| 29 মার্চ 2024
Categories
চলচ্চিত্র ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১০) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত জ্যোতিপ্রসাদকে ১৯৫০ সনের গোটা বছরটা রোগের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। চিকিৎসকরা শিলং মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। সেই সময় জ্যোতিপ্রসাদ কিছুই খেতে পারেন না। কিছু খেতে চেষ্টা করলেই সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে বেরিয়ে আসে। আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী ডঃভুবনেশ্বর বরুয়া জ্যোতিপ্রসাদের  চিকিৎসা করতে লাগলেন। তারই  পরামর্শে জ্যোতিপ্রসাদকে শিলঙের ওয়েলস  মিশনে স্থানান্তরিত করা হল। ইতিমধ্যে দুমাস পার হয়ে গেছে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে ডক্টর হিউজ জ্যোতিপ্রসাদের অপারেশন করা স্থির করলেন। ১৯৪৬ সনের এক্স-রে রিপোর্টে ধরা পড়া টিউমারটা ইতিমধ্যে কালান্তক রূপ ধারণ করেছে। অপারেশনের সময় রক্তের প্রয়োজন হল। রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। পরিবারের কারও সঙ্গে মিলল না। তিনজন রক্ত দান করলেন। একজন বাঙ্গালী ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর ,বোন নীরা ডোগ্ৰার বাড়িতে কাজ করা একটি মাদ্রাজি ছেলে এবং শিলংয়ের লেডীকিন স্কুলের ওয়ার্ডেন রত্নপ্রভা বরকাকতি। অপারেশন সফল হল না । তবু কিছুদিনের জন্য জ্যোতিপ্রসাদকে সুস্থ দেখা গেল। এই সময়ে তিনি তার খবর নিতে আসা মানুষের সঙ্গে নানা ধরনের হাসি ঠাট্টা করতেন। একদিন মজা করে বললেন-‘ এবার আমি কী মূর্তি ধরি তার ঠিক নেই । আমার শরীরে অসমিয়া ,বাঙালি ,মাদ্রাজি সবার রক্তই প্রবেশ করেছে।’ সেই রুগ্ন অবস্থাতেই অভয় দুয়ারা তার একটি প্রতিকৃতি আঁকলেন। কিছুদিনের মধ্যেই জ্যোতিপ্রসাদের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হল। এবার তিনি তেজপুরের সেই ‘পকী হাউসে’ ফিরে আসতে চাইলেন। নবীনের গাড়িতে জ্যোতিপ্রসাদকে গুয়াহাটিতে নিয়ে আসা হল। সঙ্গে একজন নার্স এবং ভাই হৃদয়ানন্দ। ডক্টর বরুয়া রোগী দেখে সঙ্গে সঙ্গে তেজপুরে নিয়ে যেতে  বললেন।জাহাজে করে তেজপুরে  নিয়ে যাওয়া হল। তেজপুরে পৌঁছানোর দুদিন পরে ১৯৫১  সনের ১৭ জানুয়ারি জ্যোতিপ্রসাদ তার প্রিয় ‘পকী ঘরে’ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

    এবার আমরা আবার জ্যোতি প্রসাদের  নাটকের আলোচনায় ফিরে যাব । ‘রূপালীম’জ‍্যোতিপ্রসাদের তৃতীয় নাটক। ৩৩ বছর বয়স থেকে আরম্ভ করে ৩৫/৩৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নাটকটি লিখেছিলেন । ১৯৩৬  সনে তিনি নাটকটির লেখা সম্পন্ন করেন। এরপরেও নাটকটিতে তিনি অনেক পরিবর্তন করেন।১৯৩৭ সনে নাটকটি তেজপুরের রঙ্গমঞ্চে পরিবেশিত হয় । নাটকের ঘটনা চরিত্র সমস্তই কাল্পনিক । নাট্যকারের মতে নাটকটিতে আদর্শ চরিত্র রূপায়িত করার চেয়ে চরিত্রের বিচিত্রতা দেখানোই মূল লক্ষ্য ছিল । এই নাটকে একটি  পাশ্চাত্য নাটকের প্রভাব রয়েছে।  মেটারলিংকের ‘ মন্না ভান্না’র প্রভাব। 

    সীমান্তের পার্বত্য সমাজের প্রচলিত কাহিনি, রীতিনীতি, নাটকটিতে  প্রকাশিত হতে দেখা যায়।পূব সীমান্তের সভ্য বৌদ্ধ জনজাতি রুকমী জনজাতির যুবক-যুবতির  প্রেমকে কেন্দ্র করে নাটকটির কাহিনি গড়ে উঠেছে। নাটকটিতে রুপালীম এবং মায়াব রুকমী জাতির প্রেমিক প্রেমিকা। কিন্তু দুজনের মিলনের পথে বাধা হল রুপালীমের  বৃদ্ধ পিতা জুনাফা। তিনি শর্ত আরোপ করলেন যে মায়াবই একটা বাঘ মেরে নিজের বীরত্ব দেখাতে পারলে তবেই  রপালীমকে মায়াবর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে। মায়াবই শর্ত পূরণ করে একটা বাঘ মারল। ঠিক তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হল সীমান্ত রাজ্যের সেনাপতি রেণথিয়াং। তিনি দাবি করলেন যে বাঘটা তার তীরে বিদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত রাজা মণিমুগ্ধ সেখানে উপস্থিত হলেন। মণিমুগ্ধ রূপালীমকে  দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন ।এই প্রস্তাবে জুনাফা রাজি হল না। রেণথিয়াং জুনাফাকে আঘাত হেনে রূপালীমকে মণিমুগ্ধের জন্য রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল। জুনাফা এবং মায়াব রুকমী রাজার কাছে রুপালীমকে উদ্ধার করার প্রার্থনা জানায়। রাজা মনিমুগ্ধের  বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহস করে না ।এই রাজার বোন ইতিভেন মণিমুগ্ধের বাগদত্তা। কিন্তু ইতিভেন মণিমুগ্ধের  এই কাজের কথা জানতে পেরে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে এবং ভাইয়ের অকর্মণ্যতাকে ধিক্কার দিয়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নিজেই রুপালীমকে উদ্ধার করার জন্য যাত্রা করে। মণিমুগ্ধের সৈন্য ইতিভেনকে বন্দি করে। রুপালীম সুযোগ পেয়ে মায়াবের কাছে পালিয়ে যায় কিন্তু মৃণিমুগ্ধের সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে আসে । মায়াব এবং জুনাফাও বন্দি হয়। শেষ পর্যন্ত মায়াব এবং জুনাফার মুক্তির বিনিময়ে রুপালীম মণিমুগ্ধের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মণিমুগ্ধের সমস্ত অহংকার রুপালীমের কাছে চুরমার হয়ে গেল। রুপালীমকে মুক্ত বলে ঘোষণা করতে মণিমুগ্ধ বাধ্য হল। এদিকে রূপালীমের আত্মসমর্পণ নিয়ে নিজেদের রাজ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সবাই রূপালীমকে  গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। মায়াব,জুনাফা এবং ইতিভেন রুপালীম কে কলঙ্কিতা নারী বলে ঘোষণা করে পুড়ে মরার জন্য আহ্বান জানাল। রুপালীমকে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। এভাবেই রুপালীম সামাজিক রীতির বলি হল।

    ‘রুপালীম’ নাটকে সাতটি অংক রয়েছে। অংক গুলিতে দৃশ্য বিভাজন নেই। আঁটোসাঁটো কাহিনিতে সমৃদ্ধ নাটকটি বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে সমুজ্জ্বল। একদিকে রয়েছে মায়াব, জুনাফা এবং রুপালীমের মতো দুর্বল শ্রেণি,অন্যদিকে রয়েছে রুকমী  রাজা,রেনফিয়াং  এবং মণিমুগ্ধের মতো ভোগ বিলাসে মত্ত শাসকশ্রেণি। তৃতীয় শ্রেণিতে রয়েছে ইতিভেন এবং রুকমী ডেকার চরিত্র।

    রুপালীমের  প্রেমের দৃঢ়তার কাছে মণিমুগ্ধ হার মেনে রুপালীমকে  মুক্ত করে দেয়। রুপালীম নিজের সতীত্ব অক্ষুন্ন রেখে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিল যদিও কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। সে যার মুক্তির জন্য নিজের সমস্ত কিছু অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিল সেই মানুষগুলি তাকে ভুল বুঝে। তার পিতা জুনাফাও তাকে অসতী বলে ভাবে। এতখানি ত‍্যাগ করার পরেও রুপালীমকে আগুনে পুড়ে মরতে  হয় । তাই রুপালীম হয়ে উঠে নাটকের ট্রাজেডি নায়িকা। মায়াবের চরিত্রে কোনো ধরনের গতিশীলতা নেই। নায়কের চরিত্রের দৃঢ়তা  তার মধ্যে দেখা যায় না তা সত্ত্বেও চরিত্রটি দর্শক পাঠকদের সহানুভূতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে কারণ ভোগ বিলাসে মাতাল সমাজের শাসকশ্রেণির নির্মম রথের চাকার নিচে মায়াবের মতো সহজ-সরল সাধারণ মানুষের জীবন চুরমার হয়ে যায়। তারই প্রতিফলন ঘটেছে আলোচ্য চরিত্রে। ইতিভেন চরিত্রটিও মণিমুগ্ধের মতোই বিচিত্র এবং জটিল। একদিকে প্রেমিকা অন্যদিকে চরম নিষ্ঠুরা, একদিকে গভীর নীতিবোধ সচেতনতা অন্যদিকে স্বদেশ প্রেম, একদিকে নারীসুলভ কোমলতা অন্যদিকে পুরুষসুলভ কঠিনতা- এই ধরনের বিচিত্র প্রবৃত্তির সমাহার ঘটেছে আলোচ্য ইতিভেন চরিত্রে।

    মণিমুগ্ধের চরিত্র অঙ্কনে নাট্যকার যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নাটকটিতে সুন্দর এবং অসুন্দরের মধ্যে অর্থাৎ জ্যোতিপ্রসাদের নিজের ভাষায় বলতে গেলে সংস্কৃতি এবং দুষ্কৃতির মধ্যে সংঘাত দেখানো হয়েছে। নাটকের সংলাপে রোমান্টিক কাব্যিক ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। জ্যোতিপ্রসাদ নাটকটিতে চরিত্রসমূহের মুখে যে সংলাপ প্রয়োগ করেছেন তাতে  যে শুধু চরিত্রগুলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তাই নয়, এই সংলাপগুলি চরিত্র সমূহের মানসিক অবস্থা ,দ্বন্দ্ব, হিংসা ,প্রতিশোধ ,আবেগ-অনুভূতির ও আভাস দান করে। আমরা অনায়াসে বলতে পারি আলোচ্য নাটকের কাহিনি, চরিত্র এবং সংলাপ আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক হওয়ার জন্য পাঠকসমাজ এবং দর্শক নাটকটিকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত