| 25 এপ্রিল 2024
Categories
চলচ্চিত্র ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১২) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

    ‘লভিতা’ জ্যোতিপ্রসাদের শেষ বয়সে রচিত নাটক। নাটকটি ১৯৪৫-১৯৪৬  সনে রচিত হয়। প্রকাশিত হয় ১৯৪৮  সনে। পূর্বের কোনো নাটকের সঙ্গে এই নাট্যরীতির মিল দেখা যায় না । এটি একটি সামাজিক নাটক। এর পটভূমি হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমকালীন অসমের রাজনৈতিক অবস্থা। জ্যোতিপ্রসাদের এই নাটকটি পরম্পরাগত নাট্যরীতি পরিহার করে বাস্তববাদী ধ্যান-ধারনা এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের গতানুগতিকতা থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছে। নাটকের ভূমিকায় লেখা হয়েছে-‘ লভিতা যদিও নাট্যকার রঙ্গমঞ্চের জন্য লিখেছেন তবুও এটি গতানুগতিক নাটকের সারিতে পড়ে না। এখানে সচরাচর যেভাবে নাটকে আখ্যান, প্লট, চরিত্রাঙ্কন  থাকে ঠিক সেভাবে এখানে দেওয়া হয়নি। আখ‍্যান আছে যদিও তাকে মাত্র নাটকীয় ঘটনাবলী গাঁথার জন্য সূত্রের মতো নেওয়া হয়েছে। প্লট এখানে দেখানো হয়নি। এর নায়ক সমগ্র অসমিয়া জনগণ। অসমিয়া সমাজ কীভাবে পৃথক পৃথক জীবন ক্ষেত্রে,সেই ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির সাম্রাজ্যবাদী সমরের অসমের জীবনের ওপরে সংঘাতকে এক হাতে  বাধা দিয়ে ,অন্য হাতে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব রোধ করার জন্য বিয়াল্লিশের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতির সক্ষমতা বা অক্ষমতা দেখিয়েছে তাই এই নাটকে পাওয়া যাবে।’

    নাটকের কাহিনির শুরু হয়েছে গোলাঘাটের লহর জান মৌজার ফুলগুড়ি গ্রামকে কেন্দ্র করে। এই গ্রামের চাষি বাণেশ্বর বরুয়ার মেয়ে লভিতা। লভিতা শিক্ষিতা এবং সুন্দরী। জাপানিদের আক্রমণে গ্রামের বিস্তর ক্ষতি হয়। অনেক লোকের মৃত্যু হয়। বাণেশ্বর বরুয়া ও তাদের মধ্যে একজন। সরকার বিমানঘাঁটির আশেপাশে থাকা বাড়ি ঘর খালি করে দিতে নির্দেশ দেওয়ায় লভিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেমিক গোলাপের চাপে সেই জায়গা ত‍্যাগ  করে লহরিজানের মৌজাদারের ঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানে লভিতা শান্তিতে থাকতে পারো না। লভিতার সঙ্গে মৌজাদারনী দুর্ব্যবহার করে। লভিতার প্রতিবাদী চরিত্র মৌজাদারনী পছন্দ করে না। শেষ পর্যন্ত লভিতা মৌজাদারের গৃহত্যাগ করে । পথে মিলিটারি লভিতার শালীনতা হানির চেষ্টা করে। একজন এ এস আই এর সহযোগে লভিতা রক্ষা পায় ।লভিতা  ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে নার্সের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ লাভ করে। সেখানেই লভিতা এবং অন্যান্য নার্সেরা জাপানি সৈন্য এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের হাতে বন্দি হয়। প্রত্যেকেই আজাদহিন্দ  ফৌজে যোগদান করে। ফৌজের লেফটেন্যান্ট বরুয়া ব্রিটিশের অধীনে থাকা ভারতীয় সৈন্য বাহিনীদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানায়। একদল সৈন্য নিয়ে বরুয়া  একটা টিলার ওপরে ত্রিরঙ্গা জাতীয় পতাকা উড়ানোর জন্য এগিয়ে যায়। লভিতা এবং অন্যান্য নার্সেরা  জয়হিন্দ ধ্বনি দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন‍্যের মুখোমুখি যুদ্ধ হয় । লভিতা রণচণ্ডী মূর্তি নিয়ে টিলায় উঠে দাঁড়ায় । মেশিনগানের গুলি এসে  লভিতার  বুকে লাগে এবং জাতীয় পতাকার খুঁটিটাকে ধরে লভিতা মৃত্যুবরণ করে।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১১)


    এই নাটকে অনেক চরিত্র দেখা যায়। সেগুলি হল যথাক্রমে লভিতা ,ইলাহী বক্স, আমলা, ঠিকাদার ,মহাজন, মৌজাদারনী, গ্রাম প্রধান এবং গোলাপ ইত্যাদি। সত্যের প্রতি গভীর নিষ্ঠা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদই লভিতার জীবনের মূলমন্ত্র । সেই জন্যই ‘কারেঙর লিগীরী’ এবং ‘রূপালীম’ নাটকের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে ওঠা জ্যোতিপ্রসাদের কাঙ্খিত চরিত্রটি আলোচ্য লভিতা নাটকে পূর্ণতা লাভ করেছে।

    নাটকটি পাঁচ অঙ্কের। প্রথম অঙ্কে  তিনটি, দ্বিতীয় অঙ্কে  দুটি, তৃতীয় অঙ্কে দুটি , চতুর্থ অঙ্কে দুটি এবং পঞ্চম অঙ্কে চারটি দৃশ্য বিভাগের মাধ্যমে নাটকের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

    আলোচ‍্য নাটকে যে সমস্ত গীত সংযোজিত হয়েছে তার সবগুলিই দেশভক্তিমূলক। প্রতিটি গীতই নাটকে বলিষ্ঠতা দান করেছে। প্রথম অঙ্কে ‘লুইতেদি যাৱ করে নাৱরীয়া’,’মোর বারীত ফুলিলে ইন্দ্রজিৎ মালতী’,’সাজু হ সাজু হ ন-জোৱান ‘ অ আমার চতুর্থ অঙ্কে বিশ্ববিজয়ী নওজোয়ান’, পঞ্চম অঙ্কে ‘ জয় হিন্দ জয় জয়’ এবং’লুইতর আকাশত তরার তরাবলী’ গীতটি সন্নিবিষ্ট হয়েছে ।

    লভিতা প্রথমে ডিব্রুগড়ে মঞ্চস্থ হয়। ডিব্রুগড় আর্ট প্লেয়ার্স  সোসাইটি ১৯৪৭ সনে প্রথম মঞ্চস্থ করার আগে জ্যোতিপ্রসাদ আখড়ায় উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিল।

    সংলাপ নাটকের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এর মাধ্যমে নাটকের কাহিনি এবং চরিত্র নিজস্ব রূপ লাভ করে। আলোচ্য নাটকের মুখ্য চরিত্র লভিতাকে কেন্দ্র করে  নাটকটি এগিয়ে গেছে। লভিতা ছাড়াও দারোগা, মৌজাদার-মৌজাদারনী, ইলাহী বক্স, ঠিকাদার, মহাজন ইত্যাদি চরিত্র অসমের সমাজ জীবনের এক একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছ। এই চরিত্র গুলির মধ্য দিয়ে নাট্যকার অসমের গ্রামের পরিবেশ, গ্রামীণ চরিত্র এবং চরিত্রের মানসিকতা বাস্তব রূপ তুলে ধরেছেন।

    আলোচ্য নাটকের মাধ্যমে জ্যোতিপ্রসাদ স্বাধীনতা-পূর্ব অসমের সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত এবং সমাজ বিপ্লবী এই দুই শ্রেণি অসমিয়ার চরিত্রগত কিছু দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।ইলাহী বক্স নামের চরিত্রটি মানবীয় উদারতাবাদের কিছু দিক দেখানো হয়েছে।একজন সাধারণ গ্রাম্য অসমিয়া যুবতি ‘কমিউনিস্ট আখ্যা পাওয়া ,পুলিশের হাত থেকে পিস্তল কেড়ে আনার মতো সাহস অর্জন করা ,’আমি গান্ধীর বুকে নাম লেখাইনি’বলা ,গোলাপের মতো মানসিকভাবে দুর্বল যুবকের প্রেম প্রত্যাখান করা,ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া –ইত্যাদি ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ নাটকটিকে এক অনন্য চরিত্র প্রদান করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত