১৯২১ সনে কয়েক জন মেধাবী ছাত্র কলেজ ছেড়ে এসে তেজপুরে আন্দোলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল। জ্যোতিপ্রসাদ ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। ষষ্ঠ শ্রেণির বিজয় চন্দ্র ভাগবতীও গভরমেন্ট স্কুল ছেড়ে এসে তেজপুর কেন্দ্রের অধীনে থেকে কিছুদিন কাজ করেছিল। সেই সময় তাদের যেখানে প্রথম সুতো কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সেই ঘরটি ছিল জ্যোতিপ্রসাদ দের ঘর ‘পকীর’কাছেই রাস্তার বিপরীত দিকে। আন্দোলনের কাজ পরিচালনা করা ছাত্রনেতারা মাঝেমধ্যে ‘পকী’তে বৈঠক করা ,কথাবার্তা আলোচনা করা বিজয় ভাগবতী সুতো কাটার কেন্দ্র থেকে দেখতে পেত। সেখানে বিজয় ভগবতীর সঙ্গে প্রায়ই জ্যোতিপ্রসাদের দেখা হত। জ্যোতিপ্রসাদের চোখ দুটি ছিল উজ্জল, সুদীর্ঘ নাসিকা,সুদর্শন চেহারার যুবক ।ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে পরিচয় হওয়ার পরে ভাগবতী বুঝতে পেরেছিল যে জ্যোতিপ্রসাদের মন সজাগ এবং অন্তর সহানুভূতিশীল। সেই সময় তেজপুর নগরে কংগ্রেসের প্রচার পত্রিকা হাতে লিখে এবং সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করার দায়িত্ব ছিল গৌহাটির কলেজিয়েট স্কুল ছেড়ে আসা কৃতি ছাত্র গুণাভিরাম শর্মার উপরে। জ্যোতিপ্রসাদ এই কাজে তার সহযোগী ছিল। শব্দ যোজনায় জ্যোতিপ্রসাদের যে দক্ষতা ছিল সে কথা তখনই সবাই বলাবলি করত।
যদিও জ্যোতিপ্রসাদের জীবনের প্রথম সাধনা ছিল সঙ্গীত তবু তিনি যখনই দেশমাতার মুক্তির সংগ্রামের আহ্বান এসেছে তখনই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন । শৈশব থেকে বিলাসিতায় জীবন যাপন করা জ্যোতিপ্রসাদের শরীর দুর্বল ছিল যদিও তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে শারীরিক বলে বলীয়ান সবাইকে পরাস্ত করতে পারা শারীরিক কাজও হাতে নিয়েছিলেন। একবার তেজপুর মহকুমার ছয় দুয়ার অঞ্চলের যুবকদের সঙ্গে কলাবাড়ি থেকে বিশ্বনাথ ঘাটে ডক্টর হরেকৃষ্ণ দাস দেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নয়দুয়ার রায়ত সভায় যোগ দেবার জন্য হাতে মশাল নিয়ে রাতের বেলা পায়ে হেঁটে একটি শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ত়াঁর এই ধরনের কার্যকলাপ যুবকদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল।
বিয়াল্লিশের বিপ্লবেও জ্যোতিপ্রসাদ একই উদ্যোমে যোগদান করেছিলেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জয় প্রকাশ নারায়ণ এবং অরুনা আসফ আলি যেভাবে আত্মগোপন করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অসমের সেই আন্দোলন পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল অসুস্থ ত্যাগবীর হেমচন্দ্র বরুয়ার উপর। তার সহযোগী ছিল জ্যোতিপ্রসাদ, গহন চন্দ্র গোস্বামী, লক্ষ্মী প্রসাদ গোস্বামী ,মহেন্দ্র হাজরিকা ইত্যাদি নেতৃবৃন্দ।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৩)
পরশুরাম ওরফে ফুনু বরুয়া জ্যোতিপ্রসাদের বন্ধু ছিলেন। ১৯২১ সনের শেষের দিকে জ্যোতিপ্রসাদ কলকাতার বিদ্যাপীঠ এবং পরশুরাম বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার জন্য কলকাতা উপস্থিত হন। পরবর্তীকালে দুজনেই কলকাতা বিদ্যাপীঠে নাম লেখান। আন্দোলনের জন্য তাদের তিনদিনের মতো কলকাতার বিখ্যাত হোটেল ‘রয়েল’ এ থাকতে হয়েছিল। তারপর তারা দুজন বিদ্যাসাগরের বাড়ির কাছে বিদ্যাসাগর স্কোয়ারের একটি ছোট দোতলা বাড়িতে বসবাস করেন। সেই সময় সেই বাড়িতে অসমের আর ও কিছু ছাত্র ছিল যারা পরবর্তীকালে অসমের মুখ উজ্জ্বল করেছিল।
কৈশরের শুরুতেই জ্যোতিপ্রসাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ হয়। ছাত্রাবস্থায় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি সর্বপ্রথম ‘শোণিত কুওঁরী'( শোণিত কুমারী) নাটক লেখেন। তার লেখা অনেকগুলি ছোট গল্প চৌদ্দ থেকে একুশ বছর বয়সের মধ্যে লেখা। আমৃত্যু অসংখ্য কবিতা, গান , নাটক ,শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ রচনা এবং পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা করে অসমিয়া সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা ,সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা, অন্যায় অত্যাচার অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রোমান্টিক ভাবাবেগে পরিপূর্ণ প্রেমের কবিতা এবং গানও লিখেছেন । তিনি লেখার মাধ্যমে একদিকে যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বিশিষ্ট ভক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মগুরু শ্রীমন্ত শংকরদেবকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তেমনই ১৯১৭ সনে যুগান্তকারী সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। অজস্র গান ও কবিতার মাধ্যমে সমকালীন বিশ্ব তথা ভারতের নানা প্রগতিশীল ও মুক্তিকামী আন্দোলনের সঙ্গে নিজে জড়িত ছিলেন। চিন্তায় মানবতাবাদী ও রাজনৈতিক দর্শনে গান্ধীবাদী হলেও জীবনের অন্তিম লগ্নে উপনীত হয়ে জ্যোতিপ্রসাদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়। সদ্য স্বাধীন দেশের কংগ্রেসী রাজ্য সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ তাকে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদ মুখর করে তোলে ।চা বাগানের মালিক জ্যোতিপ্রসাদ যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে(IPTA)। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ অসম প্রাদেশিক শাখার তিনি ছিলেন প্রথম সভাপতি(১৯৪৭)। শারীরিক অসুস্থতার জন্য গণনাট্যের প্রথম রাজ্য সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকলেও ১৯৪৯ সনে নালিয়াপুলের দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনে তিনি উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন ।
১৯৩৬ সনে ডিব্রুগড়ের দেবযানী ভূঞার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি দুই পুত্র এবং চার কন্যার জনক ছিলেন।
[চলবে]
অনুবাদক