| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৯) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

জ্যোতিপ্রসাদ ছিলেন প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্রকার। আধুনিক সংস্কৃতির এই শক্তিশালী মাধ‍্যমটির প্রতি তিনি কলকাতায় পড়াশোনার সময় আকর্ষিত হয়েছিলেন ।কলকাতায় অধ্যয়নরত বন্ধু ফুনু বরুয়ার  (পরশুরাম বরুয়া) সঙ্গে ১৯২২ সনে ‘আঁধারে আলো’ নামের বাংলা ছবি দেখার পরে তাদের মনেও অসমিয়া চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ জেগে উঠেছিল।ফুনু বরুয়া লিখেছেন, জ্যোতিপ্রসাদ বিলাতে উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে প্রধানত চলচ্চিত্র নির্মাণ করার যাবতীয় কারিগরি কৌশল শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যেও গিয়েছিলেন। প্রফুল্ল চন্দ্র বরুয়া, ফুনু  বরুয়া এবং জ্যোতিপ্রসাদ তিনজনে মিলে চলচ্চিত্র বিষয়ক বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন।

লন্ডনে চলচ্চিত্র শিল্পের শিক্ষা গ্রহণের বিশেষ সুবিধা না থাকায়  তিনি ১৯৩০ সনে বার্লিন গমন করেন। সেখানে সাত-আট মাস বাস করে সঙ্গীত এবং চিত্রশিল্পে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন ।Universum Films Akjen Genselshaft নামে জার্মানির বিখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পের অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। এই কোম্পানির মাধ্যমে তিনি ‘শোণিত কুৱরী চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার চিন্তা ও করেছিলেন ।

জ্যোতিপ্রসাদ নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রটি হল ‘জয়মতী’। ১৯৩৪ সনে নির্মাণকার্য আরম্ভ করে ‘ জয়মতী’১৯৩৫ সনে মুক্তি লাভ করে। এই চলচ্চিত্রটি জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালার জীবনের সংগ্রাম এবং প্রত্যাহ্বানের সফল রূপায়ণ। ভারতের সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের মাত্র তিন বছর পরে জ্যোতিপ্রসাদ প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেন।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৮)


১৯৩১ সনের ১৪ মার্চ প্রথম ভারতীয় সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা ‘মুক্তি লাভ করে এবং মুম্বাইর ম‍্যাজেস্টিক  হলে প্রদর্শিত হয়। স্বাধীনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গান লেখার জন্য জ্যোতিপ্রসাদ তখন ইংরেজ সরকারের রোষে পড়ে কারাদন্ডে দন্ডিত। যক্ষা রোগে আক্রান্ত জ্যোতিপ্রসাদ কারাগারে থাকা কালীন’ জয়মতী’ চলচ্চিত্র নির্মাণের সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেই তিনি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার ‘ জয়মতী কুৱরী’র আধারে ‘ জয়মতী’ নামে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেন। চিত্রনাট্যের   জন্য লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার কাহিনি গ্রহণ করার কারণ হল কাহিনিটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসমের সমাজ জীবন এবং ডালিমী নামের চরিত্রটি।

যে সময়ে জ্যোতি প্রসাদ ‘জয়মতী’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন সেই সময় অসমে চলচ্চিত্র সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা প্রায় শূন্য অবস্থায় ছিল । তাই জ্যোতিপ্রসাদকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল । জেল থেকে বের হয়েই ১৯৩৩ সনে তেজপুরের ভোলাগুরি চা বাগানে জ্যোতি প্রসাদ ‘চিত্রবন স্টুডিও’ নির্মাণ করেন । জ‍্যোতিপ্রসাদের পিতা পরমানন্দ আগরওয়ালা উদ্বোধন করা স্টুডিওটিতে সাউন্ড স্টুডিও ,ফিল্ম শিবির, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থাকার জায়গা ইত্যাদির ও ব্যবস্থা করা হয় । এগুলি ছাড়াও জয়মতী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ভোলাগুরি চা বাগিচায় শরাই, পুরোনো সাজপোশাক, জাপি, বন্দুক, তরোয়াল,কিংখাপ ইত্যাদি সংগ্রহের মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র মিউজিয়াম  গড়ে তোলা হয় ।

‘ জয়মতী’ নির্মাণের সময় জ্যোতিপ্রসাদকে অনেক অসুবিধার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটি  ছিল মহিলা শিল্পীর অভাব। সেই সময় অসমিয়া সমাজে মহিলাদের অভিনয়কে সুনজরে দেখা হত না। তাই মহিলা শিল্পী সংগ্রহ করতে প্রায় এক বছর আগে থেকে অনেক চেষ্টা করেও জ্যোতিপ্রসাদ সফল হতে পারেননি শহরের শিক্ষিত মেয়েরা অভিনয়কে নিচু কাজ বলে মনে করত। শেষ পর্যন্ত জ্যোতিপ্রসাদের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রামের মেয়েরা এগিয়ে এল।গ্ৰাম্য সমাজের সমস্ত বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে তাঁরা চিত্রবনে যোগদান করল। অবশ্য তার জন্য জ্যোতিপ্রসাদ কে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হল। গ্রামাঞ্চলে তিনি যখন অভিনেত্রীর খুঁজে গিয়েছিলেন তখন অনেকেই বিদ্রুপ করে চিৎকার করেছিল–’ঐ যে মেয়ে চোরের গাড়ি এসেছে।’  গ্রামপ্রধানের সামনে মেয়ের বাবার কাছে জ্যোতিপ্রসাদকে লিখে দিতে হয়েছিল–’ যদি মেয়ের সতীত্ব নষ্ট হয়, তাহলে দন্ড হিসেবে আমি… টাকা দিতে বাধ্য থাকব।’ শেষ পর্যন্ত জ্যোতি প্রসাদের আপ্রাণ চেষ্টাও কষ্টের বিনিময়ে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের  জন্য উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে পাওয়া গেল। রাজমাতার ভূমিকায় রাজকুমারী মোহিনী আইদেউ, জয়মতীর ভূমিকায় অভিনয় করে শ্রীমতী স্বর্ণজ‍্যোতি। অভিনয় সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা এই শিল্পীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে  চলচ্চিত্রের উপযোগী করে তোলা সাধারণ কথা ছিল না। জ্যোতিপ্রসাদ ঐকান্তিক চেষ্টায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন।

জয়মতীর জন্য লাহোর থেকে কলাকুশলী আনা হয়েছিল । ক্যামেরাম্যান ছিল ভূপাল শংকর মেহতা এবং শব্দ গ্রহণকারী ছিল ফৈজী ভ্রাতৃদ্বয়। মোটর গাড়ির ব্যাটারির সাহায্যে ফৈজী ভাতৃদ্বয় নির্মাণ করা শব্দগ্রহণ যন্ত্রটির নাম ছিল ‘ফৈজী সাউন্ড সিস্টেম ‘। সেই সময় ভোলাগিরি চা বাগান অঞ্চলে বিদ্যুৎ যোগানের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা । তাই ত্রুটিপূর্ণ ‘ফৈজী সাউন্ড সিস্টেমে’ শব্দ গ্রহণ করায় অনেক খুঁত থেকে যায়।

অমানুষিক কষ্ট, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রচুর টাকা খরচের বিনিময়ে কলকাতার রাওনাক হলে ১৯৩৫ সনের ১০ মার্চ জয়মতী মুক্তি লাভ করে । এর দশ দিন পরে অর্থাৎ ২০ মার্চ গুয়াহাটির উজান বাজারে কামরূপ নাটমন্দিরে জ্যোতিপ্রসাদের চেষ্টায় ফিলিপস পোর্টেবল প্রজেক্টরের সাহায্যে অসমে প্রথমবারের জন্য ‘ জয়মতী’ দেখানো  হয়। ছবিটা দেখে গোপীনাথ বরদলৈ এবং লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর বিপরীতে উমেশ চন্দ্র বরুয়া তীব্র কঠোর সমালোচনায় ছবিটিকে ক্ষতবিক্ষত করেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত