‘নিমাতী কইনা’ বা ‘রুপকোঁয়র’ জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার চতুর্থ নাটক। নাটকটি ১৯৩৬ সণে লেখা। লক্ষ্ণীনাথ বেজবরুয়ার ‘বুড়ি আই’র সাধু ‘থেকে গৃহীত একটি রূপকথার আদর্শে নাট্যকার এই গীতি নাটকটি রচনা করেন। নাট্যকার নাটকটিকে শিশু নাটিকা বলে উল্লেখ করেছেন যদিও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এটি একটি গভীর অর্থ ব্যঞ্জক নাটক।
রতনপুরের রাজা সবিতাপ্রিয় এবং তার কন্যা নিমাতী কইনা। নিমাতী কইনা কথা বলে না। নিমাতী সখী রত্নাবলী, চিত্রাবলী, মুক্তাবলী, রূপাবলী,এবং নিদ্রাবলী নানা উপায় অবলম্বন করেও নিমাতীর মুখে কথা ফোটাতে পারেনি। কথাটা জানতে পেরে বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু লোক রতনপুরের রাজদরবারের এসেছে। প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য একটি। বোবা নিমাতীর মুখে কথা ফোটানো। প্রথমেই উপস্থিত হয়েছে কামরূপ প্রদেশের একজন ওঝা। তিনি নিমাতীর মাথার কাছে বসে নানা রকম মন্ত্র পাঠ করে,ঝাড়ফুঁক করে নিমাতীকে কথা বলাতে চেষ্টা করে কিন্তু তার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপরে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ জন এসে নিমাতীর মুখে কথা বলানোর চেষ্টা করে এবং অসফল হয়ে চলে যায় –
‘পারিষদ বৃন্দ
এসে গেল দেশ-বিদেশের
অচিন অজানা প্রদেশের
নানা লোক
তারা ভেবে বুঝতে পারে না ।
কেন কথা বলে না নিমাতী কইনা?’
দেশ-বিদেশের লোক এসে নিমাতীর মুখে কথা ফোটাতে পারেনি যদিও রাজা সবিতাপ্রিয় আশাবাদী যে তার কন্যা নিমাতী একদিন হলেও কথা বলবে। গন্ধর্ব দেশ থেকে নৃত্য কুশলা রূপবতী বিলাসিনী রাজদরবারে এসে উপস্থিত হয়।উদ্দেশ্য সেই একটাই, নিমাতীর কন্ঠে কথা বলানো। নানা ধরনের নৃত্য প্রদর্শন করেও সে ব্যর্থ হয়।-
‘ ব্যর্থ, ব্যর্থ আমি প্রভু ।
ব্যর্থ আমার ছন্দের প্রভাব
ক্ষমা কর মহারাজ।‘
একের পর এক গুণীজন এসে নিমাতীর কন্ঠে কথা ফোটাতে ব্যর্থ হলেও রাজা কিন্তু আশা ছাড়েননি। তাই তিনি লোক পাঠিয়ে দেশে দেশে প্রচার করেন যে, যে ব্যক্তি নিমাতীর কন্ঠে ভাষা দিতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা নিমাতীকে দান করা হবে। শেষ পর্যন্ত রতনপুরের রাজদরবারে রূপকোঁয়র নামে এক যুবক এসে উপস্থিত হয়। রাজসভার সমস্ত পন্ডিত বিজ্ঞজনেরা বীণা হাতে বৈরাগীর রূপে আসা রূপকোঁয়রকে উপহাস করে রাজসভা থেকে বের করে দিতে চায়। কিন্তু রাজা সবিতাপ্রিয় রুপকোঁয়রকে একটি সুযোগ দান করে। শেষ পর্যন্ত রূপকোঁয়র নিমাতীর কন্ঠে ভাষা ফোটাতে সমর্থ হয়।রূপকোঁয়রের আগে যারা নিমাতী কইনার মুখে ভাষা ফোটাতে চেষ্টা করেছিল তারা নিজের স্বার্থ পূরণের জন্য এসেছিল। রাজকন্যার মুখে হাসি ফোটাতে পারলে রাজার কাছ থেকে প্রচুর ধন এবং পুরস্কার লাভ করতে পারবে কিন্তু এই ধরনের স্বার্থলোভী কামনা যুক্ত কলা চর্চা লক্ষ্মী অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক মুখের ভাষা জোগাতে পারে না। নিমাতীর কণ্ঠে ভাষা জোগাতে পারে চির সুন্দরের একান্ত সেবক রপকোঁয়র। ডক্টর সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা যথার্থই বলেছেন-‘ পাণ্ডিত্যের পর্ব ধনের গর্ব, রূপের অহংকার এই সমস্ত কলা লক্ষ্ণী বোধনের জন্য মিথ্যা প্রয়াস। কলা বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায় হয়ে থাকে। তাই কলা সাধনায় নিমাতীর কন্ঠে সুর দিতে পারে একমাত্র সৌ্নদর্যের পূজারী রূপকোঁয়র।নাটকটিতে গন্ধর্ব রাজা, গন্ধর্ব নৃত্যবিশারদ আচার্যদেব, শিপীনী মেয়েরা, চাষার মেয়েরা বুড়ো রাজা ইত্যাদি চরিত্রের ধ্ন, রূপ এবং পাণ্ডিত্যের অহংকার থাকার জন্য নিমাতী কন্যার কন্ঠে ভাষা ফোটাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে রূপকোঁয়র নিমাতীর কন্ঠে সুর দিতে সক্ষম হয়েছে। গর্ব, অহংকার না থাকা একান্ত কলা সাধক রূপকোঁয়র । জ্যোতিপ্রসাদ দেখিয়েছেন শিল্পীর মানস রাজনীতিবিদদের অহংকার, গর্ব ,ক্ষমতালিপ্সা জয় করতে পারলেই বিশ্বে শান্তি সম্প্রীতি স্থাপিত হতে পারে। ছয়টি দৃশ্যে বিভাজিত নাটকটি কাব্য- ভাষা এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। হীরেন গোঁহাই লিখেছেন-‘ নিমাতী কইনা লিরিক ধর্মী কাব্য নাটক। তার মধ্যে মানবীয় চরিত্রের আলো ছায়ার মধ্য দিয়ে এক দ্বন্দ্ব প্রকাশ করার ,বা সেই দ্বন্দ্বের সমাধান প্রদর্শন করার কোনো চেষ্টা নাই। বরং তাঁর জায়গায় কতগুলি বিমুর্ত মানবীয় গুণ বা ক্রিয়ার রূপক ধর্মী প্রতিমার সংলাপের মাধ্যমে একটি ধারণা মূর্ত করা হয়েছে – রূপ নয়, বিজ্ঞান নয়, পাণ্ডিত্য নয়, অবহেলিত এবং শিল্পীই জগতে নিমাতীর কণ্ঠস্বরে ভাষা দিতে পারে।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১০)
‘সোণপখিলী’ জ্যোতিপ্রসাদের একটি অসম্পূর্ণ নাটক।একটি শিশু নাটক। নাট্যকার এই নাটকটির মাধ্যমে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে কলার সাধনার মাধ্যমে কীভাবে মানুষ চরম আনন্দ লাভ করতে পারে। তিন খণ্ডে বিভক্ত নাটকটির তৃতীয় খন্ড অসম্পূর্ণ হয়ে রইল। প্রধান চরিত্র কবিতা কুমার। সোণপখিলী কোনো মানবীয় রূপ নয়। সে একটি পাখি যে রুনুঝুনু করে আওয়াজ করে, হাসে, নাচে, গান গায়। মানুষের যখন মন খারাপ থাকে তখন সে মানুষের মনে আনন্দের স্পর্শ বুলিয়ে মন-প্রাণকে আন্দোলিত করে তোলে। আসলে জ্যোতিপ্রসাদ সোণপখিলীকে সোন্দর্য এবং আনন্দের প্রতীকরূপে গড়ে তুলেছেন। কবিতা কুমার সোণপখিলীকে পেতে চায় ।সোণপখিলী কবিতা কুমারের কাছে ধরা দেব, দেব করেও ধরা দেয় না, দূরে সরে যায়। কারণ সোণপখিলী ধরা দিতে পারেনা বা ধরার জিনিস নয় । মানুষ নিজের কর্ম করে বিশুদ্ধ পথে এগিয়ে গেলেই সোণপখিলীকে অর্থাৎ সৌন্দর্য এবং আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।সৌন্দর্য এবং আনন্দ পেতে হলে মানুষকে সমস্ত দুষ্কৃতি কার্যের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। এটা সম্ভব হবে মানুষের একান্ত কলার সাধনার দ্বারা। এই নাটকটি রাক্ষসের দেশ অতিক্রম করে সোণপখিলীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা তারই ইঙ্গিত দান করে। এখানে রাক্ষস কথাটি দুষ্কৃতির প্রতীক। নাটকটি যদি জ্যোতিপ্রসাদ সম্পূর্ণ করে যেতে পারতেন তাহলে হয়তো আমরা জ্যোতিপ্রসাদের শিল্পীমনের চিন্তা ভাবনার তথা দর্শনের বিষয়ে আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম।
অনুবাদক