ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২২) । বাসুদেব দাস
প্রাচীনকাল থেকেই অসম গীতি সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে এসেছে। বিয়া নাম আইনাম, ধাই নাম, বিহুগীত, বনগীত, বরগীত, পাঁচালী, বেহুলা লখিন্দরের কাহিনি নিয়ে রচিত গীত অসমিয়া জনমানসে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। এই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই জ্যোতিপ্রসাদের গীতি প্রতিভা বিস্তার লাভ করেছে।সঙ্গীতের ক্ষেত্রে জ্যোতিপ্রসাদের প্রতিভা ছিল সহজাত।তিনি নিজেই ছিলেন গীতিকার এবং সুরকার। তাঁর রচনায় ভাব,ভাষা সুর ও সাধনার সমন্বয় ঘটার ফলে জ্যোতিপ্রসাদ রচিত গানগুলি অভিনবত্বের দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের যেমন জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা রয়েছে ঠিক তেমনই জ্যোতিপ্রসাদ এর গানের জনপ্রিয়তা মর্যাদা রয়েছে। জ্যোতিপ্রসাদের গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা আদর্শের ধ্বনি প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো জ্যোতিপ্রসাদও অনুভব করেছিলেন –’ পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার/ সেথা হতে সবে আনে উপহার / দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে / যাবে না ফিরে / এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’
জ্যোতিপ্রসাদ ভেবেছিলেন, নিজের জাতীয় সম্পদের উত্তরণ ঘটানো যেমন প্রতিটি ব্যক্তির কর্তব্য, তেমনই অন্যের সংস্কৃতির় মূল্যবান সম্পদকে শ্রদ্ধা করাও আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করাও সমীচীন।
অসমিয়া ভাষায় গীত বা সুগম সংগীতের জন্ম গত শতকের শুরুতে লক্ষ্ণীরাম বরুয়ার দিন থেকে। অবশ্য এই গীত সমুহে পার্শ্ববর্তী রাজ্য বঙ্গদেশের সংগীতের প্রভাব যে পড়েনি তা নয়। রামপ্রসাদী এবং কীর্তনীয়া ঢঙের গীত ছাড়াও নিধুবাবু দ্বিজেন্দ্রলাল আদির গীত এবং রচনার দ্বারা সেই সময়ের অসমিয়া গীতিকাররা প্রচুর পরিমাণে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। বেহাগ, দেশ, ভীমপলশ্রী, কাফি ইত্যাদি হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগের আধারে গীত রচনা করা সেই সময়ে একটি রীতিতে পরিণত হয়েছিল । বেশিরভাগ গীতই রচনা করা হয়েছিল নাটকের জন্য। কারণ বাংলা নাটকের আদর্শে লেখা সেই সময়ের বেশির ভাগ নাটকে চার পাঁচ বা ততোধিক গীত সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল। গীতগুলির রাগ ও তালও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বলাবাহুল্য জ্যোতিপ্রসাদের শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল সংগীতের এরকম একটি পরিবেশে।সেই সময় অসমিয়া নাটক এবং সংগীতের অন্যতম কেন্দ্রস্থল বাণ রঙ্গমঞ্চেও প্রধানত বাংলা ভাষা থেকে অনুদিত নাটকই অভিনয় হত। এই ধরনের অনেক নাটকেই অংশগ্রহণ করা এবং কলকাতার রঙ্গমঞ্চে সেই নাটক গুলির অভিনয় দেখে নাটকে সন্নিবিষ্ট গীতগুলির সুর সংগ্রহ করার কথা জ্যোতিপ্রসাদ নিজেই স্বীকার করেছেন।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২১)
জ্যোতিপ্রসাদ দেশপ্রেমমূলক, প্রকৃতি প্রেম মূলক, মানবপ্রেম মুলক এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রকাশ পাওয়া গান রচনা করেছিলেন।
দেশপ্রেম মূলক গান–
মোরে ভারতরে মোরে সপোনরে
চির সুন্দর সংস্কৃতি
সেউজীয়া বনতে, সেউজীয়া মনতে
বিকশি প্রকাশি উঠা
নব জন জীবনরে অভিনব জ্যোতি।’
প্রকৃতি প্রেম মূলক গান–
গছে গছে পাতি দিলে ফুলরে শরাই
রাম রাম ফুলরে শরাই
কালিয়া ভোমোরা গুঞ্জরি আহে
গোন্ধকে ধিয়াই ( রাম রাম)
মানবপ্রেম মূলক গান–
আজি নব সুর লয় মান মাত্রা
জাগ্রত জনতার আলোক যাত্রা
জনতার ভোক জাগে
জনতার শোক জাগে
বাসনা কামনা যত জাগে
জাগে জাগে
বেলির উদয় কোনে রুধিব পারে
আধ্যাত্বিক চিন্তাধারার গান–
মোরে জীবনরে সখা কৃষ্ণ
বাজাও কি সুরে বেণু
কপালতে তোর কোনে আঁকি দিলে ইন্দ্রধনু।
জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া সংগীতে লোক কথা ও লোক সুর ব্যবহার করে সঙ্গীতের জগতে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। অসমে যখন নব্য শিক্ষিত সমাজ বাংলা ও হিন্দুস্থানী গানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল, তখন জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া ঐতিহ্যমন্ডিত ঐশ্বর্যশালী সঙ্গীতকে জনতার গ্রহণযোগ্য করে তুলে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
তিনি অনুভব করেছিলেন, পাশ্চাত্য সংগীতের দুটি উপাদান ঐক্যতান ও কালবৈচিত্রকে ব্যবহার করে আধুনিক ভারতীয় সঙ্গীতের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি সম্ভব। যুদ্ধ সঙ্গীত, সমদল সঙ্গীতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিশেষ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি অসমিয়া গানে ঐতিহ্য মন্ডিত অসমিয়া সঙ্গীত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সংমিশ্রণে এক ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটিয়েছিলেন।
অনুবাদক