Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,julio cortez

হুলিও কোর্তাসারের অনুবাদ গল্প: বেদখল বাড়ি

Reading Time: 9 minutes
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,julio cortezহুলিও কোর্তাসার

হুলিও ফ্লোরেন্সিও কোর্তাসার (২৬ আগস্ট, ১৯১৪-১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪) লাতিন সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি ও প্রাবন্ধিক। সাহিত্যের জগতে তিনি হুলিও কোর্তাসার নামে পরিচিত। আর্জেন্টিনার নাগরিক হলেও লেখার মাধ্যমে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপের স্প্যানিশ ভাষাভাষী পাঠক তথা লেখকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোর্তাসারকে লাতিন আমেরিকান জাগরণের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তার বহু সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— হপস্কচ (উপন্যাস), ব্লো আপ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (গল্প), উই লাভ গ্লেন্ডা সো মাচ অ্যান্ড আদার টেলস (গল্প)। গল্পের ক্ষেত্রে নতুন পথের দিশারী হওয়াতে কোর্তাসারকে বলা হয় ‘আধুনিক ছোটগল্পের রূপকার’।

কোর্তাসারের জন্ম ব্রাসেলসে। যুদ্ধের পরে তার পরিবার আর্জেন্টিনায় ফিরে এসেছিল বলে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বুয়েনস আয়ারসের অদূরে ব্যানফিল্ডে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। প্রথম দিকে প্রকাশিত গল্পগুলোর মধ্যে ‘বেদখল বাড়ি’ অন্যতম যা তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন বলে পরে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে হোর্হে লুই বোর্হেসের সম্পাদনায় গল্পটি পত্রিকায় ছাপানো হয়। পরবর্তী কালে হুলিও কোর্তাসার ক্রমাগত গল্প উপন্যাস লিখে যেতে থাকেন এবং একাধারে ইউনেসকোর অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘হপস্কচ’ বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে তার নাম প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।

১৯৫১ সাল থেকে হুলিও কোর্তাসার প্যারিস এবং তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায়ই আর্জেন্টিনায় গিয়ে সময় কাটাতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে আর্জেন্টিনার তৎকালীন সরকার নিজ ভূমিতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। হুলিও কোর্তাসার ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।


 

 

পুরনো আর বিশাল হলেও, আমাদের বাড়িটা আমরা পছন্দ করতাম (সেরকম সময়ের কথা বলছি যখন পুরনো বাড়ি আর বাড়ি বানানোর জিনিসগুলো নিলামে বেশ ভালো দামে বিক্রি হতো)। দাদার বাবা, দাদা, বাবা-মা আর আমাদের শৈশবের হাজার স্মৃতি নিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল।

ইরিন আর আমি এমনিতেই বাসাটায় থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যেটা আসলে ছিল একটা পাগলামো। বাড়িটা এতই বড়ো যে অন্তত আটজন মানুষ ওই বাড়িতে একসঙ্গে থাকলেও কারো সামনে কারো পড়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠতাম আর বাড়ি পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে ফেলতাম। তারপর এগারোটার দিকে ঘরগুলোয় বাকি যা কাজ থাকে সেসব করতে করতে আমি ইরিনকে রান্নাঘরের দিকে যাবার জন্য ছেড়ে দিতাম। দুপুরে দুজনে ঠিক সময়মতো খেয়ে নিতাম। আর তারপর এঁটো কয়েকটা বাসন ধোয়া ছাড়া কাজ বলতে আর কিছু থাকত না। ওই শূন্য আর নিস্তব্ধ বাসায় বসে টুকটাক আলাপ করতে করতে খাওয়া খুব আনন্দদায়ক মনে হতো। সত্যি বলতে কী, বাসাটা শুধু পরিষ্কার রাখতে পারলেই আমরা শান্তি পেতাম। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে ভাবলে দেখতাম যে এটাই একটা বিষয় যা কিনা আমাদেরকে বিয়েও করতে দিচ্ছে না। কোনো কারণ ছাড়াই ইরিন পরপর দুটো ভালো পাত্রকে নাকচ করল আর ওদিকে মারিয়া ইসথার তো আমার বাগদত্তা হবার আশায় আশায় প্রায় মারাই যাচ্ছিল! আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাড়িটাতে যেমন নিজের ভাই বোনদের বিয়েশাদির ব্যাপারে উদাসীন ছিল, সেই অব্যক্ত আদেশের ভার মাথায় চাপিয়ে আমরা অবধারিতভাবে চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে গেলাম। জানতাম, আমরা ওই বাড়িতেই কোনোদিন মারা যাব, আমাদের দূর সম্পর্কের অচেনা আত্মীয়-স্বজন এসে বাড়িটা দখল করবে, হয়তো প্রথমেই ভেঙে ফেলবে, ইটগুলো খুলে খুলে বিক্রি করবে আর তারপর জায়গাটার মালিক হয়ে বড়োলোক হয়ে যাবে; আর তার চেয়ে ভালো আর সুবিবেচিত কিছু যদি করতে হয় তবে অনেক দেরি হয়ে যাবার আগে আমাদেরই এই বাড়িটার একটা গতি করা দরকার।

ইরিন কখনো কোথাও যেত না। সকাল সকাল ঘরের কাজ শেষ হয়ে গেলে সে তার শোবার ঘরের সোফায় বসে উল বুনে বাকি দিনটা কাটিয়ে দিত। আমার মাথায় ঢুকত না সে কেন এত সোয়েটার বুনত। আমার কাছে মনে হতো মেয়েরা আসলে কাজ না করার অজুহাত হিসেবে দিনভর উল বুনতে থাকে। তবে ইরিন ঠিক সেরকম ছিল না। সে বরাবর দরকারি জিনিসই বুনত। যেমন, শীতের জন্য সোয়েটার, এমনিতে পরার জন্য আমার মোজা, সকালে পরার জন্য হালকা লম্বা জামা, আর তার নিজের রাতের পোশাক। কখনো আবার হুট করে একটা জ্যাকেট বানিয়ে ফেলত আর পরমুহূর্তেই সেটা উল টেনে টেনে খুলতে থাকত, কারণ ওটার নকশায় কি বানানোতে কিছু একটা হয়তো তার মনমতো হয়নি। তার সেলাইয়ের বাকসে তখন যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোঁকড়ানো উলের স্তূপ দেখতে ভালোই লাগত যা কিনা থাকত নিজের আগের আকৃতিতে যাবার প্রতীক্ষায়। প্রতি শনিবার আমি উল কিনতে শহরে যেতাম। আমার পছন্দের ব্যাপারে ইরিনের আস্থা ছিল। আমার কেনা রঙগুলো সে পছন্দ করত, তাই একটা উলের গোল্লাও দোকানে কখনো ফেরত দিতে হয়নি। উল কেনার ছলে বাজারে গিয়ে আমি বইয়ের দোকানে খানিক ঢুঁ মারতাম। খামোখাই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম ফরাসি সাহিত্যের নতুন কোনো বই এসেছে কি না। সত্যি কথা বলতে কী, ১৯৩৯ সালের আগপর্যন্ত আর্জেন্টিনায় পড়ার মতো কোনো বই-ই আসেনি।

তবে সে যাই হোক, আমি বলছিলাম আমাদের বাড়িটার কথা। বাড়ি আর ইরিনের কথা, এখানে আমার কাহিনী মুখ্য নয়। আমার জানা নেই উল না বুনলে ইরিন বেচারা সারাদিন কী করত। মানুষ একটা বই পড়ে ফেলার পরে আবারও নতুন করে পড়তে আরম্ভ করতে পারে। কিন্তু একটা সোয়েটার বানিয়ে ফেলার পরে তাকে বারবার নতুন করে বানানো সাজে না। এটা একরকমের অপমান। একদিন ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার টেনে দেখি ন্যাপথলিন দিয়ে ঠাসা। সেখানে ভাঁজ করা সাদা, সবুজ, বেগুনি চাদর স্তূপ করে রাখা। চাদরের বিশাল স্তূপ থেকে কর্পূরের গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে—যেন একটা দোকান। আমার কেন যেন তাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না, উলের এতগুলো চাদর দিয়ে সে আসলে করবেটা কী। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো পয়সা রোজগার করতে হতো না। খামারগুলো থেকে প্রতিমাসে প্রচুর আয় হতো, যা আমাদের খরচের পরেও জমতে থাকত। কিন্তু ইরিনের একমাত্র পছন্দের কাজ ছিল উল বোনা। বুনতে বুনতে তাতে সে অদ্ভুত এক দক্ষতা অর্জন করেছিল। আর আমার কথা যদি বলি, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। ইরিনের হাতগুলোকে মনে হতো সাগরের রুপালি রঙা শুশুক। কাঁটাগুলো তার মধ্যে থেকে থেকে দপ দপ করে জ্বলে উঠত। মেঝেতে ছড়ানো একটা কি দুটো উলের ঝুড়ি, উলের গোল্লাগুলো তার ভেতরে লাফাত আর লাফাত। সব মিলিয়ে দেখতে দারুণ।

পুরো বাড়ির নকশাটা ভোলা কখনো সম্ভব নয়। খাবার ঘর আর বসার ঘরের জানালাগুলোয় বিশাল পরদা, আর ওই অংশের চারদিকে বড়ো বড়ো তিনটা শোবার ঘর। তাদের মধ্যে একটা রদ্রিগুয়েজ পেনিয়ার দিকে মুখ করা। বিশাল ওক কাঠের দরজায় গিয়ে মেশা একটা করিডোর ওদিকটাকে বাড়ির সামনের অংশ থেকে আলাদা করেছিল। সামনের অংশটায় ছিল গোসলের জায়গা, রান্নাঘর, আমাদের শোবার ঘর আর বড়ো হল রুম। বাড়িটাতে এলে প্রথমে চকচকে টাইলসের বিস্তৃত লবিতে এসে দাঁড়াতে হতো। তারপর রট আয়রনের কারুকাজ করা বিরাট দরজাটা পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে হতো। মানে, বসার ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে হলে ওই বড়ো লবিটা পার হয়ে বড়োসড়ো দরজাটা খুলতেই হতো। বসার ঘরের পরে করিডোর আর আমাদের দুজনের দুটো শোবার ঘরের দরজা সেখান থেকে দুদিকে। উলটোদিকের করিডোরটা গেছে বাড়ির পেছনের অংশে। সেই করিডোর ধরে এগোলে সামনে বিশাল ওকের দরজা। আর সেটা খুললেই বাড়ির বাকি অংশটা দেখা যাবে। কিংবা ওই দরজার ঠিক আগেআগেই কেউ যদি বাম দিকে ঘুরে যায় আর সরু একটা করিডোর ধরে কিছুটা নিচে নামে তাবে গোসলখানা আর রান্নাঘরটা পেয়ে যাবে। ওক কাঠের ওই বড়ো দরজাটা খুললেই কেবল বাড়িটার সত্যিকারের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যেত। তবে ওই দরজাটা বন্ধ থাকলে সামনের দিকটা দেখতে অনেকটা লাগত অ্যাপার্টমেন্টের মতো, আজকাল মানুষ যেমন বানায় আর কী, যেখানে ভালোমতো হাঁটাচলার জায়গাও থাকে না। ইরিন আর আমি থাকতাম বাড়িটার সামনের দিকের অংশে। পরিষ্কার করা ছাড়া করিডোরের শেষ মাথায় ওকের দরজাটা খুলে বাড়ির পেছনের অংশে আমাদের তেমন যাওয়াই হতো না। জিনিসপত্রের ওপরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ধূলা পড়ে থাকত তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বুয়েনস আয়ারস যদিও খুব পরিষ্কার শহর কিন্তু মানুষ যেহেতু বেশি তাই ধূলা হবারই কথা। বাতাসে বরাবর প্রচুর ধূলা উড়ে বেড়াত আর সামান্য বাতাস বয়ে গেলেই উপরে মার্বেল বসানো দেয়ালে ঠেকানো সরু টেবিলগুলোতে, কিংবা চামড়া কেটে হীরার নকশার মতো করে বসানো গান বাজানোর যন্ত্রগুলোয় পুরু হয়ে পড়ে থাকত। পালকের একটা ঝাড়—দিয়ে ওসব পরিষ্কার করা বলতে গেলে ছিল বিরাট ঝক্কি। ধুলোর কণাগুলো তখন উড়ে যেত ঠিকই কিন্তু সামান্য পরেই বাতাসে ঝুলে ঝুলে দুলে দুলে পিয়ানো আর অন্যান্য আসবাবের ওপরে আবারও স্তর হয়ে পড়ে থাকত।

আর এই সমস্ত বাদ দিলে, সেদিনের সেই ঘটনাটার কথা আমার স্মৃতিতে খুব স্পষ্ট কারণ সেটা এত দ্রুত আর এমন অবলীলায় হয়ে গিয়েছিল যে ভোলা সম্ভব না। ইরিন তার শোবার ঘরে বসে উল বুনছিল, রাত তখন আটটা বাজে। আমার হঠাৎ মেইট পানীয়টা বানানোর জন্য গরম জল উপরে আনার কথা মনে হলো। নিচের করিডোরটা ধরে ওক কাঠের দরজা পর্যন্ত চলে গেলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল, তারপর হলের ভিতরে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলাম। আর তখনই আমি লাইব্রেরি কিংবা খাবার ঘরের দিক থেকে কিছু একটা শুনতে পেলাম। শব্দটা আছে কি নেই ধরা যাচ্ছিল না। আবার চট করে অন্য শব্দ থেকে আলাদাও করা যাচ্ছিল না। একটা চেয়ার কার্পেটের ওপরে উলটে পড়ে গেল নাকি গুনগুন করে একই লয়ে কেউ কিছু কথা বলল, কিছুই স্পষ্ট নয়। একই সময়ে, কিংবা মাত্র এক সেকেন্ড আগে-পরে আমি করিডোরের এদিককার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে দুদিকে দুটো শোবার ঘরের দরজা, ঠিক সেখান থেকে শব্দটা শুনতে পেলাম। দেরি হয়ে যাবার আগেই আমি ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি ওকের দরজাটা চেপে ধরলাম, তারপর আটকে দিলাম। আমার শরীরের পুরোটা ওজন নিয়ে দরজাটার ওপরে চাপ দিয়ে রাখলাম। ভাগ্য ভালো দরজার চাবিটা আমাদের দিকেই ছিল। আরো বেশি নিরাপদ থাকার জন্য ঠিক তখনই দরজার বড়ো খিলটা দ্রুত জায়গামতো বসিয়ে দিলাম।

আমি নিচের করিডোর ধরে রান্নাঘরে গেলাম। কেতলিতে জল চড়ালাম। আর যখন গরম জল দিয়ে মেইট বানিয়ে ট্রে-তে নিয়ে ফিরছি, ইরিনকে বললাম, “ওদিকের করিডোরের দরজাটা আমাকে আটকে দিতে হলো। ওরা আমাদের বাড়ির পেছনের অংশটা দখল করে ফেলেছে।”

তার হাত থেকে উল আর কাটা ধুপ করে পড়ে গেল। ক্লান্ত আর চিন্তিত চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

“সত্যি বলছো?”

আমি উপর-নিচ মাথা নাড়লাম।

“তাহলে তো,” বলতে বলতে সে তার কোল থেকে কাঁটাদুটো আবারও হাতে তুলে নিল, ‘মানে, এখন থেকে তাহলে আমাদেরকে কেবল এই দিকটাতেই থাকতে হবে।”

গরম মেইটে আমি সাবধানে চুমুক দিলাম। তবে ইরিনের আবারও উল বোনা শুরু করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। আমার মনে আছে সে তখন ছাইরঙা হাফ হাতা একটা সোয়েটার বুনছিল। ওই সোয়েটারটা আমার খুব প্রিয় ছিল।


আরো পড়ুন: ব্রেনে ব্রাউনের অনুসন্ধান ও আপন ভুবনে আপন হয়ে ওঠা

প্রথম কয়েকটা দিন আমাদের বেশ অসুবিধা হয়েছিল, কারণ, বাড়ির বন্ধ করে রাখা দিকটায় আমাদের দুজনেরই কিছু জিনিসপত্র রয়ে গিয়েছিল যে দিকটা ওরা দখল করে ফেলেছে। যেমন, আমার ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের ভাণ্ডার তখনও ওদিকের লাইব্রেরিতে পড়ে ছিল। ইরিনের দরকারি কিছু কাগজপত্র আর তার খুব প্রিয় একজোড়া বাড়িতে পরার স্যান্ডেল যা সে শীতকালে সবসময় পরে থাকত। আমি আমার তামাক খাওয়ার পাইপটার অভাব বোধ করছিলাম, আর ইরিন সম্ভবত লেবু আর কমলায় ঠাসা একটা ক্রিস্টালের বোতলের জন্য মন খারাপ করে ছিল। বলতে গেলে প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে আমাদের আফসোস লেগেই থাকত। (তবে সেটা ওই প্রথম কয়েক দিনের জন্যই।) দেখা যেত আমরা প্রায়ই কোনো না কোনো ড্রয়ার বা আলমারি খুলছি আর একে অন্যের দিকে দুঃখী দুঃখী চেহারা করে দু’একবার তাকাচ্ছি।

“উফ্, ওটা এখানে নেই!”

তার মানে যা যা হারিয়েছে বলে ভাবছিলাম তার সঙ্গে আরো একটা কিছু যোগ হলো।

তবে তাতে কিছু সুবিধাও হয়েছিল। বাড়ি পরিষ্কার করার কাজ এতটাই কমে গিয়েছিল যে আমরা যদি বেশ দেরি করেও ঘুম থেকে উঠি, ধরা যাক, সাড়ে নয়টা, তখন শুরু করে হেলে দুলে পরিষ্কার করলেও এগারোটা নাগাদ আমাদের কাজকর্ম শেষ। তারপর দেখা যেত আমরা দুজনেই হাত গুটিয়ে বসে আছি। দুপুরের খাবার বানানোর সময়ে ইরিন আমাকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘরে আসত। আমরা নিজেরাই আলাপ করে ওটা ঠিক করেছিলাম যে আমি যখন দুপুরের খাবার রাঁধব তখন ইরিন একই সময়ে রাতের জন্য কিছু খাবার বানিয়ে ফেলবে, যে খাবার রাতে আমরা ঠান্ডাই খেয়ে ফেলতে পারি। এই ব্যবস্থায় আমরা দুজনেই বেশ স্বস্তি পেয়েছিলাম, কারণ সন্ধেবেলা রাতের রান্নার ঝামেলা আর সে কারণে শোবার ঘর থেকে আরেকবার বেরোনো আমাদের কারোরই ভালো লাগত না। তাই ইরিনের শোবার ঘরে একটা টেবিলেই আমরা রাতের ঠান্ডা খাবারের আয়োজনটা সেরে নিতাম।

এই নিয়মে যেহেতু ইরিন উল বোনার জন্য আরো কিছু বাড়তি সময় পেত তাই সে খুশিই হয়েছিল। আমি অবশ্য আমার বইগুলোর অভাবে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছিলাম কিন্তু তাই বলে সেটা মনে করিয়ে আমার বোনের কষ্ট বাড়াতে চাইনি। আমি তখন বসে বসে বাবার সংগ্রহ করা ডাকটিকেটের অ্যালবামগুলো দেখতাম। এই কাজে বেশ খানিকটা সময় চলে যেত। আমরা নিজেদেরকে যতটুকু পারা যায় আনন্দে রাখতাম। নিজেদের কাছে তৃপ্ত হবার মতো সামান্য যা ছিল, তাই দিয়েই খুশি থাকতাম আমরা। বেশিরভাগ সময় ইরিনের শোবার ঘরেই কেটে যেত। ওই ঘরটাই ছিল বেশি আরামদায়ক। খানিক পরে পরে ইরিন হয়তো বলত, ‘দেখ দেখ, এই নতুন নকশাটা দেখতে তিন পাতাওলা গাছটার মতো না?’

তার কিছু পরে হয়তো আমি শুরু করতাম, বর্গক্ষেত্রাকার কোনো একটা কাগজ তার সামনে মেলে ধরতাম, তাকে অসাধারণ কিছু ডাকটিকেট দেখাতাম। সে যেন বুঝতে পারে সেগুলো কত অসামান্য কিংবা দেখে অবাক হয় যে ইউপেন-ইটি-মালমেজির একটা ডাকটিকেট কত চমৎকার হতে পারে। আমরা আসলে ভালোই ছিলাম। আর ধীরে ধীরে আমরা ভাবতেও ভুলে যাচ্ছিলাম। মানুষ ভাবনা-চিন্তা ছাড়াও বেশ থাকতে পারে।

(ইরিন যখনই ঘুমের মধ্যে কথা বলত, আমি সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতাম। তারপর আর ঘুমাতাম না। আমি কেন যেন কখনোই ওরকম আওয়াজ যা কোনো মূর্তি বা কাকাতুয়ার গলা থেকে বেরিয়ে আসে কিংবা কোনো স্বপ্নের আলাপন যা কল্পনার অবদান, যা হয়তো ঠিক কণ্ঠ থেকে ইচ্ছাকৃত তৈরি করা আওয়াজ নয়, তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। ইরিন বলেছিল আমি নাকি ঘুমের মধ্যে নিজেকে প্রচণ্ড ঝাঁকাই আর মাঝেমধ্যে শরীর থেকে কম্বলও ছুঁড়ে ফেলে দিই। আমাদের দুজনের শোবার ঘরের মাঝখান দিয়ে বিস্তৃত বসার ঘরটা বয়ে যায় কিন্তু রাতের নির্জনতায় এক ঘরের শব্দ আরেক ঘরে স্পষ্ট শোনা যায়। আমরা একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের বা কাশির শব্দ তো পেতামই, এমনকি কখনো বাতির সুইচের দিকে নিঃশব্দ হাত বাড়ানোর আকুতিও টের পেতাম। আর সেসব শব্দে ঘুম ভাঙলে তারপর যা হতো, আমাদের মধ্যে কেউই আর ঘুমাতে পারতাম না।

রাতে আমাদের দুজনের নিশাচরের মতো উশখুশ করার শব্দ ছাড়া বাকি বাড়িটা ছিল একেবারেই চুপচাপ। দিনের বেলা অবশ্য বাড়ির কাজকর্মের নানানরকম আওয়াজ শোনা যেত। শোনা যেত ধাতব উল বোনার কাঁটার একটার সঙ্গে আরেকটা টোকার শব্দ, আর শোনা যেত ডাকটিকেটের অ্যালবামের পাতা ওলটানোর ফরফর আওয়াজ। বাড়ির ওই ওক কাঠের দরজাটা যে বিশাল ছিল তা হয়তো আমি আগেই বলেছি। রান্নাঘর আর ঘোসলের ঘর, যে দুটো আমাদের বাড়ির দখলকৃত অংশের ঠিক পাশে সেখানে আমরা বেশ উঁচু স্বরে কথা বলতাম। ইরিন মাঝেমাঝে সেখানে গুনগুনিয়ে গানও গাইত। রান্নাঘরে বরাবর জোরে শব্দ হতে থাকত, গ্লাসের শব্দ, থালা-বাটির শব্দ, সামান্য বিরতিতে সেখানে শোরগোল লেগেই থাকত। রান্নাঘরে থাকলে আমরা কখনোই তেমন চুপচাপ থাকতাম না। কিন্তু ওখানকার কাজ শেষে আমরা যখন শোবার ঘরে চলে আসতাম কিংবা বসার ঘরে কিছুক্ষণ সময় কাটাতাম, বাড়িটা তখন একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যেত। কখনো অল্পস্বল্প মাতাল হলে আমরা বুঝেশুনে আরো সাবধানে পা ফেলতাম যেন একে অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে না দাঁড়াই। আমার মনে হয় আমি এতটা সাবধান হয়ে চলতাম তার কারণ ইরিন যখন ঘুমের মধ্যে কথা বলা শুরু করত আমার ঘুম অবধারিতভাবে ভাঙত আর আমার খারাপ লাগত।)

সামান্য আগুপিছু ছাড়া বাকি সমস্তকিছুই আসলে দিনের পর দিন ছিল একই কাজের পুনরাবৃত্তি। এক রাতে আমার খুব পিপাসা পেল। আর ঘুমানোর আগে আমি ইরিনকে বলেছিলাম যে এক গ্লাস জলের জন্য আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। ইরিন যথারীতি তখন উল বুনছিল। তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি রান্নাঘরের দিক থেকে কিছু শব্দ শুনলাম। শব্দটা যদি রান্নাঘরে না হয়ে থাকে তবে নিশ্চয় গোসলের ঘরে। রান্নাঘর আর গোসলের ঘরের মাঝখান থেকে আসা লম্বা করিডোরটা শব্দটাকে ধীরে ধীরে ক্ষীণ করে দিচ্ছিল। ইরিন লক্ষ করেছিল যে সেদিকে এগোতে গিয়েই কেমন হুট করে আমি থেমে গিয়েছিলাম। তাই উল রেখে কোনো কথা না বলে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমরা দুজন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে শব্দ শুনতে লাগলাম। শব্দের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। শুনতে শুনতে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে তারা ওক কাঠের ভারী দরজাটা পেরিয়ে আমাদের এদিকটাতে এসে পড়েছে। হয় রান্নাঘরে, না হলে গোসলখানায় নিশ্চিতভাবে আস্তানা গেড়েছে। আর সেসবের কোনোটাতে না হলে তার পাশের বড়ো হল রুমে, যেটা বলতে গেলে আমাদের শোবার ঘরের পরপরই।

একজন আরেকজনের দিকে তাকানোর জন্য আমরা আর এতটুকু সময় ব্যয় করিনি। আমি ইরিনের হাতটা টেনে ধরে তাকে আমার সঙ্গে দৌড়োতে বাধ্য করলাম। রট আয়রনের দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার আগপর্যন্ত আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। তখনও আমাদের ঠিক পেছনে গুনগুনানো আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে সেটা তীব্র চিৎকারে পরিণত হচ্ছিল। দরজাটা আমি চেপে আটকে দিলাম আর বাইরের লবিতে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে আর কিছু শুনতে পাওয়া গেল না।

“আমাদের এদিকটাও ওরা নিয়ে নিল!” ইরিন বলল। তার হাতে ধরে রাখা উলের বোনা অংশের মাথা থেকে উল চলে গেছে দরজার নিচে দিয়ে অদৃশ্য উৎসের দিকে। সে যখন বুঝতে পারল যে উলের গোল্লাটা দরজার ভিতরের দিকে, বোনা অংশের দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে সে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে দিলো।

হতাশাগ্রস্ত গলায় আমি জানতে চাইলাম, “তুমি কি সঙ্গে কিছু আনতে পেরেছিলে?”

“নাহ্, কিছুই আনিনি।”

আমাদের কাছে নিজেদের হাত-পা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শোবার ঘরের আলমারির মধ্যে রাখা পনের হাজার পেসোর কথা আমার তখন হুট করে মনে পড়ে গেল।

আমার হাতে অবশ্য ঘড়িটা ছিল আর তাকিয়ে দেখলাম তাতে এগারোটা বাজে। আমি ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম (আমার মনে হয় সে তখন কাঁদছিল) আর ওভাবেই আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে আমার ভয়ানক খারাপ লাগছিল। বাইরের বিশাল দরজাটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা ম্যানহোলে ফেলে দিলাম। আমি কিছুতেই চাইনি যে ফালতু কোনো বদমাশ বাসাটার মধ্যে ঢুকে আমাদের প্রিয় জিনিসগুলো চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। তবে ঠিক ওই মুহূর্তে আস্ত বাড়িটা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>