শেকড়ের শিল্পী জয়নুল আবেদিন
পুলক হাসানের এই লেখাটি আর্টস বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম এ প্রকাশিত হয়েছিল। ইরাবতী পাঠকদের জন্য তা আবার পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের অগ্রনায়ক। তাঁর হাত ধরেই এ দেশে চারুকলার যাত্রা শুরু হয় এবং তিনি এর প্রথম শিক্ষাগুরু। তিনি শিল্পমানসে ছিলেন নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন ও কাছ থেকে দেখেছেন তারই স্বতঃস্ফূর্ত রূপদান এবং মর্মরস আহরণই ছিল তাঁর শিল্পদর্শন। ফলে তাঁর রঙতুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোরে দেখা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিসর্গ ও জীবনবৈভব। ব্রহ্মপুত্র নদ এবং এর দু’তীরের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংগ্রামের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন তাঁর শিল্পবাস্তবতা। জীবনবোধে ও চিন্তাচৈতন্যে তিনি তাই ছিলেন শতভাগ শেকড়েরই সন্ধানী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্পকলা থেকে আহরণ তাঁর যাই-ই থাক, তার প্রভাব থেকে দ্রুতই বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র ও অনন্য হয়ে ওঠেন। যে কারণে তাঁকে ‘শিল্পাচার্য’ অভিধায় ভূষিত করা হয়। তবে জয়নুলের শিল্প অন্বেষণ শুধুমাত্র নিসর্গ ও গ্রামীণ পটভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মানুষের জীবন সংগ্রামের আরো আরো দিক এবং লোক-ঐতিহ্য চেতনা ছিল সুগভীর। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের মানচিত্র উপহার দিয়েছিলেন জয়নুল সেখানে লোক-ঐতিহ্যের মধ্যে খুঁজেছিলেন বাংলার চিরায়ত রূপ। ১৯৭৫ সালে তাই বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন ‘লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ (লোকশিল্প জাদুঘর)। শিল্প সংগঠক হিসেবে এটা তাঁর অবশ্যই অতুলনীয় অবদান। তবে এক্ষেত্রে তাঁর অবদান আরো বিস্তৃত। তিনি একজীবনে শিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক তিন পর্বেই অনন্য এক শিল্পতাপস। শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও জীবনবাদী। এক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার ও আন্তরিক। ফলে জীবনকে দেখা ও নির্ণয়ে কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। তাঁর প্রতিটি চিত্রকর্মই তাই সময় ও বাস্তবতার এক একটি ভাষ্যচিত্র। তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে একই সঙ্গে দুই বিপরীত বাস্তবতার উপস্থিতি দেখা যায়। তাঁর তুলিতে নিসর্গ যেমন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত তেমনি এর বিপরীত চিত্রও সময়ের প্রয়োজনেই এঁকেছেন তিনি। নদী, নৌকা, গুণটানা, মাঝি-মাল্লার দৃশ্য, গ্রাম্য বধূর মুখ তুলে বসে থাকা, ঘোমটা সরিয়ে উঁকি দেয়া কিংবা আয়নায় মুখ দেখা, সাঁওতাল রমণী ইত্যকার চিত্র তাঁর বাঙালি সংস্কৃতির আবহমানবোধ থেকেই তৈরি।
আবার গ্রাম জীবনের দারিদ্র্য, সংগ্রাম, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, মহাপ্লাবন, প্রকৃতির ছোবলে লাশের দৃশ্য তাঁর চিন্তা ও মানবিকবোধকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। তাঁর এই দুই বিপরীত অবস্থান ছিল অবধারিত। পরিস্থিতির প্রয়োজনেই সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা স্টাইলে শুধুমাত্র চৈনিক কালি ও ব্রাশে তিনি মূর্ত করে তুলেছেন এসব বাস্তবতা যার মধ্যে কি ভারতীয় কি পাশ্চাত্য একাডেমিক রীতির কোনো প্রভাব ছিল না। ১৯৪৩’র দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাঁর সিরিজ স্কেচগুলো যেমন তাঁর কোলকাতার একাডেমিক প্রভাবমুক্ত তেমনি সে সময়ের প্রচল অঙ্কনরীতি থেকে একদমই আলাদা। জয়নুলের গ্রামীণ পটভূমির অনন্য চিত্রাবলী এটুকু জানান দেয় যে, আঞ্চলিক বাস্তবতার ওপরই বাংলার প্রকৃত রূপ খুঁজে নিতে হবে। বাংলার পথ, ঘাট, মাঠ, প্রান্তর, নদীনালা, মাটির ঘরে মাটির মানুষের জীবনযাপন ছিল তাই তাঁর শিল্পাদর্শ। তার চিত্রকর্ম যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই সত্য শুনিয়ে যায় যে, গ্রাম ও লোক-ঐতিহ্যের মধ্যেই বাংলার পরিচয়। তিনি এটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন বলেই তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী ও আরো আরো অনেক চিত্রকর্মের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এরমধ্যে হয়তো সামাজিক দায়বদ্ধতাও ছিল, তবে পরিকল্পিত নয়। তাঁর ‘নবান্ন’ (১৯৭০) ও ‘মনপুরা ৭০’ (১৯৭৩) শীর্ষক দীর্ঘ দুই স্ক্রলচিত্র আমাদের জনজীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক নিয়তিরই সাক্ষ্য যা তার অনন্য সৃষ্টিই নয় শুধু, তাঁর বিবেকী সত্তার জাগরণও। তাঁর এসব অনন্য সৃষ্টি বিশ্বের অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর কালজয়ী শিল্পকর্মের সমতুল্য। যদিও দুর্ভিক্ষ সিরিজের জন্য জয়নুলের মধ্যে আমরা যে মানবিক সত্তার পরিচয় পাই তার কোন তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন নির্মোহ এক শিল্পী। কোন প্রলোভন তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। যে কারণে তিনি এদেশের চিত্রকলার পথিকৃৎ ও জনক। তিনি বলেছেন, তিনি যে ছবি আঁকেন এটা তাঁর অভিপ্রকাশ। তার মধ্যে অন্য অভিপ্রায় নেই। খ্যাতির মোহে এসব কালজয়ী চিত্র তিনি আঁকেননি বরং জীবনের বিপর্যয় ও ভয়াবহতাকে তুলিতে অনবদ্য করতেই চেয়েছিলেন। সেজন্য তাঁর এই নির্মল উক্তি : ‘যে ছবি সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে সে-ই হচ্ছে মহৎ ছবি।’ জীবনবোধের প্রশ্নে তিনি কখনো প্রান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হননি, আকৃষ্ট হননি নাগরিক আভিজাত্যে। ফলে প্রবল দেশাত্ববোধে তিনি ছিলেন মনে প্রাণে শেকড়ের শিল্পী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তাদের সাথে তাঁর আত্মার আত্মীয়তা মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত ছিল অটুট।
.