন হটাৎ বিদ্যুৎ খেলে যায়।
জয়েস সেভাবে না পড়লেও অমিয় চক্রবর্তীর মনে হল,আমরা আজ যা তার খানিক অংশ এই প্যারিসীয় আইরিশ লেখকের যদৃচ্ছ রচনার ফল।এক আত্মীয়তা অনুভব করছিলেন তিনি।
তেমনই করতেন তখনকার বাঙালি কবিরা।বিষ্ণু দে-র এলিয়ট, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর মালার্মে, বুদ্ধদেব বসুর বোদল্যের, অরুণ মিত্রর আরাগঁ।আর জীবনানন্দ?এঁদের সব্বাই এবং আরও অনেক।জীবনানন্দ শ্বাস নিতেন ইউরোপের বাতাস।
তো জয়েস বললেন,তর্জমা সাহিত্য নয়,তবু তর্জমায় পড়েই তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে চিনতে পেরেছেন।
খানিক বলে অনেকক্ষণ থেমে যান,আবার কথাটা শেষ করেন।বললেন গ্রামাফোনের রেকর্ডে আমার কন্ঠের গদ্য পাঠ শুনে অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে।রচনার সঙ্গে আচ্ছনতার সম্পর্ক রয়েছে।গান শুনে এমন হয়।সেটা মানের জন্য নয়।
ছোটো ছাপানো একটি পুঁথি উপহার দিলেন অমিয় চক্রবর্তীকে।নতুন গ্রন্থের টুকরো।জাহাজে ফিরবার পথে পড়বার জন্য।নানা ভাষার আবহাওয়ায় রচিত যে এই গ্রন্থ তা জানাতে ভুললেন না।
বললেন,ভাষার মূলে যারা যাবে তারা মনের কথা শরীরের কথা এবং সব মিলিয়ে মানুষের কথা শুনবে।লেখা তো এজন্যই।
অমিয় চক্রবর্তী অবশ্য শেষ পর্যন্ত কথার স্তুুপে,কথার অঙ্কশাস্ত্রে,ভাবের ল্যাবরেটরির গন্ধে বিরক্ত হয়ে বইটা ফেলে দিয়েছিলেন।মেডিটেরিয়ানের নীল অর্থহীন শব্দ তাঁর কাছে ঢের অর্থবহ মনে হয়েছিল।’ফিনেগানস্ ওয়েক’-এর অংশ ছিল পুঁথিটি।
একটা মজার ঘটনাও আছে।জয়েসের থেকে বিদায় নেওয়ার সময়,জয়েস তাঁর নামের অর্থ বুঝে নিয়ে একটা পুরনো বই উপহার দিলেন,তাতে লেখা, To Mr. Ambrose Wheelturner!এবং জানাতে ভুললেন না,এটা তর্জমা নয়,সত্যি নাম।
একটা গল্প অমিয় চক্রবর্তীকে শোনালেন জয়েস।যা খুব অর্থবহ।একদিন জয়েস তাঁর এক বন্ধুকে ‘ফিনেগানস্ ওয়েক’ শোনাচ্ছেন হঠাৎ কী প্রয়োজনে যেন বাইরে যেতে হল।বাড়ির ফরাসি দাসীর সঙ্গে দরজা খুলতেই ধাক্কা।কান পেতে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জয়েসের পাঠ শুনছিল।অশিক্ষিত এই দাসীর কাছে এই রচনার এক বর্ণও বোঝা সম্ভব নয়।
জয়েস অমিয় চক্রবর্তীকে ঘটনাটি বর্ণনা করে বললেন, যারা বোঝবার তারা বোঝে।কেন বা কীভাবে বোঝে তার কোনও উত্তর নেই।যারা শোনে বা পড়ে, শোনবার ও বোঝবার জন্য, তাদের বাধে না।কারণ বোঝাটা উপলক্ষ তাদের কাছে।
জীবনানন্দর সঙ্গে জয়সের বা রিলকের বা ইয়েটস বা কাফকার বা বোদল্যের-এর তুলনায় যাঁরা ভ্রুকুঞ্চন করেন তাঁদের বিনীতভাবে শুধু সময়টাকে বুঝতে অনুরোধ করি।
কবি,সমালোচক,গবেষক