ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৬) । বাসুদেব দাস
নিখুঁত অসমিয়া শব্দসম্ভারে জ্যোতিপ্রসাদ শিশুর স্বপ্নের জগতটি ‘ভূতপোৱালি’কবিতায় প্রকাশ করেছেন।-
মই,মই সপোনত
দেখিলো দুটা
ভূতর পোৱালি
আরু দুজনী –নাক জিলিকা
চকু টেলেকা
তিলিকা তিলিকা
পিলিকা পিলিকা
যখিনী- ছোৱালী।
এটা কলা,এটা বগা
নাঙঠ পিঙত ভূত
কথা পাতে টাকুট টাকুট কুট।
জ্যোতিপ্রসাদ শিশুদের ভূতের রহস্যময় কাহিনির স্বপ্ন দেখিয়েছেন কিন্তু তিনি ভয়কে জয় করার শিক্ষাও দান করেছেন।- মা মোর হলে অকনমানো
ভূতলৈ ভয় নাই,
ক’তা মোর ওচর চাপিবলে’
সিঁহতে দেখোন অলপোকে
সাহেই করা নাই।
ভয় করা লরাকহে
ভূতে ধরি কিলায়।
মা,মোর হলে ভূতলে ভয় নাই
জ্যোতিপ্রসাদের শিশু সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন হল ‘জ্যোতি রামায়ণ’।এর মাধ্যমে তিনি শিশুমনকে রামায়ণের কাহিনি শুনিয়েছেন।এতে বিভিন্ন খণ্ড দেখা যায়। প্রথম খণ্ডটি হল ভূমিকা (আগকথা)।আর্য-অনার্যরা ভারতে এসে কীভাবে ভারতীয় জাতি এবং সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল তারই ব্যাখ্যা এই খণ্ডে পাওয়া যায়।-
‘… আর্যর এজন রাজা ভরত আগর
ভারতবর্ষ তাঁর নামর।
ধন সোণ মুকুতারে দেশখন
জ্যোতিপ্রসাদ রামকে ভগবান হিসেবেই চিত্রিত করেছেন।পৃথিবীর অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য রামের জন্ম হয়েছে একথা তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৫)
‘মারীচ এবং সুবাহু বধ’খণ্ডে মারীচ এবং সুবাহু নামের দুই অসুরকে রাম লক্ষ্ণণ বধ করার বর্ণনা পাওয়া যায়। বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রমে যজ্ঞ নষ্ট করার জন্য আসা মারীচ এবং সুবাহুকে রাম লক্ষ্ণণ দমন করা বর্ণনা বীররসের সৃষ্টি করেছে।-
চিঁয়রত বনখন করি তালফাল
ভল্ল শর জুরি তাক লক্ষ্ণণে মারিলে
পর্বত খহার দরে সুবাহু পরিলে।’
‘তারকা রাক্ষসী বধ’খন্ডে রাম-লক্ষ্ণণ তারকা রাক্ষসীকে বধ করার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।এই খণ্ডে অদ্ভুত রস,ভয়ানক রস এবং বীররস প্রকাশ পেয়েছে।রাক্ষস রাক্ষসীদের দেহের আকৃতি অদ্ভুত রস এবং তাঁদের বিভিন্ন ধরনের কার্য ভয়ানক রসের সৃষ্টি করেছে।এছাড়া রাম-লক্ষ্ণণের বীরত্বব্যঞ্জক কার্য বীররসের সৃষ্টি করেছে ।
জ্যোতিপ্রসাদ গল্প রচনার ক্ষেত্রেও নিজের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দান করেছেন। তাঁর রচিত গল্প গুলি যথাক্রমে রুপহী, বগীতরা,সোণতরা,সোণটির অভিমান, যুঁজারু,সতীর সোঁৱরণী,সন্ধ্যা, প্রত্নতাত্ত্বিকর কলাঘুমটি এবং নীলা চরাই’।জ্যোতি প্রসাদ রচিত প্রথম গল্পটি হল রূপহী। গল্পের নায়িকার নাম অনুসারে গল্পটির নামকরণ করা হয়েছে। গল্পের কাহিনি শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক বর্ণনায়। নায়ক বেনু এবং রূপহীর প্রণয় মধুর বর্ণনা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বগীতরা গল্পটি বিদেশি গল্পের ছায়া নিয়ে লেখা। বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা হলেও গল্পটিতে অসমের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক ছবি, অসমের মানুষের উপরে বরলুইত অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্রের ভূমিকা এবং রঙালী বিহুর জীবন্ত ছবি গল্পটিতে সুন্দরভাবে ফুটে ফুটে উঠেছে।’সোণতরা’গল্পটি নয়টি খন্ডের একটি দীর্ঘ গল্প। গল্পটিতে প্রধান নারী চরিত্র সোণতরা। দুটি পুরুষ চরিত্র, চন্দ্র এবং গোলাপ। গল্পটিতে নায়িকা সোণতরার যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। সোণতরা একটি গতিশীল জীবন্ত চরিত্র। নিজের জীবন পথে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল। জ্যোতিপ্রসাদের অন্যান্য গল্পের নারী চরিত্রের তুলনায় সোণতরা অনেকটাই সফল সৃষ্টি। গল্পটির কাহিনি ভাগও সুপরিকল্পিত এবং সংযত।
জ্যোতিপ্রসাদের অন্যান্য গল্পের তুলনায় ‘সোণটির অভিমান’ একটু ব্যতিক্রমী ধর্মের। এই গল্পে শিশুর স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি অত্যন্ত বাস্তব সম্মত রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সোণটির দুষ্টুমি, মাসির রুক্ষ আচরণ এবং সোণটির মাতৃহীন মানসিকতার অভিমান গল্পটিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
‘যুজাৰু’ গল্পের পটভূমি হল ফ্রান্স। অসমিয়া সৈনিক বীরহু ফ্রান্সের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করে। অসমের গ্রামীণ যুবতি রূপহীর প্রণয় পাশে বীরহু আবদ্ধ এবং অন্যদিকে ফ্রান্সের নার্স মিস এনার বীরহুর প্রতি গভীর ভালোবাসা– এটাই গল্পের দ্বন্দ্ব । চরিত্র হিসেবে মিস এনার মানসিক দ্বন্দ্ব যত গভীর তার তুলনায় রূপহীর মানসিক দ্বন্দ্ব গল্পটিতে অপ্রকাশিত থেকে গেছে।
‘সতীর সোঁৱরণী’ বিদেশি গল্পের ছায়ায় রচিত। তবে গল্পটিতে অসমের সহজ সরল মানুষের ছবি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। গল্পকার অসমের বরলুইতের তীর ,অসমের গ্রাম্য সমাজ এবং অসমের সামন্তযুগের সমাজের পটভূমি সাজিয়ে তুলেছেন।
‘ সন্ধ্য’ গল্পটি অসমে মানের আক্রমণের পটভূমিতে রচিত হয়েছে। মানের আক্রমণ অসমে কী ধরনের ভয়াবহতার সৃষ্টি করেছিল তা গল্পটিতে সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। অসমিয়া মহিলার সততা, সাহস এবং নিষ্ঠার পরিবর্তে ভীরু এবং চরিত্রহীন রূপটিই গল্পে চিত্রিত হয়েছে।
জ্যোতিপ্রসাদের ‘ নীলা চরাই’ গল্পে মেটার লিংকের ‘ দি ব্লু বার্ড’ নাটকের ছায়া রয়েছে। এটি একটি শিশু উপযোগী গল্প। এতে শিশুর কল্পনাপ্রবণ মনের উপযোগী করে রহস্যময় ঘটনার আভাস রয়েছে। গল্পের প্রধান শিশু চরিত্র দুটি হল– তিলতিল এবং মিতিল। গল্পকার এই শিশু চরিত্র দুটির মাধ্যমে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শিশু দুটির নীল পাখির সন্ধানের মধ্য দিয়ে মানুষের চিরন্তন শান্তিপ্রয়াসী মনের নিরন্তর ব্যাকুলতাকেই প্রকাশ করা হয়েছে।

অনুবাদক