ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৫) । বাসুদেব দাস
জ্যোতিপ্রসাদের জাতীয়তা বোধে কোনো ধরনের সংকীর্ণতা ছিলনা। তিনি ছিলেন গ্রামের গন্ডিতে জন্মগ্রহণ করা বিশ্বনাগরিক কবি। জাতীয়তাবোধকে তিনি সবসময় উদার মানবতার সুরে সমৃদ্ধ করেছেন। ধ্বংসাত্মক চেতনাকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেননি। তিনি বিজ্ঞানের বিশাল গতিশীল ভূমিকার কথা জানেন। তাই তিনি গেয়ে উঠেন-
বিদারিম মই সমাজতন্ত্র
রচিম নতুন মানবতন্ত্র
বিজ্ঞান স্বর্গজিৎ
মই জ্ঞানর ইন্দ্রজিৎ।
কিন্তু বিজ্ঞান যখন ক্ষমতাশালীদের হাতে পড়ে মানুষের অধিকার খর্ব করে, জাতির প্রগতি রুদ্ধ করে তখন কবি হয়ে উঠেছেন কঠোর, ধিক্কার দিয়েছেন এই ধরনের বিধ্বংসী প্রবণতাকেঃ
এফালে শোষকর দলে
সজ্জিত হৈ জড় বিজ্ঞানর
অস্ত্রে সদলবলে
পৃথিবীর যত নিষ্পেষিতক
চিরদাস করিবলে
ভাগ ভাগ করি পৃথিবীখনকে
প্রতিদ্বন্দ্বী আন শোষকর সতে
মর যুঁজ যুঁজে
আকাশে আকাশে
সাগরে সাগরে
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে ভাগ ভাগ করে জনতার শক্তিকে দুর্বল করে সেকথা জ্যোতিপ্রসাদ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অসমীয়া একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতি। ভাষা, কৃষ্টি ধর্মের বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থিতি জাতিটিকে সমৃদ্ধ করেছে। জ্যোতিপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন এরকম একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতির প্রতিটি উপাদানের উৎকর্ষ সাধন না করে যদি কোনো ভাগকে পেছনে ফেলে যাওয়া হয়, তাহলে তার মধ্য দিয়ে পূর্ণ সংস্কৃতি প্রকাশ পায় না- সমন্বয়ের সভ্যতাও গড়ে উঠে না। জ্যোতিপ্রসাদ তাই জাতি-ধর্ম ভাষা বর্ণ নির্বিশেষে একই মঞ্চে সবাইকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ করাতে চেয়ে ছিলেন ।
জ্যোতিপ্রসাদের কবিতায় তৎকালীন বিশ্বের রাজনীতি,অর্থনীতি এবং সমর-সংস্কৃতি হতে পারে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হয়ে বিশ্বরাজনীতির উপরে তিনি চোখ রেখে ছিলেন এবং মানুষের কল্যাণ কামনা করা কবির মানবপ্রীতি দেশের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। বিশ্ব সংকটের মধ্যে পরিত্রাণের উপায় তিনি নিজের দেশের ইতিহাস চেতনার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেনঃ
মহা সংস্কৃতি ভ্রষ্ট ভারত হীনবীর্য হল।… সেই মহা আলোকর বাণী লৈ জাগে/ এক মহা সন্ন্যাসী ত্যাগী/… কৌপিনধারী মোহন গান্ধী ।’ জয়মতীর আত্মার উক্তি) । কাব্য চিন্তার এই পরিসর বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গ্রামে গ্রামে আলো জ্বালিয়ে যাওয়া গ্রামের ছেলের কাছ থেকে সামগ্রিকভাবে বিশ্বমানবের মুক্তিচিন্তা, বিজ্ঞানীর আবিষ্কার থেকে হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার সংস্কৃতির সারবত্তা গান্ধীর অহিংসার মধ্যে খুঁজে পাবার জন্য কবি একজন সূক্ষ্মভাবে সংবেদনশীল হওয়ার সঙ্গে গভীরভাবে অধ্যয়ন পুষ্ট হতে হবে। জ্যোতিপ্রসাদের সেই অধ্যায়ন ছিল। রাজনীতি অর্থনীতি এবং সমাজনীতির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকার জন্যই জ্যোতিপ্রসাদ স্বরাজোত্তর ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সাবধান বাণী শোনাতে পারেনঃ
‘ রাষ্ট্রনীতির/ সমাজনীতির/ রাজনীতির/ অর্থনীতির তোর/ থৈ দে ফোপোলা জ্ঞান/ জনতাই তোর স্বরূপ চিনেছে…।'(সাবধান, সাবধান)
জ্যোতিপ্রসাদের কাব্য চিন্তা সুকুমার কলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদির অর্থ মানুষের কল্যাণ এবং প্রগতির মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন।–‘কেবল সুকুমার কলাই মানুষের সংস্কৃতি নয়…এইসব মানব সংস্কৃতির একভাগ মাত্র।মানব সংস্কৃতির অন্যভাগ…প্রকাশ পায় মানুষের প্রতি মানুষের ব্যভারে,মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধে,মানুষের প্রাণীজগতের প্রতি হওয়া দৃষ্টিতে।’(ডিব্রুগড় কলেজের বাৎসরিক সঙ্গীত সম্মেলনের সভাপতির অভিভাষণ)। তিনি যে পূর্ণ সংস্কৃতির কথা বলেছেন,মানুষের আয়ত্তে তা না ও আসতে পারে ,কিন্তু সেই লক্ষ্যের দিকে মানুষ এগিয়ে যেতে পারে। সংস্কৃতি সেদিক থেকে হয়ে উঠে মানুষকে অবিরাম ভেতরে বাইরে পরিবর্তন করতে থাকা একটি প্রক্রিয়া।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৪)
বিশ্বসংস্কৃতির পূজারী হিসেবে তাঁর মনোভাব ছিল আন্তর্জাতিক। নানা ভাষা,নানা জাতি-বর্ণের মধ্য দিয়ে তিনি শুনতে পেয়েছিলেন বিশ্বজগতের এক অপূর্ব সঙ্গীত। তা বলে তাঁর আন্তর্জাতিক্তার অর্থ এটা নয় যে বিমূর্ত বিশ্বমানবের চিন্তায় বিভোর হয়ে নিজের জাতি,নিজের ভাষা,নিজের সংস্কৃতির প্রতি আমাদের উদাসীন হয়ে থাকতে হবে।তাঁর বিশ্বায়তনের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল নিজেদের গ্রাম,নিজের রাজ্য,নিজের দেশঃ
‘ওপজা গাৱঁর পৰা
নিজরার পারে দি
জান-জুরি নৈয়েদি লুইতর বালিয়েই মই
জোনাকত বালিভাত খাই
- – – – – – – –
মহাভারতর বাটে
পৃথিবীর সবাহলে’যাওঁ।
তিনি বিশ্বমানব হয়ে ফুটে উঠতে চেয়েছিলেন আমাদের নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির মৌ্লিকতার মধ্য দিয়ে।’
জ্যোতিপ্রসাদ রূপান্তর প্রয়াসী কবি।কারণ শুধুমাত্র রূপান্তরই পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলে। তাই রূপান্তর কবির গায়ত্রী মন্ত্র। এই বৈপ্লবিক মনীষার কবি জ্যোতিপ্রসাদ জনতাকে সম্বোধন করে বলেন –
তোর আন্ধারক নামিবলে
তোর বুকুতেই বিপ্লবী হৈ জাগিম।’
এবং,
রূপান্তরর মই /যুগান্তরর মই /ভারতর/জগতর/বিদ্রোহী বীর্য/বিপ্লবে বিপ্লবে /বিজুলি বজ্র হানি /সুঘোষিত ক্রি থওঁ/অগ্নিসূর্য।’(চিরবিদ্রোহী)।
জ্যোতিপ্রসাদ শীশুর উপযোগী কিছু সাহিত্য রচনা করে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দান করেছেন। সংখ্যার দিক থেকে তাঁর শিশু সাহিত্য খুব বেশি নয়,কিন্তু এই স্বল্প সংখ্যক সাহিত্যের মধ্যেই শিল্পীর সৃজনী প্রতিভার আভাস পাওয়া যায়।শিশুর জগত ল্পনাপ্রবণ।তারা যুক্তির ভাষা বোঝে না।জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত,তিক্ত-কষা থেকে তাদের অবস্থান অনেক দূরে।ক্লপ্নার রাজ্যে ভেসে বেরানো শিশু মনের ভালো লাগা খারাপ লাগা সমস্ত দিকগুলি বুঝে নিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ সাহিত্য রচনা করেছিলেন।শিশুর মনস্তত্ত্ব তথা শিশু সাহিত্য রচনা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।কিন্তু জ্যোতিপ্রসাদের যে শিশু মনস্তত্ত্বের গভীর জ্ঞান ছিল তা আমরা তাঁর শিশুসাহিত্য থেকেই বুঝতে পারি।
জ্যোতিপ্রসাদের শিশু সাহিত্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে শিশু কবিতা,জ্যোতি রামায়ণ এবং কাহিনি গল্পগুলিকে। তার রচিত শিশু উপযোগী কবিতার সংখ্যা বারোটি। নিজের ছেলেমেয়েদের শৈশবাস্থায় তিনি শিশুর মনোজগতকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার শিশু কবিতায় স্বপ্ন একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে।বিশ্বজগতের অনাত্মীয় বস্তুও কল্পনার মাধ্যমে শিশুর একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছে।‘কুম্পুর সপোন’,’অকণমানির সপোন’,’ফুলকুৱরী’ইত্যাদি কবিতায় স্বপ্ন জায়গা করে নিয়েছে।
অনুবাদক